অনেক অনেএক বছর আগে শহরের রাস্তায় চকচকে রুপোলি টিনের বাস চলত। সিটের উপরে
লেখা থাকত চমৎকার কিছু উপদেশ - সদুপদেশ। তেমনই এক উপদেশের কথা মনে পড়ে গেল -
মালের দায়িত্ব আরোহীর।
এতদিনে নিশ্চয়ই এটা বুঝেছেন, যে, স্বাস্থ্য
একটি ক্রয়যোগ্য সামগ্রী - কেননা, সরকার উত্তরোত্তর তেমন দিকেই এগোচ্ছেন,
যেখানে অসুস্থতা থেকে সুস্থতা কিনে নিতে হবে - সরকারের দায় বলতে, গরীবের
ক্ষেত্রে সেই খরচ সরকার বহন করবেন (কদিন করবেন, সেটা বলা মুশকিল)। অর্থাৎ,
স্বাস্থ্য যে নাগরিকমাত্রেরই অধিকার, এমন আশ্চর্য কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলাই
ভালো। বুঝে নিন, স্বাস্থ্য স্রেফ একটি পণ্য - খরচে পোষালে কিনবেন - না
পোষালে...থাক সেসব কুকথা।
অতএব, স্বাস্থ্য একটি মাল - এবং জানেনই তো, মালের দায়িত্ব আরোহীর।
স্বাস্থ্যকর্মী-চিকিৎসক
তাঁরাও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নন। সে যতোই বড় বড় লোকজন বলে থাকুন না কেন,
যে, স্বাস্থ্যকর্মী-চিকিৎসক এনারা হলেন গিয়ে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার
সবচেয়ে মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ, এবং এই সঙ্কটকালে তো বটেই, হুঁ হুঁ
বাবা, আমাদের সরকার হলেন গিয়ে এক্কেবারে নো ননসেন্স।
সুপ্রীম কোর্ট
যখন জিজ্ঞেস করেছেন, চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সরকার
কী ভাবছেন বা কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন, দেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ
মন্ত্রক পষ্টাপষ্টি লিখিত জানিয়েছেন -
"While the Hospital
Infection Control Committee in the health facility is responsible for
implementing the Infection Prevention and Control activities, but the
final responsibility lies with healthcare workers. It is their
responsibility to train themselves and take all measures in preventing
the infection."
মোদ্দা কথা, চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদেরই দায় সংক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচানো - অর্থাৎ, নিজের দায়িত্ব নিজেরই।
এদিকে, কী গেরো দেখুন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছেন -
"Because
occupational hazards arise at the workplace, it is the responsibility
of employers to ensure that the working environment is safe and healthy.
This means that they must prevent, and protect workers from,
occupational risks. But employers’ responsibility goes further,
entailing knowledge of occupational hazards and a commitment to ensure
that management processes promote safety and health at work….Adequate
arrangements should also be made for compensation of work-related
injuries and diseases, as well as for rehabilitation and to facilitate a
prompt return to work."
সরকারবাহাদুরকে যদি স্বাস্থ্যব্যবস্থার
পরিচালক ও নিয়ামক মানতে হয়, তাহলে তো, অন্তত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার নিয়ম
অনুসারে, স্বাস্থ্যকর্মী-চিকিৎসকদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে কিছু দায়িত্ব
সরকারের থাকে। তাই না?
একই বক্তব্যে সরকার এও জানাচ্ছেন, যে, কোভিড
পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যকর্মীদের সংক্রমণের ঝুঁকি আমজনতার চেয়ে বেশী নয়। এবং,
প্রোটেক্টিভ পোষাক পরলে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের সংক্রমণের ঝুঁকি তেমন
নেই - এবং তাঁদের থেকে তাঁদের পরিজন সংক্রামিত হতে পারেন, এমন সম্ভাবনা
স্রেফ কষ্টকল্পনা।
অথচ, নার্সদের আন্তর্জাতিক কাউন্সিল গতমাসের
শুরুতেই জানিয়েছিলেন, তাঁদের হিসেবে বিশ্ব জুড়ে অন্তত নব্বই হাজার
স্বাস্থ্যকর্মী সংক্রামিত (আবারও বলি, এই হিসেব মে মাসের শুরুর) - এবং,
তাঁদের নিজেদেরই কথায়, এই তথ্য অসম্পূর্ণ - কেননা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও
জানিয়েছেন, সদস্য দেশগুলির অধিকাংশই চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে
সংক্রমণের হার জানাচ্ছেন না।
অথচ, একজন সংক্রামিত সাধারণ নাগরিক এবং
একজন সংক্রামিত স্বাস্থ্যকর্মী - দেশে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের পক্ষে
দ্বিতীয়জন অনেক বেশী বিপদ। কেননা, প্রথমত, তিনি অনেক বেশী মানুষকে
সংক্রামিত করতে পারেন এবং দ্বিতীয়ত, একসাথে অনেক চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী
সংক্রামিত হয়ে ঘরবন্দি হয়ে পড়লে সমগ্র স্বাস্থ্যব্যবস্থাটিই ভেঙে পড়ার
পরিস্থিতি।
একদিকে লকডাউন আচমকা তুলে দিয়ে সংক্রমণের আশঙ্কা বহুগুণ
বাড়িয়ে ফেলা - সবরকম অফিস-কাছাড়িতে হাজিরা বাড়ানোর কথা বলে মানুষকে
রাস্তায় নামতে বাধ্য করা - গণপরিবহন ব্যবস্থা আধাআধি খুলে সেই সীমিত
যানবাহনে গাদাগাদি ভিড় নিশ্চিত করা - আর আরেকদিকে
চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সংক্রমণের দায় থেকে হাত ধুয়ে ফেলা -
কী কিউট না!!!
কিন্তু, সেসব কথা থাক। সৎ দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে আমাদের গুরুদায়িত্ব সরকারেরব কথাকে বেদবাক্য বলে মেনে নেওয়া।
এই
পরিস্থিতিতে, নিজের স্বাস্থ্য নিজের সুরক্ষার দায় এক এবং একমাত্র নিজের,
এমত সরকারি ঘোষণায় উদবুদ্ধ হয়ে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের একটি বড় অংশ যদি
বাড়িতে বসে থাকতে চান, তাহলে নিশ্চয়ই তাঁদের দোষ দেওয়া যায় না। তাই না??
তাহলে কী করবেন?
কী আবার!!! সবাই হাত ধুচ্ছেন তো? সরকারও হাত ধুয়ে নিলেন।
আপনি থালা বাজান। বাতি জ্বালুন।
কোনো এক শুভদিনে সন্ধ্যা আট ঘটিকায় পরবর্তী ঘোষণার অপেক্ষায় থাকুন।
No comments:
Post a Comment