মৃত্যু না থাকলে কী কী হতো বলা যায়না। হয়তো অনেক কিছুই অন্যরকম হতো। তবে এটা ঠিক যে পৃথিবীতে কোনও ঈশ্বরের কল্পনাও থাকতো না। কোনও গোষ্ঠীবদ্ধ 'ধর্ম'ও থাকতো না নিশ্চিত। প্রমথনাথ বিশী একটি গল্প লিখেছিলেন, " ভগবান কি বাঙালি ?" সেখানে তিনি বলেছিলেন এই বিষয়টি নিয়ে পৃথিবীর বৃহত্তম থিসিসটি লেখা হবে। কারণ এটাই হবে মানুষের শেষ থিসিস। যেহেতু ভগবান বাঙালি প্রমাণ হয়ে গেলে পৃথিবীতে আর কোনও থিসিসের দরকারই হবেনা। সেরকমই মৃত্যু না থাকলে শুধু ভগবান কেন, মানুষের যাবতীয় মাথার ঘাম পায়ে ফেলার ইচ্ছেই তো বাতিল হয়ে যাবে। মৃত্যু নিয়ে সারা পৃথিবীতেই মানুষের অনন্ত কৌতুহল, প্রশ্ন, উদ্বেগ এবং অনিঃশেষ ভয়। প্রাচীনকাল থেকে আজ অবদি এই মৃত্যুকে ও মৃত্যুপরবর্তী লোভ, ভয়, পুনঃজন্ম নিয়ে অগনিত লোকাচার, ধর্ম, ভন্ডামীর সূত্রপাত হয়েছে। শ্রীমদভগবদ্গীতা নামক গ্রন্থটিতে তো শুধু এই নিয়েই আঠেরোটি অধ্যায় রচিত হয়ে গেলো। মৃত্যুভয় ও তদ্জনিত শোক কীভাবে বাগে আনতে হয় তা নিয়ে ভারতবর্ষে উপনিষদ বা বৌদ্ধবিদ্যায় সুদীর্ঘ চর্চাসমূহ দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু প্রাগ ইতিহাসের অর্ধসভ্য মানুষজনের মৃত্যুকেন্দ্রিক উদ্বেগ ও আশংকার মাত্রা একুশ শতকের অতিসভ্য জনসমাজেও কিছুই হ্রাস পায়নি।
নিজেকে মানুষ অত্যন্ত ভালোবাসে। হয়তো শুধু নিজেকেই বাসে। বাকি এক্সপ্রেশনগুলি হয় সামাজিক দায়বদ্ধতা, নয় নিছক শরীরলিপ্সা। কখনও'ই সে স্বীকার করতে পারেনা যে 'আমি' নেই, অথচ সব কিছু একইরকম রয়েছে। 'আমার' থাকা না থাকাটা এতো'ই তুচ্ছ, তাৎপর্যহীন একটা নিয়মরক্ষা, যে আমার মৃত্যুতে গাছের একটা পাতাও ঝরে পড়েনা। এই সত্যটা কখনও কোনও মানুষ সহ্য করতে পারেনা। এই অসহ্য সত্যটিকে জায়গা করে দিতে রচনা করা হয় অসংখ্য দর্শন, অগণিত দৈবী-ঐশী নির্মাণ। জন্মান্তরবাদ, অবতারবাদ, কর্মফলতত্ত্ব, পাপপুণ্য মাপা পুথির পর পুথির অবতারণা। তবুও মরণ আসে নিয়ম করে।অতি স্বল্প কেউ কেউ অভিযোগহীন মসৃণতায় তাকে আলিঙ্গন করেন।বড়ো মানুষেরা নিজেদের কীর্তির ভিতরে বেঁচে থাকবেন। কিন্তু যাঁরা ততো বড়ো ন'ন? তাঁদেরও তো আকাঙ্খা থাকে। এই শরীর শেষ হয়ে যাবার পরেও কীভাবে আরো কিছুদিন প্রাসঙ্গিক থাকা যায়? চিরন্তন প্রশ্ন।
পৃথিবীর সব 'সভ্য-অসভ্য' সংস্কৃতিতে প্রথম ভীতির সূচনা হলো প্রয়াত আত্মা'র কল্পনা। মৃতপুরুষরা নিজেদের জীবৎকালে নিয়ম বেঁধে যান, যেখানে শরীরের মৃত্যুর পরেও তাঁরা উত্তরপুরুষের অভিভাবক হয়ে রয়ে যাবেন। কিছু ভক্তিশ্রদ্ধা, কিছু কৃতজ্ঞ ভালোবাসা, বাকিটা আনুগত্য; সন্ততিরা এভাবেই পূর্বপুরুষদের বাঁচিয়ে রাখেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম। ক্রমে নানা বিশদ প্রথার জন্ম হয়। প্রথাগুলি শাস্ত্রায়িত হয়ে ধর্মবিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গও হয়ে যায়। মানুষ ভরসা খোঁজে দিনে আর রাতে। নানা গল্পকথা, অধিআদেশের লোহার খাঁচাও তৈরি করা হয়। পূর্বপুরুষদের স্মৃতি উত্তরপুরুষদের বহন করতেই হবে। নয়তো পৃথিবী উচ্ছন্নে যাবে। শরীরকেন্দ্রিক অস্তিত্ত্ব ঘুচে যাবার পর স্মৃতিকেন্দ্রিক অস্তিত্ত্বের আশা মানুষের আত্মপ্রেমকে শুশ্রূষা যোগায়। স্বস্তি সান্ত্বনার আশ্বাস দেয়। নশ্বর মানুষের অলীক আশ্রয়ের একটা ভ্রান্ত বিশ্বাস তৈরি হয়ে যায় এইভাবে।
