Thursday, January 9, 2020

শাস্তিই কি ধর্ষন রোধের সঠিক পন্থা?

যেকোন নারকীয় ধর্ষন সংবাদ মাধ্যমের থ্রু দিয়ে সামনে আসার পর নাগরিক হিসাবে আমাদের একটা ঈমানি দায়িত্ব থাকে। দায়িত্বটা হল অভিযুক্ত ধর্ষকের কঠোরতম শাস্তির দাবি করা। কঠোরতম শাস্তি বলতে কারোর কাছে মৃত্যুদন্ড। কেউ একটু এগিয়ে ধর্ষকের পুরুষাঙ্গ কেটে নেওয়ার কথা বলে। আবার কেউ আরও একটু এগিয়ে ধর্ষককে কুচিকুচি করে কেটে নুনলঙ্কা মাখানোর বিধান দেন । দিন কয়েক আগে একটা গ্রুপে দেখলাম একজন অতি দরদী নাগরিক বলেছে " শ্লা রেপিষ্টের মা বোনকে রেপ করা হোক, তবেই রেপিষ্ট বুঝবে জ্বালা"। ধর্ষনের বিরুদ্ধে কঠোর 'প্রতিবাদ' করতে গিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই ধর্ষনের সংস্কৃতিকে শীলমোহর দেওয়া। যে বা যারা এমন বলছে তাদেরও মনমানসিকতার ব্যবচ্ছেদ দরকার নয় কি? ঘুরিয়ে রেপের কথা যারা বলে তারাও পোটেন্সিয়াল রেপিষ্ট। ধর্ষনবিরোধী বয়ানের ধারা এমন যে আমি ধর্ষকের যত নৃশংস শাস্তির দাবি তুলতে পারব তত বেশি বেশি করে আমি ধর্ষিতার প্রতি 'দরদী'। ধর্ষনের বদলা ধর্ষন দিয়ে দেশের অতি সুনাগরিক হওয়ার প্রানপন চেষ্টা।
যে নারীকে আমরা সুরক্ষা দিতে পারলাম না, ঘটনার পর ধর্ষকের কঠোরতম শাস্তির দাবি করে নিজেদের অক্ষমতা ঢাকতে চাই আমরা। এরপর তার 'আত্মাকে' বিচার পাইয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগি সেই আমরাই । বাহ বিবেক! একটা কথা বলবেন? কঠোর শাস্তিই কি সব ? এটা কোনো প্যানাসিয়া? ডেথ পেনাল্টি চালু হলেই তার পরের দিন থেকে নৃশংস হত্যা আর ঘটবে না ? আপনি বা আমি বুকে হাত দিয়ে জোর গলায় একথা বলতে পারব? আগেওতো দেখেছিলাম, গোটা দেশ জুড়ে প্রতিবাদের স্বর ভেসে উঠেছিল। ক্ষোভের আগুনে ফুঁসতে থাকা ছাত্রছাত্রীরা নেমেছিল রাস্তায়। সেবারেও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে একই রকমের জনরোষ। একইরকম কঠোরতম শাস্তিবিধানের বয়ান। অনেকেই ভেবেছিলেন এই বুঝি শেষ, আর বোধ হয় আমাদের বোনেদের অসহায়ত্ব কেউ খাবলে খেতে পারবে না।
