Sunday, June 28, 2020

নেটফ্লিক্সের অশ্বডিম্ব

নেটফ্লিক্সে বুলবুল বলে এক সিনেমা নাকি আলোড়ন ফেলেছে। অনুরাগ কাশ্যপ বলেছেন এই শতকের সেরা সিনেমা। উনবিংশ শতকের বাঙালির গপ্পো বলে উৎসাহিত হয়ে দেখে ফেলা গেল। কিন্তু খুলে যা দেখা গেল, তা হল প্রচন্ড পলিটিকালি কারেক্ট একটি অশ্বডিম্ব। ইদানিং কালে বিন্দুমাত্র চিন্তাভাবনা পড়াশুনো বা সৃষ্টিশীলতার চূড়ান্ত অভাবকে ঢাকতে একটা চড়া দাগের যাহোক 'সঠিক' কথাকে হাঁইমাই করে তীব্র চিৎকার সহকারে জোর গলায় বলতে পারাকেই 'শিল্প' বলে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। এই উচ্চমার্গের 'প্রগতিশীলতা'র বেশ কিছু খদ্দেরও আছেন, ফলে চলছেও ভালই, ব্যবসাপাতিও নিশ্চয়ই ভালই হচ্ছে। সেই ঘরনার একটি নিখুঁত উদাহরণ হল এই সিনেমা।

সেই কারণেই কলম বাগিয়ে এটা লিখতে বসা। নইলে এই সিনেমার রিভিউ করা পন্ডশ্রম। ইতিহাস, ভূগোল সবকিছুকে গোল্লায় পাঠিয়েও কীকরে 'প্রগতিশীল' এবং হিট ছবি বানানো হয় এবং হয়েছে, সেইটুকুই এখানে দেখা হয়েছে। আর অন্য কিছু এই লেখার উদ্দেশ্য নয়।

তো, কাজের কথায় আসা যাক। সিনেমার পটভূমি ১৮৮১ সালের। গোড়াতেই জ্বলজ্বল করে লেখা আছে বলে জানা গেল। একদম গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত দেখা গেল কোনো এক অজ জঙ্গলের জমিদারবাড়ি। সেখানে উনবিংশ শতকের বাঙালি জমিদার কলার দেওয়া পাঞ্জাবি পরে ঘুরছেন। সেই ১৮৮১ সালে। রবীন্দ্রনাথের তখন সবে দাড়ি গজিয়েছে, বছর কুড়ি বয়স, বিদ্যেসাগর তখনও বেঁচে। সেই আমলে কলার দেওয়া পাঞ্জাবি? সেসব তখনও আবিষ্কার হয়নি, বঙ্গীয় পুংদের আটপৌরে পোশাক ছিল ঊর্ধ্বাঙ্গে উড়নি (বিদ্যাসাগরের বিখ্যাত পোট্রেটটি মনে করুন), আর জমকালো পোশাক বলতে ছিল চোগা-চাপকান (এবার বঙ্কিমচন্দ্রের বিখ্যাত পোট্রেটটি স্মরণ করুন), শহরে শার্ট-আর-ধুতিও চালু হয়ে গিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু কলার দেওয়া পাঞ্জাবি? ওরে বাবা। পরিচালক বা চিত্রনাট্যকার বা শিল্পনির্দেশক সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র খবর রাখার প্রয়োজন বোধ করেননি, বোঝা গেল। মেয়েদের পোশাকের খবরটা অন্তত রাখা উচিত ছিল, নারী নিয়েই যখন এত বক্তব্য। কিন্তু সিনেমায় গুষ্টিশুদ্ধ মেয়েদের দিব্যি দেখা গেল হয় ফুলফুল হাতা, কিংবা এমনি ছোটোহাতা ব্লাউজ পরে। যেন চারুলতার দৃশ্য। চারুলতা থেকে সিনেমাটি যে প্রচুর 'অনুপ্রাণিত', সে অবশ্য নায়িকার হাসি, চাউনি দেখেও বোঝা যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল চারুলতা নেহাৎই শহুরে ঘটনা, সত্যজিৎ বাবু সেসময়ের পোশাক নিয়ে বিস্তর রিসার্চ করেছিলেন, কিন্তু দুঃখের বিষয় ১৮৮০-১৮৯০-১৯০০ -- এই সময়কালের গাঁয়ের মেয়েদের পোশাক নিয়ে রিসার্চটা বুলবুলের হয়ে করে দেননি। খুব বেশি রিসার্চ করারও দরকার নেই, বাংলার ইতিহাস যাঁরা একটুও পড়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানেন, যে, বাংলায় শাড়ি পরা হত কোনো ব্লাউজ বা সায়া ছাড়া। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ওই দুইয়ের প্রচলন করেন, শেমিজ নামক একটি বস্তু আবিষ্কার করে। তিনি কলকাতায় ফেরেন ওই ১৮৮০ সাল নাগাদ, তারপর প্রাথমিক ভাবে স্রেফ ব্রাহ্মসমাজের মহিলাদের মধ্যে এর চল শুরু হয়। শহুরে আলোকপ্রাপ্ত মহিলারাও পরতে শুরু করেন। তারই ফল চারুলতার পোশাক। শুধু বাঙালি নারী ব্লাউজ পরেছে বললে পুরোটা বলা হবে না, বাঙালি বিধবা পর্যন্ত ব্লাউজ পরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সিনেমা জুড়ে! কিন্তু সুদূর গ্রামে ১৮৮০-৯০ সালে মহিলারা শাড়ি-ব্লাউজ পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, এ খুবই কষ্টকল্পনা। বস্তুত সেই সময়ের জমিদার মেয়েদের পোশাক নিয়ে আলাদা একটা রিসার্চেরই দরকার, সে এঁয়ারা করেননি, স্রেফ চারুলতা থেকে কপি মেরেছেন, সে বোঝাই যাচ্ছে।

এর চেয়েও প্রলয়ঙ্কর হল গানের ব্যবহার। সহনায়িকা এখানে গুণগুণ করে গায় রবিবাবুর গান। মোটামুটি ১৮৯৫ সাল নাগাদ। কী গান? সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে। যে গান লেখা হবে এর বছর তিরিশেক পরে। বাঙালি হলেই একটু রবীন্দ্রনাথের পাঞ্চ দিতেই হবে, বাঙালি রবীন্দ্রনাথের জন্মের আগে থেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়, এ তো জানা কথা। যেকোনো দিন পলাশীর যুদ্ধের দৃশ্যায়নেও সিরাজদৌল্লাকে 'ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে' গুণগুণ করতে দেখা যেতে পারে। বলিউডি ওয়েবসিরিজ/সিনেমার কারবার বলে কথা। এর আগে একটি সিরিজে দেখা গিয়েছিল বাঙালি নায়িকা সঙ্গমকালে 'শেষের কবিতা' থেকে আবৃত্তি করে। বলিউডি প্রযোজক-পরিচালকদের নির্ঘাত ধারণা ওতেই বাঙালির অর্গ্যাজম। একে বলিউডি জিকের পরাকাষ্ঠা বলা যেতে পারে। ওঁদের জিজ্ঞাসা করলে হয়তো এও বলবেন, যে, আশা ভোঁসলেকে উদ্দেশ্য করেই রবিবাবু 'বড় আশা করে' গানটি রচনা করেছিলেন।

তা, এ তো গেল বলিউডের রবীন্দ্রচর্চা। এছাড়াও আরেকটি দ্বিতীয় গান সিনেমায় ব্যবহৃত। সে হল 'কলঙ্কিনী রাধা'। এর উৎস নিশ্চিত করে জানা যায়না, রাধারমণ দত্তর লেখা হলে পুরোনো, কিন্তু শাহ আবদুল করিমের রচনা হলে অনেক পরে লেখা। সিনেমার সময়কালে ব্যবহার করা যায়না। কিন্তু ওসব নিয়ে কে আর কী ভাববে, একটা পপুলার গান পেয়েছি, লেঃ সালা ব্যবহার করে দি, এই তো অ্যাটিটিউড। তাও রক্ষে, কোনো চরিত্র 'বঙ্গাল কি মিট্টি বাঙ্গাল কি পানি' গেয়ে বসেনি। হ্যাঁ হিন্দিতে। কারণ এই সিনেমা দেখে নিশ্চিত ভাবে জানা গেল গ্রাম বাংলায় ১৮৮০-১৯০০ সালে সব্বাই হিন্দিতে কথা বলত তো বটেই এমনকি গপ্পো টপ্পোও লিখত দেবনাগরীতে। বড় বড় অক্ষরে এই সিনেমার অমল আর চারু দেবনাগরীতে গদ্য লিখেছে, পরিষ্কার ক্যামেরায় দেখা গেল। এরপর যেকোনো দিন জানা যাবে বঙ্কিমচন্দ্র আনন্দামাঠ লিখেছিলেন হিন্দিতে, আর জানাগাণামানার রচয়িতা দেবনাগরী ছাড়া অন্য কিছুতে লিখবেনই বা কীকরে? বাঙালি মানে হল, দু-ইঞ্চি রবীন্দ্রসঙ্গীত, শাড়ি-পাঞ্জাবি, রাসগুল্লা আর দুর্গাপুজা। ব্যস। বাকি সব ইতিহাস বলিউডের। ইতিপূর্বে আমরা সুভাষ বসুকে হরবখৎ হিন্দি বলতে দেখেছি, মাস্টারদা আর গণেশ ঘোষকে চট্টগ্রামে হিন্দিতে বাক্যালাপ করতে শুনেছি, ফলে এ আর নতুন কি। আসল কথা হল পলিটিকাল কারেক্টনেসের পরীক্ষা। সেই পরীক্ষায় এই ফিলিম ১০০ তে ২০০ পেয়েছে। অনুরাগ কাশ্যপ ঢেলে প্রশংসা করেছেন। বাঙালিও ঢেলে তালি মেরেছে। কে কবে পাঞ্জাবি পরেছে, রবিবাবু কবে জন্মেছেন, আর বাঙালি বাংলায় কথা বলে না হিন্দিতে, এই তুচ্ছ জিনিসে কার কী এসে যায়? বলিউডে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। এই হল নেটফ্লিক্সের কামাল। এই হল অনুষ্কা শর্মা প্রযোজনা। যেখানে একবর্ণও রিসার্চ না করে, স্রেফ ঝা চকচকে তিনটে দামী ক্যামেরা এনে শুট করে ফেললেই কম্মো খতম, বাকিটা পোস্ট প্রোডাকশন সামলে দেবে।
জয় বাবা বলিউড। জয় মা কারেক্টনেস।

Sunday, June 21, 2020

বাস্তবে সব প্রশ্নের উত্তর হয় না

যে কোনো সময়ে যে কোনো জায়গায় সময় পার করা মতিনের জন্য কোনো ব্যাপারই না।
যে কোন জায়গায় বসে চোখ খোলা রেখেই মতিন নিজের মনের মধ্যে ডুব মারে। মাঝে মাঝে মতিনের মনে হয় তার মনের মধ্যে একটা দিঘী আছে। ছোট মোটো না। বড় সাইজের দিঘী। হাজার হাজার লাখ লাখ ছোট বড় চিন্তা সেই দিঘীতে নানা সাইজের মাছের মত ঘুরে বেড়ায়। দিঘীর মাছেরা যেমন মাঝে মাঝে সারফেসের পানিতে ঘাঁই মারে, বা পানির সীমানার খুব কাছ দিয়ে সাতরিয়ে গিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়, তেমন করে মতিনের মনেও চিন্তারা এভাবে ঢেউ তোলে, তখন মতিন কাজের ভেতরেও টুপ করে মনের ভেতরে সেই দিঘীতে নেমে পড়ে। চিন্তার এই দিঘীর জল খুব স্বচ্ছ। মতিন ঘন্টার পর ঘন্টা হারিয়ে যেতে পারে চিন্তা নামের মাছেদের পিছে ডুব সাঁতার দিতে দিতে। কখনো তার দম আটকে আসেনা। চিন্তার এই দিঘীটা মতিনের বয়সের সাথে সাথে দিকে পাশে বাড়ছে, বাড়ছে এর ভেতরে নতুন নতুন চিন্তা। চেনা চিন্তা ছাড়াও নতুন অজানা অচেনা চিন্তা। মতিনের বাস্তব দৈনন্দিন জীবনের সাথে সমান্তরাল তার মনের ভেতর বয়ে নেয়া এই চিন্তার দিঘী।
বাস্তব খুব অস্থির, রুক্ষ, বৈষয়িক, ব্যস্ত। মতিন নিয়ম মেনে বাস্তবের সাথে তাল মেলায়, কিন্তু একা একা ভাবে, বাস্তব জীবনটা যেন ব্যস্ত চৌরাস্তার মাঝখানে পথ খুঁজে না পাওয়া পথচারী। যেন কোথায় যেতে হবে, তা ভাল ভাবে না জেনে এসে নেমে পড়া নতুন শহরে ঠিকানা হারিয়ে ফেলা। যেন কোন বাসে উঠতে হবে বুঝতে না পেরে বার বার পথ চেনা মানুষের সাথে ধাক্কা খেতে খেতে জেনে নেয়ার চেষ্টা। বাস্তব জীবন যেন আশংকা পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখতে থাকা ভীড় বাস এসে চলে যাওয়া, তাতে নতুন করে গুতাগুতি করে চড়ে বসা চালু শহরের মানুষের ভীড়ে নিজেকে খুঁজে না পাওয়া। তাই বাস্তবকে মতিনের খুব সাফোকেটিভ লাগে। বাস্তব জীবনের এই ঠাঁসাঠাঁসির ভেতরে তাই মতিনের সুযোগ পেলেই চিন্তা মাছের সাথে খেলা করাই অভ্যাস।
দিন দিন মতিনের মনে হয় তার বাস্তব জীবনের স্পেস কমে আসছে, আর তার চিন্তার দিঘী বড় হচ্ছে। বাস্তবের হিসাবের চিন্তায় বেশিক্ষন মনকে আটকাতে ভালো লাগেনা তার এখন। গুনে গুনে চিন্তা করার জীবনের চেয়ে অনেক স্বাধীনতা আছে দায়বোধবিহীন অবাধ চিন্তায়। কোনো হিসাবের ছাতামাথা নাই। ইচ্ছা হল, ভাবতে শুরু হল। আবার ছেদ পড়লে লেজ ভাঁজ করে সেই চিন্তা ডুব দেয় জলের তলায়।
ইদানিং মাঝে মাঝে মতিনের খুব অদ্ভুত একটা সমস্যা হচ্ছে। তার প্রতিদিন একটু একটু করে মনে হচ্ছে, তার কম্ফোর্ট জোন হচ্ছে মনের দিঘীটায়। রিয়েলিটি বলে প্রতিদিন তাকে যে জীবনটা পার করতে হচ্ছে, তার ভেতরেও সে দিঘীর জলেই গলা ডুবিয়ে বসে থাকে। দিঘীর পানি বাড়তে বাড়তে মনের গভীর থেকে এখন যেন তার বাস্তবতার চৌরাস্তায় উঠে আসতে চাইছে। মাঝে মাঝেই কাজের ভেতরেই কিভাবে কিভাবে যেন মতিন চিন্তার দিঘীতে নেমে যাচ্ছে। আচ্ছা এভাবে চলতে থাকলে একসময় কি পুরা বাস্তব জগতটাই একসময় চিন্তার গভীর দিঘীর জলে তলিয়ে যাবে? ব্যাপারটা এইভাবে ভাবলে কেমন হয় ? যে আমাদের বাস্তব জীবনটা ত্রিমাত্রিক বস্তুজীবন। আমাদের শরীর হচ্ছে আমাদের ত্রিমাত্রিক অস্তিত্ব। আর আমাদের মন বা চিন্তা হচ্ছে মাত্রাহীন জগত। মতিনের মাত্রাহীন চিন্তার জগত যেভাবে পরিধি বাড়িয়ে মাঝে মাঝেই মতিনের বস্তু জগতের ভেতরেও চলে আসছে, এভাবে একসময় মতিনের পুরো অস্তিত্ব কি মাত্রাহীন চিন্তা দিয়ে ডুবে যেতে পারে ? তখন তো তাহলে মতিনের ত্রিমাত্রিক দেহটা আর প্রয়োজন পড়ে না। মাত্রাহীন মন আর মাত্রাহীন চিন্তার জগতের সেই পূর্ণ অবস্থাটাই কি তাহলে মৃত্যু ? ত্রিমাত্রিক বস্তুজগতের অবসান, শরীরের বিদায় ?
ইন্টারেস্টিং তো ।
আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে মতিন বারান্দার গ্রীল ধরে জুত করে দাঁড়ায়ে খুব আয়েশে টান দিল। এই যে, মৃত্যুবিষয়ক খুব ভালো একটা চিন্তার সুতা পাওয়া গেল। এই জাতীয় চিন্তা নিয়ে মাথায় ঘোরাতে মতিনের ভাল লাগে। যদিও দ্বিতীয় কারো চোখ দিয়ে দেখলে বিষয়টা বোঝার কোনো কায়দাই নাই । দেখা যাবে শহরের ঘিঞ্জি ফ্ল্যাটবাড়িগুলার কোনো এক বারান্দায় নীল রং এর প্লাস্টিকের মগ হাতে দাঁড়ায়ে এক উস্কোখুস্কো চুলের লোক সিগারেট খাচ্ছে বাইরের দিকে তাকিয়ে।
মতিনের বারান্দার বাইরে ৩ তলা নীচে বাড়িটার ছাদে কাপড় নাড়তে আসা বুয়াটা যেমন মতিনকে দেখে ভাবছে, মতিন হয়ত তাকে লক্ষ করবে। ইচ্ছা করেই সে কাপড় শুকাতে দেয়ার পরও খালি বালতি হাতে আরো কিছুক্ষন ছাদে পায়চারী করে।
উল্টা পাশের দুরের সমান উচ্চতার বারান্দায় বসে থাকা বুড়ো লোকটা, চিন্তায় মগ্ন সিগারেট হাতে বারান্দায় দাড়ানো মতিন কে দেখে ভাবে, বউ এর সাথে ঝগড়া করা স্বামী। মনে মনে ভাবে,
এসব কত দেখলাম। দুইটা সিগারেট খাবে, তারপরে তো ঠিকই বেডরুমে ফিরা গিয়া বউ এর কাছে মাফ চাবে, ঝগড়া মিটমাট। সন্ধায় দুইজন সাইজা গুইজা একসাথে বের হইয়া ডিনার করে আসবে। সাচ ইজ লাইফ।
আর এসবের বাইরে, যেই বারান্দায় মগ হাতে দাড়ায়ে মতিন চিন্তায় হারিয়ে গেছে, সেই বারান্দার পেছনের দরজা দিয়ে ভেসে আসে, মতিনের স্ত্রীর গলা
- ২ টা টবে পানি দিতে গিয়া আধাঘন্টা খাড়ায়া থাকলা, নাস্তা খাবে কখন ?