পৃথিবীর সব প্রান্তেই পুর্বপুরুষদের স্মৃতির প্রতি সম্মানসূচক নানা লৌকিক প্রথা প্রচলিত আছে। প্রাচ্যের দেশগুলিতে তার প্রভাব গভীরগামী। ভারতবর্ষ, চিনসহ দূরপ্রাচ্যের সমস্ত দেশেই যেখানে যৌথপরিবারকেন্দ্রিক আর্থসামাজিক ব্যবস্থা দৃঢ়্মূল ছিলো, বহুবিচিত্র উপায়ে পূর্বজদের শ্রদ্ধা-ভক্তি-আনুগত্য নিবেদন এখনও করা হয়ে থাকে। তবে ভারতবর্ষের সনাতনধর্মীয়দের মতো এতো বিশদ, স্ট্রাকচার্ড প্রথাপ্রণালী বোধহয় আর কোথাও তৈরি হয়নি । পুরো ব্যাপারটিকে আচরণীয় ধর্মীয় কৃত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার অবকাশ বিশেষ রাখা হয়নি।
কৃতপুরুষদের স্মরণ করা অবশ্যই পুণ্যকর্ম এবং সেহেতু এই দিনটি একটি পবিত্র উপলক্ষ্য । কিন্তু এর সঙ্গে শোকের মাত্রা যোগ করাটি পুরাণযুগের অবদান। প্রাচীনকালে বৈদিকযুগে মৃত্যুঞ্জয় হবার সাধনা করা হতো, পশ্য, মৈত্রেয়ী, নচিকেতা ইত্যাদি । যেহেতু মৃত্যু জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি, তাই বেদ-উপনিষদের কালে তার মাহাত্ম্য স্বীকার করা হলেও ততো প্রাধান্য দেওয়া হতোনা। কিন্তু পুরাণযুগে মানুষ চারিত্র্যে অল্পপ্রাণ হয়ে যাবার ফলে, 'মৃত্যু' মানুষের মনে এক চরম ভীতিকর মাত্রা নিয়ে আসতে শুরু করে। এই ভীতির বাণিজ্যীকরণ করে পুরোহিতকুল বহু লোকাচারের সৃষ্টি করেছে। সনাতনধর্মীয়দের মধ্যে এই পক্ষকালে পরলোকগত পিতৃপুরুষদের উদ্দেশে জল ও ফলদান করার বিধি রয়েছে। ব্রাহ্মণরা বলেছেন, এই আচারটি পালিত না হলে পিতৃপুরুষ ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত হয়ে অভিশাপ দিতে দিতে মহালয়া অমাবস্যার দিন আবার যমলোকে ফিরে যাবেন। সেটা উত্তরপুরুষদের জন্য অকল্যাণকর। তাই মহালয়া অমাবস্যায় পিন্ডদান ও গঙ্গাস্নানের বিধান 'শাস্ত্রের' অঙ্গ ।তবে একটা শর্ত আছে!! ঔরসজাত 'পুত্র' ছাড়া কেউ পিন্ডদান করতে পারবে না। করলেও সে অন্ন পিতৃলোক পর্যন্ত পৌঁছোবে না। গরুড়পুরাণ বলছে, পুত্রহীন পিতারা কখনও মুক্তিলাভ করবেন না। পুত্রলাভের জন্য তাঁদের বারবার জন্ম নিতে হবে। মার্কন্ডেয়পুরাণ বলছে, পূর্বপুরুষের আত্মা যদি পুত্রের শ্রাদ্ধে সন্তুষ্ট হয় তবে প্রচুর সমৃদ্ধিলাভের ব্যবস্থা পাকা হয়ে যায়। মোক্ষলাভও গ্যারান্টিড।
মৃত্যুশিল্প বিষয়ে আমার জানা শ্রেষ্ঠ শিল্পীর নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রের আয়নায়-"লোকাচারের 'শ্রাদ্ধ' ইত্যাদি অনুষ্ঠানের সঙ্গে তার (মৃতব্যাক্তির) সম্পর্ক নেই। লোকাচারের 'শ্রাদ্ধে' আমাকে এক ব্রাহ্মণ পুরোহিত যখন বলে আমার প্রয়াত মাতৃদেবী ক্ষুধার্ত প্রেত হয়ে আমার পিন্ডদানের জন্য অশরীরী অপেক্ষা করে আছেন এবং 'পিন্ড' না পেলে তিনি আমার অমঙ্গল করবেন। আমি সেই ব্রাহ্মণকে বলি, যে 'লোকাচার' মনে করে ঐ চালকলার পিন্ড না পেলে আমার মা আমার অমঙ্গল করবেন, সেই মূর্খতাকে ধিক্কার জানাই এবং আমি কোনমতে সেই 'শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে'র অংশ থাকতে পারিনা। পুরোহিত বিড়ম্বিত বোধ করেন এবং আমি এরকম একটি মূঢ়তার অংশভাগী হয়ে নিজের প্রতি করুণা বোধ করি। এই লোকাচারটিকে যদি 'শ্রাদ্ধ' বলা হয়, তবে তা কোনমতে শুভবোধের অংশ নয়।"
আধুনিক নাগরিক সভ্যতায় সদ্যোমৃত প্রিয়জনকে 'হারানো'র যে বেদনা, তার একটা শেলফ লাইফ রয়েছে । বেদনার প্লাবন চলে যায়, কিন্তু পলিমাটির মতো যা পড়ে থাকে, তার নাম শোক। শোক একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি। এর কোনও সামাজিক তাৎপর্য নেই, পূর্ণত গহনগামী এক উপলব্ধি। এই উপলব্ধি এক নিগূঢ় শিল্পের মতো।
No comments:
Post a Comment