Sunday, July 8, 2018

ধর্মপ্রাণ বাঙালি ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-আচার ­সংস্কার-কুসংস্কারের­ পার্থক্য বুঝে না

ধর্মপ্রাণ বাঙালি ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-আচার ­সংস্কার-কুসংস্কারের­ পার্থক্য বুঝে না। বুঝো ধর্ম আর ধর্মের বিরোধী। এরা সবকিছুকেই ধর্মের অন্তর্ভুক্ত করে তালগোল পাকিয়ে ফেলে। এরা নবান্ন থেকে পহেলা বৈশাখ সবকিছুকেই ধর্মীয় আচার অনুষ্টান মনে করে। তাই ধর্ম ও সংস্কৃতি আজ মুখোমুখি অবস্থানে। এটি কোন নতুন বিষয় নয় সংস্কৃতির ভিন্নতা থাকলে জাতি নির্মানে সংকট সৃষ্টি হয়। তাও যদি হয় সেই সংস্কৃতি ধর্মের ভিত্তিতে। আমরা বাঙালিরা সেই সংকট পেরিয়ে এসেছি অনেক পূর্বে। কিন্তু বর্তমান কালে ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে সেই সংকটটি প্রকট আকার ধারণ করে আছে তা হচ্ছে ধর্মের মুখুশে ধর্মান্ধতা। যুগ যুগ ধরে ধর্ম নিয়ে যে অতিরঞ্জিত বারাবারি, ধর্মের কুসংস্কার ও ধর্মীয় আধিপত্যবাদের যে প্রভাব আমাদের জনজীবনকে আক্রান্ত করেছে সেগুলো থেকে মুক্তির একমাত্র পথই হচ্ছে সংস্কৃতির বিকাশ ও চর্চা। কারণ সংস্কৃতি নিয়ে এই পর্যন্ত যারাই লেখালেখিতে মেতেছিলেন মোতাহের হোসেন চৌধুরী, আবু জাফর শামসুদ্দীন, আহম্মদ শরীফ, আবুল কাশেম ফজললু হক, যতিন সরকার, বদরুদ্দীন উমর সহ সকলেই শিকার কারেছেন যে-ধার্মিকের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে শাস্তির ভয় আর পুস্কারের লোভ।
সংস্কৃতি ও ধর্মের মধ্যে সম্পর্কের আলোচনার প্রথম দিকে আমাদের এই উপমহাদেশের বিগত কয়েক শতক ধরে যে সংস্কৃতি পূর্ণাঙ্গ চর্চা হয়ে এসেছে সেই সংস্কৃতির সাথে আপোষ ও বিরুদ্ধতার একটি নমুনা উপস্থাপন করলাম।যেহেতু বাংলাদেশে মুসলমান জনগোষ্ঠীই সংখ্যাগরিষ্ঠ, কিন্তু যে ইসলাম ধর্মের বিধিবিধান তারা মেনে চলেন, তার স্বরূপটি বুঝে নিতে হলে আমাদের প্রয়োজন হয়ে পড়ে ইসলামের ইতিহাস নিয়ে কথা বলার। ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রসঙ্গে বিনয়কুমার সরকার বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় "বেঙ্গলি কালচার অ্যাজ এ সিস্টেম অব মিউচু্যয়াল আককুলটুরেশনস" আর্টিকেল লিখেন। ১৯৪২ সালে এই লেখাটির বাংলা অনুবাদ করেন ক্ষিতি মুখোপাধ্যায়। শুধু অনুবাদই নয়, রচনাটির অনুপঙ্খু বিশ্লেষণও হাজির করেন তিনি। এই লেখা ও এর বিশ্লেষণের মূল কথটি হলো সংস্কৃতির বিনিময় আককুলটুরেশনস কথাটির মানে পারস্পরিক সংস্কৃতি-বিনিময়।