মতিন বাস্তবে ফিরে আসে, তার চিন্তাটা টুপ করে ল্যাজ গুটায়ে জলের নীচে চলে যায়, চিন্তার জলে ভেজা মতিন বলে
- সরি, রাতে বৃষ্টি হইসে তো, পানি দেয়া লাগবেনা।
- এটা আবিষ্কার করতে তোমার পাক্কা আধঘন্টা লাগলো ?

মতিন উত্তর দেয়না।
আসলে বাস্তবতার মূল সমস্যাটাই মতিনের কাছে লাগে এইখানে।
বাস্তবে সব প্রশ্নের উত্তর হয় না।

Friday, June 5, 2020

স্বাস্থ্য একটি মাল - এবং মালের দায়িত্ব আরোহীর।

অনেক অনেএক বছর আগে শহরের রাস্তায় চকচকে রুপোলি টিনের বাস চলত। সিটের উপরে লেখা থাকত চমৎকার কিছু উপদেশ - সদুপদেশ। তেমনই এক উপদেশের কথা মনে পড়ে গেল - মালের দায়িত্ব আরোহীর।

এতদিনে নিশ্চয়ই এটা বুঝেছেন, যে, স্বাস্থ্য একটি ক্রয়যোগ্য সামগ্রী - কেননা, সরকার উত্তরোত্তর তেমন দিকেই এগোচ্ছেন, যেখানে অসুস্থতা থেকে সুস্থতা কিনে নিতে হবে - সরকারের দায় বলতে, গরীবের ক্ষেত্রে সেই খরচ সরকার বহন করবেন (কদিন করবেন, সেটা বলা মুশকিল)। অর্থাৎ, স্বাস্থ্য যে নাগরিকমাত্রেরই অধিকার, এমন আশ্চর্য কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলাই ভালো। বুঝে নিন, স্বাস্থ্য স্রেফ একটি পণ্য - খরচে পোষালে কিনবেন - না পোষালে...থাক সেসব কুকথা।

অতএব, স্বাস্থ্য একটি মাল - এবং জানেনই তো, মালের দায়িত্ব আরোহীর।

স্বাস্থ্যকর্মী-চিকিৎসক তাঁরাও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নন। সে যতোই বড় বড় লোকজন বলে থাকুন না কেন, যে, স্বাস্থ্যকর্মী-চিকিৎসক এনারা হলেন গিয়ে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার সবচেয়ে মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ, এবং এই সঙ্কটকালে তো বটেই, হুঁ হুঁ বাবা, আমাদের সরকার হলেন গিয়ে এক্কেবারে নো ননসেন্স।

সুপ্রীম কোর্ট যখন জিজ্ঞেস করেছেন, চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সরকার কী ভাবছেন বা কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন, দেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক পষ্টাপষ্টি লিখিত জানিয়েছেন -

"While the Hospital Infection Control Committee in the health facility is responsible for implementing the Infection Prevention and Control activities, but the final responsibility lies with healthcare workers. It is their responsibility to train themselves and take all measures in preventing the infection."

মোদ্দা কথা, চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদেরই দায় সংক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচানো - অর্থাৎ, নিজের দায়িত্ব নিজেরই।

এদিকে, কী গেরো দেখুন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছেন -

"Because occupational hazards arise at the workplace, it is the responsibility of employers to ensure that the working environment is safe and healthy. This means that they must prevent, and protect workers from, occupational risks. But employers’ responsibility goes further, entailing knowledge of occupational hazards and a commitment to ensure that management processes promote safety and health at work….Adequate arrangements should also be made for compensation of work-related injuries and diseases, as well as for rehabilitation and to facilitate a prompt return to work."

সরকারবাহাদুরকে যদি স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিচালক ও নিয়ামক মানতে হয়, তাহলে তো, অন্তত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার নিয়ম অনুসারে, স্বাস্থ্যকর্মী-চিকিৎসকদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে কিছু দায়িত্ব সরকারের থাকে। তাই না?

একই বক্তব্যে সরকার এও জানাচ্ছেন, যে, কোভিড পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যকর্মীদের সংক্রমণের ঝুঁকি আমজনতার চেয়ে বেশী নয়। এবং, প্রোটেক্টিভ পোষাক পরলে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের সংক্রমণের ঝুঁকি তেমন নেই - এবং তাঁদের থেকে তাঁদের পরিজন সংক্রামিত হতে পারেন, এমন সম্ভাবনা স্রেফ কষ্টকল্পনা।

অথচ, নার্সদের আন্তর্জাতিক কাউন্সিল গতমাসের শুরুতেই জানিয়েছিলেন, তাঁদের হিসেবে বিশ্ব জুড়ে অন্তত নব্বই হাজার স্বাস্থ্যকর্মী সংক্রামিত (আবারও বলি, এই হিসেব মে মাসের শুরুর) - এবং, তাঁদের নিজেদেরই কথায়, এই তথ্য অসম্পূর্ণ - কেননা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও জানিয়েছেন, সদস্য দেশগুলির অধিকাংশই চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে সংক্রমণের হার জানাচ্ছেন না।

অথচ, একজন সংক্রামিত সাধারণ নাগরিক এবং একজন সংক্রামিত স্বাস্থ্যকর্মী - দেশে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের পক্ষে দ্বিতীয়জন অনেক বেশী বিপদ। কেননা, প্রথমত, তিনি অনেক বেশী মানুষকে সংক্রামিত করতে পারেন এবং দ্বিতীয়ত, একসাথে অনেক চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী সংক্রামিত হয়ে ঘরবন্দি হয়ে পড়লে সমগ্র স্বাস্থ্যব্যবস্থাটিই ভেঙে পড়ার পরিস্থিতি।

একদিকে লকডাউন আচমকা তুলে দিয়ে সংক্রমণের আশঙ্কা বহুগুণ বাড়িয়ে ফেলা - সবরকম অফিস-কাছাড়িতে হাজিরা বাড়ানোর কথা বলে মানুষকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করা - গণপরিবহন ব্যবস্থা আধাআধি খুলে সেই সীমিত যানবাহনে গাদাগাদি ভিড় নিশ্চিত করা - আর আরেকদিকে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সংক্রমণের দায় থেকে হাত ধুয়ে ফেলা - কী কিউট না!!!

কিন্তু, সেসব কথা থাক। সৎ দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে আমাদের গুরুদায়িত্ব সরকারেরব কথাকে বেদবাক্য বলে মেনে নেওয়া।

এই পরিস্থিতিতে, নিজের স্বাস্থ্য নিজের সুরক্ষার দায় এক এবং একমাত্র নিজের, এমত সরকারি ঘোষণায় উদবুদ্ধ হয়ে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের একটি বড় অংশ যদি বাড়িতে বসে থাকতে চান, তাহলে নিশ্চয়ই তাঁদের দোষ দেওয়া যায় না। তাই না??

তাহলে কী করবেন?

কী আবার!!! সবাই হাত ধুচ্ছেন তো? সরকারও হাত ধুয়ে নিলেন।

আপনি থালা বাজান। বাতি জ্বালুন।

কোনো এক শুভদিনে সন্ধ্যা আট ঘটিকায় পরবর্তী ঘোষণার অপেক্ষায় থাকুন।

Sunday, May 3, 2020

ভাষার বিবর্তন।

মারা
খুব রিসেন্টলি একটা জিনিস খেয়াল করলাম। ৩০/৪০/৫০ বছর আগের মুভি দেখতে বসলে কেমন জানি অস্বস্তি লাগে। সাদাকালো জামানার ইংরেজী ভাষার যে কোন সিনেমা দেখতে বসলেই অস্বস্তিটা হয়। ছবিগুলার ডায়লগ শুনতে কেমন জানি কানে বাজে। মাত্র ৫০ বছরেই ইংরেজী ভাষায় পরিবর্তন টা আমার কানেই বেশ ধাক্কা খায়।

ভাষা নিয়ে অনেকের এলার্জি আছে। ছুত ছুত আছে। এইভাবে বলা ঠিক না, ওভাবে কেন বলে না, এমন অনেক দাবীকে অনেকে বেশ জোর গলায় তুলে ধরেন। এই ধারনাটাকে আমার একদমই ব্যাক্তি কেন্দ্রিক মনে হয়। ভাষা আসলে আমার কাছে মনে হয় খুব ধীর গতিতে গড়িয়ে নামা হিমবাহ-এর মত। এর সরে যাওয়া, গড়ানো টেরই পাওয়া যায়না। কিন্তু আসলে ভাষা সরে, নড়ে। একটা বড় সময়ের আগপীছ করে দেখলে ভাষার এই প্রতিসরণ কিছুটা আঁচ পাওয়া যায়। আমার ইংরেজী জ্ঞান ভাল না। তাই বাংলায় উদাহরন টানি।
বাংলায় গত ৫০ বছরে (আমার আন্দাজ, কম বেশি ও হইতে পারে। (আমি তো আর তথ্যবহুল প্রবন্ধ লেখছিনা যে প্রপার রেফারেন্স পাবেন। ধরে নেন আরকী ) কিছু শব্দ সুঁই হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে যাচ্ছে, সামনে দিকে কুড়াল হয়ে বের হবে। একটা শব্দ নেই, যেমন- "মারা"
শাব্দিক অর্থ অতি সরল - মেরে ফেলা, হত্যা করা ইত্যাদি।

শুরুতে এই শব্দ তার নিজের শাব্দিক অর্থের গন্ডি পার হয়ে অন্য শব্দের সাথে ভিন্ন অর্থ নিয়ে যোগ করা শুরু হল। শুরুতে ছোট্ট ছিল তাই কেউ অতটা পাত্তা দেয় নাই। কিন্তু এখন সে আরো স্পেস নিয়ে ফেলছে।
ফাঁকি মারা, ঝাঁকি মারা, ঝিম মারা, তালি মারা, ঢিল মারা, ধাক্কা মারা, চড় মারা !!
এই যুগে যখন "মারা" শব্দ টা যোগ করা শুরু হল তখন একটা অদৃশ্য শর্ত ছিল। তা হল - মারা'র সাথের শব্দটা মোটামুটি প্রাথমিক অর্থবহ একটা শব্দ হতে হবে। জানিনা এই "মারা" যোগ করা শব্দযুগলকে প্রাথমিক পর্যায়ে কতটা চাপ সহ্য করতে হয়েছে। সুশীল সমাজ একে অশ্রাব্য, বর্বর বলে সীল মেরে দিয়েছিলো কিনা। কিন্তু শব্দগুলা একটা বড় সময় পর্যন্ত টিকে তো গেছে। তারমানে এই শব্দযুগলের ব্যাবহারিতা আর গ্রহনযোগ্যতার সার্টিফিকেট আছে।

তারপর যখন দেখা গেল 'মারা' একটা হার্মলেস শব্দ। তখন তাকে আরেকটু নড়াচড়া করার লাইসেন্স দেয়া হইল। নতুন নতুন শব্দের সাথে "মারা" যোগ করার প্রবনতা আসলো। নতুন পর্বে "মারা'র" সাথে প্রাথমিক অর্থ থেকে ভিন্ন এমন শব্দ দিয়ে নতুন অর্থবহ শব্দযুগল বানানো শুরু হল -

গুল মারা, চাপা মারা, টাংকি মারা, চোখ মারা, পাট মারা (অবশ্য "ইয়ে মারা" "হাত মারা" এই পর্বে পড়সে, নোংরা অর্থবহন করার অপরাধে)

এই পর্বে খেয়াল করলে দেখা যাবে "মারা" যদিও অনেক বোল্ড হইসে কিন্তু এখনও তার সাথে গেটিস শব্দ লেগে আছে। যদিও সেই শব্দের "মারা" নামের ল্যাঞ্জা ছাড়া নিজের মূল অর্থ অনেক ভিন্ন। তাকে "মারা" নির্ভর হয়ে চলতে হয় নতুন এই ভাব প্রকাশ করার জন্য। এই শব্দযুগলকে এখনো সার্বিক ভাবে খুব একটা গ্রহনযোগ্যতা দেয়া হয় নাই। যদিও কথ্যরূপের মধ্যেই বেশি চলে। কিন্তু ইদানিং লিখিত সাহিত্য বা নাটক সিনেমা চিত্রায়নে চরিত্রের প্রয়োজনে এই শব্দব্যাবহারের নির্ভরতা বাড়ছে। আমার ধারনা বলে, "মারা" এই রাউন্ডের শব্দক্ষমতা নিয়ে টিকে যাবে।

এইবার আসি এলার্মিং স্টেজে। "মারা" মোটামুটি বাংগালীর এত বেশি দরকারী শব্দ হয়ে গেছে যে, বাংগালীর এখন "মারা" কে ওপেন লাইসেন্স দেয়ার অভ্যাস হয়ে গেছে। যদিও এই আধুনিক ফর্ম অনেক সেন্সেটিভ। "মারা" এখন বিশেষ ক্ষেত্রে নিজেই এক টা মৌলিক অর্থবহন করার চেষ্টা করে। রীতিমত তেজস্ক্রীয় ক্ষমতা পাওয়া "মারা" এখনো সাহিত্যে জায়গা করে নাই। তবে মুখে ব্যাবহার বেশ চালু হয়ে গেছে।
উদাহরণ দেই
ছাত্র - প্রশ্ন কঠিন হইসে। কঠিন "মারা" খাইছি।
কর্মচারী- ভাবসিলাম ছুটি নিব, বস "মারা" দিয়ে দিছে।
নিষ্পেষিত জনতা- খালি আমাগোরেই পান, "মারা" দেয়ার লাইগা ?
পুলিশ - এমন "মারা" দিমু, কাউরে কইতারবি না।

মারা খাবা, মারা দিব, মারা খাইছি, মারা দিছি
এমন শব্দের ব্যাবহার চোখ কান এড়ায়ে পার করছি আমরা, স্বীকৃত দিচ্ছি না। কিন্তু, আমার মনে হয় এরাও একসময় হয়ত টিকে যাবে। যতই এদেরকে ধমক ধামক বকা ঝকা দিয়ে চেপে চুপে রাখা হোক না কেন। পাবলিক ইন্টারেস্টের জোরে ডেমোক্রেটিক ফর্মে "মারা" এমন পাওয়ারফুল এখন যে, মারার সাথে বেসিক ভার্ব জোড়া দিয়েই কথা বলা যায়।

