যে কোনো সময়ে যে কোনো জায়গায় সময় পার করা মতিনের জন্য কোনো ব্যাপারই না।
যে কোন জায়গায় বসে চোখ খোলা রেখেই মতিন নিজের মনের মধ্যে ডুব মারে। মাঝে মাঝে মতিনের মনে হয় তার মনের মধ্যে একটা দিঘী আছে। ছোট মোটো না। বড় সাইজের দিঘী। হাজার হাজার লাখ লাখ ছোট বড় চিন্তা সেই দিঘীতে নানা সাইজের মাছের মত ঘুরে বেড়ায়। দিঘীর মাছেরা যেমন মাঝে মাঝে সারফেসের পানিতে ঘাঁই মারে, বা পানির সীমানার খুব কাছ দিয়ে সাতরিয়ে গিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়, তেমন করে মতিনের মনেও চিন্তারা এভাবে ঢেউ তোলে, তখন মতিন কাজের ভেতরেও টুপ করে মনের ভেতরে সেই দিঘীতে নেমে পড়ে। চিন্তার এই দিঘীর জল খুব স্বচ্ছ। মতিন ঘন্টার পর ঘন্টা হারিয়ে যেতে পারে চিন্তা নামের মাছেদের পিছে ডুব সাঁতার দিতে দিতে। কখনো তার দম আটকে আসেনা। চিন্তার এই দিঘীটা মতিনের বয়সের সাথে সাথে দিকে পাশে বাড়ছে, বাড়ছে এর ভেতরে নতুন নতুন চিন্তা। চেনা চিন্তা ছাড়াও নতুন অজানা অচেনা চিন্তা। মতিনের বাস্তব দৈনন্দিন জীবনের সাথে সমান্তরাল তার মনের ভেতর বয়ে নেয়া এই চিন্তার দিঘী।
বাস্তব খুব অস্থির, রুক্ষ, বৈষয়িক, ব্যস্ত। মতিন নিয়ম মেনে বাস্তবের সাথে তাল মেলায়, কিন্তু একা একা ভাবে, বাস্তব জীবনটা যেন ব্যস্ত চৌরাস্তার মাঝখানে পথ খুঁজে না পাওয়া পথচারী। যেন কোথায় যেতে হবে, তা ভাল ভাবে না জেনে এসে নেমে পড়া নতুন শহরে ঠিকানা হারিয়ে ফেলা। যেন কোন বাসে উঠতে হবে বুঝতে না পেরে বার বার পথ চেনা মানুষের সাথে ধাক্কা খেতে খেতে জেনে নেয়ার চেষ্টা। বাস্তব জীবন যেন আশংকা পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখতে থাকা ভীড় বাস এসে চলে যাওয়া, তাতে নতুন করে গুতাগুতি করে চড়ে বসা চালু শহরের মানুষের ভীড়ে নিজেকে খুঁজে না পাওয়া। তাই বাস্তবকে মতিনের খুব সাফোকেটিভ লাগে। বাস্তব জীবনের এই ঠাঁসাঠাঁসির ভেতরে তাই মতিনের সুযোগ পেলেই চিন্তা মাছের সাথে খেলা করাই অভ্যাস।
দিন দিন মতিনের মনে হয় তার বাস্তব জীবনের স্পেস কমে আসছে, আর তার চিন্তার দিঘী বড় হচ্ছে। বাস্তবের হিসাবের চিন্তায় বেশিক্ষন মনকে আটকাতে ভালো লাগেনা তার এখন। গুনে গুনে চিন্তা করার জীবনের চেয়ে অনেক স্বাধীনতা আছে দায়বোধবিহীন অবাধ চিন্তায়। কোনো হিসাবের ছাতামাথা নাই। ইচ্ছা হল, ভাবতে শুরু হল। আবার ছেদ পড়লে লেজ ভাঁজ করে সেই চিন্তা ডুব দেয় জলের তলায়।
ইদানিং মাঝে মাঝে মতিনের খুব অদ্ভুত একটা সমস্যা হচ্ছে। তার প্রতিদিন একটু একটু করে মনে হচ্ছে, তার কম্ফোর্ট জোন হচ্ছে মনের দিঘীটায়। রিয়েলিটি বলে প্রতিদিন তাকে যে জীবনটা পার করতে হচ্ছে, তার ভেতরেও সে দিঘীর জলেই গলা ডুবিয়ে বসে থাকে। দিঘীর পানি বাড়তে বাড়তে মনের গভীর থেকে এখন যেন তার বাস্তবতার চৌরাস্তায় উঠে আসতে চাইছে। মাঝে মাঝেই কাজের ভেতরেই কিভাবে কিভাবে যেন মতিন চিন্তার দিঘীতে নেমে যাচ্ছে। আচ্ছা এভাবে চলতে থাকলে একসময় কি পুরা বাস্তব জগতটাই একসময় চিন্তার গভীর দিঘীর জলে তলিয়ে যাবে? ব্যাপারটা এইভাবে ভাবলে কেমন হয় ? যে আমাদের বাস্তব জীবনটা ত্রিমাত্রিক বস্তুজীবন। আমাদের শরীর হচ্ছে আমাদের ত্রিমাত্রিক অস্তিত্ব। আর আমাদের মন বা চিন্তা হচ্ছে মাত্রাহীন জগত। মতিনের মাত্রাহীন চিন্তার জগত যেভাবে পরিধি বাড়িয়ে মাঝে মাঝেই মতিনের বস্তু জগতের ভেতরেও চলে আসছে, এভাবে একসময় মতিনের পুরো অস্তিত্ব কি মাত্রাহীন চিন্তা দিয়ে ডুবে যেতে পারে ? তখন তো তাহলে মতিনের ত্রিমাত্রিক দেহটা আর প্রয়োজন পড়ে না। মাত্রাহীন মন আর মাত্রাহীন চিন্তার জগতের সেই পূর্ণ অবস্থাটাই কি তাহলে মৃত্যু ? ত্রিমাত্রিক বস্তুজগতের অবসান, শরীরের বিদায় ?
