শুভ জন্মদিন বাংলাদেশ !!!
ধুড়ুম...উম...ম...ম...ম !!
কামানের শব্দটা দুর থেকে আসে, আসার পথে দালানে দালানে বাড়ি খেয়ে পীছে করে প্রতিধ্বনী নিয়ে আসে কানে। ফাঁপা, ভোঁতা এই শব্দটার ভেতর শত শত বছরের আতংক মেশানো আছে। জয়ের, গৌরবের, শক্তির বা সাহসেরও মনে হয় রেশ লুকানো আছে কামানের এই শব্দে।
শীতের ভোরের আরামের ঘুম এই শব্দে কাটে না পুরাটা। একটু পাতলা হয়ে আসে হয়ত। আমিও ঘুমন্ত থাকলে হয়ত একঠু নড়ে চড়ে কাঁথাটা ঘুমের ঘোরে টেনে গলা পর্যন্ত তুলে আবার তলায়ে যেতাম গভীর ঘুমে। শান্তি কালীন সময়ের নাগরিকের ঘুম ভাঙ্গানোর জোর, কামানের গোলার নাই। তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তি, মোবাইলে সেট করা অ্যালার্মের। আজ কামানের গোলার আওয়াজ ফুটছে, মোবাইল গুলা অফ। সবাই ঘুমে, আজ ছুটি।
আমি জেগে জেগে গুনি ২৯
আজ বিজয় দিবস,
দিন শুরু হবে দীপ্ত গৌরবে ৩১ বার তোপধ্বনীর মাধ্যমে স্বাধীনতার সৈনিক আর শহীদদের সালাম জানিয়ে। এখন ২৯, আর মাত্র ২ বার।
আনুষ্ঠানিকতার র্যাপিং পেপারে বিজয় দিবস টা এত বেশি মোড়ানো যে, দিন পার হয়ে যায় মোড়ানো র্যাপিং খুলতে খুলতে। ভেতরের আসল উপহারটা আর দেখা হয় না। কাল থেকে আবার নাগরিকদের ছুটাছুটির জীবন শুরু। আধখোলা র্যাপিং এ জড়ানো বিজয়ের চেতনা না দেখাই পড়ে থাকে আরো এক বছরের জন্য। আজ সকাল থেকেই জাতীর জনক, শহীদ, বীর, মুক্তিসেনা, বীরাংগনা নানান বিশেষ্য বিশেষণ চুষে নির্যাস বের করার প্রাণান্ত চেষ্টা হবে। সস্তা দরের ফুডকোর্টের সেট মেনুর মত। আমাদের টিভি চ্যানেলের হাটের কিছু দূর্বল বেপারী, অতি দূর্বল কিছু সেট কন্টেন্ট দিয়ে পর্দা ভরানোর চেষ্টা করবেন। রাজনৈতিক স্বার্থ সন্ধানীদের দুর্বার মিছিলে স্মৃতিসৌধের সড়কে লেগে যাবে দীর্ঘ যানজট। দেখানো আয়োজনের বাড়াবাড়ি চলবে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যাক্তিগত পর্যায়ে। আগের কোন এক বিজয় দিবসে দেখসিলাম এক তরুনীর উপরের ঠোট সবুজ, নীচের ঠোটে লাল লিপস্টিক। আয়োজনের বিচিত্র উদ্ভাবনী চিন্তার চাপে, শ্রদ্ধাটা কেমন জানি চ্যাপ্টা টিশ্যুর মত কই দলামোছা হয়ে কোনায় পড়ে থাকে যেন।
স্বাধীন দেশের নাগরিকের বিজয় উদযাপনের কত নানান মাধ্যম। পতাকাটা হাতে পেতে মাত্র ২০টাকা লাগে। গাড়ির রেডিও এন্টেনায় বেঁধে ছোট। লাল সবুজ বুটিকের ফ্যাশান। মাইকের হেড়ে আওয়াজ বদলে এখন ভালো মানের লাউড স্পিকারে বাজাও মুক্তির গান। টিভিতে দেখ ফিকে হয়ে আসা, সাদা কালো স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরানা ফুটেজ। পাল্লায় করে মেপে মেপে ক্রেডিট তুলে দাও দলভারী নেতার কোচড়ে। আজ সবাই বিজয়ী।