কিন্তু তাই কি? তারপরেও সমপরিমান নৃসংসতা ঘটল। আমরা পরখ করেছি। আটকাতে পারি নি। পূর্বতন অপরাধীদের কঠোর শাস্তির বয়ান পারে নি। নৃসংসতার পর অপরাধীকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হলে আমরা আশ্বস্ত হয়ে যাব যেন কাল থেকে কন্যাশিশুদের উপর যৌন নির্যতনের ঘটনা আর ঘটবে না। নুসরাতের ঘটনার পরও মোমবাতি মিছিলে বেরিয়ে ছিল। কিন্তু মোমবাতির আগুন বেঁচে থাকে না, নিভে যায়। তারপরেও একের পর এক নৃশংসতা আমাদের বিবেককে চাগিয়েছে। আবারও কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়েছি সেই আমরাই । দাবি সময়ের নিয়ম মেনে আবার নিভেও গেছে। কঠোর শাস্তির মধ্যে যে আসল সমাধান সুত্র লুকিয়ে নেই, এই বিচারবোধটা আমাদের অধিকাংশের এখনও আসে নি। সমস্যার শিকড় অন্য জায়গায়। সেটা যাতে আমরা ধরতে না পারি তাই জনরোষ কঠোর শাস্তিবিধানের ফোকাসে আটকে রাখা হয়। রাষ্ট্রকর্তৃক এহেন শাস্তির বিধান আদতে প্রতিবন্ধক হিসাবে কাজ করে। এতে করে সাময়িক জনরোষ চেপে দিয়ে সহজেই মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া যায়। রাষ্ট্রও নিশ্চিন্তে নিদ্রা যায়।
শেক্সপিয়ারের "মেজার ফর মেজার" এ ইসাবেলার কথা মনে আছে? তার ভাই ছিল ক্লদিও। সেই ক্লদিও ছিল ব্যাভিচারে অভিযুক্ত। ডিউক অব ভিসেন্টোর থেকে রাজ্যচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত অ্যাঞ্জেলো তার বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদন্ড দিতে বদ্ধপরিকর। ইসাবেলা অ্যাঞ্জেলোর কাছে ভাইয়ের প্রানভিক্ষা চাই। তার রূপজ মোহে কামাতুর হয়ে পড়ে অ্যাঞ্জেলো । অ্যাঞ্জেলো বলে যে ইসাবেলা যদি তার কামনার আগুন নেভায় তবে তিনি ক্লদিওকে ছেড়ে দেবেন। ইসাবেলা রাজি হয় নি । ইসাবেলা রাগে ক্ষোভে দুঃখে ঘৃনায় পালিয়ে আসে। ইসাবেলা অ্যাঞ্জেলোর কুপ্রস্তাবের কথা তাঁর বন্দী ভাইকে গিয়ে জানায়। ক্লদিও নিজের প্রানের ভয়ে বোনকে কুপ্রস্তাবে রাজি হয়ে যেতে বলে। ইসাবেলা রাজি হয় নি। নিজের ভাই এর জীবনের থেকেও তার সতীত্ব অনেক বড়। শুধু তৎকালীন ব্রিটিশ সমাজ বলে নয় আমাদের সমাজেও এই যে "সতীত্ব" এবং তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা "মর্যদা" মানুষের জীবনের থেকেও বেশি মূল্য পায়। সতীত্বকে অতিমাত্রায় মূল্যায়িত করা হয় বলেই নারী নিরাপত্তাহীনতাই ভোগে। পুরুষের ভূমিকা হয়ে দাঁড়ায় হয় আক্রমনকারী কিংবা রক্ষাকর্তার, সেটাও নারীর সতীত্বকে ঘিরেই। এই সম্ভ্রম ব্যপারটা ব্যক্তিনারীর পরিসর ছাড়িয়ে অনেক ক্ষেত্রেই জাতির মর্যাদায় পর্যবসিত হয়। যেন নারীর দু'পায়ের মাঝখানে গোটা জাতির সম্মান নিহিত, যেমন রাজপুত নারীর জহরব্রত।
