Saturday, March 28, 2020

মুখোশ

ঘুম ভাঙলে প্রথম কোন জিনিসটা টের পায় মানুষ ?
শব্দ পায় মনে হয়। কিছু দেখার আগে কিছু শুনে ঘুমটা ভাঙ্গে। দেখার চেয়ে শোনার সুবিধা বেশি। কারণ চোখের মত, কানের পর্দা খোলার ব্যাপার নাই। কান সদা খোলা। চোখ খোলার পর চোখে কি পড়বে তা নির্ধারিত হয় শোবার ভঙ্গীর উপরে। চিত শুয়ে যার অভ্যাস, সে চোখ খুলে দেখবে ছাদ আর ফ্যান, পাশ ফিরে যার ঘুম ভাঙবে সে দেখবে দেয়াল বা পর্দা আর কিছু ফার্নিচারের কোনাকানা। কিছু মানুষ চোখ খুলেই দেখে বালিশ, চাদর আর নিজের লোলে ভেজা দাগ। তারা জাগে উপ্তা হয়ে ঘুমন্ত অবস্থা থেকে।
         
আমানত উল্লা মিন্টু ঘুম ভাঙলে দেখে মায়াজাল। পাতলা কাঁথার উপর জানালা দিয়ে আসা আলোয়, খুব সুন্দর একটা আলোছায়ার ছবি হয়। আম্মার পুরানা শাড়ি দিয়ে বানানো পাতলা কাঁথা ৭ বছর ব্যাবহারে আরও পাতলা ন্যাতা ন্যাতা হয়ে গেছে। মাথা সহ কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর অভ্যাসের কারণে মিন্টু সকালে সেই কাঁথার ওপর আলো পড়া একটা এক্সরে ছবি দেখে। কাঁথার ভেতর জায়গায় জায়গায় কাপড় ফেঁসে দলা দলা হয়ে যাওয়া, কোথাও পাতলা কাপড়, কোথাও ভারী। প্রতিদিন সকালে এমন আলাদা আলাদা প্যাটার্ন দেখে ঘুম ভাঙ্গে তার।

প্রাকৃতিক নিয়মে সব মানুষ ঘুমায়, সবাই জেগে উঠে। কিন্তু তারতম্য হয় জীবনযাত্রায়। গ্রামের আর শহরের মানুষের ঘুম ভাঙ্গার তত-তরিকা আলাদা। গ্রামের মানুষের ঘুম ভাঙ্গার সঙ্গে সঙ্গেই চাঞ্চল্য শুরু হয় না। কিন্তু শহরের মানুষের হয়। নগরের অর্ধেকের বেশি মানুষের ঘুম ভাঙ্গে, হয় এলার্মে আর না হয় কারো ডাকে। নিজে থেকে জেগে ওঠার ক্ষমতা নগরের ঘুমন্ত মানুষের কমে যায়। নগরকে জাগাতে হয়। গ্রাম নিজেই জেগে উঠে। ভোরের বাতাস, মোরগের ডাক, খুদার্ত অস্থির বাছুরের ঘোতঘোতানি। ঘরের পাশে সংসার শুরু করা ছোট পাখির কিচমিচ এই সব আয়োজনে ঘুম ভাঙ্গে নগরের বাইরের মানুষের। আমানত উল্লা মিন্টু চোখ খুলে কিছুক্ষণ এই সব খোঁজে। লাভ নাই, তার ঘুমানোর জায়গায় এই সব কানে আসে না। বরং তার কানে দলা পাকায়ে ঢুকে পড়ে, পাড়ার ছোট গলিতে মোড় ঘুরানো প্রাইভেট কারের কর্কশ হর্ন বা রিকশার বেল, মুরগী বা সবজী ওয়ালার চিৎকার, কোন দুই মুখ খারাপ ব্যাক্তির ঝগড়া, কখনো বা ছাদের ট্যাংকি উপচে পড়া পানির শব্দ। মুখ থেকে কাঁথা সরায়ে মিন্টু হাত ঘড়ি দেখে। পৌনে আটটা বাজে। মোবাইলে এলার্ম দেয়া থাকে আটটায়। তবে নিয়ম করে মিন্টুর ঘুম কিছুটা আগেই ভাঙ্গে।

