Wednesday, October 12, 2022

আমরা সবাই চতুর টাইপের বোকা

আব্দুল গফুর মিয়া এই শহরের একজন দুধ বিক্রেতা। তিনি চিকন বুদ্ধির বাঙালি, তাই ১০ লিটার দুধে ৫ লিটার পানি মিশিয়ে ১৫ লিটার করলেন। সামান্য বুদ্ধিতে পাক্কা পাঁ-চ লিটার লাভ!! খুশিতে চোখ চকচক করে ওঠে তার।
দুধ বিক্রির টাকা পকেটে নিয়ে তিনি চাল কিনতে যান সাবু মুদির দোকানে। সাবু মুদি তাকে 'অতি উত্তম চাউল', 'এরকম চাউল কোথাও পাইবেন না' ইত্যাদি বলে শেষে পাথর মেশানো চাল বিক্রি করে। ওজনেও আধা কেজি কম দেয়।'কত লাভ করে ফেললাম' ভেবে বেজায় খুশি সাবু মুদি লাভের টাকা নিয়ে বাজারে যায় মাছ কিনতে।
মাছ বিক্রেতা সুরুজ মিয়া তাকে ফরমালিন মেশানো পচা মাছ ধরিয়ে দেয় কেনা দামের দ্বিগুন মূল্যে। তার লাভ করতে হবে না?
কিছুক্ষণ পরে সুরুজ মিয়ার কাছে খবর আসে, তার ছেলেটা এক্সিডেন্ট করেছে। দ্রুত সে তার ছেলেকে হাসপাতালে নেয়। হাসপাতালের একজন ধান্দাবাজ দালাল 'ভালো চিকিৎসা' র ব্যবস্থা করে দেবার কথা বলে ভংচং বুঝিয়ে সুরুজ মিয়ার কাছ থেকে ভালো পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেয়।
সেই ধান্দাবাজ বাড়ি ফেরার পথে পড়ে ছিনতাইকারীর হাতে। ছিনতাইকারী তার পেটে ছুরি মেরে সব টাকাপয়সা ছিনিয়ে নেয়।পালিয়ে যাবার সময় ছিনতাইকারী ধরা পড়ে পুলিশের হাতে। পেদানি দিয়ে সব টাকা নিয়ে নেয় পুলিশ।রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা বা ভিক্টিমের কাছে ফেরত দেয়া কোনটাই করেন না পুলিশ অফিসার।
সেই পুলিশের ছেলে আবার হয়ে পড়ে ইয়াবা আসক্ত.. মাদকের পেছনে টাকা ঢেলে প্রতিনিয়ত সে খালি করে দেয় বাবার পকেট..।
আর মাদক বিক্রেতা সেই টাকায় হয়তো কিনতে থাকে আব্দুল গফুর মিয়ার সেই পানি মেশানো দুধ।

যারাই অবৈধ পথে উপার্জন করে, তারাই মনে করে যে সে 'বিরাট লাভ' করে ফেলেছে। কিন্তু আসলে তা নয়।সে একজনকে ঠকাচ্ছে, আবার তাকে ঠকাচ্ছে অন্য কেউ।যেহেতু সমাজের প্রত্যেকেই একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল, আল্টিমেটলি সবাই চক্রাকারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।বাইরে থেকে হয়তো মনে হয় অসৎ লোকগুলোই সফল, তারাই সুখে আছে। আসলে তা নয়। তারা নিজেরা হয়তো মনে করে এইভাবে তারা খুব ভালো থাকবে, আসলে তাও হয় না। অসৎ পথে উপার্জন করে শেষ পর্যন্ত কেউ পার পায় না। পরকাল তো পরের কথা, দুনিয়াতেই তারা পেয়ে যায় ফিরতি হিসাব।প্রকৃতির নিয়ম হলো, এখানে কাউকেই ছেড়ে দেয়া হয় না। আজ কিংবা কাল।

Thursday, September 29, 2022

দ্যা আর্ট অফ থিংকিং ক্লিয়ারলি



একবার এক রাজা সিদ্ধান্ত নিলো সে দুধের পুকুর বানাবে। সব প্রজাদের ইনস্ট্রাকশন দেওয়া হলো সবাই পরদিন সকালে এক কলসি দুধ নিয়ে পুকুরে ঢালবে। রাতে সবাই ভাবলো ” আমি যদি এক কলসি পানি দেই তাতে কোন সমস্যা হবে না, যেহেতু সবাই দুধ নিয়ে যাবে” ফলাফলঃ দুধের বদলে পানির পুকুর হয়ে গেলো।

