ছেলেটার নাম ছিল তোতা।
পুরো নাম মোহাম্মদ তোতা মিয়া সরদার।
দাদা নানা নাম রাখার সুযোগ নিলে যা হয় আর কি, ক্যালাস একটা নাম ধরায়ে দেয়। তোতার কপালে তাই হইসে। দাদার কাছে ফর্সা টুকটুকে নাতিকে দেখে নাম রাখতে ইচ্ছা হইসে "তোতা"। কি সুন্দর পাখীর নামে নাম। এই নাতি একসময় কথা বলা শিখবে, কুট কুট করে তোতা পাখির মত কথা বলবে, চিন্তা করেই আরামে দাদার চোখে পানি চলে আসছিল। নামের সমস্যা হল। যুগের সাথে পাল্লা দেয়ার শক্তি। সব নামে এই শক্তি থাকে না। তুলতুলা আদরের নামে তো আরো কম থাকে।
দাদার মত ১২ কানি জমিতে ২ ফসলি ধান আর শীত কালে সবজী চাষ করলে তোতা নামে কিছু আসে যায় না। কিন্তু সমস্যা হয় মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানীতে এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসাবে তোতা মিয়া নাম ক্যারী করা খুব টাফ। লোকে নাম নিয়ে বিটলামী করে। কর্পোরেট যুগে, অন্যকে বিটলামী করতে দেয়ার সামান্য সুযোগ থাকাও বিরাট অযোগ্যতা। তোতা এই ঘটনা বুঝতে শুরু করসিলো হাইস্কুলে।
গ্রামের তোতা জেলা সদরের জিলা স্কুলে ভর্তি হয়ে টিসটাশ পোলাপাইনের সামনে পড়ে ৫ মিনিটেই বুঝে ফেলসিলো এইখানে তোতা নাম চলবে না। যেখানের যা নীতি। তোতা অই ৫ মিনিটেই ঠিক করে ফেলল নামে রেনোভেশান করতে হবে। তাই নিজের একটা শর্ট নেম বানায়ে বলে দিলো টিটো। পুরো নাম থেকে গেল খাতা পত্র আর সার্টিফিকেট টেস্টিমোনিয়াল এর জন্য। গল্পের সামনের অংশে আমরা তোতাকে টিটো নামেই ডাকবো।
তো টিটো ছাত্র খারাপ না। জিলাস্কুল থেকে কলেজ হয়ে ভার্সিটিতেও পা ফেললো।
ততদিনে টিটো বুঝে ফেলল, এই দেশে সম্মান, টাকা, আরাম সব কিছুই ঢাকায়। গুতাগুতি ঠুশাঠুশি করে হলেও তাকে ঢাকায় জায়গা করে নিয়ে হবে। তার পৈত্রিক ঠিকানা নৈল্লারচরে, ফিরে যাওয়াকে জীবনের লক্ষ্য বানানোর যুক্তি , সাহস কোনোটাই হল না। দাদার জমি ভাগ হবে বাপের ভাগে ৪ কানি পড়েছিল। টিটোর বয়স ২১ এ পড়ার আগেই, নানা কারনে সেই জমি হাত খুইয়ে এখন ৮ গন্ডার বসত বাড়ি আর ৯ গন্ডার ধানী জমি ছাড়া কিছু নাই। সো নো টার্নিং ব্যাক। টিটো ঢাকায় ঢুকার ফাইটে গুতা দিল। সফল ও হইতে থাকলো।
৩৪ বছর বয়সে বনানীর কফি শপে, ক্লায়েন্ট এর সাথে পোস্ট লাঞ্চ মিটিং এ রেমন্ড এর স্যুট এর পকেট থেকে ফেক আরমানী ব্র্যান্ডেড বিজনেস কার্ড পাউচ থেকে বের টিটো নিজের কার্ড আগায়ে দেয়।
মিস্টার টি এম সারদার ( ইংলিশ এ সরদার এ দিয়ে লিখতে হয়, তাই উচ্চারনেও প্রভাব পড়ে, কি আর করা)
সিনিয়ার জেনারেল ম্যানেজার
খুব কায়দা করে টি আর এম দিয়ে তোতা মিয়া কে ঢেকে ফেলসে টিটো। চকচকা চৌকষ টিটো এখন ঢাকার মানুষ। আধুনিক ঢাকাবাসী নাগরিক জীবনে মিশে গেছে বউ-বাচ্চা, চাকরী, লোনের টাকায় ফ্ল্যাট সব হইসে। লাইফ সেট। এখন শুধু আরাম আর আরাম।
জীবনের কোনো না কোনো পর্বে সব পাখি ঝড়ে পড়ে, তোতাও পড়লো জীবন সেট হবার পর।
ব্যাংক লোনে টিটো ধাপাস করে একটা গাড়ি কিনে ফেললো। চকচকা নতুন গাড়ি, তোতার গর্ব আর স্বপ্নের সীমা নাই। বহুদিন বাসে, রিকশায় আর সিএনজিতে বসে মনে মনে ঢাকার রাস্তাকে গালি দিতে দিতে টিটো কত ভাবসে, একদিন এই ঢাকার রাস্তায় নিজের গাড়ির ব্যাকসীটে এসি ছেড়ে চোখ বন্ধ করে গান শুনতে শুনতে অফিস যাওয়া ... আহ !