তাঁরা দেখালেন, আদি বাঙালির সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য সংস্কৃতির বিনিময়ের ফলে নতুন সংস্কৃতির ধরন কীভাবে পাল্টে গেলো। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে দিকটার প্রতি তাঁরা দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন, সেটি হলো বাংলায় বিভিন্ন ধর্মের প্রবেশ এবং এর প্রভাবে বাঙালি সংস্কৃতির রূপান্তর, একইভাবে বাঙালি সংস্কৃতির প্রভাবে বাইরে থেকে আসা ধর্মগুলোর রূপান্তর। তাঁদের মতে- শুধু ইসলামই নয়, হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মও বাংলা অঞ্চলের বিদেশী ধর্ম। এইসব ধর্মের আগমনের আগেও এ অঞ্চলের মানুষের নিজস্ব কোনো ধর্ম ছিলো- তারা এর নাম দিয়েছেন বাঙালি ধর্ম। তাঁরা এ-ও বললেন- ইসলাম আসার আগে এ অঞ্চলের সমস্ত মানুষ হিন্দু বা বৌদ্ধ ছিলো- ঐতিহাসিক এই ধারণাটিই ভুল। বরং এক বিরাট সংখ্যক জনগোষ্ঠি অ-হিন্দু বা অ-বৌদ্ধ রয়ে গিয়েছিলো, বা কেউ কেউ সেসব ধর্ম গ্রহণ করলেও তা এমনভাবে তাঁদের আদি সংস্কৃরি ছাঁচে ঢেলে পরিবর্তিত করে নিয়েছিলো যে তাদেরকে বড়জোর নিম-হিন্দু বা নিম-বৌদ্ধ বলা যায়। ইসলাম আগমনের ফলে এই অঞ্চলের অ-হিন্দু বা অ-বৌদ্ধ এক বিরাট সংখ্যক লোক, সঙ্গে কিছু হিন্দু এবং কিছু বৌদ্ধও নতুন ধর্ম গ্রহণ
করে। কিন্তু নিজস্ব সংস্কৃতিকে বিসর্জন দেয়া এ ক্ষেত্রেও ঘটেনি। ফলে প্রত্যেক ধর্মই বাঙালি ধর্মের দাপটে নিজেদের আদি রূপ খুইয়ে নতুন এক রূপ লাভ করে।

কিন্তু  বাঙালী হিন্দু ও বাঙালী মুসলমানদের আচার-ব্যবহার ও চালচলনে মিল আছে। কারণ কি? সাধারণের ধারণা- হিন্দুদের কেউ কেউ মুসলমান হয়ে যাওয়ায় এইরূপ ঘটেছে। কথাটার ভিতর কিছু সত্য আছে। কিন্তু আসল কারণ- হিন্দু ধর্মের মতো মুসলমান ধর্মেও অনার্য বাঙালী আদিম লোকদের আচার-ব্যবহার আর চালচলন ঢুকে গিয়েছে। হিন্দু ও মুসলমান দুই ধর্মেই 'বাঙ্লামি'র প্রলেপ পড়েছে। হিন্দু ও মুসলমান ধর্মের উপর খাঁটি স্বদেশী সংস্কৃতি দিগবিজয় চালাচ্ছে। এই কথাটা মনে রাখলে বাঙালী হিন্দু এবং মুসলমানদের রীতিনীতির ভিতর ঐক্য ও সাদৃশ্যগুলো সহজে বুঝতে পারব। দুই সংস্কৃতিই 'বাঙালীকরণের' প্রভাবে অনেকটা একরূপ দেখিয়ে থাকে।

এতো গেল সদৃশ্যবার্তা। তার উল্টোপিঠে আরেকদল প্রতিক্রিয়াশীলরা ভাবেন বাঙালি সংস্কৃতি মানেই হিন্দুদের সংস্কৃতি।তাই এইসব ইতিহাস ঐতিহ্যের সংস্কৃতির বিরোধিতা করে আমদানিকারকের দ্বায়িত্ব নেয়। এর আগমন স্বাভাবিক হলে স্বাভাবিকই থাকতো, কিন্তু বিপর্যয় হচ্ছে যখন ধর্মের জোলাপে সংস্কৃতির আগমন ঘটছে। আর এইখানেই ইতিহাস আমাদেরকে আরও একটি ভয়াবহ সত্যের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়।  গাছ কেটে আগাছার চাষ হচ্ছে। ধর্মেরও ধর্মীয় সংস্কৃতি রয়েছে কিন্তু এই ধর্মীয় সংস্কৃতি আমাদের হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির সাথে মিল খাবে না। বাঙালি সংস্কৃতি আমাদের জাতিগত সংস্কৃতি কিন্তু ধর্মীয় সংস্কৃতি ভিন দেশী।ধর্মকে সংস্কৃতির সাথে এক করে চিন্তা করাটা এক ধরনের বোকামি। ধর্মের একটা আর্ন্তজাতিকতাবাদ রয়েছে কিন্তু সংস্কৃতির রয়েছে জাতিয়তাবাদ।

No comments:

Post a Comment