Saturday, December 22, 2018

নারীবাদ মানে কি পুরুষের প্রতি বিষেদেগার?

পুরুষ আর পুরুষতন্ত্র অনেকেই হামেশাই গুলিয়ে ফেলেন। নারীবাদী আন্দোলন পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে, ব্যক্তি পুরুষের বিরুদ্ধে নয় । অনেক পুরুষ আছে যারা নারীবাদ বলতে বোঝেন পুরুষের বিরুদ্ধাচরণ । অনেক নারী আছেন যারা নারীবাদের দোহাই পেড়ে ব্যক্তিপুরুষকে আক্রমন করে বসেন । কিন্তু পুরুষতন্ত্র একটা সিষ্টেম যা আদ্যিকাল ধরে চলে আসছে । নারীদের মতো পুরুষরাও এই সিষ্টেমের শিকার । পার্থক্যটা হল নারীরা পুরুষতন্ত্রের শিকার এটা সমাজসিদ্ধ, কিন্তু পুরুষের ক্ষেত্রে নয় । নারীর লড়াইটা গোষ্ঠীর, পুরুষের লড়াইটা একার । বিংশ শতকের মাঝামাঝি নারীবাদী তাত্ত্বিক সিমন দ্য বোভায়ের তাঁর "সেকেন্ড সেক্স" গ্রন্থে "নারীরা নারী হয়ে জন্মায় না, সমাজ তাকে নারী বানায়" বলে মন্তব্য করেন । কিন্তু শুধুই কি নারী ? একই কথা কি পুরুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য নয় -- "পুরুষরা পুরুষ হয়ে জন্মায় না, সমাজ তাকে পুরুষ বানায়।" নারীকে যেমন এ সমাজে নারী হয়ে উঠতে হয় তেমনি পুরুষকেও পুরুষ হয়ে উঠতে হয় । তাত্ত্বিকরা বলেন নারী আর পুরুষের জেন্ডার পরিচিতির এই যে বিভাজন, সেটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজেরই তৈরি।

যৌন পরিচিতির দুই ধরনের ওরিয়েন্টেশেন আছে -- একটা শারীরবৃত্তীয় ( সেক্স) আর একটি মনোসামাজিক (জেন্ডার) । সমাজ মূলত এই মনোসামাজিক দিকটাই দুমড়েমুচড়ে একটি ছাঁচে ঢালে । মানব শিশু শিশ্ন নিয়ে জন্মালে সমাজ যৌন পরিচিতি চাপিয়ে দেয় --- "ছেলে হয়েছে গো" । কিন্তু শিশ্ন নিয়ে জন্মালেই যে সে "ছেলে হবে" তার কোন মানে নেই । সংখ্যায় লঘুত্ব থাকলেও শিশ্ন নিয়ে জন্মানো শিশুর মনোলৈঙ্গিক (জেন্ডার) পরিচিতি মেয়েও হতে পারে । সেক্স ও জেন্ডার পরিচিতি যাদের এক তারা সমাজের চোখে "স্বাভাবিক", আর যাদের আলাদা তারাই "রূপান্তরকামী" । যাই হোক, বেশি তত্ত্ব আউড়ে লাভ নেই । মূল বক্তব্যে আসি । যেদিন থেকে "ছেলে হয়েছে" শব্দটা পরিবারের লোক শোনে সেদিন থেকেই শুরু হয় শিশুটাকে "আল্ট্রা ম্যাসকুলাইন" বানানোর পালা । কিন্তু পুরোমাত্রাই পুরুষ বলে কিছু হয় না, পুরুষের মধ্যে কমবেশি নারীত্ব যেমন আছে, তেমন নারীর মধ্যেও কমবেশি পুরুষত্ব থাকে।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী ও পুরুষ ভেদে আলাদা পালনীয় ভূমিকা থাকে । একটি বিশেষ সমাজ ও সাংস্কৃতিতে সেই পালনীয় গুলো বাচ্চা বয়স থেকে ক্রমাগত পালন করতে করতে মানব শিশু আলাদা করে নারী এবং পুরুষ হয়ে ওঠে । শিশ্নধারী শিশু যখন হামাগুড়ি টানতে শেখে খেলনা হিসাবে পুতুলের বদলে পরিবারের লোক ধরিয়ে দেয় খেলনা বন্দুক । পুরুষ মানে লড়াকু ও আগ্রাসী , সেটা হয়ে উঠতে হবে, তাই অস্ত্রের ডেমো দিয়ে উদ্বোধন । মানব শিশু যখন হাঁটতে শেখে হোঁচট খেলে কাঁদে । মা কোলে নিয়ে আদর করে বলে "কাঁদে না বাবু, ছেলেরা কাঁদে না" । প্রিয়জন বিয়োগ হয়েছে, বুকফাটা কষ্টে চোখের জল বেরিয়ে আসছে নতুন কিশোরের । আত্মীয়া চুপিসারে বলে দেয় "ছেলেদের কাঁদতে নেই রে, ছেলেদের শক্ত হতে হয়" । একদিকে প্রিয়জন হারার বেদনা আর অন্য দিকে পুরুষ হয়ে ওঠার চাপ, জাঁতাকলে পিষ্ট হয় কিশোর মন । বোনেরা যখন খেলনা হাঁড়িকুড়ি নিয়ে সংসার-সংসার খেলে তারও ইচ্ছা জাগে পুতুল খেলার সাথী হতে । বোন বলে দেয় "তোকে খেলা নেব না, তুই মেয়ে নাকি, তুই তো ছেলে"।