এই না হলে লাইফ ?
নো লেইট, নো ঘামাঘামি, জামা চকচকা, মুখ ঝকঝকা, পকেটে আধ ময়লা রুমাল থাকবেনা, শার্টের কলারে বাদামী দাগ বসবে না, প্যান্টে থাকবে শুধু আয়রনের ক্রিজ, আর কোন কুচকানো দলামোচা ভাজ নাই। আরামের সাথে সাথে ইজ্জত বেড়ে যাওয়াটা তো বাড়তি পাওনা আছেই। এই সবই একদিন সত্য হবে টিটো জানতো।
কিন্তু,
ধরা খাওয়াটা টিটো টের পাইলো গাড়ি কেনার ৯ দিন পর। বাচ্চাকে নিয়ে আইস্ক্রিম খেতে গিয়ে বনানীর রাস্তায় পার্ক করা গাড়ির রিয়ারভিউ মিরর খোয়া গেল, সেটা ছিল শুরু, এর পর কখনো বিট, কখনো গাড়ির বাইরের এখানে ওখানে লাগানো খুচরা পার্ট, খুবলে খুবলে চোরে নিতে থাকলো। টিটো গাড়ি নিয়ে কোথাও গেলে আতংকে থাকা শুরু হল। শান্তি মত বসতে পারে না, উশখুশ করে।
চোখের সামনে গাড়ি রাখবে, তার ও উপায় নাই। অতি ততপর ট্রাফিক পুলিশের বর্গী সেনারা নিমেষে গাড়ির চাকায় হলুদ রং এর লক লাগিয়ে রেকার ফি নিতে থাকলো। টিটো দিশেহারা হয়ে গেল। গাড়ি নিয়ে বাসা থেকে বের হতে ভয় লাগে। কোথাও গেলে গাড়ি কোথায় রাখবে, এই টেনশানে টিটো গাড়ি রাস্তায় বের করা কমায় দিলো। তাও যখন বের করে, গাড়ি চালানোর সময় ও টিটোর অসহায় লাগে, মাঝে মাঝে কলিজা ছ্যাত করে উঠে। রাস্তায় উত্তাল ঢেউ এর মতন গর্ত আর টিলা। গাড়ির কলকব্জা অল্প কয়দিনেই ক্যাচর কোচর করে জানায়ে দিল, এভাবে হচ্ছে না বস। টিকতে পারবো না। তারপর দিন দিন টিটো ধৈর্য হারায়ে ফেলতে থাকলো জ্যাম খেতে খেতে। প্রতিদিন ৪-৬ ঘন্টা টিটো গাড়ির ভেতর ঝিম মেরে বসে স্থবির রাস্তা দেখে অসহায় চোখে, গাড়ির ইঞ্জিন চলে, জ্বালানী পোড়ে, এসি চলে।
টিটোর টাকায় টাকা পোড়ে, আরাম আর মেলে না।
দিশাহারা টিটো বুঝতে পারে না কি করবে। এসি ছেড়ে বউ বাচ্চা ঘুমায়, টিটো ঘামে টেনশানে।
ঢাকা শহরে গাড়ি ছাড়া চলা যায় না, সরকারকে হাতখুলে ট্যাক্স দিয়ে সবাই গাড়ি নামাচ্ছে রাস্তায়। কিন্তু রাস্তায় নামা গাড়ির আর কোনো মা বাপ নাই, এটা হয়ে যায় গাড়ি মালিকের বোঝা।
বউ একসময় বুদ্ধি দিলো, এত হ্যাপা হলে, গাড়ি নিয়ে ডেইলি বের হবার দরকার নাই।
গাড়ি না বের করুক, টিটোকে তো বের হতেই হবে। কর্পোরেট লাইফ বলে কথা, টনটনা সময়সূচী আর পাহাড় সমান কর্তব্যের চাপে টিটো গাড়ি রেখেই অফিস ছুটে। সময় মত আর পৌছানোর কায়দা পায় না।
সিএঞ্জি ওয়ালাদের নবাবী আর দূষ্প্রাপ্যতা, বাসে উঠার অভ্যাস হারানো টিটো পাঠাও চড়ে অফিস করবে সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু একদিন পাঠাও চড়ে যাবার সময় ট্রাফিক থামায়ে তাকে নামায়ে দেয়, পাঠাও সার্ভিস অবৈধ বলে। ৪ কিলোমিটার হেটে হেটে টিটো বাসায় যখন ফেরে, তার অবস্থা নালায় পড়ে ল্যাতাপ্যাতা হওয়া কুকুরের মত।
টিটোর বউ টিটোকে বুদ্ধি দেয় একটা ইলেক্ট্রিক স্কুটার কিনে ফেলতে।
ফ্ল্যাটের লোন, গাড়ির লোন, বউ বাচ্চা নিয়ে স্ট্যান্ডার্ড লাইফ স্টাইল সব মিলায়ে টাকাপয়শার খিচ কিন্তু ম্যালা, তবুও নিরুপায় টিটো কিনেই ফেলে একটা ব্যাটারী চালিত স্কুটার। এইবার অন্তত অফিস টা ঠিক টাইমে ধরা যাবে।
২ মাস ১১ দিনের মাথায় টিটোর স্কুটার সীজ করে ডাম্প ইয়ার্ডে পাঠিয়ে দেয় ডিএমপি ট্রাফিক।
ইলেক্ট্রিক বাইক বিক্রী হচ্ছে দেদারসে, বিক্রীতে মানা নাই, কিন্তু রাস্তায় চলা অবৈধ। টিটো বুঝতে পারে না এই বাইক কিনে মানুষ তাহলে চালাবে কোথায় ? বেডরুমে ? সরকার এর নিয়ম নীতি কারা বানায় ?