৩১ বার তোপ দাগানো সেনা বাহিনী বিজয়ী।
দলীয় ব্যানার নিয়ে সাভারের রাস্তা জ্যাম করা কর্মীবাহিনী বিজয়ী।
আয়োজোন করে মঞ্চ সাজানো আয়োজক, গায়ক, গায়িকা, নর্তক, নর্তকী, দর্শক সবাই বিজয়ী।
১২ ঘন্টার প্রোগ্রাম বানিয়ে ঠুশে দেয়া টিভিওয়ালারা বিজয়ী।
ছুটির দিনের আমেজে ঘরে বসে ভুনা খিছুড়ি খাওয়া ছা পোষা মধ্যবিত্ত সে ও বিজয়ী।
শত শত এই আয়োজনের মাঝে দেখানো ভালোবাসায় গৌন হয়ে যায় যে মানুষটা স্বাধীনতার এই বিশাল পাহাড়ে অন্ধকারের ভেতর জাতীকে মশাল হাতে এগিয়ে নিয়ে যেতে যেতে বলেছিলেন, তার কথা গুলা
- সেক্যুলার এক বাংলা বানানোর কথা।
সিংহের মত শরীরে বজ্রকন্ঠে কান্না চাপতে চাপতে বলেছিলেন
- আমি বাংগালী, আমি মানুষ।
খুব মৃদুস্বরে দু একবার শোনা যাবে নিঃসংগ সারথী সেই ছোট খাটো মানুষটার কথা। রামের জুতা সিংহাসনে রেখে রাজ্য শাসন করা ভরতের মতো। কিংবা ব্রেভহার্ট সিনেমার রবার্ট ব্রুসের শেষ যুদ্ধে উইলিয়াম ওয়ালেসের তলোয়ার সামনে ছুঁড়ে দিয়ে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়া সৈন্যের মত। দুইশ বছরের ফুঁশতে থাকা স্বাধীনতার স্বপ্নটাকে নেতার অবস্থান সমুন্নত রেখে বাস্তবায়ন করার নীলনকশা কাটা অন্ধকারের ঘোড়সওয়ার বংগতাজের কথা। চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধটাকে ৯ মাসে আটকে ফেলে, বিজয় এনে দিয়ে যিনি সরে গেলেন এক পাশে। সেই সেকুলার বাংলা বানানোর কারিগরের না জানা সংগ্রামের গল্প, শোনায় কেউ ?
কত কত বড় বড় কথা শোনায় কতজনে, কেউ শোনায় না- সেই অসুর বধের যুদ্ধে, ঝোপের আড়ালে তিন দিন পর এক শানকীতে ভাত আর পোড়া মরিচ ডলে ভাত খেয়েছিল মৌলভী আর ব্রাহ্মনের যোদ্ধা ছেলে ?
বিজয় দিবস আসবে, যাবে, প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনের কলেবর আরো বাড়বে, আয়োজনের মাত্রা নিয়ে বাড়াবাড়ি হবে, প্রতিযোগীতা হবে, সবাই যার যার অবস্থানে বিজয়ী হবে।
শুধু বার বার মুক্তি পাবেনা সেকুলার বাংলা বানানোর স্বপ্নটা।
বাংগালী জবাব দেবার আগে দ্বিধায় ভুগবে, সে বাংগালী, না মোসলমান, কোনটা আগে...
পাদপ্রদীপের নেপথ্যে মগজে শান দেয়া অভিজিত, অনন্ত, নীলাদ্রী, দীপন রা মরে যাবে।
পতাকার আড়ালের নীচে শুওরের পাল বড় হবে। ধর্মের দোহাইয়ে, খেলার দোহাইয়ে, রুপের দোহাইয়ে, বার বার ছোট করে দেবে জাতীয়তার গৌরব।
কেউ টুটী চেপে ধরবে না, পাইক্কা হারামজাদা গুলার, যারা এখন বলে ৭১ এ গনহত্যা হয় নাই।
বিজয় দিবস আসে,
৩১ টা তোপধ্বনী হয়।
...আমাদের ঘুম ভাঙ্গে না।
No comments:
Post a Comment