নগরে মানুষ বেশি।
যত বেশি মানুষ, তত বেশি স্বকীয়তা খোঁজার চেষ্টা। সবাই যার যার মত স্বকীয়তা পেতে চায়। কোটি মানুষের ভীড়ে নিজেকে আলাদা করার এই রেসের বাইরে কেউ নাই। সকাল হলেই জেগে উঠে নগরীর মুখগুলা। তারপর আবার ঘুমায়ে পড়ার আগ পর্যন্ত তাদের মুখ আড়াল করে ঝুলতে থাকে মুখোশ। মুখ আর মুখোশের মজার একটা আত্মীয়তা আছে। মুখ মানুষটার আয়না। তার ভেতরের সব কিছুকে সামনে এনে দেয়। আর মুখোশ, মুখের ফ্রেম টা ধার করে ভেতরের সব চাপা দিয়ে ফেলে তাতে চাপায় নতুন ছবি। ভেতরের আনন্দ ঢাকা পড়ে যায় ভার চেহারার মুখোশে, কষ্ট লুকিয়ে যায় হাসি মুখোশে।

আমানত উল্লা মিন্টুর মত মানুষের দিন কাটে মুখোশের পর মুখোশ পালটে। সকালে বাথরুমে দরজার সামনে মেসের অন্য রুমমেটদের দাঁড়ানো দেখে মিন্টু মুখে একটা হাসি মুখোশ টাঙ্গিয়ে হালকা রসিকতা করার চেষ্টা করে। যদিও তার মনে তখন খচ খচ করছে গতরাতে দেখা মানিব্যাগে শেষ তিনশ তেপ্পান্ন টাকা। বেতন পেতে এখনো আরও ১১ দিন বাকী।
বাথরুমের দেয়ালে ফ্যাকাসে ছোপ ছোপ ছাতা পড়া আয়নায় তাকায়ে মিন্টু নিজেকে যখন দেখে, তখন সে নিজে বুঝে না, এটা তার মুখ, নাকি মুখোশ। খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে তার চেহারা দেখতে অনেকটা তার বাবার কমবয়সের ছবির মত লাগে। তখন সেটা মুখ মনে হয়। শেভ করার পর সেটা হয়ে যায় "সুইট টপিং" রেস্টুরেন্ট এর সকাল ১১ টা থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত হাসিমুখে ফরমায়েশ নেয়া ওয়েটার এর মুখোশ।
            চাকরী চলে যাওয়া প্রাক্তন বিডিআর সৈনিক বাবার সঙ্গে আমানত উল্লা মিন্টুর স্মৃতি খুব বেশি না। বাবা বছরের ১১ মাসই সীমান্তে পাহারা দিয়েছে সৈনিকের মুখোশ পরে। যদিও মিন্টু জানে, তার বাবার ভেতরে লুকায়ে থাকে একটা রাখাল কিশোর। ছুটিতে একমাস বাড়ি আসলে, বাবা মাঝে মাঝে লাজুক মুখে দুপুর বেলায় পুকুর ঘাটলায় বসে বাঁশী বাজাতো। তখন বাবার মুখ থেকে মুখোশ খুলে পড়তো। ক্লাস টু বা থ্রিতে পড়া মিন্টু তখন বাবার কোলের কাছে, বাবার হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে অসীম মুগ্ধতায় বাবার আদর নিত। সেই আদরের ভাষা নাই। মুখোশের আড়াল নাই। বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে বাবার হাঁটুতে মুখ ঠেকিয়ে বসে আদর নেয়াটা হয় না। অনেক কিছু দিতে না পারার অভিযোগ জমে, অনুযোগ বের হয়ে আসে। দিনে দিনে বাবার মুখে, সৈনিকের মুখোশের মতন আরও অনেক বেমানান মুখোশ চড়ে। সেই ছোটবেলায় মাঝ রাতের ট্রেনে বাড়ি ফেরা বাবা তাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে নিজের বেরেট ক্যাপটা মিন্টুকে পরিয়ে দিয়ে স্যালুট দিত। সেই ক্যাপ পরে মিন্টু মনে মনে নিজেকে বন্দুক চালানো সৈনিক ভাবতো। বলতো "আমি বড় হইলে গুল্লি করুম"। তার বাবা এক গাল হেসে বলতো
" না রে বাবা, তুমি কুট টাই পিন্দা ডিউটিত যাইবা"।
   
