Thursday, December 27, 2018

গালগপ্প মহাভারত

ভারতীয় পুরাণ ঘেটে ইতিহাস খুঁজতে যাওয়ার সব থেকে বড়ো ঝামেলাটা হল এসব পুরাণের রচয়িতা ঋষি কিংবা কবিদের অন্য কোন বিষয়ে কোন জ্ঞান ছিল, আর কোন বিষয়ে ছিল না তা নিশ্চিত হওয়া যায়না। তবে সেটা নিশ্চিত না হলেও একটা বিষয় পরিষ্কার যে তাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র সময়-সংখ্যা কিংবা ইতিহাস জ্ঞানের কোনো অস্তিত্ব ছিল না; অথবা অদরকারি মনে করে তারা এই তিনটা জিনিসের সাথে বাচ্চা শিশুদের মতো খেলা করে গেছেন। সময় মাপতে গিয়ে তারা ষাট বছর আর ষাট হাজার বছরে যেমন কোনো ফারাক করেননি; তেমনি সৈন্যসংখ্যা একশোরে একশো কোটি বলতেও আপত্তির কিছু দেখেননি। একইভাবে নতুন কবিরা যখন সাহিত্য রচনা করছেন কিংবা পুরাতন সাহিত্য সম্পাদনা করছেন তখনো কিন্তু আশপাশের ঐতিহাসিক উপাদানগুলোকে বাদ দিয়ে কোন কালের সেই কল্পিত ঐতিহ্যর লোকস্মৃতি ঢেলে সাজিয়েছেন নিজের পুস্তকের সমাজ বাস্তবতা। যার জন্য দুই হাজার বছর আগের আর পরের সাহিত্যে সমাজ বাস্তবতা মূলত কপিপেস্ট ছাড়া কিছু না...

ভারতীয় সংস্কৃতিতে ইতিহাস চর্চার মূল কনসেপ্টাই হল কাল্পনিক এক সমৃদ্ধ অতীতের কাবিক্য চিত্রকল্প নির্মাণ। অনেকটা শাহ আবদুল করিমের গানের মতো- আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম-এর নস্টালজিয়া অথবা জীবনানন্দের মতো কোনো এক শ্রাবস্তির কারুকার্য কল্পনা করে তাব্দা খেয়ে বসে থাকা। সকলেই মনে করে আগের দিনগুলা ছিল খুবই দারুণ। মূলত এটা একটা নতুনত্বভীতি আর বুড়ামির প্রতীক। এর জন্য সকলেই  শুধু কল্পিত এক নতুন দিনের সাধনা করে; আর কবিরা সেটা নতুন করে রচনা করে আবার প্রচারও করেন নতুনের মতো। কল্পিত রঙিন অতীত নির্মাণের এই বাজে অভ্যাসটা এখনো আছে আমাদের সংস্কৃতির মাঝে। বর্তমান সময়ে রচিত আমাদের গানগুলায় এখনো নদীর পাড়ে বসে রাখাল বাঁশি বাজায় আর মেয়েরা কলসি নিয়ে পানি তুলতে নদীঘাটে যায়। অথচ গত তিন দশক ধরে যেমন রাখাল পেশাটাই বাংলাদেশ থেকে নাই হয়ে গেছে আর চল্লিশ বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষ নদীর পানি খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে সেইটার কোনো সংবাদ নেই এইসব লোক সাহিত্যের পাতায়....

পুরাণগুলোর মধ্যে যে টুকটাক ইতিহাসের উপাদান পাওয়া যায় সেইগুলো মূলত সাহিত্যে ছড়ানো ঘৃণার বাক্য কিংবা লেখকের মূর্খতার ফাক ধরে। রামায়ণে যখন রামের মুখ থেকে জাবালিকে বৌদ্ধ বলে গালি শুনি তখন আমাদের বুঝে নিতে হয় যে, যেই সমাজে বসে রামায়ণ লেখা হয়েছে সেই সমাজে তখন বৌদ্ধ বিপ্লবের ঠেলায় হিন্দু ধর্ম বিপন্ন। আবার বিশ্বামিত্রের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে যখন বশিষ্ঠের কামধেনুরে যবন সৈন্য উৎপাদন করতে দেখি তখন আমাদের ধরে নিতে হয় যে মহাভারতের এই বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্র যুদ্ধটা হয় হয়েছে ভারতে গ্রিকদের আগমণের পর; না হয় যারা এই গপ্পটা মহাভারত-রামায়ণে ঢুকিয়েছেন তারা ভারতে গ্রিক অভিবাসনের পরের মানুষ। অথচ ঘটনার বর্ণনাগুলা কিন্তু সেই আদি কাল্পনিক। বশিষ্ঠ সেখানে যেমন তার আদি কাল্পনিক অলৌকিকত্ব নিয়া বসে আছেন তেমনি তার কামধেনুও কাল্পনিক; তার অস্ত্রপাতিও কাল্পনিকতার কপি পেস্ট...

