Wednesday, December 19, 2018

প্রকাশনা বাণিজ্য

একটা ছোট্ট মেয়ে নার্সারীতে উঠলো। বয়স মাত্র সাড়ে চার। আমাদের সময় এই বয়সটা মায়ের কোলে বসে স্লেটে অ আ লেখা শুরু করার চেষ্টা হতো। আর এসময়ে জন্ম নেয়ায় মেয়েকে সাড়ে তিন বছরেই স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ কাবার করতে হলো। জিনিষটার ভালোদিক দেখায় সবাই আমাকে। কিন্তু আমাকে চিন্তিত করে এর পেছনের অন্ধকার দিকটা।

অনেকেই ভাবেতে পারেন প্লে গ্রুপের বাচ্চার পড়াশোনায় আবার অন্ধকার দিক কী থাকে। বলছি, প্রথমত প্লে গ্রুপের পাঠ্যসূচীর কোনো সরকারী নীতিমালা নেই। এক এক স্কুল এক এক ঢং এ পড়ানো শুরু করে। কি পড়ানো হবে কতটুকু পড়ানো হবে নেই কোনো হিসাব। চার বছরের বাচ্চার জন্য এই পাঠ্যসূচী আদৌ উপযোগী কিনা সেই বিচারও কেউ করেনা। অভিভিবকরা তো বেতন দিয়ে আশায় থাকেন বাচ্চার জন্য ঠিকঠাক শিক্ষার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু একটু ভালো করে তাকালে্ই দেখবেন শিক্ষাবাণিজ্যের প্রথম বলি হলো দুধের বাচ্চারা।

সিলেবাস শেষ করার নামে ক্লাসে এক চিমিটি পড়িয়ে এক গামলা হোমওয়ার্ক, নানান রঙ্গের লম্বা লম্বা ছুটি, এর মাঝেও পাহাড় সমান হাতের লেখা। আর সবচেয়ে আতংকের বিষয় হলো বাচ্চাদের বর্ণমালার বই। স্কূল ভেদে পাঠ্যবই নির্বাচন নিয়ে চলে বাণিজ্য। এমন এমন বই প্লে গ্রুপ, নার্সারীতে পাঠ্য করা হয় যা আসলে কোন বয়সের বাচ্চার পাঠ্য বিবেচনা করে লেখা, তা বোঝার কোনো সাধ্য নাই। বই এর ডিজাইন, হরফ, তুলনা চিত্র সবিকছুতে খামখেয়ালি। প্রকাশনা বাণিজ্যের সস্তা চাকচিক্য।

একটা বাচ্চা যে প্রথমবারের মতো একটা বর্ণের সঙ্গে পরিচিত হতে যাচ্ছে তার বই এর বর্ণমালার হরফ অবশ্যই হওয়া উচিত প্রমিত বিদ্যাসাগর টাইপ। কিন্তু দেখে অবাক হতে হয় বিচিত্র জটিল টাইপফেস দিয়ে বর্ণমালা লেখা এই বই নাকি প্লে গ্রুপের জন্য। যে বই এর "ম" এবং "য' এর পার্থক্য বুঝতেই পারছেনা বাচ্চারা। তার পর আসে শব্দ নির্মাণ এর পাঠ। আমরা ছোট বেলায় পড়েছি বর্ণ দিয়ে শব্দ চেনানো হয় এমন পরিচিত বস্তুর, যার নাম সহজ সরল ২/৩ অক্ষরে লেখা হয়। আর যার চিত্রটা বাচ্চা সহজে চিনতে পারে। কিন্তু এখনকার বই এ এসবের কোনো বালাই নেই। যাচ্ছেতাই একটা শব্দ দিয়ে দিলেই হলো। যেমন "শ" দিয়ে আমি প্রথম শিখেছিলাম "শাক" পাশে ছিল শাকের ছবি। আর এই বাচ্চাটার বইএ আছে শনি, পাশে শনি গ্রহের ছবি। চার বছরের বাচ্চা শাক চেনা যত সোজা শনি চেনা কি ততটাই সোজা বলে মনে হয় ??

তার পর আরও আছে । বাচ্চাদের বইতে বর্ণ পরিচয় করানোর ক্ষেত্রে ছবি ও অক্ষর হতে হয় সরল, যেন বাচ্চা চট করে তার পরিচিত বস্তুটির ছবি চিনতে পারে। কিন্তু এখনকার বই এর ইলাস্ট্রেশন করানো হয় সস্তা চিত্রকর দিয়ে যারা অনেকটাই অপ্রাসংগিক একটা কিছু এঁকে কাজ সারে। যেমন "স" তে সাইকেল। ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটা লোক সাইকেল ধরে দাড়িয়ে আছে, সাইকেলের হ্যান্ডেলে বেলুন বাধা। বাচ্চার চোখ যায় আগে বেলুনের দিকে।
যারা বইগুলো লেখে তারা কারো কাছে জবাবদিহিতায় বাধ্য কিনা আমি জানিনা। কিন্তু আমার ভাবতে কষ্ট হয়। আমাদের বাচ্চারা কচি বয়সেই কিছু অর্থলোভী মানুষের লোভের সস্তা শিকারে পরিণত হয়। সহজ ভাবে আনন্দ নিয়ে যে শিক্ষা পাবার অধিকার তাদের আছে সেটা তারা পায়না। তাদের হাতের বই, তাদের স্কুলের হামবড়া কার্যক্রম সবকিছু তাদের ওপর কঠিনভাবে চেপে বসে। স্কুলগুলোর বই সিলেকশনের সস্তা দূর্নীতি একটা ছোট্ট বাচ্চার শিক্ষার শুরুটাকেই লন্ডভন্ড করে দেয়।

সর্বেশষ কষ্ট বলে লেখাটা শেষ করি। গতবছর যে পুতুলটা ১-৩০ বলতে শিখেছিল শুধু, এবার তার বই এর ৪ নং পাতায় যোগ অংক করতে বলা হচ্ছে !!!! ৭ +১১ = ? এই ২ মাসে তাকে এটা শিখতে হবে!!!! নতুন প্রিন্সিপাল এসে এই নতুন বই পাঠ্য করেছেন ( মোটা কমিশন পেয়ে হয়তো) এখন বাচ্চকে এটা শিখতে হবে, না হলে ফেল !!! এখন হয়তো বাচ্চারা নিজ থেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করবে যে তার মাথায় বুদ্ধি নেই নয়তো অংক জিনিসটা অনেক বাজে রকম কঠিন!!!!

No comments:

Post a Comment