Sunday, June 28, 2020

নেটফ্লিক্সের অশ্বডিম্ব

নেটফ্লিক্সে বুলবুল বলে এক সিনেমা নাকি আলোড়ন ফেলেছে। অনুরাগ কাশ্যপ বলেছেন এই শতকের সেরা সিনেমা। উনবিংশ শতকের বাঙালির গপ্পো বলে উৎসাহিত হয়ে দেখে ফেলা গেল। কিন্তু খুলে যা দেখা গেল, তা হল প্রচন্ড পলিটিকালি কারেক্ট একটি অশ্বডিম্ব। ইদানিং কালে বিন্দুমাত্র চিন্তাভাবনা পড়াশুনো বা সৃষ্টিশীলতার চূড়ান্ত অভাবকে ঢাকতে একটা চড়া দাগের যাহোক 'সঠিক' কথাকে হাঁইমাই করে তীব্র চিৎকার সহকারে জোর গলায় বলতে পারাকেই 'শিল্প' বলে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। এই উচ্চমার্গের 'প্রগতিশীলতা'র বেশ কিছু খদ্দেরও আছেন, ফলে চলছেও ভালই, ব্যবসাপাতিও নিশ্চয়ই ভালই হচ্ছে। সেই ঘরনার একটি নিখুঁত উদাহরণ হল এই সিনেমা।

সেই কারণেই কলম বাগিয়ে এটা লিখতে বসা। নইলে এই সিনেমার রিভিউ করা পন্ডশ্রম। ইতিহাস, ভূগোল সবকিছুকে গোল্লায় পাঠিয়েও কীকরে 'প্রগতিশীল' এবং হিট ছবি বানানো হয় এবং হয়েছে, সেইটুকুই এখানে দেখা হয়েছে। আর অন্য কিছু এই লেখার উদ্দেশ্য নয়।

তো, কাজের কথায় আসা যাক। সিনেমার পটভূমি ১৮৮১ সালের। গোড়াতেই জ্বলজ্বল করে লেখা আছে বলে জানা গেল। একদম গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত দেখা গেল কোনো এক অজ জঙ্গলের জমিদারবাড়ি। সেখানে উনবিংশ শতকের বাঙালি জমিদার কলার দেওয়া পাঞ্জাবি পরে ঘুরছেন। সেই ১৮৮১ সালে। রবীন্দ্রনাথের তখন সবে দাড়ি গজিয়েছে, বছর কুড়ি বয়স, বিদ্যেসাগর তখনও বেঁচে। সেই আমলে কলার দেওয়া পাঞ্জাবি? সেসব তখনও আবিষ্কার হয়নি, বঙ্গীয় পুংদের আটপৌরে পোশাক ছিল ঊর্ধ্বাঙ্গে উড়নি (বিদ্যাসাগরের বিখ্যাত পোট্রেটটি মনে করুন), আর জমকালো পোশাক বলতে ছিল চোগা-চাপকান (এবার বঙ্কিমচন্দ্রের বিখ্যাত পোট্রেটটি স্মরণ করুন), শহরে শার্ট-আর-ধুতিও চালু হয়ে গিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু কলার দেওয়া পাঞ্জাবি? ওরে বাবা। পরিচালক বা চিত্রনাট্যকার বা শিল্পনির্দেশক সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র খবর রাখার প্রয়োজন বোধ করেননি, বোঝা গেল। মেয়েদের পোশাকের খবরটা অন্তত রাখা উচিত ছিল, নারী নিয়েই যখন এত বক্তব্য। কিন্তু সিনেমায় গুষ্টিশুদ্ধ মেয়েদের দিব্যি দেখা গেল হয় ফুলফুল হাতা, কিংবা এমনি ছোটোহাতা ব্লাউজ পরে। যেন চারুলতার দৃশ্য। চারুলতা থেকে সিনেমাটি যে প্রচুর 'অনুপ্রাণিত', সে অবশ্য নায়িকার হাসি, চাউনি দেখেও বোঝা যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল চারুলতা নেহাৎই শহুরে ঘটনা, সত্যজিৎ বাবু সেসময়ের পোশাক নিয়ে বিস্তর রিসার্চ করেছিলেন, কিন্তু দুঃখের বিষয় ১৮৮০-১৮৯০-১৯০০ -- এই সময়কালের গাঁয়ের মেয়েদের পোশাক নিয়ে রিসার্চটা বুলবুলের হয়ে করে দেননি। খুব বেশি রিসার্চ করারও দরকার নেই, বাংলার ইতিহাস যাঁরা একটুও পড়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানেন, যে, বাংলায় শাড়ি পরা হত কোনো ব্লাউজ বা সায়া ছাড়া। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ওই দুইয়ের প্রচলন করেন, শেমিজ নামক একটি বস্তু আবিষ্কার করে। তিনি কলকাতায় ফেরেন ওই ১৮৮০ সাল নাগাদ, তারপর প্রাথমিক ভাবে স্রেফ ব্রাহ্মসমাজের মহিলাদের মধ্যে এর চল শুরু হয়। শহুরে আলোকপ্রাপ্ত মহিলারাও পরতে শুরু করেন। তারই ফল চারুলতার পোশাক। শুধু বাঙালি নারী ব্লাউজ পরেছে বললে পুরোটা বলা হবে না, বাঙালি বিধবা পর্যন্ত ব্লাউজ পরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সিনেমা জুড়ে! কিন্তু সুদূর গ্রামে ১৮৮০-৯০ সালে মহিলারা শাড়ি-ব্লাউজ পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, এ খুবই কষ্টকল্পনা। বস্তুত সেই সময়ের জমিদার মেয়েদের পোশাক নিয়ে আলাদা একটা রিসার্চেরই দরকার, সে এঁয়ারা করেননি, স্রেফ চারুলতা থেকে কপি মেরেছেন, সে বোঝাই যাচ্ছে।