হতাশ টিটো খুঁজে পায়না, সমাধান কোথায়।
একসময় এক কলিগের বুদ্ধিতে টিটো একটা সাইকেল কিনে ফেলে। সাইকেল খুব চলছে, ট্রেন্ডি। আগের মত পিয়ন পিয়ন লুকটা নাই। ভাল একটা সাইকেল হলে, দিব্বি চালায়ে অফিস কমিউট তো করাই যায়। এই ভেবে টিটো ঢেলে ফেললো আরো ৩৫ হাজার টাকা।
যাক, আর জ্যাম, চুরি, রেকার, ডাম্পিং এইসবে আটকাবে না। টিটো দিব্বি ২ প্রস্থ কাপড় নিয়ে সাইকেল করে অফিস যায়, অফিস গিয়ে কাপড় পাল্টে মানেজার সাহেব হয়ে কাজ সামলায়, তারপর আবার সাইকেল চালায়ে ফিরে আসে। নিজেকে বুঝায় বেশ একটা ফিটনেস ও হচ্ছে ফাও ফাও।
হচ্ছিলো সবই ঠিক ঠাক। শুধু মহাখালীর ভাংগা গর্তে চাকা পড়ে একটা টাল সামলাতে হিসাবে ভুল আর পেছন থেকে হক মাওলা পরিবহনের সিটি বাসের ধাক্কায় টিটো ধরাশায়ী হয়ে যায় জুলাই মাসের কোনো এক বৃষ্টির সন্ধায়।
এপোলো তে দেড় মাস নিওরো, অর্থোপেডিক্স সার্জারী ট্রিটমেন্ট। কোমরের ভাংগা হাড্ডি আর মেরুদন্ডের নীচের দিকে টুকরা হয়ে যাওয়া ৩ পিস কশেরুকা শুষে নেয় টিটোর জমানো সব টাকা। তাতেও কুলায় না। গাড়িটা সারেন্ডার করে ব্যাংকে, ফ্ল্যাট বিক্রী করে দেয়। টিটোর বউ, বাচ্চা নিয়ে উঠে রামপুরার ছোট্ট একটা ভাড়া বাসায়।
৩ মাস পর অফিসে ফিরে, কলিগদের চেহারায় ফাইক দুঃখ দেখে দুদিন, তারপর সব আগের মত। দুই সপ্তাহ পর, এমডির রুমে ডাক পড়ে টিটোর।
টার্মিনেশান লেটারে খুব ভালো ভালো কথা লেখা, এমন শারিরীক অবস্থায় টিটোর বিশ্রাম দরকার, তাই কোম্পানী মনে করে টিটোর কাজের চাপ যেন তার শারিরীক উন্নতির অন্তরায় না হয়ে দাঁড়ায় ... হেনতেন।
বাংলা কথায় টিটোর চাকরীটাও যায়। শুধু যে যায় তা না। টিটো সহসা বিকল্প কোনো উপায় পায় না।
শুল্কপক্ষের নবমীর রাতে, ঘুমাতে না পারা টিটো মাঝরাতে হঠাত সিদ্ধান্ত নেয়।
নাহ ! সে আসলে হেরে গেছে। তার পক্ষে আর উপায় বের করা সম্ভব হচ্ছে না। এই শহরে সে আর টিকে থাকার অস্ত্র খুঁজে পাচ্ছে না। পরাজিত টিটো জানালার পর্দা খুলে ঝুলে পড়ে সিলিং ফ্যান এর সাথে।
নৌল্লারচর এর সরদার বাড়ির পড়ালেখায় ভালো ছেলে তোতা মিয়া ডিফিটেড হয় মেগাসিটি ঢাকার দুই কোটি মানুষের প্রতিযোগীতায়।
No comments:
Post a Comment