আমি করোনা বিশেষজ্ঞ নই। জীবাণু বা জনস্বাস্থ্য বিষয়েও বিশেষজ্ঞতার
ধারেকাছেও যাইনা। তাহলে এটা লিখছি কেন? কারণ, চারদিকে দেখছি, লকডাউনে
হাঁফিয়ে যাওয়া মানুষ, নানারকম পাগলামি করছেন, এবং লকডাউন উঠে গেলেই
করোনামুক্ত পৃথিবীতে আবার নিঃশ্বাস ফেলবেন, এই আশায় দিন কাটাচ্ছেন। এই লেখা
নেহাৎই সাধারণজ্ঞান নির্ভর। কিন্তু স্পষ্ট করে সাধারণ কথাগুলোই বিশেষ কেউ
লিখছেন বলে দেখছি না। তাই এই পুচকে লেখা।
---------
লকডাউন উঠে
গেলেই কি করোনা ফিনিশ? স্পষ্ট করে প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার, না। এই
ধুন্ধুমার লকডাউন উঠে গেলে পৃথিবী আদপেই পৃথিবী করোনামুক্ত হবেনা। একবার
যখন এসে পড়েছে, ভাইরাসটি আছে এবং থাকবে। নির্মূল হবেনা। সে চেষ্টাও পৃথিবীর
কোনো দেশের কোনো স্বাস্থ্যসংস্থা বা সরকার করছেনা। অতএব, যদি নেহাৎই
প্রশান্ত মহাসাগরের কোনো দ্বীপে গিয়ে একাকী বসবাস না করতে পারেন, আজ হোক বা
ছমাস পরে, এর সংস্পর্শে আপনি আসবেনই, যদি না ইতিমধ্যেই এসে গিয়ে থাকেন।
তার মধ্যে কোনো টিকা বেরিয়ে যাবার সম্ভাবনা খুবই কম। (যখন বেরোবে তার পরেও,
ফ্লুয়ের মতোই ভাইরাসের নতুন কোনো গোষ্ঠী সম্ভবত উদয় হবে, টিকা যার কোনো
প্রতিষেধক নয়।) ফলে ভাইরাস নাকের ডগায় এলে আপনার ভরসা আপনার
প্রতিরোধক্ষমতা। কোনো লকডাউন, কোনোভাবেই আপনাকে তার থেকে বাঁচাবেনা।
গোষ্ঠীগতভাবে মানুষ যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জার বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন
করেছে, সেভাবেই করোনার বিরুদ্ধেও করবে। এইটিই একমাত্র পথ। কোনো সরকার, কোনো
স্বাস্থ্যব্যবস্থা, অন্য কোনো পথ এখনও দেখায়নি, দেখানোর সুযোগও নেই। এবং
এই লকডাউন, তথাকথিত সামাজিক দূরত্ব, এসব কেবল এক সাময়িক ব্যবস্থা। এতে করে
ভাইরাস নির্মূল হয়না। ভাইরাল নির্মূল করার কোনো চেষ্টা আদপেও কোথাও করাও
হচ্ছেনা।
তাহলে হচ্ছে টা কী? এই দূরত্ব বজায় রাখা, দরজা বন্ধ রাখা,
এসব দিয়ে একটাই জিনিস হচ্ছে। খুব কায়দা করে যেটাকে বলা হচ্ছে বক্ররেখাকে
সিধে করা। ফ্ল্যাটেনিং দা কার্ভ। অর্থাৎ, ছড়ানোর গতিটা একটু কমানো। নানা
জায়গায় লোক সমাগম হলে খুব দ্রুত ভাইরাস ছড়াবে। দরজা বন্ধ করে রাখলে ধীরে।
অর্থাৎ, আপিস-কাছারি-দোকান-বাজার করলে আপনি হয়তো আগামী কালই ভাইরাসের
সংস্পর্শে আসতেন। এখন দরজা বন্ধ করে রাখার ফলে তিনমাস বা ছমাস পরে আসবেন।
কিন্তু আসবেনই যে, এতে বিশেষ কোনো সন্দেহ নেই। ফলে, যারা করোনাক্রান্ত বা