স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলো আর হামেশাই হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে কিশোর । ততদিনে সে শিখে নিয়েছে হাতাহাতি মারপিট না করলে পুরুষ হয়ে ওঠা যায় না । যখন বন্ধুর সঙ্গে পেরে উঠছে না, মনের মধ্যে তৈরি হয় চাপ, অবচেতনে কাজ করে "আমি পুরুষ হয়ে উঠতে পারছি না"। ক্রমাগত পুরুষ হয়ে ওঠার চাপ তাকে তেড়ে নিয়ে বেড়ায় । সকালবেলা ছেলের বিছানা অগোছালো পড়ে থাকতে দেখলে মা খুশি হন, ভবিষ্যতের সুপুরুষ হওয়ার রসদ খুঁজে পান ছেলের অগোছালো ঘরে । মাধ্যমিক পাশ করে গেছে ছেলে, বন্ধুদের দু একজন সিগরেট ফুঁকে পুরুষালী ধোঁয়া ছাড়তে শিখে গেছে । মাথায় ভাবনা গজিয়েছে সিগরেট না ফুঁকলে বোধ হয় পুরুষ হয়ে ওঠা যায় না । একটু একটু করে পুরুষের মতো পুরুষ হয়ে ওঠে কিশোর।

বন্ধুদের দু একজনের তখন ষোড়শী প্রেয়সী জুটে গেছে । পাশে প্রেয়সীকে নিয়ে বন্ধুর হাঁটার অহং তাঁকে ঈর্ষান্বিত করে । পাশে প্রেয়সীকে না থাকলে তার পৌরুষ সার্থক নয় যে । সিঙ্গেল থাকার চাপ তাকে হতাশার দিকে ঠেলে দেয় । রাস্তায় মেয়ে পেরোলে দু একটা টিটকেরি না মারলে বন্ধু মহলে সে "মেয়েলি" পরিচয় পাবে, সেটাও সে জেনে যায়। বন্ধুদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে পুরুষ হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা । মুখে গোঁফ দাড়ির রেখা না গজালে, হাত পা লোমশ না হলে বান্ধবীদের ব্যঙ্গ "তুই মাকু নাকি রে ?"। যেহেতু দাড়িগোঁফ না থাকলে শরীর পেশীবহুল না হলে পুরুষ হওয়া যায় না, তাই পুরুষবোধে আঘাত লাগে সামনে উচ্চ মাধ্যমিক দিতে যাওয়া কিশোরের । রাগে ক্ষোভে কিশোর তখন পাল্টা দেয় "তুইও তো সাবালিকা হতে চললি, এখনও তুই বিপিএল কেন ?" । নারীত্ববোধে আঘাত লাগা বান্ধবী চুপসে যায় । কারন তারও চাপ আছে পুরোদস্তুর নারী হয়ে ওঠার । সেটা হতে না পারার ইমোশোনাল ক্রাইশিস বান্ধবীকেও তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।

