Friday, December 14, 2018

গৃহপালিত লেখক।

দুইটা গল্প বলি।
দুইটা কেন ? ব্যাপার আছে। ছোটদেরকে একটা গল্প বললেই হয়। বড়দেরকে বলতে হয় দুইটা। এর একটা থাকে কমন গল্প। যেটা আগে সবাই শুনসে, আরেকটা থাকে সিস্টেমের গল্প। আগে শোনা হয় নাই এমন। সেই গল্পের মধ্যেই "কিন্তু" থাকে। তবে চিন্তার কিছু নাই এই গল্প শোনার বা পড়ার পর সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্ন করা হবেনা।

তো প্রথম গল্পটা এক নাপিতের।
যার কামাই রুজি কম। ধুকে ধুকে চলতেসে। একদিন তার দোকানে এক কাস্টোমার আসলো। চুল কাটার পর, দাড়ি কামাতে গেলে সেই কাস্টোমার কোঁও করে কাঁকিয়ে উঠলো। নাপিত দেখলো কাস্টোমারের গালে এক ফোঁড়া। তো সে কাস্টোমারকে বললো -"দেন আপনার ফোঁড়াটা কেটে পুজ বের করে দেই, আরাম পাবেন"। দুইদিন ধরে ফোঁড়ার যন্ত্রণায় কাহিল বেচারা চিন্তা করলো খারাপ কী!! যদি একটু আরাম হয়। অনুমুতি পেয়ে নাপিত তার ক্ষুর চালিয়ে নিখুঁতভাবে ফোঁড়া কেটে দিল। কাস্টোমারের ব্যাথা কমে গেল। ঘটনা সেখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু এই কাস্টোমার জনে জনে বলে রাষ্ট্র করে দিল যে, এই নাপিতের হাতে গুণ আছে। ফোঁড়া কাটতে পারে নিখুঁতভাবে। তারপর একজন দুইজন করে নাপিতের দোকানে ফোঁড়া নিয়ে ব্যাথায় কোঁকানো রোগীর ভিড় বাড়তে লাগলো। নাপিতও সিস্টেম বুঝে চুল দাড়ি কাটা কমিয়ে দিয়ে ফোঁড়া কাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কামাই রুজি বেড়ে গেল। দিনে দিনে নাপিতের হাতযশ বাড়তে লাগলো। আগের চেয়ে দ্রুত, আগের চেয়ে কম ব্যাথায় ফোঁড়া কেটে দিয়ে ছাই পট্টি বেঁধে দিতে পারে। রোগীও সুস্থ হয় তাড়াতাড়ি। ঢলের মতো রোগীর লাইন লেগে গেল নাপিতের দোকানে। যা হয় আরকী সাধারণত। একজনের নাম ডাক ছড়ালে তার কাছেই সবাই লাইন দেয়। ভালোই চলছিল। কিন্তু চিন্তায় পড়ে গেল এলাকার ডাক্তার সমাজ। তাদের এন্টিবায়োটিক, ডায়গনোস্টিক, সার্জারী ব্যাবসার লাল্বাত্তি জ্বলার অবস্থা। তারা ভেবে পেলনা এইভাবে সব রোগী যদি নাপিতের কাছে গিয়ে ধর্ণা দেয়, তাদের আয় রোজগারের ব্যবস্থা কী? তো তারা একটা ফন্দি করলো। তারা নাপিতকে ডেকে বলল- " তুমি তো শল্যবিদ্যা না জেনেই ফোঁড়া কাটাকাটি করছো হে বাপু, তার চেয়ে আসো তোমাকে শল্যবিদ্যা, স্নায়ুবিদ্যা, জীবাণুমুক্তকরণ ইত্যাদি জ্ঞান শিখিয়ে দেই। আরো ভালোভাবে ফোঁড়া কেটে বেড়াও"।
নাপিত খুশি মনে রাজী হল। শিখলো সব কিছু। তারপর নিজের দোকানে গিয়ে কানে ফোঁড়া নিয়ে আসা এক কিশোর ছেলের ফোঁড়া কাটতে গিয়ে সে ভাবলো কান খুবই স্পর্শকাতর অংগ, অনেক স্নায়ু কানের পাশে থাকে। কাটাকাটি বিশাল রিস্কের ব্যাপার হয়ে যায়। তার উপর কাটার পর সেপ্টিক হয়ে ইনফেকশানের ভয় আছে। নাপিত ফিরিয়ে দিল ছেলেকে। এভাবে একে একে পীঠে ফোড়া, কপালে ফোড়া, বগলে ফোড়া সব রোগীকেই নাপিতের ফিরিয়ে দিতে হল। ফোড়া কাটতে গেলেই নানান সাবধানতা, সতর্কতায় তার হাত কাপতে লাগলো, ক্ষুর কাপতে লাগলো। একসময় নাপিত ফোঁড়া কাটার ব্যবসা ছেড়ে দিল।
এই গল্প থেকে আমরা কী শিখলাম ? যে যা সাবলীল ভাবে করতে পারে, তাকে সেটার ব্যাপারে বেশি গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান দিয়ে দিলে, সে তার সাবলীলতা হারায়।
প্রথম গল্প শেষ। একটা ব্রেক নিয়ে আসেন দ্বিতীয় গল্পে যাই।