কড়া শাস্তিতে সমাধান সুত্র খোঁজার আগে আমাদের 'ধর্ষন' সম্পর্কীয় ধারনার পরিবর্তন হওয়া দরকার। 'ধর্ষন' আদতে একটি ঘৃন্য শারীরিক আক্রমন। যিনি আক্রমন করেন তিনি আক্রমনকারী এবং যার উপর আক্রমন হয় তিনি আক্রান্ত। কিন্তু আমরা 'ধর্ষন', 'ধর্ষক', 'ধর্ষিতা' এই সব শব্দ ব্যবহার করে আক্রান্তের উপর সতীত্ব, সম্ভ্রম ও মর্যদার বোঝ চাপিয়ে দিই। যে কারনে আক্রান্ত মহিলা বাকি জীবনটা সেই 'লজ্জা' বয়ে বেড়ান। ঠিক সেই কারনেই ধর্ষিতাকে অহরহ শুনতে হয় "মেয়েটার সব্বোনাশ হয়ে গেল গো"। এই মধ্যযুগীয় ভাবনাটাই ক্লিশে এবং নোংরা। সে ক্যামেরায় মুখ দেখায় না এই চাপানো 'লজ্জা' থেকেই। একজন 'ধর্ষিতা' নারী যে শুধু একবারই ধর্ষনের শিকার হয় তা নয়; পাড়াপ্রতিবেশীর কথাবার্তায়, মিডিয়ায়, বুদ্ধিজীবির আলোচনায়, রকের আড্ডায় সে বারংবার 'ধর্ষিতা' হয়। সামাজিকভাবে আমাদের উচিৎ এই ধর্ষন সম্পর্কীয় ধারনার বিনির্মান। আক্রান্ত নারী কেন লজ্জা নিয়ে বাঁচবে? লজ্জা তো তার না, লজ্জাটা সমাজের। বরং সেই লজ্জাটা শুধু তোলা থাক ঐ কামুক ধর্ষকের জন্য। 'ধর্ষিতা' শব্দের বদলে ব্যবহার হোক "আক্রমন উত্তীর্ণা"। 'ধর্ষিতা' শব্দটিই নারীকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে, তাই এই ঘৃন্য শব্দের অবলুপ্তি দরকার। আক্রান্ত নারীর ছবি ঠিকুজীকুষ্ঠি উদ্ধার আর নয়, বরং আক্রমনকারীর ছবি ও ঠিকুজীকুষ্ঠি সামনে আসুক। লজ্জাটা আক্রান্তের হাত থেকে ফিরে দেওয়া হোক আক্রমনকারীকে।
আক্রমনকারী ও আক্রান্তের সম্পর্ক যেমন ক্ষমতার, তেমনি ধর্ষক ও ধর্ষিতার সম্পর্কও ক্ষমতার। লক্ষ্য করে দেখবেন, কেবল অসহায় একা নারীকেই আক্রমনকারী কামনাজাত শারীরিক আক্রমন করতে উদ্যত হয়। দলের মধ্যে থাকা বিশেষ কোন নারীর উপর আক্রমন শানাতে আক্রমনকারীর কিন্তু সাহস হয় না। আবার এই 'ধর্ষন' কখনও পাল্টা প্রতিশোধ, কখনও আবার রাজনৈতিক অস্ত্র। ধর্ষনের সঙ্গে মানসম্মানের প্রশ্ন সামাজিকভাবে জড়িয়ে দেওয়া হয় বলেই এই প্রবনতা গুলো দেখা যায়। যেকোন যুদ্ধ বিগ্রহে বা বীভৎস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হাজার হাজার 'ধর্ষনের' ঘটনা ঘটে ঠিক এই কারনেই। এখানে 'ধর্ষক' যেন বিজয়ী, আর যাকে 'ধর্ষন' করা হল সে যেন পরাজিত। আমরা অবচেতনভাবেই এই বদ্ধমূল ধারনা লালন করি, তাই জয়-পরাজয়ের প্রশ্নে অবলীলায় যথেচ্ছাকারে রেপ রেটোরিক ব্যবহার করি। আর্জেন্টিনা ব্রাজিলকে হারিয়ে দিলে আর্জেন্টিনার বাঙালী সমর্থক বলে, "আর্জেন্টিনা ব্রাজিলকে পুরো চু* দিল রে"। এই ধরনের রেপ রেটোরিকগুলো এবার বন্ধ হওয়া উচিৎ। 