Monday, December 17, 2018

ডিজিটাল হেদায়েত

সাড়ে ১৪০০ বছর আগে নবী সাল্লাল্লাহু আলাহিসালাম দুনিয়া ছেড়ে যাবার পর মুস্লিম উম্মাহর কাছে ২ টা আমানত দিয়ে গিয়েছিলেন। একটা হল দ্বীন ইসলাম কায়েম করা দুই নাম্বার হল হেদায়েত করা। দুইটার একটাও সোজা কাজ না। দায়িত্ব বড় কঠিন।
প্রথম কাজটা তুলনামূলক ভাবে সোজা ছিল খেলাফতের যুগে। কিন্তু দ্বিতীয় কাজটা করা আসলেই টাফ। নিজেকে মুমিন বানানোর ক্ষেত্রে আল্লাহ বিচারক। ভুল ত্রুটি তাঁর কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ আছে। শুধরানোর রাস্তা আছে। কিন্তু হেদায়েত করতে হয় অন্য মানুষকে। সেক্ষেত্রে নিজেকে আগে গ্রহনযোগ্য একটা অবস্থানে তুলতে না পারলে হেদায়েতের পুরা প্রচেষ্টাই মাঠে মারা যায়। তাই যথেষ্ট জ্ঞান, যুক্তি, উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ অর্জন করতে না পারলে হেদায়েতের চেষ্টা করা উচিত না। কারন মানুষ হেদায়েতকারীকে দিয়ে হেদায়েতের জ্ঞানকে বিচার করে। ভুল হেদায়েত মানুষকে বরং ধর্ম থেকে দূরে ঠেলে দেয়।
এত কথা বলার কারন, আমাদের দেশে ইদানিং হঠাত করে ইসলাম কায়েম করা আর হেদায়েত করার জন্য উঠেপড়ে লাগা মানুষজনের লম্বা লাইন লেগে গেছে। কে যে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে ঝাপ দিয়ে পড়ে ইসলামের পতাকা উচা করে নাড়াতে থাকে সেটাও বোঝার উপায় কম। ইসলাম নিয়ে কেউ রাজনীতির মাঠে শক্তি বাড়ায়, কেউ ইসলাম কে পুজি করে পকেট ভরায়। কেউ বা শুধুই নিজের পেশী প্রভাবকে শক্তিশালী করার জন্য ইসলামের মলম মাখে। এই রকম আরো নানান তালের ধান্দা আছে।
সবচেয়ে বিরক্তিকর জিনিশ হচ্ছে ইহুদী জুকারবার্গ এর ফেসবুক হাতে পেয়ে যার কোন ধান্দায় ইসলাম বেচার বুদ্ধি নাই, সে নেমে পড়েছে হেদায়েতে। হাতে একটা মোবাইল বা একটা কম্পিউটার পাইলেই হইল।
আমি আমার যতসামান্য জ্ঞানবিচারে এই হেদায়েতকারী গোষ্টিকে বোঝার চেষ্টা করে কিছু জিনিস পেলাম।

১। যারা কোন না কোন ইসলামী দলের সমর্থক, এরা ফেসবুকে সেলফি, চেক ইন, পেতি স্ট্যাটাস, লাভ , লাস্ট আর গ্লোবাল এন্টারটেইনমেন্টের দুনিয়া ফেসবুকে, টুপি মাথায় দিয়ে ঝাপ দেয় হেদায়েত করতে। এরা এটাকে তাদের পবিত্র দায়িত্ব মনে করে।এরা সংঘবদ্ধ। এদের কন্টেন্ট মনো ডিরেকশনাল। আল্লাহ আর ইসলামের গুন গান করা। এদের কমন ডায়লগ - ভালো লাগ্লে লাইক দিন, শেয়ার করে সবাইকে জানার সুযোগ করে দিন। এরা বাংলা বানানই ভুল করে ৭০% সময়। ইংলিশ পারেনা। এরা দেশ টেশ বুঝেনা। ইসলামের আইনের বাইরে বাকি সব কিছু কে এরা নাজায়েজ লেভেল দিয়ে দেয় এক কথায়।