এরপর কলেজ । বন্ধুরা 160 সিসির পাছাউঠো বাইক গাঁঙিয়ে ঢোকে কলেজ । ক্লাস এইটে বাবার কিনে দেওয়া বাইসাইকেলটা গোঙানো বাইকের চাপে "মেয়েলি" হয়ে যায় তখন । এটা দিয়ে হবে না, পুরুষ হতে গেলে জোরে বাইক চালিয়ে কলেজ আসতে হবে । কলেজের সুন্দরীদের কাছে পৌরুষত্ব প্রমানে এছাড়া আর কোন রাস্তা খোলা নেই । সেই সঙ্গে ব্র্যান্ডেড জিন্স, পনিটেল বেনি, হেয়ার কালার, স্পাইক, হাতে বালা, শার্টের উপর দিক থেকে দুটো বোতাম খোলা যাতে গোটা কয়েক বুকের চুল দেখানো যায় । এগুলো না হলে পুরুষ বলে মান্যতা পাওয়া দুস্কর । বন্ধুদের হাতে হাতে তখন পর্ন ভিডিওর ছড়াছড়ি । গোটা কয়েক নিজের মোবাইলেও সঞ্চিত রাখতে হয়, না হলে পুরুষ হিসাবে মান থাকবে না । যৌন আলোচনা, ননভেজ জোক্স, বান্ধবীর সাথে ফ্লার্ট, টুকটাক দুষ্টুমি, হাহাহোহোহিহি সবই চলতে থাকে, পুরুষ হয়ে উঠতে হবে, আরও আরও পুরুষ হয়ে উঠতে হবে।

কলেজ পেরিয়ে মাষ্টার্সে মেস জীবন । পোড়াশোনা শিকেয় তুলে রাত জেগে তাস, কেরাম, মাঝেমধ্যে ঢুকুঢুকু । মেস জীবনে "ভাল্লুক" খায় না, সিগারেট ছুঁই না বলাটা যথেষ্ট অপমানের, পৌরুষের অপমান । খেতেই হবে, মেসের "পুরুষ" বলে কথা । এই যে বিলিতি মদ পান করে পুরুষ হয়ে ওঠার চেষ্টা এর আবার একটা মজার ইতিহাস আছে । ব্রিটেনে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে তরুনেরা খুব চাপে থাকত । তাদের পৌরুষত্ব প্রমান করতে হত তিনভাবে --- Drinking, Fighting আর Heterosexuality .. ভাবুন, মদ গাঁজা খেয়ে টুকটাক পেশী শক্তি দেখিয়ে কিছুটা পৌরুষত্ব হয়ত প্রমান করা গেল, কিন্তু Heterosexuality ? সেটা কিভাবে প্রমান করা যাবে ? পাহাড়প্রমান চাপ । আমাদের সমাজের মতোই সেসময় ইংল্যান্ডে Homosexuality ছিল "ক্ষমাহীন অপরাধ", আর সেসময়ের ধ্যানধারণা অনুযায়ী Homosexual পুরুষ "পুরমাত্রার পুরুষ" নন । কলোনিয়াল হ্যাংওভারে দুলে পুরুষ হওয়ার লিগেসি মেনেই ব্র‍্যাণ্ডেড পুরুষালী পোশাক, দামী পারফিউম ( যেটা মাখলে সুন্দরীরা ভ্রমরের মতো পিছু ধাওয়া করবে), মেল ফেসক্রিম থেকে শুরু করে সিগরেট, বিলিতি মদের মধ্য দিয়ে পৌরুষেরও বাজারিকরণ হয়ে যায়।

যাইহোক, আলোচনায় ফিরি । পড়াশোনা শেষ করে এবার বেকার জীবন । "আমার ছেলে বড় হয়ে সংসারের হাল ধরবে" এই আপ্ত বাক্য কিশোর বয়স থেকেই পুরুষকে আষ্টেপিষ্টে বেঁধে ফেলে । কিন্তু সংসারের হাল ধরতে না পারা বেকারত্ব যে কি জ্বালা কি নির্মম, সেটা কেবল বেকারই জানে । বেকার বলতে আমরা পুরুষই বুঝি, নারী বুঝি না কিন্তু । ক্ষেত্রবিশেষ ছাড়া নারীরা উচ্চশিক্ষিত হলেও পয়সাওয়ালা বরের ঘাড়ে চেপে বসার একটা বাড়তি অপশন পেতে থাকে । না না, এ দোষ সেই নারীর নয়, বরং নারী এমন ভাবনার শিকার । আসলে নারী পুরুষ ভেদে এমন মানসিক গঠন পুরুষতান্ত্রিক সমাজেরই নির্মান । ততদিনে বন্ধুদের কেউকেউ ছোট মাঝারি মাপের সরকারী চাকরি পেতে শুরু করেছে । তাদের কারোর কারোর মোটা পনে বিয়েও হয়ে যাচ্ছে । বেকার মনে তৈরি হয় হতাশা, চাপ আর হীনম্মন্যতা । মেয়ের বাবারা বিয়ের জন্য সম্মন্ধ তো দূর, ফিরেও তাকায় না । এরপর কোন বেসরকারী ব্যাঙ্ক বা কোম্পানিতে স্বল্প মাইনের চাকরি, বা টুকটাক টিউশন পড়িয়ে সেই চাপ থেকে মুক্তির অদম্য প্রয়াস । সে জানে, সে পুরুষ, "সংসারের হাল" শত কষ্টে তাকেই ধরতে হবে ।