'ধর্ষন' সম্পর্কীয় এই ধরনের মানসিক গঠনের নির্মান একদিনের নয়, স্মরনাতীত কাল ধরে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিক সমাজেরই ফসল। আর আছে আধুনিকতার খোলস পরা পুঁজিবাদী মানসিকতা যা নারী শরীরকে পন্যায়িত করে নারীকে আরো বেশি করে ভোগ্যবস্তু ভাবার মানসিকতাকে পোক্ত করছে।
বর্তমানে ধর্ষনে সাজাপ্রাপ্ত আসামীর মনমানসিকতা নিয়ে বিস্তর গবেষনা শুরু হয়েছে। এরা ছোট থেকেই নারী এবং নারী শরীরের প্রতি তীব্র ঘৃনা নিয়ে বড় হয়। একদিকে নারী শরীরের প্রতি উদগ্র কামজ বাসনা, আর অন্যদিকে তীব্র ঘৃনার মিশ্রিত সাইকোসিস। আমাদের সমাজ ধর্ষনের মতো অপরাধ নির্মূল করতে কঠোর শাস্তিবিধান বা নারীদের নানারকম রক্ষাকবচ দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু এই সামাজে যাতে ধর্ষকের জন্ম না হয় সেদিকে ফোকাস নেই বললেই চলে। এহেন অপরাধ থেকে নিস্তারের আসল চাবিকাঠি বিচারব্যবস্থার হাতে নেই, আছে আপনার আমার হাতে। আপনার নিজের কন্যাসন্তান রাস্তায় বেরোলে সুরক্ষিত কি না সেটা আপনার চিন্তার বিষয়, পাশাপাশি আপনার এটাও চিন্তার বিষয় হওয়া উচিৎ আপনার ছেলে ভবিষ্যতে ধর্ষকে পরিনত হবে না তো? কারন ধর্ষক ও তার ধর্ষন মানসিকতা এই সমাজেরই বাইপ্রোডাক্ট। আপনার ছেলের মানসিকতাও সেই ভাবে গড়ে উঠতেই পারে। একটি পরিবারে নারীদের প্রতি ধ্যানধারনা কেমন, অ্যাটিচিউড কেমন এবং নারী সম্পর্কীয় ষ্টিরিয়োটাইপ এসবই শিশুমনে দাগ কাটে। পুত্রসন্তান যদি দেখে কথায় কথায় তার বাড়ির পুরুষ অভিভাবকেরা তার মাকে ছোট করছে তাহলে সে নিজেকে শিখিয়ে নেবে যে নারীদের এভাবেই ছোট করতে হয়। মা'কে ধমকে কথা বলতে হয় তবেই পুরুষত্ব বজায় থাকে। তাই বলি, বাড়ির বাইরের নারীদের কথা পরে হবে, আগে নিজের বাড়ির নারীদের প্রতি সম্মান দিয়ে কথা বলুন। ছেলে দেখবেন সম্মান দেওয়ার ব্যাপারটায় আপনাকেই অনুকরন করছে। আমাদের ধর্মসামাজিক ভাবনায় নারী কখনও 'দেবী' কখনও 'দানবী'। নারীকে ষ্টিরিয়োটাইপিক 'দেবী' বা 'দানবী' ভাবাটা সেক্সিষ্ট মেলগেজ। ছেলেকে শেখান নারীকে মানুষ হিসাবেই সম্মান দিতে। সম্মান মানে এই নয় যে তাকে 'দেবী' বা 'জান্নাত' ভেবে কেত্তার্থ করতে হবে। নারী ভিনগ্রহ থেকে আসে নি, সে মানুষই। তাই ভাবী প্রজন্মের দরকার নারীকে পর্যাপ্ত সম্মান দেওয়ার শিক্ষা, মানুষকে মানুষ হিসাবে মর্যাদা দেওয়ার শিক্ষা।

No comments:

Post a Comment