অনুভূতিতে আঘাত পাওয়া হাল আমলের ধর্মীয় ফ্যাশন হয়ে দাড়িয়েছে। আর এ ফ্যাশনের ডিজাইনার মুসলমান ধর্মের অনুসারী উগ্রবাদী গোষ্টীসমূহ। অন্য ধর্মের দাদারাও কম যান না। ধর্মীয় অনুভূতি জিনিসটি আসলে কি বস্তু? ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগলে আসলে কি হয়? ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগলে কি তার ধর্ম চুরমার হয়ে যায়? সে আর ধর্মের পথে, সৎ পথে চলতে পারেনা? নাকি তার দৃষ্টি শক্তি, শ্রবন শক্তি চলে যায়, মাথা ঘুরতে থাকে, দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। আমাদের দেশে হাতে গুনে গুনে হলেও বেশ কিছু মানুষের লেখা বিপুল সংখ্যক মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে। কেমন আছে তারা? ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগবার পর তাদের মধ্যে কতজন পক্ষাঘাত গ্রস্ত হয়ে পড়েছিল, অঙ্গহানী হয়েছিল ঠিক কতজনের, কতজনকে নিদেন পক্ষে সাইকিয়াট্রিকের চেম্বারে গিয়ে কড়ি খসিয়ে সুস্থ জীবনে ফিরতে হয়েছে? কতজন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গিয়েছে?
যদি সংবাদ মাধ্যম গুলো টাকা খেয়ে সত্য চেপে না যেত তবে খবরে আসতো, নিশ্চয়ই আসতো আজ নিশিপুর গ্রামের আজমত আলী ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত পেয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। খবরে প্রকাশ থাকে মাঠে খড়ের আাঁটি বাঁধার সময় আচমকাই এই আঘাত আসে এবং সেখানেই তিনি পড়ে গিয়ে গোঙাতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর তার মুখে ফ্যাঁপড়া উঠতে শুরু করলে গ্রামবাসী তাকে নিকটস্থ ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিংবা ধরুন তুফান শেখের কথা, বাজারে চা খেতে খেতে একটা পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছিলেন সেই সময় তার চোখে পড়ে নাস্তিকদের একটা লেখা। লেখার কয়েকলাইন পড়া মাত্র তাঁর ধর্মীয় অনুভূতিতে এত প্রচ- আঘাত লাগে যে তিনি চিৎকার দিয়ে মাটিতে পড়ে যান। কাটা মুরগির মত তিনি ছটফট করতে থাকেন, তখন পার্শ্ববর্তী সহৃদয়রা তাঁকে নিকটস্থ ডিসপেন্সারীতে নিয়ে যায়। অথবা মরিয়ম বেগম, যিনি টিভিতে অনন্তকাল ধরে চলতে থাকা কোন মেগা সিরিয়াল দেখছিলেন হঠাৎ করেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত পেয়ে তার হাত থেকে টিভি রিমোট পড়ে যায়। চোখ কপালে তুলে তিনি সোফার উপরেই এলিয়ে পড়েন আর তার মুখ দিয়ে ফেনা কাটতে থাকে। বাড়ীর মেয়েরা কলসি কলসি পানি মাথায় ঢেলেও জ্ঞান ফেরাতে পারেননা। ক্রিকেট খেলছিল স্বপন, সেঞ্চুরী করবার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল সে আচমকা হাত থেকে ব্যাটটা খসে পড়ে, হাঁটু ভেঙ্গে সে পড়ে যায় পিচের ওপর। সবাই ভাবে বল লেগেছে কোথাও কিন্তু না তার কচি তরুণ মনের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতেই সে জখম হয়ে পড়ে যায়। তার আর সেঞ্চুরী