একটি ট্রাক থেকে একজন মানুষ ১০০টি ইট নামাতে যদি ১০ মিনিট সময় লাগে তাহলে ৮ জন মানুষ ৮০০ ইট নামাতে কতো সময় লাগবে?
সহজ প্রশ্ন। হয়তো ক্লাস ওয়ান টু থেকেই শুনে আসছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে গণিত আপনাকে সহজ উত্তর ১০ মিনিট বললেও মনোবিজ্ঞান বলবে ; না, সময়টা বাড়বে। দলের উপর নির্ভরশীলতার কারণে বা ব্যাক্তিগত নৈপুণ্য একচেটিয়াভাবে প্রদর্শিত না হওয়ার কারণে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় প্রোডাক্টিভিটি কমে যাওয়ার এই প্রভাবকে বলে ‘সোশ্যাল লোফিং’

এই বিষয়ে ১৯১৩ সালে করা ম্যাক্সিমিলিয়ান রিঙ্গলম্যানের করা একটি এক্সপেরিমেন্ট সর্বাধিক আলোচিত। তিনি পরীক্ষা করে দেখেন যে একজন ব্যাক্তিকে একটি দড়ি টানতে দিলে সে যে পরিমাণ বল প্রয়োগ করে ২ জনকে দিলে একেকজন তার প্রায় ৯৩% প্রয়োগ করে। সহযোগীর সংখ্যা ৩ হলে বল প্রয়োগ কমে হয়ে যায় প্রায় ৮৫%। একইভাবে সর্বোচ্চ ৮ জনের দলে একেকজন নিজের সামর্থ্যের প্রায় ৪৯% প্রয়োগ করে।

সর্বপ্রকার দলীয় কাজে যে সোশ্যাল লোফিং ঘটবে ব্যাপারটা তা’ও না। নৌকা বাইচের দল যতটা সোশ্যাল লোফিং এর স্বীকার হয়, রিলে রেসের দল ততটা হয় না। একেবারেই হয় না বলা চলে। কারণ রিলেতে ব্যাক্তিগত নৈপুণ্য শতভাগ দৃশ্যমান।

ব্যাপারটাকে আপাতদৃষ্টিতে যতটা স্বার্থপর মনে হচ্ছে আসলে ততটা না। দলের আকারের কারণে প্রোডাক্টিভিটি সাধারণত আমরা ইচ্ছা করে কমিয়ে দেই না। বরং আমাদের মস্তিষ্কই অবচেতনভাবে ফিল্টার করে নেয়। উদাহরণস্বরূপ একটা মিটিং এর কথাই ধরা যাক। ৫ জনের একটা মিটিং’এ আপনি যেভাবে পার্টিসিপেট করেন, ৫০ জনের মিটিং হলে কি সেভাবে করেন? করেন না। এটার মানে কিন্তু এই না যে, ৫০ জনের মিটিংটাকে আপনি কম গুরুত্ব দিচ্ছেন। বরং আপনার মস্তিষ্কই ফিল্টার করে দেয় যে “যেহেতু এখানে মানুষ বেশি, সুতরাং চুপ থাকো”।

এর মানে কী দলের আকার সবসময় ৫ জনেরই হতে হবে? না। আপনার দল কতো বড় হলে সর্বাধিক প্রোডাক্টিভিটি আশা করতে পারেন সেটা সম্পূর্ণই আপনার বিবেচনা। তবে এ সম্পর্কে অ্যামাজনের সিইও জেফ বেজোসের ‘২ পিৎজা নীতি’ সর্বমহলে সমাদৃত। তার থিওরী হচ্ছে দলের আকার এমন হওয়া উচিত যেন পুরো দলকে ২ টি পিৎজা দিয়ে আপ্যায়ন করা যায়। আপনার দল যদি তার চেয়েও বড় হয় তাহলে ধরে নিতে হবে আপনি এবং আপনার দল সোশ্যাল লোফিং’এর স্বীকার হতে যাচ্ছেন। কিছুটা অবাস্তব মনে হলেও অল্পকিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া প্রায় সবরকম দলের ক্ষেত্রেই এই থিওরী খেটে যায়।

পক্ষান্তরে ব্যাপারটাকে যতটা নিষ্পাপ মনে হয়, সবসময় ততটাও না। আপনি যদি একজন কর্পোরেট চাকুরীজীবি হয়ে থাকেন তাহলে আপনার অফিসের দিকে তাকান (কিংবা নিজের দিকেই)। আপনার যে কলিগ বসের সামনে সারাদিন ” কোম্পানীর স্বার্থ, কোম্পানীর স্বার্থ” বুলি ফোটায়, সে ইউরোপ আম্রিকা ট্রিপের মূলা ঝুলানো থাকলে নিজের একটা কাজ যতটা এফোর্ট দিয়ে করে, আপনার লিডারশীপে দলীয় একটা কাজে কী ততটা এফোর্ট দেয়? যত বড় ‘কোম্পানীর স্বার্থ’ই জড়িত থাকুক। অথবা আপনি নিজে কী একই দোষে কখনো দোষী হন নি?
(কর্পোরেট ভাইয়েরা মারতে আসবেন না প্লিজ। একটা উদাহরণ লাগতো, নিজের পিঠ বাঁচালাম জাস্ট)