তার পরিবারকে কুষ্ঠরোগীর মতো করে দেখছেন, পাড়ায় গিয়ে হামলা করছেন, কীটনাশক
দিয়ে স্নান করাচ্ছেন, ডাক্তার-নার্সদের বাড়িছাড়া করছেন, তাঁদের একটাই কথা
বলার। উন্মাদনা দিয়ে ভাইরাস আটকায়না। করোনা যদি কুষ্ঠ হয়, তো এই কুষ্ঠের
সংস্পর্শে আপনাকে আসতেই হবে। আজ বা কাল। এই লকডাউনে ব্যাপারটা একটু
ধীরগতিতে চলছে। এই মাত্র। পরশুদিন আপনার জ্বর হলে, শুকনো কাশি হলে, আপনাকেও
অবিকল এইভাবেই দেখা হবে। পাড়ার লোকে আপনাকেও বলবে, দেকেছো কীরকম ভাইরাস
ছড়াচ্ছিল ব্যাটা? গণশত্রু কোথাকার। মনে রাখবেন, সাবধানতা আর উন্মাদনা এক
জিনিস নয়। সাবধান হয়ে আপনি ভাইরাসকে ধীরগতিকে ছড়াতে দিচ্ছেন। আর উন্মাদ হয়ে
যেটা করছেন, সেটা সামাজিক অস্থিরতা তৈরি।
এবার কথা হল, আজ বা কাল, যখন ভাইরাস নাকের ডগায় আসবেই, তখন এই ধীরগতিতে ছড়িয়ে লাভটা কী? দুখানা লাভ।
১।
বহু লোক একসঙ্গে ভাইরাসের কবলে পড়লে, বেশিরভাগেরই হয় কিচ্ছু হবেনা, কিংবা
সামান্য জ্বর-কাশি হবে, কিন্তু একটা ভগ্নাংশের অবস্থা গুরুতর হবেই। খুব
দ্রুতগতিতে ছড়ালে এই ক্ষুদ্র ভগ্নাংশের সংখ্যাই অনেক বেশি হবে। তাদের
চিকিৎসা করা যাবেনা। বাংলাদেশে যদি ১০ কোটি লোক ৭ দিনে করোনা ভাইরাসের
সংস্পর্শে আসেন, তাঁদের মধ্যে ১০ লাখ লোককে যদি হাসপাতালে যেতে হয়, তাহলে
চিকিৎসা দূরস্থান, হাসপাতালের করিডোর পার করে রাস্তায় অবধি রোগশয্যা পাততে
হতে পারে। পরিকাঠামোর এমনই হাল। তখন চিকিৎসার অভাবেই বেশ কিছু লোক মারা
যাবেন, যারা হয়তো বেঁচে থাকতেন। এই অবস্থা যাতে না হয়, অসুস্থতা যাতে
ধীরেসুস্থে ছড়ায়, হাসপাতালে চাপ না পড়ে, সেই কারণেই ধীরগতিতে ছড়ানোর
প্রস্তাব।
২। ধীরগতিতে ছড়ালে গোষ্ঠীগত প্রতিরোধক্ষমতা, কোনো অলৌকিক
পদ্ধতিতে বেড়ে যেতে পারে। এটা কী করে হবে স্পষ্ট নয়। বিশেষ্জ্ঞরা এ
ব্যাপারে আমার আপনার চেয়ে বেশি কিছু জানেন বলেও মনে হয়না। কীকরে কিছু দেশে
ভাইরাস কম ছড়াচ্ছে, কিছু দেশে বেশি, যেখানে কম ছড়াচ্ছে, সেখানে আদৌ কম
ছড়াচ্ছে কিনা, নাকি মানুষ প্রতিরোধ করে ফেলছে, নাকি অন্য কোনো গূঢ় ব্যাপার
আছে, সেসব কেউই জানেননা। কিন্তু, প্রতিতুলনা দিয়ে বলতে গেলে, এক লহমায়
সবাইকে বাঘের মুখে ফেলার চেয়ে একটু একটু করে ফেললে হয়তো লোকজন বাঘকে আটকেও
দিতে পারে প্রস্তুত হয়ে, চিন্তাপদ্ধতিটা অনেকটা এরকম।
দুটো কারণই
সহজবোধ্য। কিন্তু এগুলো ভাইরাস নির্মূল করার পদ্ধতি নয়। লকডাউন দিয়ে ভাইরাস
নির্মূল হবেনা। চিকিৎসার পরিকাঠামো যাতে ভেঙে না পড়ে, সে জন্য লকডাউন একটি