এর চেয়েও প্রলয়ঙ্কর হল গানের ব্যবহার। সহনায়িকা এখানে গুণগুণ করে গায় রবিবাবুর গান। মোটামুটি ১৮৯৫ সাল নাগাদ। কী গান? সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে। যে গান লেখা হবে এর বছর তিরিশেক পরে। বাঙালি হলেই একটু রবীন্দ্রনাথের পাঞ্চ দিতেই হবে, বাঙালি রবীন্দ্রনাথের জন্মের আগে থেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়, এ তো জানা কথা। যেকোনো দিন পলাশীর যুদ্ধের দৃশ্যায়নেও সিরাজদৌল্লাকে 'ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে' গুণগুণ করতে দেখা যেতে পারে। বলিউডি ওয়েবসিরিজ/সিনেমার কারবার বলে কথা। এর আগে একটি সিরিজে দেখা গিয়েছিল বাঙালি নায়িকা সঙ্গমকালে 'শেষের কবিতা' থেকে আবৃত্তি করে। বলিউডি প্রযোজক-পরিচালকদের নির্ঘাত ধারণা ওতেই বাঙালির অর্গ্যাজম। একে বলিউডি জিকের পরাকাষ্ঠা বলা যেতে পারে। ওঁদের জিজ্ঞাসা করলে হয়তো এও বলবেন, যে, আশা ভোঁসলেকে উদ্দেশ্য করেই রবিবাবু 'বড় আশা করে' গানটি রচনা করেছিলেন।

তা, এ তো গেল বলিউডের রবীন্দ্রচর্চা। এছাড়াও আরেকটি দ্বিতীয় গান সিনেমায় ব্যবহৃত। সে হল 'কলঙ্কিনী রাধা'। এর উৎস নিশ্চিত করে জানা যায়না, রাধারমণ দত্তর লেখা হলে পুরোনো, কিন্তু শাহ আবদুল করিমের রচনা হলে অনেক পরে লেখা। সিনেমার সময়কালে ব্যবহার করা যায়না। কিন্তু ওসব নিয়ে কে আর কী ভাববে, একটা পপুলার গান পেয়েছি, লেঃ সালা ব্যবহার করে দি, এই তো অ্যাটিটিউড। তাও রক্ষে, কোনো চরিত্র 'বঙ্গাল কি মিট্টি বাঙ্গাল কি পানি' গেয়ে বসেনি। হ্যাঁ হিন্দিতে। কারণ এই সিনেমা দেখে নিশ্চিত ভাবে জানা গেল গ্রাম বাংলায় ১৮৮০-১৯০০ সালে সব্বাই হিন্দিতে কথা বলত তো বটেই এমনকি গপ্পো টপ্পোও লিখত দেবনাগরীতে। বড় বড় অক্ষরে এই সিনেমার অমল আর চারু দেবনাগরীতে গদ্য লিখেছে, পরিষ্কার ক্যামেরায় দেখা গেল। এরপর যেকোনো দিন জানা যাবে বঙ্কিমচন্দ্র আনন্দামাঠ লিখেছিলেন হিন্দিতে, আর জানাগাণামানার রচয়িতা দেবনাগরী ছাড়া অন্য কিছুতে লিখবেনই বা কীকরে? বাঙালি মানে হল, দু-ইঞ্চি রবীন্দ্রসঙ্গীত, শাড়ি-পাঞ্জাবি, রাসগুল্লা আর দুর্গাপুজা। ব্যস। বাকি সব ইতিহাস বলিউডের। ইতিপূর্বে আমরা সুভাষ বসুকে হরবখৎ হিন্দি বলতে দেখেছি, মাস্টারদা আর গণেশ ঘোষকে চট্টগ্রামে হিন্দিতে বাক্যালাপ করতে শুনেছি, ফলে এ আর নতুন কি। আসল কথা হল পলিটিকাল কারেক্টনেসের পরীক্ষা। সেই পরীক্ষায় এই ফিলিম ১০০ তে ২০০ পেয়েছে। অনুরাগ কাশ্যপ ঢেলে প্রশংসা করেছেন। বাঙালিও ঢেলে তালি মেরেছে। কে কবে পাঞ্জাবি পরেছে, রবিবাবু কবে জন্মেছেন, আর বাঙালি বাংলায় কথা বলে না হিন্দিতে, এই তুচ্ছ জিনিসে কার কী এসে যায়? বলিউডে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। এই হল নেটফ্লিক্সের কামাল। এই হল অনুষ্কা শর্মা প্রযোজনা। যেখানে একবর্ণও রিসার্চ না করে, স্রেফ ঝা চকচকে তিনটে দামী ক্যামেরা এনে শুট করে ফেললেই কম্মো খতম, বাকিটা পোস্ট প্রোডাকশন সামলে দেবে।
জয় বাবা বলিউড। জয় মা কারেক্টনেস।

3 comments:

  1. দারুণ বলেছেন-সত্যিকারের ফ্লিমওয়ালারা হারিয়ে গেছে।সবাই কপি মারতে ব্যাস্ত

    ReplyDelete
  2. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  3. আপনাদের এত কম লেখা আসে কেন? আরো লেখা চাই।

    ReplyDelete