এবার আসেন সামনে কি হবে, ভাবি। এইক্ষেত্রে আমরা বাংগালী, চিরায়ত নিয়মে বিদেশী জিনিসের অনুকরণে হাটবো সেটা তো আর নতুন করে বলার কিছু নাই। তাই ধারণা করা যায় এক সময়ের ইংরেজীর দুষ্ট শব্দ "ফাক" যেমন মোটাতাজা হয়ে এখন নিজেই বাক্যের ৭০% দখল করে নিয়ে
"হেই ফাকার, হোয়াট দা ফাক ইউ ডুয়িং ফর ফাইভ ফাকিং মিনিটস"
"আইল ফাক দা ফাকিং ফাকার টিল হি ফাকিং ডাই"
এমন পর্যায়ে ইংরেজী কথ্যভাষায় ঢুকে গেছে, মুখে মুখে ঝুলছে। তেমন করে কোনো একদিন হয়ত আমাদের বাংলা "মারা" ও জোর বাড়ায়ে বাক্য দখলে নিয়ে নিবে।

মারানির পুতেরে, এমন মারা দিমু, মারা খাইয়া, আর কোনোদিন মারাইতে আইবো না। (উদাহরণ)

"মারা" কে আর মারা যাবেনা। ভাষার স্লোমোশানের ঘোড়ার কাঁধে "মারা" মতন এমন অনেক কিছু উঠে পড়ে যাদের আর নামানো যায় না। ভাষা বদলায়, নতুন শব্দ আসে, পুরানা শব্দ, পুরানা অর্থ হারায়ে যায়।

ভবিষ্যতে কোনো একদিন সিএঞ্জির পিছনে লেখা - আমি ছোট আমাকে "মেরো" না।
দেখে কারো কারো খুব খারাপ কিছু মনে হতে পারে। দোষ দেয়া যায় না। এটাই হয়। মারার তো অনেক অর্থ । কোন মারা বুঝানো হইসে, সেইটা কে ধরে বেঁধে দিবে? তাই মারা তখন বহুমাত্রিক এক বিশাল শব্দভান্ডার। এর মানে হতে পারে অনেক কিছু।
আমরাই নিজেরা সজ্ঞানে বা অজ্ঞাতে ভাষার "মারা" দিয়ে ফেলি।
... আপাতত "মারা" র প্রাথমিক অর্থের বর্তমান ব্যাবহারের শেষ শব্দটা  বইলা নেই।
... মাইরালা আমারে মাইরালা
এর পরে আর কোনোদিন হয়ত "মারা" তার প্রাথমিক অর্থ নিয়ে নতুন রূপে আসবে না।

Thursday, April 23, 2020

"যদি বেঁচে যাও এবারের মতো যদি কেটে যায় মৃত্যু ভয়, জেনো বিজ্ঞান একা লড়েছিল মন্দির মসজিদ নয়"

"যদি বেঁচে যাও এবারের মতো
যদি কেটে যায় মৃত্যু ভয়,
জেনো বিজ্ঞান একা লড়েছিল
মন্দির মসজিদ নয়"

কথা গুলো নিয়ে অনেকের আপত্তি আছে। অনেকে একে ব্লাসফেমি মনে করছে, উদ্ধত্য মনে করছে এই উক্তিতকে। আসলেই কী তেমন মনে করার সুযোগ আছে? আমার মনে হয় না। তবে কথাটা আমার কাছে সম্পূর্ণ মনে হয়নি। বিজ্ঞান একা লড়েছে ঠিক আছে, তবে মসজিদ মন্দির একাই যে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে তা না, লড়াই শব্দটার সাথে যা যা জড়িত সেই সবও তাকিয়ে দেখছে শুধু। কোটি কোটি ডলারের মারণাস্ত্র, নিমিষে দুনিয়া ধ্বংস করে দেওয়ার মত পারমানবিক বোমা, যুদ্ধ বিমান, যুদ্ধ জাহাজ, কামান, গোলা- বারুদ এই সমস্ত কিছুও অকেজো হয়ে পরে রইছে।

এখন মসজিদ মন্দির নয় বলাতে অনেকেই একে ধর্ম বিরোধী বলে মনে করছেন। ধর্ম আর মসজিদ মন্দির এক জিনিস কী না তা আগে আমাদের বুঝা উচিত। মসজিদ বলতে আমরা যে ঝাঁ চকচকে শানদার দালান বুঝি তা আসলেই বুঝায় কিনা বা মন্দির বলতেই ধর্ম বুঝায় কিনা তা জানা দরকার। আমার তা মনে হয় না। ঈশ্বর আর মসজিদ মন্দির এক জিনিস না। এখন মসজিদ বা মন্দির বন্ধ আছে, তাতে ধর্ম নষ্ট হয়ে যায়নি, যাওয়ার কথাও না। নবী খেজুর পাতার ছাউনিতে নামাজ পড়ে ধর্ম প্রচার করেছেন আর আমাদের এখন এসি মসজিদ ছাড়া নামাজ পড়া যায় না।

তবে লেখাটায় মসজিদ মন্দিরকে যে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে বা বলা যায় কটাক্ষ করা হয়েছে তা মিথ্যা না। এর কারন আমার কাছে যা মনে হয়েছে তাই বলছি। এখন যখন আমরা সকলেই বিজ্ঞানের একটা ব্রেক থ্রুর জন্য অপেক্ষা করছি তখন প্রশ্ন জাগতেই পারে আমরা বিজ্ঞান চর্চার জন্য কী করেছি? কত টাকা দেওয়া হয় গবেষণার জন্য? অন্যদিকে মসজিদ মন্দির বা ধর্ম চর্চার জন্য কত টাকা খরচ করে সরকার? আমি আমার দেশের কথাই বলছি। সারা পৃথিবীর বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় গুলো যখন জোরেশোরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ভাইরাসের ঠিকুজি উদ্ধারে তখন আমাদের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় গুলো হ্যান্ড স্যানিটাইজার বানিয়ে ফলাও করে তা প্রচার করছে! হ্যান্ড স্যানিটাইজার বানিয়ে দোষ করেনি, মানুষের উপকারই করেছে, গবেষণার জন্য যে টাকা পায় তাতে এরা যে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বানাতে পেরেছে তাই অনেক!

আচ্ছা, তুলনাটা করেই ফেলি তাহলে। ২০১৯/২০ অর্থ বছরে দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে ইউজিসির গবেষণা বাবদ বরাদ্দ ছিল ৮০৮৮ কোটি টাকা। আর ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সরকার কেবল একটি প্রকল্প, মডেল মসজিদ প্রকল্পতে বরাদ্দ দেয় ৮৭৮৮ কোটি টাকা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল প্রায় আশি কোটি টাকা। অন্যদিকে (২০১৯ সালে) ঢাকেশ্বরী মন্দির সহ সারা দেশের মন্দির সংস্কারের জন্য বরাদ্দ ছিল ২২৮ কোটি টাকা।চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণার কী অবস্থা দেশে? সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পেয়েছে সিলেট মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। টাকার অংক শুনে হাসা যাবে না আগেই বলে দিলাম। তিন কোটি টাকা! খোঁজ নিয়ে দেখা যাবে সিলেটের পাড়া মহল্লার ওয়াজ মাহফিলে এর চেয়ে কয়েক গুন টাকা খচর হয়।

তো? সংকটকালে যাদের দিকে সকলেই তাকিয়ে রয়েছে তাদেরকে আমরা এতদিন কী দিয়ে এসেছি বুঝা যাচ্ছে? সারা দেশে ৩৬০ মসজিদ বানানোর জন্য যে আট হাজার কোটি টাকার ওপরে দেওয়া হল তা থেকে এই মুহূর্তে কী পাওয়া যাচ্ছে? এমন তো না যে এই ৩৬০ মসজিদ না হলে আমাদের দেশে নামাজ পড়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আমরা বিজ্ঞানকে থোড়াই কেয়ার করি।বিজ্ঞান চর্চা হুদা জিনিস।ফালতু খরচ সব!
আচ্ছা, এই ক্রান্তিকালীন সময়ে যদি মসজিদ কে এগিয়ে আসতে বলা হয়, তারা কী আসবে? কয়েক লাখ মসজিদ আছে দেশে। যদি বলা হয় মসজিদ গুলোকে আইসলেসন সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করা হোক। সবাই মেনে যাবে? আমাকে লাফ দিয়ে ধরার আগে আরেকবার ভাবুন। মসজিদ কমিটি লাশ নিয়ে যাওয়ার জন্য খাটিয়া দেয় নাই, এমন খবর দুইদিন আগেই পাইছি আমরা!

যদি পুরো বিশ্বের হিসেব করি তাহলে আমাদের মত রুগ্ন অবস্থা হয়ত দেখব না। কিন্তু খুব যে ভাল অবস্থা তাও না। সেখানে তুলনা আসবে মসজিদ মন্দিরের সাথে না। সেখানে আসবে পৃথিবী চোদ্দ বার করে ধ্বংস করে দেওয়া মারণাস্ত্র বানানোর বাজেটের সাথে। এই ক্রান্তিকালীন সময় কেটে যাবে। হয়ত নতুন পৃথিবীর দেখা পাব আমরা। । যেখানে আগামী পৃথিবীর দুর্যোগ সামাল দেওয়ার জন্য আমরা তৈরি থাকব। সেই আশায় থাকলাম।।

Sunday, April 12, 2020

করোনা, রাষ্ট্রের দায় কি?

আমি করোনা বিশেষজ্ঞ নই। জীবাণু বা জনস্বাস্থ্য বিষয়েও বিশেষজ্ঞতার ধারেকাছেও যাইনা। তাহলে এটা লিখছি কেন? কারণ, চারদিকে দেখছি, লকডাউনে হাঁফিয়ে যাওয়া মানুষ, নানারকম পাগলামি করছেন, এবং লকডাউন উঠে গেলেই করোনামুক্ত পৃথিবীতে আবার নিঃশ্বাস ফেলবেন, এই আশায় দিন কাটাচ্ছেন। এই লেখা নেহাৎই সাধারণজ্ঞান নির্ভর। কিন্তু স্পষ্ট করে সাধারণ কথাগুলোই বিশেষ কেউ লিখছেন বলে দেখছি না। তাই এই পুচকে লেখা।
---------
লকডাউন উঠে গেলেই কি করোনা ফিনিশ? স্পষ্ট করে প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার, না। এই ধুন্ধুমার লকডাউন উঠে গেলে পৃথিবী আদপেই পৃথিবী করোনামুক্ত হবেনা। একবার যখন এসে পড়েছে, ভাইরাসটি আছে এবং থাকবে। নির্মূল হবেনা। সে চেষ্টাও পৃথিবীর কোনো দেশের কোনো স্বাস্থ্যসংস্থা বা সরকার করছেনা। অতএব, যদি নেহাৎই প্রশান্ত মহাসাগরের কোনো দ্বীপে গিয়ে একাকী বসবাস না করতে পারেন, আজ হোক বা ছমাস পরে, এর সংস্পর্শে আপনি আসবেনই, যদি না ইতিমধ্যেই এসে গিয়ে থাকেন। তার মধ্যে কোনো টিকা বেরিয়ে যাবার সম্ভাবনা খুবই কম। (যখন বেরোবে তার পরেও, ফ্লুয়ের মতোই ভাইরাসের নতুন কোনো গোষ্ঠী সম্ভবত উদয় হবে, টিকা যার কোনো প্রতিষেধক নয়।) ফলে ভাইরাস নাকের ডগায় এলে আপনার ভরসা আপনার প্রতিরোধক্ষমতা। কোনো লকডাউন, কোনোভাবেই আপনাকে তার থেকে বাঁচাবেনা। গোষ্ঠীগতভাবে মানুষ যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জার বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন করেছে, সেভাবেই করোনার বিরুদ্ধেও করবে। এইটিই একমাত্র পথ। কোনো সরকার, কোনো স্বাস্থ্যব্যবস্থা, অন্য কোনো পথ এখনও দেখায়নি, দেখানোর সুযোগও নেই। এবং এই লকডাউন, তথাকথিত সামাজিক দূরত্ব, এসব কেবল এক সাময়িক ব্যবস্থা। এতে করে ভাইরাস নির্মূল হয়না। ভাইরাল নির্মূল করার কোনো চেষ্টা আদপেও কোথাও করাও হচ্ছেনা।

তাহলে হচ্ছে টা কী? এই দূরত্ব বজায় রাখা, দরজা বন্ধ রাখা, এসব দিয়ে একটাই জিনিস হচ্ছে। খুব কায়দা করে যেটাকে বলা হচ্ছে বক্ররেখাকে সিধে করা। ফ্ল্যাটেনিং দা কার্ভ। অর্থাৎ, ছড়ানোর গতিটা একটু কমানো। নানা জায়গায় লোক সমাগম হলে খুব দ্রুত ভাইরাস ছড়াবে। দরজা বন্ধ করে রাখলে ধীরে। অর্থাৎ, আপিস-কাছারি-দোকান-বাজার করলে আপনি হয়তো আগামী কালই ভাইরাসের সংস্পর্শে আসতেন। এখন দরজা বন্ধ করে রাখার ফলে তিনমাস বা ছমাস পরে আসবেন। কিন্তু আসবেনই যে, এতে বিশেষ কোনো সন্দেহ নেই। ফলে, যারা করোনাক্রান্ত বা তার পরিবারকে কুষ্ঠরোগীর মতো করে দেখছেন, পাড়ায় গিয়ে হামলা করছেন, কীটনাশক দিয়ে স্নান করাচ্ছেন, ডাক্তার-নার্সদের বাড়িছাড়া করছেন, তাঁদের একটাই কথা বলার। উন্মাদনা দিয়ে ভাইরাস আটকায়না। করোনা যদি কুষ্ঠ হয়, তো এই কুষ্ঠের সংস্পর্শে আপনাকে আসতেই হবে। আজ বা কাল। এই লকডাউনে ব্যাপারটা একটু ধীরগতিতে চলছে। এই মাত্র। পরশুদিন আপনার জ্বর হলে, শুকনো কাশি হলে, আপনাকেও অবিকল এইভাবেই দেখা হবে। পাড়ার লোকে আপনাকেও বলবে, দেকেছো কীরকম ভাইরাস ছড়াচ্ছিল ব্যাটা? গণশত্রু কোথাকার। মনে রাখবেন, সাবধানতা আর উন্মাদনা এক জিনিস নয়। সাবধান হয়ে আপনি ভাইরাসকে ধীরগতিকে ছড়াতে দিচ্ছেন। আর উন্মাদ হয়ে যেটা করছেন, সেটা সামাজিক অস্থিরতা তৈরি।

এবার কথা হল, আজ বা কাল, যখন ভাইরাস নাকের ডগায় আসবেই, তখন এই ধীরগতিতে ছড়িয়ে লাভটা কী? দুখানা লাভ।

১। বহু লোক একসঙ্গে ভাইরাসের কবলে পড়লে, বেশিরভাগেরই হয় কিচ্ছু হবেনা, কিংবা সামান্য জ্বর-কাশি হবে, কিন্তু একটা ভগ্নাংশের অবস্থা গুরুতর হবেই। খুব দ্রুতগতিতে ছড়ালে এই ক্ষুদ্র ভগ্নাংশের সংখ্যাই অনেক বেশি হবে। তাদের চিকিৎসা করা যাবেনা। বাংলাদেশে যদি ১০ কোটি লোক ৭ দিনে করোনা ভাইরাসের সংস্পর্শে আসেন, তাঁদের মধ্যে ১০ লাখ লোককে যদি হাসপাতালে যেতে হয়, তাহলে চিকিৎসা দূরস্থান, হাসপাতালের করিডোর পার করে রাস্তায় অবধি রোগশয্যা পাততে হতে পারে। পরিকাঠামোর এমনই হাল। তখন চিকিৎসার অভাবেই বেশ কিছু লোক মারা যাবেন, যারা হয়তো বেঁচে থাকতেন। এই অবস্থা যাতে না হয়, অসুস্থতা যাতে ধীরেসুস্থে ছড়ায়, হাসপাতালে চাপ না পড়ে, সেই কারণেই ধীরগতিতে ছড়ানোর প্রস্তাব।