সাময়িক ব্যবস্থামাত্র। এই সাময়িক ব্যবস্থাপনায় এমনিতে কোনো সমস্যা থাকার
কথা নয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অন্য জায়গায়। চিকিৎসা ব্যবস্থা, এই মূহুর্তে,
কয়েকটি দেশ বাদ দিলে, প্রায় সারা পৃথিবীতেই একটি লাভজনক ব্যবসা। বিশেষ করে
তৃতীয় বিশ্বে সরকারি ব্যয়বরাদ্দ কোথাওই প্রয়োজনের চেয়ে অনেক নিচে। এবং
চিকিৎসা যে মানবাধিকার, এটা প্রায় কেউই স্বীকার করেনা। স্বাস্থ্য এবং
জনস্বাস্থ্যব্যবস্থার অপ্রতুলতার যে দায় সরকারের নেবার কথা, লকডাউন করে
দিয়ে সেই দায় বস্তুত মানুষের ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে। দিগ্বিদিকে কেবলই শোনা
যাচ্ছে লকডাউনই করোনা মোকাবিলার একমাত্র রাস্তা। এবং লকডাউন ভেঙে মানুষ কী
দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো কাজ করে ফেলেছে। কিন্তু সরকারের দায়ের আলোচনা কোথাও
নেই। কেন হাসপাতালে রোগির ভিড় সামাল না দেবার অসুস্থতার চিকিৎসা স্রেফ
লকডাউন দিয়ে করা হবে, কেন চিকিৎসাব্যবস্থা এমন হবে, যে, সতেরো কোটির
দেশে সতেরো লাখ লোককে একদিনে জরুরি চিকিৎসা দেওয়া যাবেনা, কেন বাজেট বরাদ্দে
স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা বহু বহু নিচে, সে আলোচনা উধাও। এখন সব দায়িত্বই
মানুষের। এবং বাদবাকিটা ধীরে-চলো নীতি। এতদ্বারা কোনো অজানা উপায়ে মানুষ
যদি প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন করেই ফেলে, তাহলে বলা যাবে, এই ব্যবস্থা দিব্যি
কাজ করছে। না পারলে, সব দোষ দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষের। অনেকে একসঙ্গে অসুস্থ
হয়ে পড়লে কীকরে সবাইকে চিকিৎসা দেওয়া যাবে? অতএব আপনারই দায়িত্ব অসুস্থ না
হওয়া। রাষ্ট্র তাই আপনাকে বন্দী করে রাখবে। চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেনা।
রাষ্ট্রের বিশেষ দায় নেই, আপনি অসুস্থ হয়ে যাতে না পড়েন, তার জন্য তো তারা
কারফিউ জারি করে রেখেইছে। ব্যস দায়িত্ব খতম।
এবং এটা ভাবা হচ্ছে
এমনভাবে, যেন এর কোনো বিকল্প নেই। বলা হচ্ছে এমনভাবে, যেন লকডাউনই এক ও
একমাত্র অমোঘ ওষুধ, যা ভাইরাস ঠেকাবে। অথচ, তা আদৌ নয়। লকডাউন ভাইরাস
মারেনা। এবং এর বিকল্প বিলক্ষণ আছে। খুব স্বল্পবুদ্ধিতেই, বিকল্প হিসেবে
যেটা হতে পারত, বা পারে, সেটা হল স্পষ্ট করে বলা, যে, লকডাউন কোনো
চিরস্থায়ী সমাধান দেবেনা। ভাইরাস আছে ও থাকবে। সরকার যেটা করতে পারে, তা হল