এক বাসায় ছিল এক লোক ( এক দেশে এক রাজা ছিল স্টাইলে শুরু আরকী !!)
তো সেই লোকের কাজ ছিল মাথা ভাড়া দেয়া, মানে পয়সার বিনিময়ে অন্যকে বুদ্ধি বিক্রী করতো সে। নানান রকম বুদ্ধি বেচতে হয়। কখনো ভালো বুদ্ধি, কখনো দুষ্টবুদ্ধি, কোন সময় বড় বুদ্ধি, কোন সময় চিপা বুদ্ধি। যার যা লাগে আরকী। তো এইভাবে মাথা খাটিয়ে বুদ্ধি বেচতে বেচতে হাঁপিয়ে গেল লোকটা একসময়। ভাবলো সব বুদ্ধি অন্যের জন্য বিক্রি করে মজা নাই। কিছু বুদ্ধি না বিক্রী করে মজা করলে কেমন হয় ? আগ পীছ না ভেবে লোকটা একসময় শুরু করলো নিজের আনন্দে মাথা খাটানো। কাউকে দুইটা ভালো কথা বলে। কাউকে বলে এক লাইন জ্ঞানের কথা। আর কাউকে হয়তবা বলে এক চুটকি রসিকতা। তো এই ভাবে চলতে চলতে তার অন্য কথার মাঝ থেকে রসিকতাটা লেগে গেল। লোকে তাকে রসিক লোক হিসেবে চেনা শুরু করলো। তার রসিকতা শোনার জন্য লোকের ভীড় বেড়ে গেল। লোকটাও প্রথম প্রথম মজা পেল। আরে !! খারাপ কী ? দার্শনিক টাইপ কথা বললে লোকে শুনে না। সুবচন বললে লোকে আড়ালে টিটকারী করে। তারচে রসিকতার কদর বেশি। চলুক রসিকতা। ভালই চলছিল। পরিচিত গন্ডিতে রসিকতা বলে লোকটাও মজা পাচ্ছিল। কিছুদিন পর, একটু দূর দূর থেকে লোকজন আসা শুরু করলো রসিকতা শুনতে। চেনা নেই জানা নেই লোকেরা এসে বলে "ভাই, দুইটা হাসির কথা শোনান তো। মনটা ভালো করে চলে যাই।" লোকটা একটু ফাপড়ে পড়ে গেল। এত রসিকতার সাপ্লাই দেয়া তো মুখের কথা না। তাও সে টেনে টুনে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। খুজে খুজে রসিকতার বিষয় বের করতে তার হিমসিম অবস্থা। লোকের ভীড় আরো বাড়তে শুরু করলো। রসিকতা শোনার জন্য তার বাড়ির বাইরে লোকজন অপেক্ষা করতে লাগলো। লোকটা খুশি মনে খাটাখাটনি বাড়িয়ে দিল।
একদিন তাকে ডেকে বসলো এক প্রকাশক রসিকতা ছাপিয়ে যিনি বেশ ফুলে ফেপে গেছেন !!!! বলল,
ভালোই তো রসিক আপনি। কি সুন্দর সব কিছু নিয়ে মশকরা করে ফেলেন। দারুন ক্ষমতা আপনার। লিখে ফেলেন তো দুই চারপাতা মশকরা, ছাপিয়ে দেই। লোকে পড়ুক। হাসুক।
তো লোকটা এই কথা শুনে প্রথমে বেশ খুশি হয়ে গেল। বাহ, খারাপ না তো। কড়া কথা হালকা ভাবে বলে বলে এতদিন মজা করতে করতে এই জায়গায় চলে আসাটা তো ভালোই মনে হয়। বিখ্যাত রসিক লোকজনও তার রসিকতার কদর করতে চাচ্ছে। এতদিন আশে পাশের মানুষকে রসিকতা শোনানো হল, এবার না হয় আরো দুরদুরান্তের লোকে শুনুক।
ঝামেলা লেগে গেল এর পর। এতদিন লোকটা রসিকতা করতো তার আশেপাশে। যা মনে চায়, তাই নিয়ে একটা মশকরা করে ফেলতো। কিন্তু এখন কী নিয়ে মশকরা করবে সে?
দেশের অবস্থা নিয়ে করা যায়। দেশের অবস্থা এমনিতেও বেশি যুতের না। মশকরা করার একশ একটা জিনিস চোখের সামনে নেচে বেড়ায় প্রতিদিন। কিন্তু কথা হল এই মশকরা করে খুব একটা মজা নেই। কারন দেশটাই একটা মশকরা হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। লোকে দেশ নিয়ে মশকরা করলে সত্যবচন ভেবে বসে।