২। ধীরগতিতে ছড়ালে গোষ্ঠীগত প্রতিরোধক্ষমতা, কোনো অলৌকিক পদ্ধতিতে বেড়ে যেতে পারে। এটা কী করে হবে স্পষ্ট নয়। বিশেষ্জ্ঞরা এ ব্যাপারে আমার আপনার চেয়ে বেশি কিছু জানেন বলেও মনে হয়না। কীকরে কিছু দেশে ভাইরাস কম ছড়াচ্ছে, কিছু দেশে বেশি, যেখানে কম ছড়াচ্ছে, সেখানে আদৌ কম ছড়াচ্ছে কিনা, নাকি মানুষ প্রতিরোধ করে ফেলছে, নাকি অন্য কোনো গূঢ় ব্যাপার আছে, সেসব কেউই জানেননা। কিন্তু, প্রতিতুলনা দিয়ে বলতে গেলে, এক লহমায় সবাইকে বাঘের মুখে ফেলার চেয়ে একটু একটু করে ফেললে হয়তো লোকজন বাঘকে আটকেও দিতে পারে প্রস্তুত হয়ে, চিন্তাপদ্ধতিটা অনেকটা এরকম।

দুটো কারণই সহজবোধ্য। কিন্তু এগুলো ভাইরাস নির্মূল করার পদ্ধতি নয়। লকডাউন দিয়ে ভাইরাস নির্মূল হবেনা। চিকিৎসার পরিকাঠামো যাতে ভেঙে না পড়ে, সে জন্য লকডাউন একটি সাময়িক ব্যবস্থামাত্র। এই সাময়িক ব্যবস্থাপনায় এমনিতে কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অন্য জায়গায়। চিকিৎসা ব্যবস্থা, এই মূহুর্তে, কয়েকটি দেশ বাদ দিলে, প্রায় সারা পৃথিবীতেই একটি লাভজনক ব্যবসা। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে সরকারি ব্যয়বরাদ্দ কোথাওই প্রয়োজনের চেয়ে অনেক নিচে। এবং চিকিৎসা যে মানবাধিকার, এটা প্রায় কেউই স্বীকার করেনা। স্বাস্থ্য এবং জনস্বাস্থ্যব্যবস্থার অপ্রতুলতার যে দায় সরকারের নেবার কথা, লকডাউন করে দিয়ে সেই দায় বস্তুত মানুষের ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে। দিগ্বিদিকে কেবলই শোনা যাচ্ছে লকডাউনই করোনা মোকাবিলার একমাত্র রাস্তা। এবং লকডাউন ভেঙে মানুষ কী দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো কাজ করে ফেলেছে। কিন্তু সরকারের দায়ের আলোচনা কোথাও নেই। কেন হাসপাতালে রোগির ভিড় সামাল না দেবার অসুস্থতার চিকিৎসা স্রেফ লকডাউন দিয়ে করা হবে, কেন চিকিৎসাব্যবস্থা এমন হবে, যে, সতেরো কোটির দেশে সতেরো লাখ লোককে একদিনে জরুরি চিকিৎসা দেওয়া যাবেনা, কেন বাজেট বরাদ্দে স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা বহু বহু নিচে, সে আলোচনা উধাও। এখন সব দায়িত্বই মানুষের। এবং বাদবাকিটা ধীরে-চলো নীতি। এতদ্বারা কোনো অজানা উপায়ে মানুষ যদি প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন করেই ফেলে, তাহলে বলা যাবে, এই ব্যবস্থা দিব্যি কাজ করছে। না পারলে, সব দোষ দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষের। অনেকে একসঙ্গে অসুস্থ হয়ে পড়লে কীকরে সবাইকে চিকিৎসা দেওয়া যাবে? অতএব আপনারই দায়িত্ব অসুস্থ না হওয়া। রাষ্ট্র তাই আপনাকে বন্দী করে রাখবে। চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেনা। রাষ্ট্রের বিশেষ দায় নেই, আপনি অসুস্থ হয়ে যাতে না পড়েন, তার জন্য তো তারা কারফিউ জারি করে রেখেইছে। ব্যস দায়িত্ব খতম।

এবং এটা ভাবা হচ্ছে এমনভাবে, যেন এর কোনো বিকল্প নেই। বলা হচ্ছে এমনভাবে, যেন লকডাউনই এক ও একমাত্র অমোঘ ওষুধ, যা ভাইরাস ঠেকাবে। অথচ, তা আদৌ নয়। লকডাউন ভাইরাস মারেনা। এবং এর বিকল্প বিলক্ষণ আছে। খুব স্বল্পবুদ্ধিতেই, বিকল্প হিসেবে যেটা হতে পারত, বা পারে, সেটা হল স্পষ্ট করে বলা, যে, লকডাউন কোনো চিরস্থায়ী সমাধান দেবেনা। ভাইরাস আছে ও থাকবে। সরকার যেটা করতে পারে, তা হল আক্রান্তদের চিকিৎসার সুযোগ। সেইটুকু করার জন্য লকডাউন কেবল একটু নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ দেবে। এবং সেই সময়ে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোয় বিপুল বিনিয়োগ করে যুদ্ধকালীন প্রস্তুতিতে চিকিৎসার সুবন্দ্যোবস্তো করে ফেলা হবে। সরকার সেই দায়িত্ব নেবে। সমস্ত মানুষের জন্য নেবে। একটা ভাইরাসের জন্য না, আগামীর সমস্ত সমস্যার জন্য নেবে। বাজেট বরাদ্দ বহুগুণ বাড়বে। এবং স্বাস্থ্য যে মানবাধিকার, এটা স্বীকৃত হবে। কিন্তু সেই দাবীই কোথাও নেই, ঘোষণা তো পরের কথা।

এই দাবীগুলো আলোচনায় নেই কেন? তার কারণও পরিষ্কার। পৃথিবী জুড়েই এক যুদ্ধপরিস্থিতি তৈরি করে ফেলা হয়েছে। যুদ্ধের উন্মাদনা তৈরি করে ফেলা হয়েছে। কোনো যুদ্ধ ছাড়াই। রাষ্ট্র সমস্ত ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছে, কিন্তু প্রাথমিক বিষয়গুলো নিয়ে তার আর কোনো দায়িত্ব নেই। কারণ এখন যুদ্ধপরিস্থিতি। এখন শুধু জরুরি ভিত্তিতে শত্রু ঠেকানোর লড়াই। বাকি সবই গৌণ। এই লড়াইয়ে প্রতিটি মানুষই সৈন্য। তাদের শৃঙ্খলাপরায়ণ হতে হবে। শৃঙ্খলা ভাঙলে শাস্তি। কেউ কেউ আবার শৃঙ্খলা ভেঙে ভাইরাস পক্ষের গুপ্তচরও হতে পারেন, তাঁরা গণশত্রু। সেই কারণে প্রয়োজন তীব্র নজরদারি। কারণ এখন যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধের জয়-পরাজয় সবার আগে, সেনার কোর্ট মার্শাল হয়, তাদের জন্য অন্য নিয়ম। তাদের কোনো নাগরিক অধিকার নেই, থাকতে পারেনা। ব্যক্তির যে অধিকারগুলি গত একশ বছরে অর্জন করা গেছে, সেসবের আর কোনো মূল্য নেই। যে অধিকারগুলি, যেমন সবার জন্য স্বাস্থ্য, গণতান্ত্রিক পরিসরে রাষ্ট্রীয় নজরদারি বন্ধ করা, এসব এখন পিছনের আসনে। করোনা তো আগে তাড়াই দাদা।

গত একশ বছরে কোনো যুদ্ধ নিয়ে, পৃথিবী জুড়ে এমন ঐকমত্য দেখা যায়নি। গত পঞ্চাশ বছরে নাগরিক জীবনে রাষ্ট্রের অবাধ হস্তক্ষেপ নিয়ে ডান ও বাম উদারনৈতিক ও রক্ষণশীলদের মধ্যে এমন একমত হওয়া দেখা যায়নি। গোটা পৃথিবী এখন শৃঙ্খলার নিগড়ে বাঁধা। সেনাবাহিনীর মতই শৃঙ্খলিত। শুধু মজা এই, যে, এই যুদ্ধ শত্রুকে নির্মূল করার নয়। ভাইরাস এভাবে নির্মূল হবেনা। স্বাস্থ্যকে মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণার, স্বাস্থ্যের পরিঠামো বাড়ানোর, স্বাস্থ্যে রাষ্ট্রের দায়িত্ব সুনিশ্চিত করার একটা চেষ্টা করলে বরং একটা দীর্ঘমেয়াদি বদল আসতে পারত। কিন্তু সে চেষ্টাও কেউ করছেনা। এখনও যুদ্ধ চলছে।

শক্তির সংজ্ঞা ও পরিবর্তন

মুখস্থ বিদ্যাটা বরাবরের কম। তবুও ক্লাস সেভেনে হেগেমেতে কোনরকমে শক্তির সংজ্ঞাটা মুখস্থ করেছিলাম -- শক্তি অবিনেশ্বর, ইহার সৃষ্টি বা বিনাশ নেই, শক্তি এক শক্তি থেকে অন্য শক্তিতে রূপান্তরিত হয় মাত্র । সংজ্ঞাটিকে এবার ফেসবুকে পোষ্ট করা কোনো আপাত "মৌলিক" লেখার ক্ষেত্রে খাপে খাপে বসিয়ে দেন । ফেসবুকের পোষ্ট করা লেখা অবিনেশ্বর, ইহার সৃষ্টি বা বিনাশ নেই , এক টাইমলাইন থেকে অন্য টাইমলাইনে স্থানান্তরিত হয় মাত্র । ধরুন, আপনি অনেক ভেবে ভেবে আপনার সৃষ্টিশীল স্বত্বা দিয়ে একটি চমৎকার মনোগ্রাহী কিছু লিখলেন । পোষ্টালেন । সেটা এবার আপনার ফ্রেন্ডলিষ্টে থাকা পাঠকের মনে ধরার মতো হলে শেয়ার ও কপিপেষ্ট হতে থাকল । সেই লেখা টাইমলাইন থেকে টাইমলাইন ঘুরতে ঘুরতে সোশাল মিডিয়ার গন্ডী ছাড়িয়ে কোনো বন্ধু মারফত কুম্ভমেলায় হারিয়ে যাওয়া মেজ ছেলের মতো হোয়াটসঅ্যাপ এর চ্যাট গ্রুপে খুঁজে পেলেন । লেখার শেষে ততদিনে "সৌজন্য" ধর্ষিতা হয়ে আপনার নামটাই উবে গেছে, বা শেষ পোষ্টকারী শেষে ছোট্ট একটা হ্যাজ সহযোগে "collected" লিখে রেখেছেন। এতেই আপনাকে সন্তুষ্ট হতে হবে আপনাকে। 'collected' লিখে কিছুটা হলেও কৃপা তো করেছে, সেটাই কম কি!

ফেসবুকে লিখে সমাজ বদলের ভাবনা অনেকাংশেই দূরারোপিত কষ্টকল্পিত কল্পনা । সেটা ফেবু লেখক বিলক্ষন জানেন। তবুও লেখেন। লেখার করুণ বেওয়ারিশ পরিনতির কথা জেনেও লেখেন। কেন ? ঐ যে, লেখার জন্য লেখা, শিল্পের জন্য শিল্প। জীবনমুখীনতায় শিল্পের একমাত্র উদ্দেশ্য হলে লেখক বা শিল্পীকে সমাজকর্মীই বলা হোক, লেখক বা শিল্পী নয়। লেখকের প্রাপ্তি শুধু লেখার আনন্দটুকু। সৃষ্টিসুখের উল্লাস । সৃষ্টির আনন্দের সঙ্গে অন্য কোনো জাগতিক আনন্দের তুলনা করা চলে না । রোঁলা বার্থ যতই লেখকের মৃত্যুর তত্ত্ব শোনান, নিজের সন্তানতূল্য লেখার প্রতি অধিকারবোধ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না কোনো লেখকই, বাৎসল্য রস বলে একটা জিনিস আছে তো নাকি ! ঠিক যেমন পিতা নিজ সন্তানের দন্ত বিগলিত হাসি আর অস্ফুট কথায় যারপরনাই পুলকিত ও আহ্লাদিত হন, তেমনি ফেবু লেখক নিজের পুরোনো লেখাও অবসর সময়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পড়েন , পুনঃপুনঃ সৃষ্টির আনন্দ তাঁকে তুষ্ট করে । সেই আনন্দ ও ভাবনা শেয়ার করতেই ফেসবুকে পোষ্টানোর বাসনা জাগে । কিন্তু, সন্তানতূল্য নান্দনিক সৃষ্টি যদি অন্য কেউ অপহরণ করে নিজের সন্তান বলে চালায়, তাহলে?   বেদনাদায়ক তো বটেই।

কিন্তু, দুঃখ পাবেন না । ভার্চুয়াল দুনিয়ার হার্ডকোর বাস্তবতা, না মেনে উপায় নেই । ভারচুয়ালি চেঁচিয়েও কোনো লাভ নেই । তার থেকে বরং এক কাজ করুন, ক্লাস সেভেনে পড়া শক্তির সংজ্ঞাটা টাইমলাইনের পোষ্টে বসিয়ে সকাল দুপুর জপ করুন । সঙ্গে, একটা সান্ত্বনা বাক্য মনে গেঁথে নেবেন -- নিজের লেখা (ধরুন কবিতা) শেষ করে ফেসবুকে পোষ্ট করার সাথে সাথে সেটা আর আপনার সম্পত্তি থাকে না, ফেসবুকের পাঠক আর সমালোচকের জিম্মায় চলে যায় । লেখক যদি পোষ্টের কমেন্ট বক্সে তার উপস্থিতি ক্ষনে ক্ষনে জানান দিতে থাকেন এবং পাঠক বা সমালোচকদের সঙ্গে সমালোচনায় অংশগ্রহন করতে থাকেন তাহলে সেই কবিতার বচন বহুমাত্রিকতার বদলে একমাত্রিক হিসাবে চলতে শুরু করবে । অর্থ সংকুচিত হয়ে লেখকের ব্যক্তিজীবনের চারদিকে ঘুরঘুর করবে । আপনার কষ্ট লাঘব হবে যদি আপনি "খুব ভাল হয়েছে" বা "দারুন লিখেছেন" জাতীয় স্তুতি বাক্য সযত্নে এড়িয়ে যেতে পারেন। আপনার লেখা কবিতাটিকে খাঁচায় বন্দি না রেখে বরং ছেড়ে দেন মুক্ত বিহঙ্গের মতো। উড়তে দেন নিজের মতো করে । এরপরেও কেউ যদি সেটাকে নিজের সম্পত্তি বলে কেউ চালায় তবে সেটা তার নৈতিক দৈনতা, আপনার নয় । লেখাটিকে নিজের খাঁচাবন্দী সম্পত্তি ভাববেন না। ভাবলে কষ্ট পাবেন।

আর একটি কথা মনে রাখবেন, আপনার সৃজনাত্মক আপাত "মৌলিক" লেখাটা মৌলিক মনে হলেও সেটা মৌলিক নয়, মৌলিকের মতো । বস্তুতঃ বিশ্বের কোনো সৃজনশীল লেখাই আগমার্কা "মৌলিক" নয়, আপনি জানেন। সবটাই ভাষার মোচড় আর ব্যবহারের খেলা । ভাষাই মূখ্য প্রতিবাদক, লেখকের ভূমিকা গৌন । লেখক বা একজন টাইপিষ্ট, যে ভাবনা গুলো প্রাথমিক অনুকরণ করে টাইপ করে মাত্র ।  ভাষার বাইরে তাই লেখকের সেভাবে কোনো অস্তিত্ব নেই । কবি বা সাহিত্যিক কেবল জানেন ভাষা সাজিয়ে গুছিয়ে, দুমড়েমুচড়ে কিভাবে কথ্য ও সাধারণ কথোপকথনের ভাষা থেকে বিপরিচিতিকরন করা যায়। আমাদের বস্তুজগতকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিই পাল্টে দিতে পারে লেখকের লেখনি বা কবির কবিসত্ত্বা। সাহিত্যিক বা কবির এই লেখনি সত্তা বা লেখায় সাহিত্যিক বা কবির জন্ম দেয়, উল্টোটা নয়  । কবি ও কবিমানসকে গুলিয়ে ফেলার বিদঘুটে প্রবনতা আমাদের মধ্যে আবহমান কাল ধরে বিদ্যমান । কিন্তু কবি বা লেখকের ব্যক্তিসত্তা থেকে দূরে কবি বা লেখক হল সামাজসাংস্কৃতিক আদল ও ঐতিহাসিক বচনে নির্মিত একটি সত্ত্বা। যার সঙ্গে লেপটে থাকে কবি বা লেখকের নান্দনিক বোধ ও প্রাক্ষোভিক বুদ্ধি । লেখকসত্ত্বা বা কবিসত্ত্বা কখনই সমাজ ও সাংস্কৃতিক কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।