করা হলোনা। এখন এই আজমত আলী, তুফান শেখ, মরিয়ম বেগম আর স্বপনের পরিবারের উপর নেমে এলো শোকের কালো ছায়া। আজমত আলী খেটে খাওয়া মানুষ ধর্মীয় অনুভ’তিতে আঘাতের ফলে সে পঙ্গু হয়ে পড়ায় আর খাটতে পারেনা। আজমত আলীর পরিবারকে রীতিমত ভিক্ষা করে দানাপানি জোটাতে হয়। অবস্থা একই তুফান শেখের বাড়িতেও, তার ব্যবসা বানিজ্য দেখভালের অভাবেই লাটে উঠেছে, অসুস্থ তুফানকে চিকিৎসার খরচ দেবারও কেউ নেই। মরিয়ম বেগম পক্ষাঘাতে স্থবির হয়ে গেছেন আর বসে টিভি দেখতে পারেননা। সাত ছেলে মা মা করে বিস্তর কান্না কাটি করেছে, ছোট ছেলেটা মাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যেতে চায় কিন্তু অন্য ভাইরা মনে করে এ অবস্থায় মায়ের জার্নির ধকল সইবেনা। আর স্বপন, সে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। স্বপন বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনর্গল অশ্রু বিসর্জন করে সে আর কখনওই মাঠে নামতে পারবেনা। জাতীয় ক্রিকেট দলে খেলার স্বপ্নটা স্বপ্ন মাত্রই থেকে গেল স্বপনের। এ খবর গুলো আসেনি আমাদের টিভিতে বা খবরের কাগজে কিন্তু কাল্পনিক বলে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন। ধর্মীয় আঘাতের পরিনাম ঠিক এই রকম বা আরো ভয়াবহ না হলে কি কেউ কুপিয়ে মানুষ মারতে যায়।
সবাই বলেন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া উচিত নয়, বলেন ধর্ম নিয়ে হাসি ঠাট্টার পরিনাম ভালো হয়না। বলেন ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিলে সহ্য করা হবেনা। কিন্তু ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতে আহত মানুষ গুলোর ভয়াবহ যন্ত্রনার ছবি নিয়ে সামনে এগিয়ে আসেননা, চেপে যান। কেন এই চেপে যাওয়া? তবে কি এই আঘাত টাঘাত বানোয়াট কথা? অন্তত দৈহিক ভাবে এই আঘাত কেউ অনুভব করেছেন এরকম দৃষ্টান্ত এখনও পাওয়া যায়নি। তবে কি এই আঘাতটা মানসিক একটা আঘাত? মানসিক আঘাত হলে তার গভীরতা কতখানি? এ আঘাতে কি স্মৃতি শক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অথবা আহত ব্যক্তি কি মানসিক প্রতিবন্ধীতে রূপান্তরিত হয়ে যায়?
যারা বিশ্বাস করেন তাদের ধর্মই একমাত্র সত্য ধর্ম তাদের ভয় পাবার কি আছে। যত সমালোচনাই করা হোক সত্য হলে ধর্মের তাতেতো বিন্দু মাত্র ক্ষতি হবার কথা নয়। একমাত্র একটা মিথ্যাকেই পাহারা দিয়ে রাখতে হয়।কিন্তু নিজের কাছেই যদি নিজের বিশ্বাসকে খেলো মনে হয়, নিজের ধর্মের উপর বিশ্বাস করতে নিজেরই মনের জোর আসেনা বা এরকম মনে হয় যে যাতে বিশ্বাস করা হচ্ছে তা একটা কোমল, বায়বীয়, স্পর্শকাতর ধোঁয়াটে একটা বস্তু যা একটুখানি প্রশ্ন বা যুক্তির ফু-য়ের বাতাসেই তছনছ হয়ে যাবে একমাত্র সেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত পেলে আঘাতকারীকে নিশ্চুপ করিয়ে দিতে চাইবে কারন এছাড়া তার ধর্মকে, মিথ্যা বিশ্বাসকে সে কিছুতেই টিকিয়ে রাখতে পারবেনা।
No comments:
Post a Comment