২। এজেন্ডাধারী ইসলামীমুখোশধারী দলের কর্মী। এরা মূলত প্রোপাগান্ডা ছড়ায়, আল্লাহর কুদরত এর নমুনা খোজে গাছ, মাছ, পশু পাখী আকাশ বাতাস সব খানে। এতে ফলোয়ার বাড়ে। তারপর সেই সমর্থন যোগাড় করে সবাধীনতাবিরোধী নেতার মুক্তির জন্য কাজ করার চেষ্টা করে। ভারত - আমেরিকা বিরোধী পোস্ট মারে সমানে। সেলিব্রেটিদের ইসলাম গ্রহন করার ফেইক পোস্ট মারে। আওয়ামীলিগ কে গালি মারে। শেখ হাসিনার উপর এরা চরম বিলা। এরা বলে এই পোস্টে ১০০০ লাইক চাই, যদি মুমিন হন দ্রুত শেয়ার করুন ইত্যাদি। এদের ও বাংলা বানানের জঘন্য অবস্থা। তবে এদের ফলোয়ারদের কেউ অনেক লম্বা পোস্টে ভুল ব্যাকরণে বাংলা আর খুব প্রাইমারী লেভেলের ইংলিশে লজিকাল ডিবেট করার চেষ্টা করে, যেটা অনেক টা গো-মুর্খামীর উত্তম নমুনা। এদের মুল আক্রমনের লক্ষ্য হল বাংলাদেশী জাতিয়তা । এরা নিজেদেরকে বাংলাদেশী দাবী করে কিন্তু দেশটাকে আফগানিস্থান বানানোর ইচ্ছাও গোপন করে না।

৩। শিক্ষিত ছাগু সমাজ। এরা ধার্মিক। ফেসবুকে সব কিছুকেই ইস্লামের ফিল্টার দিয়ে ধুয়ে দেখতে চায়। জোর করে তর্ক লাগাতে চায়। এরা মনে করে এদের যুক্তি দিয়ে এরা কমন মানুষের বিহেবিয়ার শিফট করতে সক্ষম। এরা দাবী করে আমিও আগে ভুল পথে ছিলাম। আপনার মতন আমারো অনেক যুক্তি ছিল। আল্লাহ আমাকে হেদায়েত করেছেন তাই এখন আমি আল্লাহর পথে হাটছি...ইত্যাদি।ভিন্নমতের প্রতি আক্রমন এদের কাছে ইবাদত। এদের হেদায়েতে ইসলামে কারোরই সবাধীনতা নাই, না ছেলেদের, না মেয়েদের। এরা পৃথীবির বিভিন্নদেশের নিপীড়িত মুসলমানের জন্য খুব উদ্বিগ্ন থাকে সবসময়।এরা টেক স্যাভি। লেখায় ভুল কম। এরা ভয়ংকর বিলা নাস্তিকদের উপর। কতলের ফতোয়া খুব ভালবাসে। এদের কিন্তু বান্ধবী আছে, ভালোযায়গায় খাবার সময় এরা সেলফি দেয়। এদের সোশাল লাইফে এরা অনেকটাই নমনীয়। কিন্তু ফেসবুকে এক একজন খলিফা।

৪। আইডেন্টিটি সিকার- এরা মূলত অর্ধ শিক্ষিত, এরা দুই নৌকায় পা রাখা মুমিন, চটি পেইজ, হট মডেলের পেইজ, হর্নি পেইজেও আছে আবার বোরখা পরে মুনাজাতে বসা ২ বছরের বাচ্চা মেয়ের ছবিতে এই সোনামনির ছবিতে কয়টি লাইক ? এই জাতীয় জিনিস পোস্ট করে, নিজের আজগুবি সাহিত্য প্রতিভা দিয়ে এরা আল্লাহর শোকরানা আদায়, মায়ের হক, বোরখার ফজিলত ইত্যাদি নিয়ে লো রেজুলেশান পোস্ট বানায় আর শেয়ার মারে। এরা মেয়েদের সংগ পাবার জন্য উম্মুখ থাকে কিন্তু এ্যাপ্রোচ করতে পারে না। এদেরও যথারীতি বাংলায় আঞ্চলিকতা প্রচন্ড রকম বেশি। কথায় যুক্তি নাই। এদের একটা বড় অংশ প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিক। জীবন নিয়ে এদের ফ্রাস্ট্রেশান থেকেই এরা ধর্মকেই আশ্রয় হিসাবে বেছে নিয়েছে। আর একটা অংশ হচ্ছে দেশী নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা বেকার তরুন। এরা ফেসবুকে নিজেকে উপস্থাপন করতে চায়, ধর্ম্প্রচার দিয়ে শুরু করে প্রেম করে শেষ করতে চায়, এদের আশা এই ধর্ম্প্রচারের ফাকেই তারা একজন মুমিন বান্ধবী খুজে পাবে। মাঝে মাঝেই হিজাব পরা কিশোরী কাজিনের সঙ্গে ছবি তুলে ফটোশপে গোলাপফুল লাগিয়ে পোস্ট দেয় - মনের মত মানুষটাকে যে কবে খুজে পাবো ...ইত্যাদি।