লেখার আগে সব লেখক বা কবি গর্ভবতী মায়ের মতো প্রসববেদনা অনুভব করেন । মাথার মধ্যে থাকা একগুচ্ছ ভাবনা কেঁচোর মতো কিলবিল করে। ভাবনা গুলো বেরিয়ে আসতে চাই । লেখ্যরুপেই ভাবনার মুক্তি, ভাবনার মুক্তিতেই সৃষ্টির আনন্দ । লেখ্যরুপের মধ্য দিয়ে ভাবনার মুক্তির পরেও লেখক লেখার সঙ্গে নাড়ীর টান অনুভব করেন । সন্তানের প্রতি মায়ের যেমন তীব্র অধিকারবোধ থাকে তেমন লেখার প্রতি লেখকেরও । তাই সেই লেখার নেতিবাচক সমালোচনা বা আঁচড় লেখক বা কবির কাছে অসহিষ্ণু মনে হয় । নাড়ীর যোগ না কাটলে লেখার বহুত্ব , বহুবাচনিকতা বা বহুমাত্রিকতা রুদ্ধ হয়, সাহিত্য সমালোচনা ও চর্চার ক্ষেত্রেও সেটা বাধাস্বরুপ । এই প্রসংঙ্গে মনে পড়ছে কয়েক বছর আগে দেখা একটা ফরাসী সিনেমা - রুবি স্পার্কস । সেরকম গতেবাঁধা একরৈখিক গল্প এখানে না থাকলেও বিষয়বস্তু ভারী অদ্ভুত । কেন্দ্রীয় চরিত্র কেলভিন বছর কুড়ির ধারেপাশের একজন তরুন ঔপন্যাসিক । সে "রাইটার্স ব্লকে" আক্রান্ত (সৃষ্টিশীলতায় লেখকের কোষ্ঠকাঠিন্যের পর্যায় আর কি)। সাইকোলজিষ্ট দেখিয়েও সুরাহা হয় নি । পরে স্বপ্নে দেখা স্বপ্নপরী রুবিই তাঁর উপন্যাসের নায়িকা হয় । উপন্যাসে রুবির চরিত্র নির্মান করতে গিয়ে ঔপনাসিক নিজে তাঁরই তৈরি করা চরিত্র রুবির প্রেমে পড়ে যান । লেখাকে মুক্তি দেওয়া তো দূরের কথা, লেখক নিজেই গল্পের ফ্রেমে ঢুকে গল্পের নায়িকার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে গল্পের গতিপথকে প্রভাবিত করতে থাকেন ।

যাই হোক, এবার ফেসবুকের কথায় যদি ধরি, যারা ফেসবুকে লিখছে তারা ভিন্ন ভিন্ন সমাজ ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল থেকে উঠে এসেছে, এবং সেই বিশেষ সমাজ ও সংস্কৃতিভিত্তিক চিন্তাপ্রণালী বা ভাবাদর্শ আইডিওলজি) অবচেতনভাবেই মাথায় গেঁথে থাকে । প্রাক সোশালমিডিয়া বা তারও আগে বিশ্বায়নপূর্ব যুগে কবি বা লেখকের মগজে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ভাবনার মেলবন্ধন হত, কিন্তু তার গতি ছিল খুব মন্থর । সোশাল মিডিয়ার যুগে যেখানে বিভিন্ন রকম বচন ও প্রতিবচন, ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিগত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভাবনা একঘাটে সকাল বিকাল জল খায় সেরকম একটি পরিমন্ডলে লেখক বা কবির মগজে ভিন্ন ভিন্ন সামজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র থেকে আসা ভাবনাগুলো খুব দ্রুত মিথোস্ক্রীয়া ঘটায় । যাদের লেখা লেখক বা কবি পড়েন তাদের ভাষা ও ভাবনার সঙ্গে লেখকের ভাবনা ভাবাবেগ বিক্রিয়াসদৃশ জারিত হয়ে নতুন ভাবনার সংশ্লেষ হয়, ঠুনকো প্রেষনায় সেই ভাবনা গুলো ঠেলে বেরিয়ে আসে লেখার আদলে । তাই লেখক বা কবির লেখায় ঐ সবকিছুর অদৃশ্য ছায়া পড়তে বাধ্য । কাঠামো তাত্ত্বিকরা তাই বলেন যেকোনো পাঠই অসংখ্য সমাজ ও সংস্কৃতি থেকে আসা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বচনের সমাহার, তাই কোনো লেখাই আপাদমস্তক মৌলিকতা দাবি করতে পারে না । আবার ঐ পাঠ যখন আইডিওলজির ও প্রজন্ম ভেদে পাঠকের কাছে পৌঁছায় তখন লেখায় ভাসমান বচন গুলোর রং রুপ বদলে নতুন রুপে আত্মপ্রকাশ করে, পাঠকের মগজ ও হৃদয়ে নতুন করে রচিত হয় হাজার হাজার সংস্করণ । বিকল্প পঠন আর পঠনের বহুত্ব বদলে দেয় উপন্যাস বা কবিতার বহুবিধ বচনের চরিত্র। যে বচন গুলো নিয়ে লেখক তার লেখায় নিজেও ওয়াকিবহাল থাকে না সেই অবদমিত বচনগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে, ভাষার কংক্রিট রুপটা অক্ষুন্ন রয়ে গিয়ে খুলে যায় নতুন নতুন ভাবনার দ্বার, রচিত হয় সমান্তরাল আখ্যান।

Monday, March 30, 2020

পৃথিবীও পুষিয়ে নিতে জানে !!!

এক অভূতপূর্ব সময়ে এসে দাঁড়িয়েছে পৃথিবী। লাখ লাখ মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত, প্রাণ যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষের। শুধু মহামারী আর মৃত্যুই নয়, প্রকৃতির কাছে এমন সর্বব্যাপী চপেটাঘাতের ঘটনাও মানুষের ইতিহাসে বিরল। অর্থনীতির ইতিহাসেও সবচেয়ে বড় মন্দার মুখে পড়েছে মানুষ। সেই মন্দায় কত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা কল্পনা করা কঠিন, তবে সেটা যে পৃথিবীর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মৌলিক ভিত্তিকে নড়বড়ে করে দেবে সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
মানুষের এই পরিণতি কি অবধারিত ছিল? গত কয়েক শতকে মানুষ পৃথিবীর উপর কতৃত্ব ফলাতে গিয়ে মাটি-পানি-বাতাসকে বিপন্ন করেছে। পরিবেশের কথা না ভেবে উন্মাদের মত অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে, জিডিপির দিকে ছুটেছে। একটা গবেষণা বলছে, প্রতি ১০ লাখ ডলারের জিডিপির জন্য মানুষ বাতাসে ছাড়ে ৫০০ টন সিএফসি (ক্লোরোফ্লোরোকার্বন) গ্যাস। শুধুমাত্র ২০১৯ সালেই ৮ ট্রিলিয়ন ডলারের জিডিপির জন্য মানুষ পৃথিবীর বাতাসে ছেড়েছে প্রায় ৪০ বিলিয়ন টন সিএফসি গ্যাস। কোটি কোটি বছর ধরে গড়ে উঠা ওজোন স্তর ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়েছে মাত্র কয়েক শতকে। মানুষের বিলাসী খাবার, চিকিৎসা আর বিনোদনের লালসার বলি হয়েছে লাখ লাখ পাখি আর বন্যপ্রাণী। বহু বন্যপ্রাণী চিরতরে বিলুপ্ত হয়েছে। বিপন্ন হয়েছে খাদ্যশৃঙ্খল, নষ্ট হয়েছে বাস্তুসংস্থান।
কিন্তু করোনা নামে এক ভাইরাসের টিকে থাকার লড়াইয়ের রেশ ধরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে পৃথিবী। পৃথিবীর উপর, প্রকৃতির উপর মানুষের দখল তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ছে। তথাকথিত ‘উন্নত’ প্রযুক্তি এবং ‘উন্নত’ সভ্যতার মেকি ক্ষমতার মুখোশ খুলে পড়ছে। করোনা কান ধরে বন্ধ করিয়েছে কলকারখানা, গাড়ির চাকা, জাহাজের ইঞ্জিন, থমকে দিয়েছে পার ক্যাপিটা-জিডিপি আর সর্বস্ব দখলের অর্থনীতি। জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানো কমিয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে দলে দলে ‘গর্তে’ ঢুকছে পৃথিবীর ‘শ্রেষ্ঠ’ জীব।
নাসার সম্প্রতি বেশ কিছু স্যাটেলাইট চিত্র প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে কীভাবে সারা বিশ্বের শহরগুলিতে দ্রুত দূষণের পরিমাণ কমছে। সবচেয়ে বেশি কার্বন উৎপাদনকারী ও করোনার উৎপত্তিস্থল চীনের শহরগুলোতে ব্যাপকভাবে বায়ু দূষণ হ্রাস পেয়েছে। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি কোপার্নিকাস সেন্টিনেল স্যাটেলাইটের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানাচ্ছে করোনার প্রভাবে ইতালি ও চীনের আকাশে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কমেছে ৪০-৬০
শতাংশ।
ফিনল্যান্ডের সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি এন্ড ক্লিন এয়ার (CREA) বলছে, ১ মার্চ পর্যন্ত চীনে কার্বন ডাইঅক্সাইডের নির্গমন এক চতুর্থাংশ বা ২০ কোটি টন কমে গেছে, যা ব্রিটেনে এক বছরে নির্গমন হওয়া কার্বন ডাইঅক্সাইডের অর্ধেক। তারা আরও জানিয়েছে, ২২ মার্চ টানা ১৪ ঘণ্টার কারফিউর ফলে ভারতের বাতাসে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের পরিমাণ বসন্তকালে ইতিহাসের সর্বনিম্ম পর্যায়ে নেমে গেছে। রেকর্ড না ভাঙলেও অন্যান্য বিষাক্ত কণার পরিমাণও কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে।
কার্বন-সালফার মুক্ত পৃথিবী যেন বহু শতাব্দী পর একটু নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পেয়েছে। কমছে পানি-মাটি-বায়ু-শব্দ দূষণ। ‘সভ্য’ মানুষের কাছ থেকে পৃথিবীর দখল কেড়ে নিয়ে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে পাখি, সমুদ্রের প্রাণী, বনের প্রাণী ও গাছেদের দখল। অতিষ্ঠ খাল-নদী, বনানী, আকাশ কিছুটা হলেও মুক্তি পেয়েছে। একটু একটু করে ধরণী তার অপূরণীয় ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে।
বহুদিন পরে মানুষশূন্য কক্সবাজার সৈকতে ফিরেছে ডলফিনরা। ব্যস্ত মুম্বইয়ের মেরিন ড্রাইভের দখল নিয়েছে পায়রারা। ইতালির ভেনিসের বিখ্যাত খালগুলিতে স্বচ্ছ জলের দেখা মিলেছে। সেখানে ফিরে এসেছে ডলফিন ও নানা প্রজাতির মাছেরা। ইউরোপজুড়ে ফিরে আসছে হাজার হাজার পাখি। পরিবেশবিদরা বলছেন মানুষের এই অভূতপূর্ব ‘বন্দিদশায়’ পৃথিবীর উষ্ণায়নে কিছুটা হলেও বাধা পড়বে। অন্তত ছয় মাস এভাবে চলতে থাকলে উত্তর-দক্ষিণ মেরুর গলে যাওয়া বরফ আবার জমতে শুরু করবে। পৃথিবী আবার শান্ত হয়ে আসবে। আপাতঃস্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে স্থলচর-জলচর প্রাণীরা। হ্যাঁ, এটা অসম লড়াই নিশ্চয়ই। শীঘ্রই টিকা বা রোগ প্রতিরোধ শক্তিতে করোনাকে ‘জয়’ করবে মানুষ। এই লড়াইয়েরও শেষ হবে। মানুষের জীবন ‘স্বাভাবিক’ হবে। আবার জীবাশ্ম জ্বালানী পুড়বে, কল-কারখানার বর্জ্য-ধোঁয়ায় পানি-বাতাস বিষাক্ত হবে, কার্বনে ছেয়ে যাবে আকাশ। তবে
মানুষ কি এই ধাক্কা থেকে শিক্ষা নিয়ে পৃথিবীর প্রতি কিছুটা হলেও সংযমী হবে? নাকি ‘ক্ষতি’ পুষিয়ে নিতে দ্বিগুণ উদ্যমে নতুন ধংসে মাতবে?

Saturday, March 28, 2020

মুখোশ

ঘুম ভাঙলে প্রথম কোন জিনিসটা টের পায় মানুষ ?
শব্দ পায় মনে হয়। কিছু দেখার আগে কিছু শুনে ঘুমটা ভাঙ্গে। দেখার চেয়ে শোনার সুবিধা বেশি। কারণ চোখের মত, কানের পর্দা খোলার ব্যাপার নাই। কান সদা খোলা। চোখ খোলার পর চোখে কি পড়বে তা নির্ধারিত হয় শোবার ভঙ্গীর উপরে। চিত শুয়ে যার অভ্যাস, সে চোখ খুলে দেখবে ছাদ আর ফ্যান, পাশ ফিরে যার ঘুম ভাঙবে সে দেখবে দেয়াল বা পর্দা আর কিছু ফার্নিচারের কোনাকানা। কিছু মানুষ চোখ খুলেই দেখে বালিশ, চাদর আর নিজের লোলে ভেজা দাগ। তারা জাগে উপ্তা হয়ে ঘুমন্ত অবস্থা থেকে।
         
আমানত উল্লা মিন্টু ঘুম ভাঙলে দেখে মায়াজাল। পাতলা কাঁথার উপর জানালা দিয়ে আসা আলোয়, খুব সুন্দর একটা আলোছায়ার ছবি হয়। আম্মার পুরানা শাড়ি দিয়ে বানানো পাতলা কাঁথা ৭ বছর ব্যাবহারে আরও পাতলা ন্যাতা ন্যাতা হয়ে গেছে। মাথা সহ কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর অভ্যাসের কারণে মিন্টু সকালে সেই কাঁথার ওপর আলো পড়া একটা এক্সরে ছবি দেখে। কাঁথার ভেতর জায়গায় জায়গায় কাপড় ফেঁসে দলা দলা হয়ে যাওয়া, কোথাও পাতলা কাপড়, কোথাও ভারী। প্রতিদিন সকালে এমন আলাদা আলাদা প্যাটার্ন দেখে ঘুম ভাঙ্গে তার।

প্রাকৃতিক নিয়মে সব মানুষ ঘুমায়, সবাই জেগে উঠে। কিন্তু তারতম্য হয় জীবনযাত্রায়। গ্রামের আর শহরের মানুষের ঘুম ভাঙ্গার তত-তরিকা আলাদা। গ্রামের মানুষের ঘুম ভাঙ্গার সঙ্গে সঙ্গেই চাঞ্চল্য শুরু হয় না। কিন্তু শহরের মানুষের হয়। নগরের অর্ধেকের বেশি মানুষের ঘুম ভাঙ্গে, হয় এলার্মে আর না হয় কারো ডাকে। নিজে থেকে জেগে ওঠার ক্ষমতা নগরের ঘুমন্ত মানুষের কমে যায়। নগরকে জাগাতে হয়। গ্রাম নিজেই জেগে উঠে। ভোরের বাতাস, মোরগের ডাক, খুদার্ত অস্থির বাছুরের ঘোতঘোতানি। ঘরের পাশে সংসার শুরু করা ছোট পাখির কিচমিচ এই সব আয়োজনে ঘুম ভাঙ্গে নগরের বাইরের মানুষের। আমানত উল্লা মিন্টু চোখ খুলে কিছুক্ষণ এই সব খোঁজে। লাভ নাই, তার ঘুমানোর জায়গায় এই সব কানে আসে না। বরং তার কানে দলা পাকায়ে ঢুকে পড়ে, পাড়ার ছোট গলিতে মোড় ঘুরানো প্রাইভেট কারের কর্কশ হর্ন বা রিকশার বেল, মুরগী বা সবজী ওয়ালার চিৎকার, কোন দুই মুখ খারাপ ব্যাক্তির ঝগড়া, কখনো বা ছাদের ট্যাংকি উপচে পড়া পানির শব্দ। মুখ থেকে কাঁথা সরায়ে মিন্টু হাত ঘড়ি দেখে। পৌনে আটটা বাজে। মোবাইলে এলার্ম দেয়া থাকে আটটায়। তবে নিয়ম করে মিন্টুর ঘুম কিছুটা আগেই ভাঙ্গে।