ইন্টারেস্টিং তো ।
আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে মতিন বারান্দার গ্রীল ধরে জুত করে দাঁড়ায়ে খুব আয়েশে টান দিল। এই যে, মৃত্যুবিষয়ক খুব ভালো একটা চিন্তার সুতা পাওয়া গেল। এই জাতীয় চিন্তা নিয়ে মাথায় ঘোরাতে মতিনের ভাল লাগে। যদিও দ্বিতীয় কারো চোখ দিয়ে দেখলে বিষয়টা বোঝার কোনো কায়দাই নাই । দেখা যাবে শহরের ঘিঞ্জি ফ্ল্যাটবাড়িগুলার কোনো এক বারান্দায় নীল রং এর প্লাস্টিকের মগ হাতে দাঁড়ায়ে এক উস্কোখুস্কো চুলের লোক সিগারেট খাচ্ছে বাইরের দিকে তাকিয়ে।
মতিনের বারান্দার বাইরে ৩ তলা নীচে বাড়িটার ছাদে কাপড় নাড়তে আসা বুয়াটা যেমন মতিনকে দেখে ভাবছে, মতিন হয়ত তাকে লক্ষ করবে। ইচ্ছা করেই সে কাপড় শুকাতে দেয়ার পরও খালি বালতি হাতে আরো কিছুক্ষন ছাদে পায়চারী করে।
উল্টা পাশের দুরের সমান উচ্চতার বারান্দায় বসে থাকা বুড়ো লোকটা, চিন্তায় মগ্ন সিগারেট হাতে বারান্দায় দাড়ানো মতিন কে দেখে ভাবে, বউ এর সাথে ঝগড়া করা স্বামী। মনে মনে ভাবে,
এসব কত দেখলাম। দুইটা সিগারেট খাবে, তারপরে তো ঠিকই বেডরুমে ফিরা গিয়া বউ এর কাছে মাফ চাবে, ঝগড়া মিটমাট। সন্ধায় দুইজন সাইজা গুইজা একসাথে বের হইয়া ডিনার করে আসবে। সাচ ইজ লাইফ।
আর এসবের বাইরে, যেই বারান্দায় মগ হাতে দাড়ায়ে মতিন চিন্তায় হারিয়ে গেছে, সেই বারান্দার পেছনের দরজা দিয়ে ভেসে আসে, মতিনের স্ত্রীর গলা
- ২ টা টবে পানি দিতে গিয়া আধাঘন্টা খাড়ায়া থাকলা, নাস্তা খাবে কখন ?
মতিন বাস্তবে ফিরে আসে, তার চিন্তাটা টুপ করে ল্যাজ গুটায়ে জলের নীচে চলে যায়, চিন্তার জলে ভেজা মতিন বলে
- সরি, রাতে বৃষ্টি হইসে তো, পানি দেয়া লাগবেনা।
- এটা আবিষ্কার করতে তোমার পাক্কা আধঘন্টা লাগলো ?
মতিন উত্তর দেয়না।
আসলে বাস্তবতার মূল সমস্যাটাই মতিনের কাছে লাগে এইখানে।
বাস্তবে সব প্রশ্নের উত্তর হয় না।
bhaiya apni zudi blog site banate chan amake janaiyen... Ami apnake ekta site baniye dibo
ReplyDeleteFacebook.com/akibvaix