রাজা-মন্ত্রী এদের নিয়ে করা যায়। এরাও বেশ ফানি। এদের কাজ কর্মে ব্যাপক কৌতুক খুজে পাওয়া যায়। কিন্তু এতে রিস্ক আছে বেশ। হোমড়া চোমড়া কাউকে নিয়ে ফান করার পর সে যদি মাইন্ড করে বসে, ৫৭ ধারায় ভরে দেবে লাল দালানে। বলা যায় না, শুলে চড়ানোর আইন বদলালেও , শুল তো বদলায়নি। একেবারে শুল ভরে দিতে পারে জায়গা মতো। ডিম তো অহরহ ভরছে শোনা যায় একে ওকে। না থাক বাপু। রাজা -উজির ঘেটে লাভ নাই।
সমাজ নিয়ে করা যায়। কিন্তু সমস্যা হল সমাজ বড় অদ্ভুদ। সব ভালো ভালো কথা সবাই জানে। মানে না কেউ। সমাজের সবাই ভাবে সবাই ঠিক পথে আছে। যে ডাইনে আছে সে ভাবে সে ঠিক লাইনে আছে, যে বামে আছে সেও ভাবে সে লাইনে আছে। ছেলেদের লুলামী নিয়ে করলে ছেলেরা ক্ষেপে যায়। মেয়েদের সেলফি ছ্যাবলামী নিয়ে করলে মেয়েরা তো ক্ষেপেই, সঙ্গে ফেউ এর মতন কিছু ছেলেও ক্ষেপে যায়। হিজাব নিয়ে রসিকতা করলে লোকে ভাবে বিকিনি বিক্রি করা হচ্ছে। ন্যুডিটি নিয়ে রসিকতা করলে সিরিয়াস হয়ে কেউ কেউ ঘোষনা দিয়ে দিচ্ছে আই এস এর চর বলে। টেনশান অনেক। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে গেলে লোকে চোখ লাল করে বলে " তুই ব্যাটা এত জ্ঞান দেবার কে ? নিজের চরকায় তেল দে !!!" থাক সমাজ বাদ।
ধর্ম ? ধর্ম নিয়ে মশকরা ?? বিশাল রিস্কের ব্যাপার তো। এটা নিয়ে মুখ খুললে পরে তেলেস্মাতি হয়ে যাবে। পৈত্রিক সম্পদ কল্লাটাই থাকবে না। নাস্তিক বলে ধরে জবাই করে দিবে। বলা যায় না, কাওরান বাজারে নিয়ে খাশির মাংশ বলে বলে মাংশ, মগজ, গিলা কলিজাও বেচে দিতে পারে। বড় হুশিয়ার। আল্লাহ , খোদা, দেব দেবী, বুদ্ধ, জেসাস, সাইন্স, ডারউইন, স্টিফেন হকিং, সবার ফলোয়ার লাখে লাখে। কাকে লাঈড়তে কে লঈড়ে যায় পরে বেড়ার আগুন লেজে লেগে যাবে। থাক বাবা। ধর্ম না লাড়াই।
পরিবার ?? খারাপ না ইশুটা। বউ, শশুর, শালী, সম্বুন্ধী এদের নিয়ে করা যায় মশকরা। জমেও ভালো। তবে কীনা, লোকটার বউ আবার একটু মারকুটে। তাকে নিয়ে মজা করার পরে আসল মজা টের পাইয়ে দিতে পারে। বলা যায় না ঘুমের ভেতর বালিশ চাপা দিয়ে খুন টুন করে ফেলাও অসম্ভব না। শশুরবাড়ি নিয়ে রসিকতা করতে হয় শশুরবাড়িতে খাবার টেবিলে বসে। সেটা সেইফ। কেউ মাইন্ড করে না। বউকে নিয়ে হাসি মজাক করতে হয় অবশ্যই বউ এর বন্ধু বান্ধবীদের কাছে। তাতে বউ মুচকী হেসে প্রশ্রয় দেয়। ভিন্ন ভাবে ভালোবাসা প্রকাশ পায়। অচেনা কাউকে বউ নিয়ে রসিকতা শোনানোর পরিণাম বড় করুন। ভিন্ন ফোরামে রসিকতার পরিনাম সাদ্দাম হোসেনের মত হয়। বাইরে থেকে এক্কেরে হুতায়াল্বাম টাইপ শক্তি এসে ডেমোক্রেসী শিখায়ে দেবে।
অফিস নিয়ে করা যেত। কিন্তু অফিসের জোক বাইরে ভালো বাজার পায় না। সবার অফিসেই আলাদা আলাদভাবে মশকরা করার মত বিষয় বা ব্যক্তি থাকেই। কিছু বললেই দেখা গেল কমন পড়ে যায়। লোকে হাসে না। মুখ চেপে শক্ত করে ফেলে। যেই জোক সবাই জানে, সেটা করতে যাবার মত গাধামীর কোনো মানে হয় না। এটাও বাদ।