মহাভারতে কুরুযুদ্ধ হোক বা না হোক; যুদ্ধ শেষে পাণ্ডবপক্ষ জিতুক বা কুরুপক্ষ জিতুক; যুধিষ্ঠিরের কিন্তু ঐতিহাসিকতা আছে। আর সেই ঐতিহাসিকতার হিসাবে যুধিষ্ঠির ভারতে লোহার ব্যবহার শুরু হবার আগের যুগের মানুষ। অথচ যুধিষ্ঠিরকে ঘিরে কবিরা যে কুরুযুদ্ধ রচনা করছেন তাতে সম্পূর্ন লোহার খনি ঢেলে দিয়েছেন। পুরো কুরুযুদ্ধই লোহার অস্ত্রে ঝনঝন করছিলো। মহাভারতে রাজপুত্ররা প্রাচীন গদাযুদ্ধ মল্লযুদ্ধই শিখত; রামায়ণে গদার উল্লেখ নেই। তীর ধনুকের ব্যবহারই বেশি। অথচ যুধিষ্ঠিরের সমসাময়িক মানুষ মরে গিয়েছিলেন লোহা আবিষ্কাররে অনেক যুগ আগে। কিন্তু সেই হিসাবটা ছিল না কবিদের মাথায়...

হরপ্পায় পাথরের দালান ছিল; খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০ সালে। আর্য প্রভাবিত ভারতীয়রা যখন আবার স্থাপনা বানাতে শুরু করে তখন সেটা  খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০। এবং এটা শুরু হয় কাঠের দালান দিয়ে। পাথর না। ভারতে আর্যদের হাতে প্রথমরের মতো পাথরের দালান বানানো শুরু হয় গুপ্ত যুগে; ৩৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। তাহলে রাবণের বাড়িতে অত দালান আসে কেমন করে?

মহাভারতে কোনো স্থাপনার কথা কিন্তু ছিল না। রামায়ণে ইটের দালানের কথা আছে কিন্তু পুরা মহাভারতে কোনো বাস্তুশিল্পের উদাহারণ নাই। পুরোচন বারণাবতে সম্রাজ্ঞী আর যুবরাজের জন্য যে ঘরটা বানানো হয় সেটা কিন্তু কিন্তু বাঁশ-বেত শনের ঘর। অন্যদিকে রামায়ণে স্থপতিরা বেশ উপস্থিত। ইটের ব্যবহারও আছে। দালানও আছে। তবে লঙ্কায় ইটের দালান ছিল বলে মনে হয় না। লঙ্কার সবগুলা বাড়িঘর প্রাচীরই ছিল সাধারণভাবে দাহ্য; মানে কাঠ বাঁশের স্থাপনা। যদিও রাবণের দশটা গুণ বা দক্ষতার মধ্যে একটা ছিল বাস্তুশিল্প বা আজকের যুগের স্থাপত্যশিল্প...


অতঃপর হনুমানের ল্যাঞ্জা বিষয়ক মারামারি বিজ্ঞানি আর ভক্তজনেরা করবে। এই পৃথিবীর বিপুল সংখ্যক মানুষ যুগ যুগ রামায়ণকে নিরঙ্কুশ সত্য হিসেবে বিশ্বাস করে এবং রামকে ভগবানের অবতার হিসাবে। সমস্যা হয় তখন, যখন তথাকথিত শিক্ষিত মানুষেরা এর প্রতিটি লাইনকে আক্ষরিক অর্থে ধরে ইতিহাস রচনায় ব্রতী হয়ে পড়েন।

[বিঃদ্রঃ চিন্তক ও শীর্ষ অংশটুকুর কৃতিত্ব মাহবুব ভাইয়ের।]

No comments:

Post a Comment