যেসব চালাক ভাইয়েরা সোশ্যাল লোফিংকে ব্যাক্তিগত স্বার্থ সিদ্ধির মাধ্যম হিসেবে ব্যাবহার করেন তাদের হিসাব আলাদা। তবে আসল সোশ্যাল লোফিং’এর যেসব সমাধান বিশেষজ্ঞরা দিয়ে থাকেন তার কয়েকটা হলোঃ দলের আকার ছোট রাখা, সবার অবদানকে দৃশ্যমান রাখা, স্কিল অনুযায়ী কাজ ভাগ করা, যার যার কাজ অনুযায়ী প্রণোদনার ব্যাবস্থা রাখা, সব কাজের ইভালুয়্যাশনের ব্যাবস্থা করা ইত্যাদি।

সবচেয়ে প্র‍্যাকটিক্যাল সমাধান পাওয়া যায় বোধহয় সামরিক বাহিনীতে। একদম প্রথম সমস্যাটায় ফিরে যান।
সমাধানঃ You all are going to unload 100 bricks each from the truck. Once you are done, report individual timing to the adjutant. Break off!!

Thursday, August 4, 2022

ব্যক্তির নাম ও ধর্ম




ধর্মের সাথে আমাদের দেশের ব্যক্তির নামের একটা সম্পর্ক খুঁজতে শুরু করেন আমাদের ধর্মপ্রাণ ভাইয়েরা। এটা অবশ্য জন্ম হতেই আমরা দেখছি। প্রণব দাস নাম শুনলেই ধরে নেওয়া হয় এই লোকটা অন্তত মুসলিম হতে পারে না।

ঠিক কতটা এই দেশের মানুষ নিজস্ব সত্ত্বা বা পরিচয় হারিয়ে ফেলে ধর্ম পরিবর্তনের সাথে সাথে তা এই বাংলাদেশের মানুষদের দিকে না তাকালে বুঝা মুশকিল হয়ে যাবে। রতন পাল যখন মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করলো হোক সেটা কোন না কোন কিছুর চাপে, তাকে আর রতন পাল নামে ডাকা যাবে না, সঙ্গে সঙ্গে রই রই পড়ে গেল নাম পাল্টানোর জন্য। নাম খোজা শুরু হলো, যাই হোক ফাইনালি কনভার্টেড ব্যক্তিই নিজের নাম কিভাবে বুঝতে না পেরে অফিসের বড় বাবু সাহায্য করলেন, রতনের আগে রাইসূল ইসলাম লাগিয়ে নাম রাখা হলো “রাইসূল ইসলাম রতন”। আগে অফিসের সকলে রতন দা বলে ডাকতো, এখন সকলেই রতন ভাই বলে। কারন ‘দা’ শব্দটা ডাকলে গুনা টাইপ কিছু হয় কি না, যা নাকি হিন্দু হিন্দু টাইপ। অর্থাৎ মুহূর্তেই রতন পাল তাদের পূর্ব বংশের সব ভুলে নতুন রুপে পৃথিবীতে আসলেন।

ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম ধর্মপ্রচারকেরা যে পরিমাণ আরবীভাষী দেশ থেকে এসেছিলেন, নিকটবর্তী হওয়ায় তার চেয়ে অধিক পরিমাণে এসেছিলেন পারস্য থেকে। সে কারণে আমাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান আরবী প্রভাবের তুলনায় ফার্সী প্রভাব বেশ দেখা যায়। মোগলদের শাসন আমলে ফার্সী রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা পেয়েছিল। ফার্সী প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা ছিল বলেই সমাজজীবনে ফার্সী অধিক বিস্তৃতি লাভ করেছিল। ব্যক্তির নামকরণসহ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের নামকরণের আরবীর তুলনায় ফার্সীর প্রভাব বেশী। যেমন খোদা, খোদা হাফেজ, নামাজ, রোজা, শবেবরাত, শবেকদর ইত্যাদি। ফার্সী ভাষায় ব্যক্তির নাম সেলিম অত্যন্ত ইতিবাচক হলেও আরবীভাষী ইরাকীরা কুকুরকে সেলিম বলে থাকে। আরবী এবং ফার্সী ভাষার পার্থক্যে ব্যক্তির নামও ভিন্ন অর্থ বহন করে।