নগরে মানুষ বেশি।
যত বেশি মানুষ, তত বেশি স্বকীয়তা খোঁজার চেষ্টা। সবাই যার যার মত স্বকীয়তা পেতে চায়। কোটি মানুষের ভীড়ে নিজেকে আলাদা করার এই রেসের বাইরে কেউ নাই। সকাল হলেই জেগে উঠে নগরীর মুখগুলা। তারপর আবার ঘুমায়ে পড়ার আগ পর্যন্ত তাদের মুখ আড়াল করে ঝুলতে থাকে মুখোশ। মুখ আর মুখোশের মজার একটা আত্মীয়তা আছে। মুখ মানুষটার আয়না। তার ভেতরের সব কিছুকে সামনে এনে দেয়। আর মুখোশ, মুখের ফ্রেম টা ধার করে ভেতরের সব চাপা দিয়ে ফেলে তাতে চাপায় নতুন ছবি। ভেতরের আনন্দ ঢাকা পড়ে যায় ভার চেহারার মুখোশে, কষ্ট লুকিয়ে যায় হাসি মুখোশে।

আমানত উল্লা মিন্টুর মত মানুষের দিন কাটে মুখোশের পর মুখোশ পালটে। সকালে বাথরুমে দরজার সামনে মেসের অন্য রুমমেটদের দাঁড়ানো দেখে মিন্টু মুখে একটা হাসি মুখোশ টাঙ্গিয়ে হালকা রসিকতা করার চেষ্টা করে। যদিও তার মনে তখন খচ খচ করছে গতরাতে দেখা মানিব্যাগে শেষ তিনশ তেপ্পান্ন টাকা। বেতন পেতে এখনো আরও ১১ দিন বাকী।
বাথরুমের দেয়ালে ফ্যাকাসে ছোপ ছোপ ছাতা পড়া আয়নায় তাকায়ে মিন্টু নিজেকে যখন দেখে, তখন সে নিজে বুঝে না, এটা তার মুখ, নাকি মুখোশ। খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে তার চেহারা দেখতে অনেকটা তার বাবার কমবয়সের ছবির মত লাগে। তখন সেটা মুখ মনে হয়। শেভ করার পর সেটা হয়ে যায় "সুইট টপিং" রেস্টুরেন্ট এর সকাল ১১ টা থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত হাসিমুখে ফরমায়েশ নেয়া ওয়েটার এর মুখোশ।
            চাকরী চলে যাওয়া প্রাক্তন বিডিআর সৈনিক বাবার সঙ্গে আমানত উল্লা মিন্টুর স্মৃতি খুব বেশি না। বাবা বছরের ১১ মাসই সীমান্তে পাহারা দিয়েছে সৈনিকের মুখোশ পরে। যদিও মিন্টু জানে, তার বাবার ভেতরে লুকায়ে থাকে একটা রাখাল কিশোর। ছুটিতে একমাস বাড়ি আসলে, বাবা মাঝে মাঝে লাজুক মুখে দুপুর বেলায় পুকুর ঘাটলায় বসে বাঁশী বাজাতো। তখন বাবার মুখ থেকে মুখোশ খুলে পড়তো। ক্লাস টু বা থ্রিতে পড়া মিন্টু তখন বাবার কোলের কাছে, বাবার হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে অসীম মুগ্ধতায় বাবার আদর নিত। সেই আদরের ভাষা নাই। মুখোশের আড়াল নাই। বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে বাবার হাঁটুতে মুখ ঠেকিয়ে বসে আদর নেয়াটা হয় না। অনেক কিছু দিতে না পারার অভিযোগ জমে, অনুযোগ বের হয়ে আসে। দিনে দিনে বাবার মুখে, সৈনিকের মুখোশের মতন আরও অনেক বেমানান মুখোশ চড়ে। সেই ছোটবেলায় মাঝ রাতের ট্রেনে বাড়ি ফেরা বাবা তাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে নিজের বেরেট ক্যাপটা মিন্টুকে পরিয়ে দিয়ে স্যালুট দিত। সেই ক্যাপ পরে মিন্টু মনে মনে নিজেকে বন্দুক চালানো সৈনিক ভাবতো। বলতো "আমি বড় হইলে গুল্লি করুম"। তার বাবা এক গাল হেসে বলতো
" না রে বাবা, তুমি কুট টাই পিন্দা ডিউটিত যাইবা"।
   
           টাই মিন্টু পরে, সাদা হাফ শার্টের সাথে লাল টাই। সাদা শার্টের বুক পকেটের উপর সোনালী প্লেটে কালো হরফে ইংরেজিতে তার নাম লেখা "মিন্টু"। এই পোশাকের উপরে তার ওয়েটারের মুখোশ চেপে বসে। ১২ ঘণ্টা এসি চলা রেস্টুরেন্টে সেই মুখোশে ঘাম হয় না। মুখোশের পেছনে মিন্টু ছোটবেলার দুরন্ত দুপুরে কাটা ঘুড্ডির পিছনে ছুটে ঘেমে নেয়ে উঠে, কানের পাশ দিয়ে ঘামের গড়ায়ে পড়া মিস করে।
সকালের রোদেই ভাপিয়ে ওঠা সিটি বাসে দাঁড়িয়ে, বা কোনো দিন কপাল ভালো থাকলে পাছা ঠেকানোর মত বসার একটু যায়গা পেলে মিন্টু মুখে রাগী-গম্ভীর মুখোশ চাপিয়ে বসে। এই শহরে যেসব জিনিস বাকী নাগরিকদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে হয়, সেসব জিনিসের সামনে সবাই রাগী মুখোশেই থাকে। সেই মুখোশে হঠাত চোখে পড়া ছোট্ট বাচ্চার হাসি দেখে মায়া ঝরে না। হাঁটুর ব্যাথায় কষ্ট পাওয়া ৬৩ বছরের মহিলার জন্য সহমর্মিতা জাগে না। ভীড় বাসে, ঘেমে উঠে মানুষের আলাদা আলাদা গন্ধ গুলা মিলেমিশে গুমোট হয়ে সেই মুখোশে রং দেয়। আরও রাগী আরও গম্ভীর করে তুলে। মুখোশের সঙ্গে মানানসই গলার আওয়াজে কেউ কেউ বাসের কন্ডাক্টারকে ধমক মারে
"ঐ হালারপুত গুতাস ক্যান ? ভাড়া না একবার দিলাম?"

রেস্টুরেন্টে ভরা নগরীর কোনো এক অংশে, অখ্যাত এক রেস্টুরেন্টের ৩ টা টেবিলের দেখভাল করার দায় কাঁধে মাঝারী শ্যামলা, পাঁচ ফুট সাড়ে আট ইঞ্চির ২৭ বছরের যুবক আমানত উল্লা মিন্টু কাজ শুরু করে সকাল সাড়ে দশটায়। বাসের ভেতরের রাগী মুখোশ খুলে, রেস্টুরেন্টের ফ্লোরে ঢুকার সময় মিন্টু মুখে চড়ায় একটা বেচারা মুখোশ। তাতে আত্মবিশ্বাস থাকে না। কোনো অভিব্যাক্তি থাকে না। সেই মুখোশ শুধু পারে, সামনের মানুষের মুখোশের অভিব্যাক্তির বিপরীতে একটা মাপা মেকী হাসি দিতে। সেই হাসি মিন্টুর ঠোটের পেশীতে জন্ম নেয়। সেই হাসিতে তার চোখ অংশ নেয় না, মন অংশ নেয় না। মাপা সেই হাসি ঝুলানো মুখোশের পেছনে কখনো মিন্টু খেপে থাকে, কখনো অপমানিত হয়, কখনো বিরক্ত, হতাশ, কখনো বা খুব অভিমান।

৮ হাজার টাকা বেতন আর অনির্ধারিত অংকের টিপসের এই চাকরী করতে এসে, এই নগরে পা রাখার পর থেকে, নরোত্তমপুরের গনী হাজির বাড়ির মেঝ ছেলে নেয়ামত উল্লার বড় ছেলে আমানত উল্লা মুখোশ জমিয়ে চলেছে। কত কত মুখোশ তার জমছে দিন দিন। মাঝ রাতে মেসে ফেরার পথে গলিতে হেঁটে যাবার সময় টহল পুলিশের সামনে এক মুখোশ, আবার একি জায়গায় সস্তা চাকু হাতে নব্য ইয়াবাখোর ঠেকবাজ তরুণের সামনে অন্য মুখোশ। যদিও দুইবেলাতেই ফলাফল সমান। পকেটে যে কটা টাকা থাকে তা চলে যায়। ২০ টাকা টিপস পাবার হাসি মুখের মুখোশ। তার চেয়ে আলাদা হাসি মুখোশ ১০০ টাকা টিপসে। মাঝে মাঝে কিছু রেগুলার কাস্টমার, রেগুলার নির্দিষ্ট টেবিলে বসে, রেগুলার একই মেনু অর্ডার করার আগে পরিচিত হাসি দিয়ে বলে "ভালো আছেন ?" তখন একটা মুখোশ, যেটা অনেকটাই মিন্টুর মুখের হাসির কাছাকাছি। রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার বাদল ভাই যখন গালাগালি করে, তখন এক ধরনের অপরাধী মুখোশ। আবার টেবিল থেকে এঁটো প্লেট তুলে নেবার সময়, প্লেটে জমানো মুরগীর হাড্ডি যখন হাত কেঁপে টুক করে পড়ে যায় তরুণী কাস্টোমারের কোলে বিছানো জামার উপরে, তখন সঙ্গে থাকা বীর প্রেমিকের হিংস্র বিরক্ত চেহারায় বলা " আরে স্টুপিড নাকি, দেখে কাজ করেন না কেন ?" এর উত্তরে ভিন্ন ধরনের অনুশোচনার মুখোশ। কোনার দিকের টেবিলটায় বিশেষ কিছু কাস্টোমার আসে, তারা অন্তরঙ্গ হয়। তাদের কাছে যাবার সময় এক ধরনের অভিব্যাক্তিহীন মুখোশ, সেই মুখোশে চোখ থাকলেও যেন অন্ধ। সেই মুখোশ যেন দেখেও দেখেনা ছেলেটার একটা হাত লুকিয়ে ব্যাস্ত লিনেনের নীচে, অজ্ঞাতে। সেই মুখোশ দেখেনা তরুণীর ঠোঁটে ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া লিপস্টিকের রং বা তরুণের গালের কাছে সেই রং এর ছোপ। রাতে মেসে খাবার খাবার সময় সবাই মিলে নোংরা রসিকতা হয়। তখন মিন্টুও তাতে যোগ দেয় মুখোশ এঁটে। সেই মুখোশ এক অতৃপ্ত কামুকের। তাতে কথায় গোপনে লালা ঝরে। ৬ তরুণের ঘরে যৌনতার অদৃশ্য কুয়াশা ভাসে। তারা তাদের কথায় ছিঁড়ে খুড়ে ব্যাবচ্ছেদ করে অস্পৃষ্য কোনো যুবতীর। টিউব লাইটের ঘোলা সাদা আলোয় মিন্টুর বিছানায় বা বায়িং হাউসে চাকরি করা ভোলার সুজনের বিছানায় বসে 2 টাকা বোর্ড নাইন কার্ড খেলার আসর। চারজন খেলোয়াড় যার যার মুখে চতুরতার মুখোশ আঁটে। কেউ কাউকে জিততে দিবে না।

        আমানত উল্লা মিন্টু গভীর ঘুমে স্বপ্নে মাঝে মাঝে দেখে,  জুলাই মাসের এক বিকালে অরেঞ্জ জুস আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেতে খেতে বই পড়তে থাকা ছিপছিপে চশমা পরা সেই তরুণীকে। যে তার দিকে তাকিয়ে বলেছিল "আপনার হাসিটা খুব সুইট"।
স্বপ্নে মিন্টু দেখে সেই তরুণীর সামনে বসে আছে সে, তরুণী টান মেরে মেরে তার এক একটা মুখোশ খুলে ফেলছে, আর অভিমানী স্বরে বলছে
"এই হাসি টাও না, না, এইটাও না। তোমার ওই হাসিটা কই ?"
ফেরিওয়ালা মিন্টুর কাঁধে মুখোশের বোঝা, মিন্টু চীৎকার করে বলতে চায় তার হাসিটা তার মুখে, বলা যায় না। তরুণী মুখোশের পর মুখোশ টান মেরে মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিতে থাকে।

... শেষ রাতে নগরীর রাস্তায় পড়ে থাকে নানা রং এর মুখোশ। দিনের আলো ফুটতেই সেই মুখোশ মিলিয়ে যায়... কারা যেন তুলে নিয়ে যায়... মুখে পরে ফেলে...

Friday, March 27, 2020

করোনা দিনযাপন

মড়ক উছিলায় ঘরবন্দী আপনি। স্বজাতি দেখলে আতকায়া উঠেন। ভিতরে করোনা নাই তো? মিডিয়ায় ফেনা তুলেন। বাইত তাহুইন, বাইত তাহুইন। স্টে হোম, স্টে হোম। বাট হাউ ফানি, অনেকের হোম নাই এই শহরে। ভরসা নাই ভাসানচরে। এলাহী ভরসায় তারা ছুটে গ্রামে। গ্রাম যেখানে, হোম সেখানে। এই গণ মুভমেন্টে আপনার রাগ উঠে। হোয়াট দ্য গ্রাম? এত বুঝানোর পরেও অশিক্ষিত গাইয়াগুলা যে কী করে, পিটা ওগো। পিটায়া ছাল তুল অসভ্যগুলার। চাইয়া দ্যাখ, কেমনে পিটা দিতাছে পুলিশ-আর্মি। কত তাদের ক্ষমতা। প্রমাণস্বরূপ ভিডিও শেয়ার দেন। ফলে অনেকে পিটা খায়। পিতার জন্মশতবর্ষে।

করোনার কান নাই। তাই জনস্বার্থে যারা পিটা খায়, তাদের কান্না শুনতে পায় না সে। সে ব্যস্ত তার মলিকিউলার কারবারিতে। তবু আপনি যে ভাইরাস থেকে সভ্য+আশরাফ+বহুকোষী প্রাণী, তা বুঝাইতেও রাগ জারি রাখতে হয়।

কিন্তু কার উপর যে রাগ, বুইঝা উঠেন না। খালি বুঝেন, উপনিবেশ থেইকা মুক্তি নাই। ছিল ব্রিট্রিশ। তার রেপ্লিকা ও হ্যাংওভার। এখন করোনা। করোনা ছোট। সাবান-কোহল দিয়া কচলাইলে সে মইরা যায়। ফলে, করোনার উপর রাগ কইরা মাটিতে ভাত খাইলে তা প্রবাদের অপমান। বড়জোড় করতে পারেন বিরাগ।

তবে রাগ করা যায় সভ্যতার উপর। সে আকারে বেশ বড়। ফলে, বড় রাগ করা জায়েজ। কী আজব এই সভ্যতা, আপনি ভাবেন। মানুষ যত না স্বজাতির জন্য, তার চেয়ে বেশি অ্যান্টিভাইরাস বানাইয়া গেছে কম্পিউটারের জন্য। এখন করোনা সামলাও। রাগে-দুঃখে, পারলে এখনই, ডেটল বা ক্লোরোকুইন খান দুই বেলা। ভাইরাস না মরুক, নিজে তো মইরা বাঁচবেন!

অথবা, ধরেন, মাথায় মার্কিন ক্যারা উঠলে, রাগ উঠে চীনের উপর। চীন নিয়া যত গুজব পান, ছড়ান। যথা, এক, এইটা ল্যাবপ্রসূত; এইটা তাদের জৈবিক অস্ত্র মামলা। দুই, এইটা তাদের বাণিজ্যযুদ্ধের গুপন কৌশল। সারা দুনিয়ায় উহান ভাইরাস ছড়াইয়া, ফাঁকতালে আম্রিকা-ইয়ুরোপের শেয়ার কিন্না, সে নিরোগ হয়। করোনা বিস্তারের এই ন্যারেটিভ বুঝতে হাত পাতেন মিডিয়ায়। পান আখখেচরা সংখ্যা ও পরিসংখ্যা। তাতে রাগ কমে। আবার মিডিয়া দেয় স্বজাতি মরার সংবাদ। তাতে রাগ বাড়ে। সভ্যতা শিখাইছে, রাগ মেদের মতো। তা ঝাড়তে হয়। কার উপর তা ঝাড়বেন?