           টাই মিন্টু পরে, সাদা হাফ শার্টের সাথে লাল টাই। সাদা শার্টের বুক পকেটের উপর সোনালী প্লেটে কালো হরফে ইংরেজিতে তার নাম লেখা "মিন্টু"। এই পোশাকের উপরে তার ওয়েটারের মুখোশ চেপে বসে। ১২ ঘণ্টা এসি চলা রেস্টুরেন্টে সেই মুখোশে ঘাম হয় না। মুখোশের পেছনে মিন্টু ছোটবেলার দুরন্ত দুপুরে কাটা ঘুড্ডির পিছনে ছুটে ঘেমে নেয়ে উঠে, কানের পাশ দিয়ে ঘামের গড়ায়ে পড়া মিস করে।
সকালের রোদেই ভাপিয়ে ওঠা সিটি বাসে দাঁড়িয়ে, বা কোনো দিন কপাল ভালো থাকলে পাছা ঠেকানোর মত বসার একটু যায়গা পেলে মিন্টু মুখে রাগী-গম্ভীর মুখোশ চাপিয়ে বসে। এই শহরে যেসব জিনিস বাকী নাগরিকদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে হয়, সেসব জিনিসের সামনে সবাই রাগী মুখোশেই থাকে। সেই মুখোশে হঠাত চোখে পড়া ছোট্ট বাচ্চার হাসি দেখে মায়া ঝরে না। হাঁটুর ব্যাথায় কষ্ট পাওয়া ৬৩ বছরের মহিলার জন্য সহমর্মিতা জাগে না। ভীড় বাসে, ঘেমে উঠে মানুষের আলাদা আলাদা গন্ধ গুলা মিলেমিশে গুমোট হয়ে সেই মুখোশে রং দেয়। আরও রাগী আরও গম্ভীর করে তুলে। মুখোশের সঙ্গে মানানসই গলার আওয়াজে কেউ কেউ বাসের কন্ডাক্টারকে ধমক মারে
"ঐ হালারপুত গুতাস ক্যান ? ভাড়া না একবার দিলাম?"

রেস্টুরেন্টে ভরা নগরীর কোনো এক অংশে, অখ্যাত এক রেস্টুরেন্টের ৩ টা টেবিলের দেখভাল করার দায় কাঁধে মাঝারী শ্যামলা, পাঁচ ফুট সাড়ে আট ইঞ্চির ২৭ বছরের যুবক আমানত উল্লা মিন্টু কাজ শুরু করে সকাল সাড়ে দশটায়। বাসের ভেতরের রাগী মুখোশ খুলে, রেস্টুরেন্টের ফ্লোরে ঢুকার সময় মিন্টু মুখে চড়ায় একটা বেচারা মুখোশ। তাতে আত্মবিশ্বাস থাকে না। কোনো অভিব্যাক্তি থাকে না। সেই মুখোশ শুধু পারে, সামনের মানুষের মুখোশের অভিব্যাক্তির বিপরীতে একটা মাপা মেকী হাসি দিতে। সেই হাসি মিন্টুর ঠোটের পেশীতে জন্ম নেয়। সেই হাসিতে তার চোখ অংশ নেয় না, মন অংশ নেয় না। মাপা সেই হাসি ঝুলানো মুখোশের পেছনে কখনো মিন্টু খেপে থাকে, কখনো অপমানিত হয়, কখনো বিরক্ত, হতাশ, কখনো বা খুব অভিমান।