এবার হয়ত কোন মেয়ের বাবার কৃপাদৃষ্টি দৈবক্রমে তার উপর পড়তে পারে, হয়ত বিয়েও হয় । স্বল্প আয়ে সংসার চালানোর পাশাপাশি স্ত্রীর নিত্য নতুন আবদার মেটানোর চাপ । তবুও প্রানপন চেষ্টা করে যায় । তার ইচ্ছা করতে পারে স্ত্রীর রান্নাবান্নার কাজে একটু হাত লাগিয়ে দেবে । কিন্তু পারে না, পারে না কারন তার মেল ইগোতে লাগে, পাছে কেউ "জুরু কা গোলাম" বলে খোটা দেয় । বৌকে সাহায্য করার স্বাভাবিক ব্যাপারটাতেও "ইগো" এনেছে পুরুষতন্ত্র, শিকার হয়েছে নারীর পাশাপাশি পুরুষও । একদিকে মায়ের ইডিপাস কমপ্লেক্স, অন্যদিকে বৌ এর কাছে পুরদস্তুর রোমান্টিক পুরুষ হয়ে ওঠার চাপ, দুই এর মাঝে স্যান্ডুইচ হয়ে যায় পুরুষ মন । সদ্য কিশোর বয়স থেকে মাথায় ঢুকে থাকা নারীর সতী-অসতীর ধারনা স্ত্রীর উপর অবচেতভাবে প্রয়োগ করে । পুরুষতান্ত্রিক ভাবনার শিকার হয়ে নিজের মনকে অশান্ত করে তোলে । আবার যেহেতু সে পুরুষ তাই স্ত্রীর উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চাপ থেকে যায়, সেটা না করতে পারলে সমাজ "স্ত্রৈণ" বলে ব্যঙ্গ করবে । সংসারে নারী পুরুষের মধ্যেও চলে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব । পুরুষের মনে হয়, এই বুঝি তার স্ত্রী ঘাড়ের উপর চেপে বসল । কর্তৃত্ব বজায়ের চাপ অহরহ পুরুষকে অবচেতন মনে তাড়া করে বেড়ায় ।

কয়েকদিন আগে "প্যাডম্যান" দেখলাম । সেখানে প্যাডম্যান (অক্ষয়কুমার) একজায়গায় তার স্ত্রীকে (রাধিকা আপ্তে) বলছে "আশলি মর্দ ওহি হ্যায় যো আপনি অন্দরকি অওরতোকো জাগা শাক্তা হ্যায়" --- আসল পুরুষ হচ্ছে সেই যে নিজের ভিতরের নারীত্বকে জাগাতে পারে । কিন্তু দূর্ভাগ্য এটাই যে পুরুষের মধ্যে যে নারীত্ব আছে সেটাকে অহরহ ধর্ষন করতে করতে একসময় হত্যা করে ফেলে পুরুষতন্ত্র অথবা নারীর পুরুষবিদ্বেষী মনোভাবে। শত চেষ্টাতেও পুরুষ এই মৃত স্বত্বাকে জাগিয়ে তুলতে পারে না, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও মানসিকতা সেটা হতে দেয় না । মেল ইগো আর অন্তরে থাকা নারীত্বের দ্বন্দ্বে পিষ্ট পুরুষ মন । পুরুষ ধর্ষিত হয় প্রতিদিন, ক্ষনে ক্ষনে ।

No comments:

Post a Comment