ইয়েস। সরকার। তার প্রতি আপনার বহুতল প্রতি+আশা। আপনি চান, সে হোক আপনার লোকাল ঈশ্বর। যেহেতু ভোট বা ভ্যাট দিছেন। যেহেতু নগরের নাগর আপনি। ফলে বুকভরা আশা নিয়া শুনেন জাতির উদ্দেশে ভাষণ। শুইনা হতাশ হন। ভাবেন, ইস, বৈশ্বিক এই সমরকালে বেসামরিক যন্ত্রের যাবতীয় গাফিলতির দায় স্বীকার কইরা একবার যদি তিনি, মাত্র একবার যদি তিনি মন থেইকা সরি বলতেন, আপনার স-অ-ব রাগ নাইমা যাইতো। সবাই তাইলে হাতে-হাত-না-মিলাইয়া হু মোতাবেক স্টে হোম করতো। তাতে বাঁইচা যায় ঘরের বুড়া মা-মুরুব্বি-বাপ। বাঁচতো অসুখে ভোগা অসুখী পরিবার। সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস সমাধান। কত সহজে করোনা খেদানো যায় বাকি সবাই ঘরে বইসা থাকলে। ঘরে বইসা কফি লাটে খাইতে খাইতে তা ভাবেন।

কিন্তু চাকরি-ব্যবসা সব লাটে উঠায়া কতকাল ঘরে বইসা থাকতে হবে? হু ন‍ৌজ? মেইবি হু নোজ। তখন চিঠি খসড়া করেন হু বরাবর। হু জানে কচু। সে জানে না আপনার কামাই কেমনে হবে। সে জানে না আগামী মন্দায় আপনার খাওন কে জুটাবে। কথা তার একটাই: এইটা মড়ক। ঘরে মটকা মাইরা থাকতে হবে অনির্দিষ্টকাল। তাইলে স্বাস্থ্যসেবা সামলানো যাবে। কার্ভ ফ্ল্যাট হবে। ইত্যাদি। ফলে হু নিয়া আপনার হুতাশ বাড়ে। বহুকোষী রাগ ফিরা আসে। সভ্যতা শিখাইছে, রাগ মেদের ম...

রাগ কমলে আবার বুঝেন, আপনার লাইগ্যা স্টে হোম অনিবার্য। ফলে ধারদেনা কইরা হইলেও তড়িঘড়ি কিনেন বাড়তি চালডালসাবান। আর অচেনা লোকের দেখাদেখি অচেনা স্যানিটাইজার। ঘরে তো আর অনির্দিষ্টকাল না খাইয়া, হাইগা-হাত-না-ধুইয়া থাকা যায় না। সেইটা অসভ্যতা। সদাই শেষে ফেসবুকে আইসা দেখেন, সভ্যতর লোকেরা এই কিনাকাটার নাম দিছে, প্যানিক বাই। চিরকাল আপনার দৌড় টাটাবাইবাই বা শুচিবাই পর্যন্ত। এই প্যানিক বাই নামের গালি মায়ের জন্মে শুনছেন নাকি, মনে করতে থাকেন আপনি। ফলে আপনি প্যানিক ইটিং শুরু করেন। সাতদিনের খানা তিনদিনে শেষ। আর টেনশন কমাইতে প্যানিক স্মোকিং। সভ্যতা বলে, জনস্বাস্থ্যের পক্ষে তা ক্ষতিকর।

জন ও স্বাস্থ্যের মায়েরে বাপ। খুব তো দেখলেন দুনিয়াজোড়া জনস্বাস্থ্যের সার্কাস, বিশ্বমুরুব্বিদের বাহাদুরি। টাট্টিখানায় হাগতে হাগতে এইসব ভাবেন। হাগায় রাগা কমে। তখন আবিস্কার করেন, পৃথিবীতে টাট্টিখানাই সবচেয়ে ইনক্লুসিভ; আপন; সভ্যতার বড় কেরামত। কারণ, সে বিচার করে না কে অসভ্য আর কে সভ্য। নিজেরে উদাম করা যায়। কান্নাকাটি করা যায়। করোনার মতো সে নির্বিচারে সবাইরে আপন কইরা নিতে পারে।

আপনি আরও টের পান : এই বানায়া তোলা সভ্যতা — যা না শিখলে অপমানিত হন আর "নোংরা অপর" হওয়ার উপলব্ধিতে অপরাধবোধে ভুগেন — সে নিজেই একটা ব-অ-ড় ভাইরাস; প্যারাসাইট। যতই ঘরে বইসা নিরাপদ মনে করেন, আপনারে এই নভেল সভ্যতাভাইরাস রোগে ধরছে। আপনি নিজেই তার বাহক পোষক তোষক যা-তা। এমনকি যাদের উপর আপনার এত রাগ, তারাও একইভাবে সংক্রমিত।

বালের দোহাই, বেয়াদবি মাফ কইরেন, আপনার+স্বজাতির দরকার একটা অসভ্য নভেল অ্যান্টিভাইরাস। যতদিন না পান তারে, সাবান ডলেন। কম খান। আর স্টে হোম। যেহেতু সভ্যতা বলছে, হোমো স্যাপিয়েন্স আপনি।

Thursday, January 9, 2020

ফেসবুক সাহিত্য

মুখস্থ বিদ্যাটা বরাবরের কম। তবুও ক্লাস সেভেনে হেগেমেতে কোনরকমে শক্তির সংজ্ঞাটা মুখস্থ করেছিলাম -- শক্তি অবিনেশ্বর, ইহার সৃষ্টি বা বিনাশ নেই, শক্তি এক শক্তি থেকে অন্য শক্তিতে রূপান্তরিত হয় মাত্র । সংজ্ঞাটিকে এবার ফেসবুকে পোষ্ট করা কোনো আপাত "মৌলিক" লেখার ক্ষেত্রে খাপে খাপে বসিয়ে দেন । ফেসবুকের পোষ্ট করা লেখা অবিনেশ্বর, ইহার সৃষ্টি বা বিনাশ নেই , এক টাইমলাইন থেকে অন্য টাইমলাইনে স্থানান্তরিত হয় মাত্র । ধরুন, আপনি অনেক ভেবে ভেবে আপনার সৃষ্টিশীল স্বত্বা দিয়ে একটি চমৎকার মনোগ্রাহী কিছু লিখলেন । পোষ্টালেন । সেটা এবার আপনার ফ্রেন্ডলিষ্টে থাকা পাঠকের মনে ধরার মতো হলে শেয়ার ও কপিপেষ্ট হতে থাকল । সেই লেখা টাইমলাইন থেকে টাইমলাইন ঘুরতে ঘুরতে সোশাল মিডিয়ার গন্ডী ছাড়িয়ে কোনো বন্ধু মারফত কুম্ভমেলায় হারিয়ে যাওয়া মেজ ছেলের মতো হোয়াটসঅ্যাপ এর চ্যাট গ্রুপে খুঁজে পেলেন । লেখার শেষে ততদিনে "সৌজন্য" ধর্ষিতা হয়ে আপনার নামটাই উবে গেছে, বা শেষ পোষ্টকারী শেষে ছোট্ট একটা হ্যাজ সহযোগে "collected" লিখে রেখেছেন। এতেই আপনাকে সন্তুষ্ট হতে হবে আপনাকে। 'collected' লিখে কিছুটা হলেও কৃপা তো করেছে, সেটাই কম কি!

ফেসবুকে লিখে সমাজ বদলের ভাবনা অনেকাংশেই দূরারোপিত কষ্টকল্পিত কল্পনা । সেটা ফেবু লেখক বিলক্ষন জানেন। তবুও লেখেন। লেখার করুণ বেওয়ারিশ পরিনতির কথা জেনেও লেখেন। কেন ? ঐ যে, লেখার জন্য লেখা, শিল্পের জন্য শিল্প। জীবনমুখীনতায় শিল্পের একমাত্র উদ্দেশ্য হলে লেখক বা শিল্পীকে সমাজকর্মীই বলা হোক, লেখক বা শিল্পী নয়। লেখকের প্রাপ্তি শুধু লেখার আনন্দটুকু। সৃষ্টিসুখের উল্লাস । সৃষ্টির আনন্দের সঙ্গে অন্য কোনো জাগতিক আনন্দের তুলনা করা চলে না । রোঁলা বার্থ যতই লেখকের মৃত্যুর তত্ত্ব শোনান, নিজের সন্তানতূল্য লেখার প্রতি অধিকারবোধ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না কোনো লেখকই, বাৎসল্য রস বলে একটা জিনিস আছে তো নাকি ! ঠিক যেমন পিতা নিজ সন্তানের দন্ত বিগলিত হাসি আর অস্ফুট কথায় যারপরনাই পুলকিত ও আহ্লাদিত হন, তেমনি ফেবু লেখক নিজের পুরোনো লেখাও অবসর সময়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পড়েন , পুনঃপুনঃ সৃষ্টির আনন্দ তাঁকে তুষ্ট করে । সেই আনন্দ ও ভাবনা শেয়ার করতেই ফেসবুকে পোষ্টানোর বাসনা জাগে । কিন্তু, সন্তানতূল্য নান্দনিক সৃষ্টি যদি অন্য কেউ অপহরণ করে নিজের সন্তান বলে চালায়, তাহলে?   বেদনাদায়ক তো বটেই।

কিন্তু, দুঃখ পাবেন না । ভার্চুয়াল দুনিয়ার হার্ডকোর বাস্তবতা, না মেনে উপায় নেই । ভারচুয়ালি চেঁচিয়েও কোনো লাভ নেই । তার থেকে বরং এক কাজ করুন, ক্লাস সেভেনে পড়া শক্তির সংজ্ঞাটা টাইমলাইনের পোষ্টে বসিয়ে সকাল দুপুর জপ করুন । সঙ্গে, একটা সান্ত্বনা বাক্য মনে গেঁথে নেবেন -- নিজের লেখা (ধরুন কবিতা) শেষ করে ফেসবুকে পোষ্ট করার সাথে সাথে সেটা আর আপনার সম্পত্তি থাকে না, ফেসবুকের পাঠক আর সমালোচকের জিম্মায় চলে যায় । লেখক যদি পোষ্টের কমেন্ট বক্সে তার উপস্থিতি ক্ষনে ক্ষনে জানান দিতে থাকেন এবং পাঠক বা সমালোচকদের সঙ্গে সমালোচনায় অংশগ্রহন করতে থাকেন তাহলে সেই কবিতার বচন বহুমাত্রিকতার বদলে একমাত্রিক হিসাবে চলতে শুরু করবে । অর্থ সংকুচিত হয়ে লেখকের ব্যক্তিজীবনের চারদিকে ঘুরঘুর করবে । আপনার কষ্ট লাঘব হবে যদি আপনি "খুব ভাল হয়েছে" বা "দারুন লিখেছেন" জাতীয় স্তুতি বাক্য সযত্নে এড়িয়ে যেতে পারেন। আপনার লেখা কবিতাটিকে খাঁচায় বন্দি না রেখে বরং ছেড়ে দেন মুক্ত বিহঙ্গের মতো। উড়তে দেন নিজের মতো করে । এরপরেও কেউ যদি সেটাকে নিজের সম্পত্তি বলে কেউ চালায় তবে সেটা তার নৈতিক দৈনতা, আপনার নয় । লেখাটিকে নিজের খাঁচাবন্দী সম্পত্তি ভাববেন না। ভাবলে কষ্ট পাবেন।

আর একটি কথা মনে রাখবেন, আপনার সৃজনাত্মক আপাত "মৌলিক" লেখাটা মৌলিক মনে হলেও সেটা মৌলিক নয়, মৌলিকের মতো । বস্তুতঃ বিশ্বের কোনো সৃজনশীল লেখাই আগমার্কা "মৌলিক" নয়, আপনি জানেন। সবটাই ভাষার মোচড় আর ব্যবহারের খেলা । ভাষাই মূখ্য প্রতিবাদক, লেখকের ভূমিকা গৌন । লেখক বা একজন টাইপিষ্ট, যে ভাবনা গুলো প্রাথমিক অনুকরণ করে টাইপ করে মাত্র ।  ভাষার বাইরে তাই লেখকের সেভাবে কোনো অস্তিত্ব নেই । কবি বা সাহিত্যিক কেবল জানেন ভাষা সাজিয়ে গুছিয়ে, দুমড়েমুচড়ে কিভাবে কথ্য ও সাধারণ কথোপকথনের ভাষা থেকে বিপরিচিতিকরন করা যায়। আমাদের বস্তুজগতকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিই পাল্টে দিতে পারে লেখকের লেখনি বা কবির কবিসত্ত্বা। সাহিত্যিক বা কবির এই লেখনি সত্তা বা লেখায় সাহিত্যিক বা কবির জন্ম দেয়, উল্টোটা নয়  । কবি ও কবিমানসকে গুলিয়ে ফেলার বিদঘুটে প্রবনতা আমাদের মধ্যে আবহমান কাল ধরে বিদ্যমান । কিন্তু কবি বা লেখকের ব্যক্তিসত্তা থেকে দূরে কবি বা লেখক হল সামাজসাংস্কৃতিক আদল ও ঐতিহাসিক বচনে নির্মিত একটি সত্ত্বা। যার সঙ্গে লেপটে থাকে কবি বা লেখকের নান্দনিক বোধ ও প্রাক্ষোভিক বুদ্ধি । লেখকসত্ত্বা বা কবিসত্ত্বা কখনই সমাজ ও সাংস্কৃতিক কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।

লেখার আগে সব লেখক বা কবি গর্ভবতী মায়ের মতো প্রসববেদনা অনুভব করেন । মাথার মধ্যে থাকা একগুচ্ছ ভাবনা কেঁচোর মতো কিলবিল করে। ভাবনা গুলো বেরিয়ে আসতে চাই । লেখ্যরুপেই ভাবনার মুক্তি, ভাবনার মুক্তিতেই সৃষ্টির আনন্দ । লেখ্যরুপের মধ্য দিয়ে ভাবনার মুক্তির পরেও লেখক লেখার সঙ্গে নাড়ীর টান অনুভব করেন । সন্তানের প্রতি মায়ের যেমন তীব্র অধিকারবোধ থাকে তেমন লেখার প্রতি লেখকেরও । তাই সেই লেখার নেতিবাচক সমালোচনা বা আঁচড় লেখক বা কবির কাছে অসহিষ্ণু মনে হয় । নাড়ীর যোগ না কাটলে লেখার বহুত্ব , বহুবাচনিকতা বা বহুমাত্রিকতা রুদ্ধ হয়, সাহিত্য সমালোচনা ও চর্চার ক্ষেত্রেও সেটা বাধাস্বরুপ । এই প্রসংঙ্গে মনে পড়ছে কয়েক বছর আগে দেখা একটা ফরাসী সিনেমা - রুবি স্পার্কস । সেরকম গতেবাঁধা একরৈখিক গল্প এখানে না থাকলেও বিষয়বস্তু ভারী অদ্ভুত । কেন্দ্রীয় চরিত্র কেলভিন বছর কুড়ির ধারেপাশের একজন তরুন ঔপন্যাসিক । সে "রাইটার্স ব্লকে" আক্রান্ত (সৃষ্টিশীলতায় লেখকের কোষ্ঠকাঠিন্যের পর্যায় আর কি)। সাইকোলজিষ্ট দেখিয়েও সুরাহা হয় নি । পরে স্বপ্নে দেখা স্বপ্নপরী রুবিই তাঁর উপন্যাসের নায়িকা হয় । উপন্যাসে রুবির চরিত্র নির্মান করতে গিয়ে ঔপনাসিক নিজে তাঁরই তৈরি করা চরিত্র রুবির প্রেমে পড়ে যান । লেখাকে মুক্তি দেওয়া তো দূরের কথা, লেখক নিজেই গল্পের ফ্রেমে ঢুকে গল্পের নায়িকার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে গল্পের গতিপথকে প্রভাবিত করতে থাকেন ।

যাই হোক, এবার ফেসবুকের কথায় যদি ধরি, যারা ফেসবুকে লিখছে তারা ভিন্ন ভিন্ন সমাজ ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল থেকে উঠে এসেছে, এবং সেই বিশেষ সমাজ ও সংস্কৃতিভিত্তিক চিন্তাপ্রণালী বা ভাবাদর্শ আইডিওলজি) অবচেতনভাবেই মাথায় গেঁথে থাকে । প্রাক সোশালমিডিয়া বা তারও আগে বিশ্বায়নপূর্ব যুগে কবি বা লেখকের মগজে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ভাবনার মেলবন্ধন হত, কিন্তু তার গতি ছিল খুব মন্থর । সোশাল মিডিয়ার যুগে যেখানে বিভিন্ন রকম বচন ও প্রতিবচন, ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিগত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভাবনা একঘাটে সকাল বিকাল জল খায় সেরকম একটি পরিমন্ডলে লেখক বা কবির মগজে ভিন্ন ভিন্ন সামজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র থেকে আসা ভাবনাগুলো খুব দ্রুত মিথোস্ক্রীয়া ঘটায় । যাদের লেখা লেখক বা কবি পড়েন তাদের ভাষা ও ভাবনার সঙ্গে লেখকের ভাবনা ভাবাবেগ বিক্রিয়াসদৃশ জারিত হয়ে নতুন ভাবনার সংশ্লেষ হয়, ঠুনকো প্রেষনায় সেই ভাবনা গুলো ঠেলে বেরিয়ে আসে লেখার আদলে । তাই লেখক বা কবির লেখায় ঐ সবকিছুর অদৃশ্য ছায়া পড়তে বাধ্য । কাঠামো তাত্ত্বিকরা তাই বলেন যেকোনো পাঠই অসংখ্য সমাজ ও সংস্কৃতি থেকে আসা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বচনের সমাহার, তাই কোনো লেখাই আপাদমস্তক মৌলিকতা দাবি করতে পারে না । আবার ঐ পাঠ যখন আইডিওলজির ও প্রজন্ম ভেদে পাঠকের কাছে পৌঁছায় তখন লেখায় ভাসমান বচন গুলোর রং রুপ বদলে নতুন রুপে আত্মপ্রকাশ করে, পাঠকের মগজ ও হৃদয়ে নতুন করে রচিত হয় হাজার হাজার সংস্করণ । বিকল্প পঠন আর পঠনের বহুত্ব বদলে দেয় উপন্যাস বা কবিতার বহুবিধ বচনের চরিত্র। যে বচন গুলো নিয়ে লেখক তার লেখায় নিজেও ওয়াকিবহাল থাকে না সেই অবদমিত বচনগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে, ভাষার কংক্রিট রুপটা অক্ষুন্ন রয়ে গিয়ে খুলে যায় নতুন নতুন ভাবনার দ্বার, রচিত হয় সমান্তরাল আখ্যান।

শাস্তিই কি ধর্ষন রোধের সঠিক পন্থা?