প্রকাশকের উতসাহ পাবার পর, লোকটা রসিকতার বিষয় বাছতে বাছতে নিজের জীবন কষা করে ফেলল। চিন্তিত মুখ নিয়ে ঘুরাফিরা করে, বিড়বিড় করে কি যেন বলে, আবার মাথা নেড়ে নিজেই নিজের চিন্তা বাতিল করে দেয়। আশে পাশের মানুষকেও আর হুট হাট হাসির কিছু বলে না। ভুরু কুচকে বসে সিগারেট টেনে টেনে পকেট খালি করে ফেলতে শুরু করলো।
কিন্তু...
লোকটার তো বুদ্ধি ছিল, সে তো আর নাপিত না। তাই সে একদিন ভোররাতে আইডিয়া খুজে পেল। পটাপট ল্যাপ্টপে। টাইপ করা শুরু করলো। তারপর লেখা শেষ করে আরাম করে ঘুমাতে গেল। যাক শালা। ঘাড়ের থেকে টেনশন নামানো গেছে। কাল থেকে আরামে অফিস শুরু করা যাবে।

তারপর, এই লেখাটা প্রকাশককে মেইল করে দিল !!!!

... মেইলের সাবজেক্টে লিখে দিল-
"যে নাপতালি করে আরাম পায়, তাকে নাপতালিটাই করতে দেন আরাম করে"।

No comments:

Post a Comment