৮ হাজার টাকা বেতন আর অনির্ধারিত অংকের টিপসের এই চাকরী করতে এসে, এই নগরে পা রাখার পর থেকে, নরোত্তমপুরের গনী হাজির বাড়ির মেঝ ছেলে নেয়ামত উল্লার বড় ছেলে আমানত উল্লা মুখোশ জমিয়ে চলেছে। কত কত মুখোশ তার জমছে দিন দিন। মাঝ রাতে মেসে ফেরার পথে গলিতে হেঁটে যাবার সময় টহল পুলিশের সামনে এক মুখোশ, আবার একি জায়গায় সস্তা চাকু হাতে নব্য ইয়াবাখোর ঠেকবাজ তরুণের সামনে অন্য মুখোশ। যদিও দুইবেলাতেই ফলাফল সমান। পকেটে যে কটা টাকা থাকে তা চলে যায়। ২০ টাকা টিপস পাবার হাসি মুখের মুখোশ। তার চেয়ে আলাদা হাসি মুখোশ ১০০ টাকা টিপসে। মাঝে মাঝে কিছু রেগুলার কাস্টমার, রেগুলার নির্দিষ্ট টেবিলে বসে, রেগুলার একই মেনু অর্ডার করার আগে পরিচিত হাসি দিয়ে বলে "ভালো আছেন ?" তখন একটা মুখোশ, যেটা অনেকটাই মিন্টুর মুখের হাসির কাছাকাছি। রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার বাদল ভাই যখন গালাগালি করে, তখন এক ধরনের অপরাধী মুখোশ। আবার টেবিল থেকে এঁটো প্লেট তুলে নেবার সময়, প্লেটে জমানো মুরগীর হাড্ডি যখন হাত কেঁপে টুক করে পড়ে যায় তরুণী কাস্টোমারের কোলে বিছানো জামার উপরে, তখন সঙ্গে থাকা বীর প্রেমিকের হিংস্র বিরক্ত চেহারায় বলা " আরে স্টুপিড নাকি, দেখে কাজ করেন না কেন ?" এর উত্তরে ভিন্ন ধরনের অনুশোচনার মুখোশ। কোনার দিকের টেবিলটায় বিশেষ কিছু কাস্টোমার আসে, তারা অন্তরঙ্গ হয়। তাদের কাছে যাবার সময় এক ধরনের অভিব্যাক্তিহীন মুখোশ, সেই মুখোশে চোখ থাকলেও যেন অন্ধ। সেই মুখোশ যেন দেখেও দেখেনা ছেলেটার একটা হাত লুকিয়ে ব্যাস্ত লিনেনের নীচে, অজ্ঞাতে। সেই মুখোশ দেখেনা তরুণীর ঠোঁটে ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া লিপস্টিকের রং বা তরুণের গালের কাছে সেই রং এর ছোপ। রাতে মেসে খাবার খাবার সময় সবাই মিলে নোংরা রসিকতা হয়। তখন মিন্টুও তাতে যোগ দেয় মুখোশ এঁটে। সেই মুখোশ এক অতৃপ্ত কামুকের। তাতে কথায় গোপনে লালা ঝরে। ৬ তরুণের ঘরে যৌনতার অদৃশ্য কুয়াশা ভাসে। তারা তাদের কথায় ছিঁড়ে খুড়ে ব্যাবচ্ছেদ করে অস্পৃষ্য কোনো যুবতীর। টিউব লাইটের ঘোলা সাদা আলোয় মিন্টুর বিছানায় বা বায়িং হাউসে চাকরি করা ভোলার সুজনের বিছানায় বসে 2 টাকা বোর্ড নাইন কার্ড খেলার আসর। চারজন খেলোয়াড় যার যার মুখে চতুরতার মুখোশ আঁটে। কেউ কাউকে জিততে দিবে না।

        আমানত উল্লা মিন্টু গভীর ঘুমে স্বপ্নে মাঝে মাঝে দেখে,  জুলাই মাসের এক বিকালে অরেঞ্জ জুস আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেতে খেতে বই পড়তে থাকা ছিপছিপে চশমা পরা সেই তরুণীকে। যে তার দিকে তাকিয়ে বলেছিল "আপনার হাসিটা খুব সুইট"।
স্বপ্নে মিন্টু দেখে সেই তরুণীর সামনে বসে আছে সে, তরুণী টান মেরে মেরে তার এক একটা মুখোশ খুলে ফেলছে, আর অভিমানী স্বরে বলছে
"এই হাসি টাও না, না, এইটাও না। তোমার ওই হাসিটা কই ?"
ফেরিওয়ালা মিন্টুর কাঁধে মুখোশের বোঝা, মিন্টু চীৎকার করে বলতে চায় তার হাসিটা তার মুখে, বলা যায় না। তরুণী মুখোশের পর মুখোশ টান মেরে মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিতে থাকে।

... শেষ রাতে নগরীর রাস্তায় পড়ে থাকে নানা রং এর মুখোশ। দিনের আলো ফুটতেই সেই মুখোশ মিলিয়ে যায়... কারা যেন তুলে নিয়ে যায়... মুখে পরে ফেলে...

No comments:

Post a Comment