যেকোন নারকীয় ধর্ষন সংবাদ মাধ্যমের থ্রু দিয়ে সামনে আসার পর নাগরিক হিসাবে আমাদের একটা ঈমানি দায়িত্ব থাকে। দায়িত্বটা হল অভিযুক্ত ধর্ষকের কঠোরতম শাস্তির দাবি করা। কঠোরতম শাস্তি বলতে কারোর কাছে মৃত্যুদন্ড। কেউ একটু এগিয়ে ধর্ষকের পুরুষাঙ্গ কেটে নেওয়ার কথা বলে। আবার কেউ আরও একটু এগিয়ে ধর্ষককে কুচিকুচি করে কেটে নুনলঙ্কা মাখানোর বিধান দেন । দিন কয়েক আগে একটা গ্রুপে দেখলাম একজন অতি দরদী নাগরিক বলেছে " শ্লা রেপিষ্টের মা বোনকে রেপ করা হোক, তবেই রেপিষ্ট বুঝবে জ্বালা"। ধর্ষনের বিরুদ্ধে কঠোর 'প্রতিবাদ' করতে গিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই ধর্ষনের সংস্কৃতিকে শীলমোহর দেওয়া। যে বা যারা এমন বলছে তাদেরও মনমানসিকতার ব্যবচ্ছেদ দরকার নয় কি? ঘুরিয়ে রেপের কথা যারা বলে তারাও পোটেন্সিয়াল রেপিষ্ট। ধর্ষনবিরোধী বয়ানের ধারা এমন যে আমি ধর্ষকের যত নৃশংস শাস্তির দাবি তুলতে পারব তত বেশি বেশি করে আমি ধর্ষিতার প্রতি 'দরদী'। ধর্ষনের বদলা ধর্ষন দিয়ে দেশের অতি সুনাগরিক হওয়ার প্রানপন চেষ্টা।
যে নারীকে আমরা সুরক্ষা দিতে পারলাম না, ঘটনার পর ধর্ষকের কঠোরতম শাস্তির দাবি করে নিজেদের অক্ষমতা ঢাকতে চাই আমরা। এরপর তার 'আত্মাকে' বিচার পাইয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগি সেই আমরাই । বাহ বিবেক! একটা কথা বলবেন? কঠোর শাস্তিই কি সব ? এটা কোনো প্যানাসিয়া? ডেথ পেনাল্টি চালু হলেই তার পরের দিন থেকে নৃশংস হত্যা আর ঘটবে না ? আপনি বা আমি বুকে হাত দিয়ে জোর গলায় একথা বলতে পারব? আগেওতো দেখেছিলাম, গোটা দেশ জুড়ে প্রতিবাদের স্বর ভেসে উঠেছিল। ক্ষোভের আগুনে ফুঁসতে থাকা ছাত্রছাত্রীরা নেমেছিল রাস্তায়। সেবারেও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে একই রকমের জনরোষ। একইরকম কঠোরতম শাস্তিবিধানের বয়ান। অনেকেই ভেবেছিলেন এই বুঝি শেষ, আর বোধ হয় আমাদের বোনেদের অসহায়ত্ব কেউ খাবলে খেতে পারবে না।
কিন্তু তাই কি? তারপরেও সমপরিমান নৃসংসতা ঘটল। আমরা পরখ করেছি। আটকাতে পারি নি। পূর্বতন অপরাধীদের কঠোর শাস্তির বয়ান পারে নি। নৃসংসতার পর অপরাধীকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হলে আমরা আশ্বস্ত হয়ে যাব যেন কাল থেকে কন্যাশিশুদের উপর যৌন নির্যতনের ঘটনা আর ঘটবে না। নুসরাতের ঘটনার পরও মোমবাতি মিছিলে বেরিয়ে ছিল। কিন্তু মোমবাতির আগুন বেঁচে থাকে না, নিভে যায়। তারপরেও একের পর এক নৃশংসতা আমাদের বিবেককে চাগিয়েছে। আবারও কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়েছি সেই আমরাই । দাবি সময়ের নিয়ম মেনে আবার নিভেও গেছে। কঠোর শাস্তির মধ্যে যে আসল সমাধান সুত্র লুকিয়ে নেই, এই বিচারবোধটা আমাদের অধিকাংশের এখনও আসে নি। সমস্যার শিকড় অন্য জায়গায়। সেটা যাতে আমরা ধরতে না পারি তাই জনরোষ কঠোর শাস্তিবিধানের ফোকাসে আটকে রাখা হয়। রাষ্ট্রকর্তৃক এহেন শাস্তির বিধান আদতে প্রতিবন্ধক হিসাবে কাজ করে। এতে করে সাময়িক জনরোষ চেপে দিয়ে সহজেই মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া যায়। রাষ্ট্রও নিশ্চিন্তে নিদ্রা যায়।
শেক্সপিয়ারের "মেজার ফর মেজার" এ ইসাবেলার কথা মনে আছে? তার ভাই ছিল ক্লদিও। সেই ক্লদিও ছিল ব্যাভিচারে অভিযুক্ত। ডিউক অব ভিসেন্টোর থেকে রাজ্যচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত অ্যাঞ্জেলো তার বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদন্ড দিতে বদ্ধপরিকর। ইসাবেলা অ্যাঞ্জেলোর কাছে ভাইয়ের প্রানভিক্ষা চাই। তার রূপজ মোহে কামাতুর হয়ে পড়ে অ্যাঞ্জেলো । অ্যাঞ্জেলো বলে যে ইসাবেলা যদি তার কামনার আগুন নেভায় তবে তিনি ক্লদিওকে ছেড়ে দেবেন। ইসাবেলা রাজি হয় নি । ইসাবেলা রাগে ক্ষোভে দুঃখে ঘৃনায় পালিয়ে আসে। ইসাবেলা অ্যাঞ্জেলোর কুপ্রস্তাবের কথা তাঁর বন্দী ভাইকে গিয়ে জানায়। ক্লদিও নিজের প্রানের ভয়ে বোনকে কুপ্রস্তাবে রাজি হয়ে যেতে বলে। ইসাবেলা রাজি হয় নি। নিজের ভাই এর জীবনের থেকেও তার সতীত্ব অনেক বড়। শুধু তৎকালীন ব্রিটিশ সমাজ বলে নয় আমাদের সমাজেও এই যে "সতীত্ব" এবং তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা "মর্যদা" মানুষের জীবনের থেকেও বেশি মূল্য পায়। সতীত্বকে অতিমাত্রায় মূল্যায়িত করা হয় বলেই নারী নিরাপত্তাহীনতাই ভোগে। পুরুষের ভূমিকা হয়ে দাঁড়ায় হয় আক্রমনকারী কিংবা রক্ষাকর্তার, সেটাও নারীর সতীত্বকে ঘিরেই। এই সম্ভ্রম ব্যপারটা ব্যক্তিনারীর পরিসর ছাড়িয়ে অনেক ক্ষেত্রেই জাতির মর্যাদায় পর্যবসিত হয়। যেন নারীর দু'পায়ের মাঝখানে গোটা জাতির সম্মান নিহিত, যেমন রাজপুত নারীর জহরব্রত।
কড়া শাস্তিতে সমাধান সুত্র খোঁজার আগে আমাদের 'ধর্ষন' সম্পর্কীয় ধারনার পরিবর্তন হওয়া দরকার। 'ধর্ষন' আদতে একটি ঘৃন্য শারীরিক আক্রমন। যিনি আক্রমন করেন তিনি আক্রমনকারী এবং যার উপর আক্রমন হয় তিনি আক্রান্ত। কিন্তু আমরা 'ধর্ষন', 'ধর্ষক', 'ধর্ষিতা' এই সব শব্দ ব্যবহার করে আক্রান্তের উপর সতীত্ব, সম্ভ্রম ও মর্যদার বোঝ চাপিয়ে দিই। যে কারনে আক্রান্ত মহিলা বাকি জীবনটা সেই 'লজ্জা' বয়ে বেড়ান। ঠিক সেই কারনেই ধর্ষিতাকে অহরহ শুনতে হয় "মেয়েটার সব্বোনাশ হয়ে গেল গো"। এই মধ্যযুগীয় ভাবনাটাই ক্লিশে এবং নোংরা। সে ক্যামেরায় মুখ দেখায় না এই চাপানো 'লজ্জা' থেকেই। একজন 'ধর্ষিতা' নারী যে শুধু একবারই ধর্ষনের শিকার হয় তা নয়; পাড়াপ্রতিবেশীর কথাবার্তায়, মিডিয়ায়, বুদ্ধিজীবির আলোচনায়, রকের আড্ডায় সে বারংবার 'ধর্ষিতা' হয়। সামাজিকভাবে আমাদের উচিৎ এই ধর্ষন সম্পর্কীয় ধারনার বিনির্মান। আক্রান্ত নারী কেন লজ্জা নিয়ে বাঁচবে? লজ্জা তো তার না, লজ্জাটা সমাজের। বরং সেই লজ্জাটা শুধু তোলা থাক ঐ কামুক ধর্ষকের জন্য। 'ধর্ষিতা' শব্দের বদলে ব্যবহার হোক "আক্রমন উত্তীর্ণা"। 'ধর্ষিতা' শব্দটিই নারীকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে, তাই এই ঘৃন্য শব্দের অবলুপ্তি দরকার। আক্রান্ত নারীর ছবি ঠিকুজীকুষ্ঠি উদ্ধার আর নয়, বরং আক্রমনকারীর ছবি ও ঠিকুজীকুষ্ঠি সামনে আসুক। লজ্জাটা আক্রান্তের হাত থেকে ফিরে দেওয়া হোক আক্রমনকারীকে।
আক্রমনকারী ও আক্রান্তের সম্পর্ক যেমন ক্ষমতার, তেমনি ধর্ষক ও ধর্ষিতার সম্পর্কও ক্ষমতার। লক্ষ্য করে দেখবেন, কেবল অসহায় একা নারীকেই আক্রমনকারী কামনাজাত শারীরিক আক্রমন করতে উদ্যত হয়। দলের মধ্যে থাকা বিশেষ কোন নারীর উপর আক্রমন শানাতে আক্রমনকারীর কিন্তু সাহস হয় না। আবার এই 'ধর্ষন' কখনও পাল্টা প্রতিশোধ, কখনও আবার রাজনৈতিক অস্ত্র। ধর্ষনের সঙ্গে মানসম্মানের প্রশ্ন সামাজিকভাবে জড়িয়ে দেওয়া হয় বলেই এই প্রবনতা গুলো দেখা যায়। যেকোন যুদ্ধ বিগ্রহে বা বীভৎস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হাজার হাজার 'ধর্ষনের' ঘটনা ঘটে ঠিক এই কারনেই। এখানে 'ধর্ষক' যেন বিজয়ী, আর যাকে 'ধর্ষন' করা হল সে যেন পরাজিত। আমরা অবচেতনভাবেই এই বদ্ধমূল ধারনা লালন করি, তাই জয়-পরাজয়ের প্রশ্নে অবলীলায় যথেচ্ছাকারে রেপ রেটোরিক ব্যবহার করি। আর্জেন্টিনা ব্রাজিলকে হারিয়ে দিলে আর্জেন্টিনার বাঙালী সমর্থক বলে, "আর্জেন্টিনা ব্রাজিলকে পুরো চু* দিল রে"। এই ধরনের রেপ রেটোরিকগুলো এবার বন্ধ হওয়া উচিৎ। 'ধর্ষন' সম্পর্কীয় এই ধরনের মানসিক গঠনের নির্মান একদিনের নয়, স্মরনাতীত কাল ধরে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিক সমাজেরই ফসল। আর আছে আধুনিকতার খোলস পরা পুঁজিবাদী মানসিকতা যা নারী শরীরকে পন্যায়িত করে নারীকে আরো বেশি করে ভোগ্যবস্তু ভাবার মানসিকতাকে পোক্ত করছে।
বর্তমানে ধর্ষনে সাজাপ্রাপ্ত আসামীর মনমানসিকতা নিয়ে বিস্তর গবেষনা শুরু হয়েছে। এরা ছোট থেকেই নারী এবং নারী শরীরের প্রতি তীব্র ঘৃনা নিয়ে বড় হয়। একদিকে নারী শরীরের প্রতি উদগ্র কামজ বাসনা, আর অন্যদিকে তীব্র ঘৃনার মিশ্রিত সাইকোসিস। আমাদের সমাজ ধর্ষনের মতো অপরাধ নির্মূল করতে কঠোর শাস্তিবিধান বা নারীদের নানারকম রক্ষাকবচ দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু এই সামাজে যাতে ধর্ষকের জন্ম না হয় সেদিকে ফোকাস নেই বললেই চলে। এহেন অপরাধ থেকে নিস্তারের আসল চাবিকাঠি বিচারব্যবস্থার হাতে নেই, আছে আপনার আমার হাতে। আপনার নিজের কন্যাসন্তান রাস্তায় বেরোলে সুরক্ষিত কি না সেটা আপনার চিন্তার বিষয়, পাশাপাশি আপনার এটাও চিন্তার বিষয় হওয়া উচিৎ আপনার ছেলে ভবিষ্যতে ধর্ষকে পরিনত হবে না তো? কারন ধর্ষক ও তার ধর্ষন মানসিকতা এই সমাজেরই বাইপ্রোডাক্ট। আপনার ছেলের মানসিকতাও সেই ভাবে গড়ে উঠতেই পারে। একটি পরিবারে নারীদের প্রতি ধ্যানধারনা কেমন, অ্যাটিচিউড কেমন এবং নারী সম্পর্কীয় ষ্টিরিয়োটাইপ এসবই শিশুমনে দাগ কাটে। পুত্রসন্তান যদি দেখে কথায় কথায় তার বাড়ির পুরুষ অভিভাবকেরা তার মাকে ছোট করছে তাহলে সে নিজেকে শিখিয়ে নেবে যে নারীদের এভাবেই ছোট করতে হয়। মা'কে ধমকে কথা বলতে হয় তবেই পুরুষত্ব বজায় থাকে। তাই বলি, বাড়ির বাইরের নারীদের কথা পরে হবে, আগে নিজের বাড়ির নারীদের প্রতি সম্মান দিয়ে কথা বলুন। ছেলে দেখবেন সম্মান দেওয়ার ব্যাপারটায় আপনাকেই অনুকরন করছে। আমাদের ধর্মসামাজিক ভাবনায় নারী কখনও 'দেবী' কখনও 'দানবী'। নারীকে ষ্টিরিয়োটাইপিক 'দেবী' বা 'দানবী' ভাবাটা সেক্সিষ্ট মেলগেজ। ছেলেকে শেখান নারীকে মানুষ হিসাবেই সম্মান দিতে। সম্মান মানে এই নয় যে তাকে 'দেবী' বা 'জান্নাত' ভেবে কেত্তার্থ করতে হবে। নারী ভিনগ্রহ থেকে আসে নি, সে মানুষই। তাই ভাবী প্রজন্মের দরকার নারীকে পর্যাপ্ত সম্মান দেওয়ার শিক্ষা, মানুষকে মানুষ হিসাবে মর্যাদা দেওয়ার শিক্ষা।