আক্রান্তদের চিকিৎসার সুযোগ। সেইটুকু করার জন্য লকডাউন কেবল একটু নিঃশ্বাস
ফেলার সুযোগ দেবে। এবং সেই সময়ে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোয় বিপুল বিনিয়োগ করে
যুদ্ধকালীন প্রস্তুতিতে চিকিৎসার সুবন্দ্যোবস্তো করে ফেলা হবে। সরকার সেই
দায়িত্ব নেবে। সমস্ত মানুষের জন্য নেবে। একটা ভাইরাসের জন্য না, আগামীর
সমস্ত সমস্যার জন্য নেবে। বাজেট বরাদ্দ বহুগুণ বাড়বে। এবং স্বাস্থ্য যে
মানবাধিকার, এটা স্বীকৃত হবে। কিন্তু সেই দাবীই কোথাও নেই, ঘোষণা তো পরের
কথা।
এই দাবীগুলো আলোচনায় নেই কেন? তার কারণও পরিষ্কার। পৃথিবী
জুড়েই এক যুদ্ধপরিস্থিতি তৈরি করে ফেলা হয়েছে। যুদ্ধের উন্মাদনা তৈরি করে
ফেলা হয়েছে। কোনো যুদ্ধ ছাড়াই। রাষ্ট্র সমস্ত ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছে, কিন্তু
প্রাথমিক বিষয়গুলো নিয়ে তার আর কোনো দায়িত্ব নেই। কারণ এখন যুদ্ধপরিস্থিতি।
এখন শুধু জরুরি ভিত্তিতে শত্রু ঠেকানোর লড়াই। বাকি সবই গৌণ। এই লড়াইয়ে
প্রতিটি মানুষই সৈন্য। তাদের শৃঙ্খলাপরায়ণ হতে হবে। শৃঙ্খলা ভাঙলে শাস্তি।
কেউ কেউ আবার শৃঙ্খলা ভেঙে ভাইরাস পক্ষের গুপ্তচরও হতে পারেন, তাঁরা
গণশত্রু। সেই কারণে প্রয়োজন তীব্র নজরদারি। কারণ এখন যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধের
জয়-পরাজয় সবার আগে, সেনার কোর্ট মার্শাল হয়, তাদের জন্য অন্য নিয়ম। তাদের
কোনো নাগরিক অধিকার নেই, থাকতে পারেনা। ব্যক্তির যে অধিকারগুলি গত একশ বছরে
অর্জন করা গেছে, সেসবের আর কোনো মূল্য নেই। যে অধিকারগুলি, যেমন সবার জন্য
স্বাস্থ্য, গণতান্ত্রিক পরিসরে রাষ্ট্রীয় নজরদারি বন্ধ করা, এসব এখন
পিছনের আসনে। করোনা তো আগে তাড়াই দাদা।
গত একশ বছরে কোনো যুদ্ধ
নিয়ে, পৃথিবী জুড়ে এমন ঐকমত্য দেখা যায়নি। গত পঞ্চাশ বছরে নাগরিক জীবনে
রাষ্ট্রের অবাধ হস্তক্ষেপ নিয়ে ডান ও বাম উদারনৈতিক ও রক্ষণশীলদের মধ্যে
এমন একমত হওয়া দেখা যায়নি। গোটা পৃথিবী এখন শৃঙ্খলার নিগড়ে বাঁধা।
সেনাবাহিনীর মতই শৃঙ্খলিত। শুধু মজা এই, যে, এই যুদ্ধ শত্রুকে নির্মূল করার
নয়। ভাইরাস এভাবে নির্মূল হবেনা। স্বাস্থ্যকে মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণার,
স্বাস্থ্যের পরিঠামো বাড়ানোর, স্বাস্থ্যে রাষ্ট্রের দায়িত্ব সুনিশ্চিত করার
একটা চেষ্টা করলে বরং একটা দীর্ঘমেয়াদি বদল আসতে পারত। কিন্তু সে চেষ্টাও
কেউ করছেনা। এখনও যুদ্ধ চলছে।
No comments:
Post a Comment