৫। আমার সোজা ভাষায় জোগালী। এক কথায় অশিক্ষিত। স্কুল কলেজে গিয়ে থাকতে পারে কিন্তু এদের নিরেট শীশাভরা মাথায় বিদ্যা নাই। এদের সর্বোচ্চ বিদ্যা কয়েকটা সুরা মুখস্ত আছে, নামাজ পড়তে পারে, আর কয়েকটা ওয়াজ শুনে মুগ্ধ হইসিলো, প্রতি সপ্তাহে জুমা'র নামাজে শোনা খুতবা। এই নিয়ে এরা ফেসবুকে ঝাপ দিয়ে পরেছে। এদের মুল কর্ম হল মেয়েদের ছবিতে কমেন্ট করা, বোরখার হেদায়েত করা, নত হওয়ার হেদায়েত করা, নারী যে মাংশের দলা এইটা মুখে লালা নিয়ে বলা। কিন্তু কোন লজিক জানেনা। প্রতিবাদ করলেই মেয়েদেরকে মাগী বলে গালি দিয়ে ফেলে। আবার অন্য মেয়ের পেইজে এ্যাড মি এ্যাড মি করতে থাকে। হেজাব পরা ছবি দেখলে মাশাল্লাহ বলে, অন্য পোশাক পরা দেখলে নাইচ, পাইন ইত্যাদি প্রশংসা করে তারপর নামে হেজাবের হেদায়েত করতে। এরা সবাই একটা যুক্তি জানে, সেটা হল কলা যুক্তি। ছিলা কলা কেউ খায় না, ছিল্কাসহ কলার কদর বেশি। এরা লজিকাল ডিবেটে কাউকে পরাস্ত করতে না পারলে "নাস্তিক বলগার" বলে গালি দিয়ে সরে যায়। এদের লেখা পড়লে যদিও হাসি পায়, দুর্বোধ্য অসীম ভুলে ভরা, অনেকে বাংলা টাইপও করতে পারেনা। এরাই মুরাদ টাক্লা ভাষার জনক।
আশচর্য জনক ভাবে সত্য হল এই নানান লেভেলের হেদায়েত কারীদের দখলে ফেসবুকের ৪০% চলে গেছে প্রায়, আরো যাবে । একসময় এই রেশিউ চলে যাবে ৭০-৩০ তে। অশিক্ষাকে উদার চোখে দেখতে দেখতে আমরা এই পর্যায়ে এসে গেছি। যার যেই বিষয়ে কথা বলার মত তিল মাত্র জ্ঞান নাই, সেও এই দেশে পন্ডিতি ঝাড়ে। এটাতে আমরা দোষ ধরিনা। তাই এখন বিভিন্ন ইশুতে যার কেউ নাই তাঁর আল্লাহ আছে টাইপ জনতার বিশাল মিছিল দিন দিন বাড়ছেই।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা - রাজাকার, পাকি দালাল
হেফাজতে ইসলাম - মুক্তচিন্তা ( আরো উপরের লেভেলে গেলে নাস্তিকতা)
বাংগালী সংস্কৃতি - ধর্মীয় সংস্কৃতি
লিংগসমতা- নারী নিয়ন্ত্রণ ( হিজাব, একা চলাফেরা না করা, এমন কি সাইকেল, বাইক না চালানোও আছে)
ইত্যাদী নানা ইশুতে এখন বাংগালী জাতী যুক্তি খোজার বদলে হেদায়েতে নেমে পড়ে। ইসলামের নাম ব্যাবহার করার আগে এরা চিন্তাও করে না। ইসলাম বহন করার মতন জোর এর কাঁধে এখনো তৈরী হয় নাই। তাতে কি ? সো্যাব তো পাওয়া যাবে...
ক্লিভেজ দেখানো মেয়ের ছবিতে উকি মেরে এসে যেই গুনাহ হল, টিএসসিতে নির্যাতিত মেয়েদেরকে বোরকা পরার হেদায়েত করলে যেই সোহাব হবে তাতে কাটাকুটি হয়ে যাবে না ? যক্তি ফুক্তি খুজে লাভ কী ? বাংগালী এখন হেদায়েত আর গুনাহর কাটাকুটি খেলা শিখসে, ফেসবুকে খেলছে, রিয়েল লাইফে খেলছে। এক সময় এই খেলা বাড়তেই থাকবে। জাতি বিদাত আর হেদায়েতের দোলাচালে গবেট নাগরিক এর বিশাল পাল নিয়ে উলটা পথে যেতে থাকবে। কিন্তু সেই উলটো যাত্রাকে জায়েজ করা হবে ডিজিটাল উন্নতি নাম দিয়ে।
১৪০০ বছর আগে যেই ইহুদী জাতির হাত থেকে ধর্মকে সুরক্ষা দেবার জন্য হেদায়েত শু্রু।
১৪০০ বছর পর ইসলামের হেদায়েত করার এই অপার সুগোগ করে দেবার জন্য ইহুদী মার্ক জুকারবার্গ কি বেহেস্তে বসে আপেল খাবার সুযোগ পাবার কথা না ?? কি মনে হয় ?

No comments:

Post a Comment