জন্মসূত্রে আপনি হয়তো এক হিন্দু নারী, ছোটবেলা থেকে রামায়ণ মহাভারতের গল্প শুনে এসেছেন। রাম-লক্ষ্মণ সীতা থেকে যুধিষ্ঠির-দুযোধন দুঃশলাদের কথা জানেন। আপনি হয়তো এক গরীব পরিবারের মেয়ে, স্কুলে এইট-নাইন অব্দি পড়ার পর আর পড়া হয়নি , তারপর কোনরকমে এক নিম্ন মধ্যবিত্ত যুবকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। কিংবা মোটামুটি স্বচ্ছল এক পরিবারে আপনার জন্ম গ্রাজুয়েট হয়েছেন ; একটি ছোট স্কুলে চাকরিও করছিলেন, এমন সময় বিয়ের সম্বন্ধ আসায় বা নিজে দেখেশুনেই, একজনকে বিয়ে করলেন - চাকরিটা হয়তো ছাড়তে হ’ল – বা কোনরকমে চাকরিটা করেও গেলেন। অথবা আপনি একজন উচ্চশিক্ষিতা - হয়তো বা ডাক্তার, কিংবা ইঞ্জিনিয়ার, কিংবা অধ্যাপিকা ; নিজে ভালবেসে বা বাড়ীর যোগাযোগে একজনকে বিয়ে করেছেন। কিংবা হয়তো অন্যধরনের কিছু, কিন্তু সদ্য বিবাহিতা ।
বিয়ের কিছুদিন পরে দূরে কোথাও বেড়াতে গেছেন - হয়তো বা শৈলশহর, কিংবা সমুদ্রতট অথবা জঙ্গলে ঘেরা মনোরম জায়গা। দু’জন মিলে বেড়াচ্ছেন - এমন সময় কেউ একজন আপনার স্বামীকে বোকা বানিয়ে বা কপোকাৎ করে, আপনাকে ধরে নিয়ে পালিয়ে গেল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর আপনার স্বামী জানতে পারলেন, কোন এক অভিজাত ব্যক্তিই আপনাকে অপহরণ করেছেন। এবং সমানে আপনাকে বিয়ে করার চাপ দিয়ে যাচ্ছে। আর তার পরিচিত মেয়েদের বসিয়েছে আপনার পাহারায় যাতে আপনি পালাতে না পারেন।
কিন্তু একদিন পুলিশ আর বন্ধুবান্ধদের সাহায্য নিয়ে অনেক পরিশ্রম করে আপনার স্বামী আপনাকে ঐ বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করলেন। দীর্ঘদিন পরেস্বামীর সঙ্গে সাক্ষাতের পুলকে আপনি তখন তীব্র আনন্দ আর বেদনায় ভাসছেন। কিন্তু ঐ সময় ঐখানেই আপনার ঐ প্রিয়তম স্বামী আপনাকে বলেন ঐ বন্দিদশায় আপনি যে সতী ছিলেন অর্থাৎ যৌনমিলন করেন নি, তার প্রমাণ দিতে হবে, ডাক্তারি পরীক্ষা দিতে হবে - তাঁরা আপনার যোনি পরীক্ষা করবেন, প্রয়োজনে প্রস্রাব পরীক্ষা করে গর্ভবতী কিনা জানবেন ইত্যাদি। তখন আপনার কেমন লাগবে?
আপনি নিশ্চিত যে বন্দিদশায় আপনার সঙ্গে কারোর যৌনমিলন হয় নি। তবু আপনি রাজি হলেন এবং ডাক্তারেরা রায় দিলেন - না, আপনি ধর্ষিতা নন। একমাত্র তখনই আপনার স্বামী আপনাকে গ্রহণ করলেন।
এরপর সবাই মিলে বারি এলেন। বেশ সুখে ঘরসংসার করছেন। এর পর আপনার গর্ভে এলো আপনাদের সন্তান। কিন্তু ঐ সময় একদিন আপনার স্বামীর কানে এল - পাড়ার লোকেরা, আত্মীয়স্বজন আপনাকে সন্দেহ করছে। দীর্ঘদিন বন্দি অবস্থায় আপনার যৌনজীবন সম্পর্কে তারা সন্দিহান। কারন আগের ডাক্তারি পরীক্ষার কথা তারা জানেন না, বা জানলেও তাদের সামনে করা হয়নি বলে তারা সন্দিহান। মনে করা যাক আপনার স্বামী একজন জনপ্রতিনিধি, তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন জনসমক্ষে তার ইমেজ ঠিক রাখতে হবে। কিংবা একজন সাধারন মানুষ তাই চাই চারপাশের মানুষদের সন্তুষ্ট রাখতে চান। আপনার দেবরকে ডেকে বল্লেন, “যাও, বৌদিকে এ ঘর থেকে দূর করে অন্য কোথাও রেখে এস।” কিংবা বাপের বাড়ীতেই পাঠিয়ে দিতে বল্লেন। আর সঙ্গে সঙ্গে তিনি যে দুঃখ পেলেন, তা-ও আপনি জানেন। তবু এভাবে বিতাড়িত হবার পর আপনার কেমন লাগবে ? তা সত্ত্বেও, স্বামীর সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে আপনি দিন কাটাতে থাকলেন। সন্তান হল। ঘটনাচক্রে একদিন শ্বশুরবাড়ীর লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ হল । ছেলের খবর শুনে স্বামী আর থাকতে পারলেন না। সসম্মানে, ভালবাসায় আপনাদের ফিরিয়ে নিলেন। কিন্তু এতদিন তো আপনি ঘরছাড়া। তাই আপনার স্বামী (এবং হয়তো বা পাড়ার লোকজন বা বন্ধুবান্ধবদের চাপে) আবার চাইলেন আপনার চরিত্রের শুদ্ধতা যাচাই তথা ডাক্তারি পরীক্ষা ইত্যাদি। না, আপনার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। আপনি ক্ষোভে দুঃখে আত্মহত্যা করলেন।
আচ্ছা সত্যি করে বলুন তো এমন স্বামী কি আপনি চান ? দরিদ্র, মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত যে পরিবার থেকেই আপনি আসুন না কেন – ঠিক এমন, যেমন ব্যবহার তখনকার দিনে শ্রীরামচন্দ্র নিজের স্ত্রী সীতা-র প্রতি করেছিলেন, তেমন ব্যবহার কি আপনার কাম্য ? আপনি রামায়ণ পড়েছেন। তাই রামের এমন ব্যবহার আপনার জানা, আপনি যদি জানেন যে আপনার ভাবী স্বামী ঐ রামেরই মত ব্যবহার আপনার সঙ্গে করবেন, তবে কি আপনি ঐ ব্যক্তিকে বিয়ে করবেন ? সত্যি কথা বলুন।
লেখাটি ভবানী প্রসাদ সাহু’র রচনাবলী থেকে সংগ্রহিত সংক্ষিপ্ত রূপ।
No comments:
Post a Comment