আমাদের দেশে বর্তমানে হিন্দুদের ধর্মালম্ব্বীদের নাম এই দেশের বাংলা ভাষার অর্থ বহন করে এমন কিছু শব্দ দিয়েই রাখে যদিও ডাক নামের সাথে খাতা কলমে রেজিস্টার নাম বা প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট নাম আলাদা হয়। কিন্তু ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা নাম রাখেন মূলত আরবী বা ফার্সি শব্দে। যেমন সেলিম নামটা ফার্সী ভাষায় ইতিবাচক কিছু হলেও আরবীভাষী ইরাকীরা কুকুরকে সেলিম বলে থাকে।


অর্থাৎ বলা যায় এই দেশের মানুষেরা ইসলাম গ্রহণ করার সাথে সাথে নিজদের সমৃদ্ধ ভাষা ও সস্কৃতি সেটাকে হারিয়ে ফেলেছে হোক না সেটা পল্টু বা বল্টু ইত্যাদি, সেটাতো আমাদের পূর্বপুরুষদেরই পরিচয় বহন করে।
ইরানীরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও নিজদের সমৃদ্ধ ফার্সী ভাষা-সস্কৃতি পরিত্যাগ করেনি। মুসলিম-অধ্যুষিত এবং মুসলিম রাষ্ট্র ইরানে নামাজ আদায় ব্যতীত অপর কোন ধর্মীয় আচারে আরবী ভাষার প্রচল নেই। এমনকি ইরানীদের জীবনাচারের ক্ষেত্রেও আরবী ভাষার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন।


ইরানের পার্সী ধর্মালম্বরীরা যাদের অগ্নিউপাসক বলা হয়, ধর্মীয় নিপীড়ণের মুখে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তারা ছড়িয়ে রয়েছে। ভারতবর্ষেও প্রচুর পার্সী সম্প্রদায়ের লোক সুদীর্ঘকাল যাবৎ বসবাস করে আসতেছে।

ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওরলাল নেহেরুর একমাত্র সন্তান প্রয়াত ইন্দিরা নিজ পছন্দে বিয়ে করেছিলেন পার্সী সম্প্রদায়ের ফিরোজ গান্ধীকে, যার বাবার নাম জাহাঙ্গীর গান্ধী। স্বামীর পদবীতে ইন্দিরা হয়ে যান ইন্দিরা গান্ধী। গান্ধী অবশ্য বণিক পদবী যা হিন্দু – পার্সী উভয় সম্প্রদায়ের লোকেরাই রাখে।
ভারতের টাটা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জামশেদ টাটা পার্সী ধর্মালম্বী। বিহারে টাটানগর, জামশেদপুর তারই নামানুসারে। ফিরোজ, জাহাঙ্গীর এবং জামশেদ অগ্নিপূজারী। তবে ফার্সী ভাষার তাদের নাম দিয়ে সম্প্রদায়গত পরিচয় নির্ধারণ অসম্ভব। ফার্সী ভাষার ঐ নাম মুসলিম বিবেচনায় প্রচুর মুসলিম সম্প্রদায়ের ব্যক্তির নাম ফিরোজ, জাহাঙ্গীর এবং জামশেদ রয়েছে। সম্প্রদায় ভিন্ন হলেও ফার্সী জাতিসত্তার প্রত্যেকের নাম মাতৃভাষাভিত্তিক। সেজন্য ফার্সী ভাষাভিত্তিক নাম দিয়ে সম্প্রদায়গত পরিচয় চিহ্নিত করা যায় না।
চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, মঙ্গোলিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম এবং মিয়ানমার, দুই কোরিয়াসহ এশিয়ার দেশগুলোতে কারো নামই ধর্মভিত্তিক নয়, যার যার মাতৃভাষা ভিত্তিক। একমাত্র মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের নাম আরাকান এবং আরবী-ফার্সী ভাষায় দেখা যায়।


তাহলে আমাদের দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের নাম মাতৃভাষাভিত্তিক হতে সমস্যা কোথায়? মূল কারণ হতে পারে ধর্মীয় গোড়ামী। কিন্তু কম ধার্মিক ও বেশী ধার্মিক বলে তো কোন টার্ম নেই। তাহলে কি এশিয়ার অন্যান্যদেশের মানুষেরা ধার্মিক নয়?

তথ্যসূত্র: নতুন দিগন্ত, জানু-মার্চ ২০১৩ সংখ্যা।

Wednesday, August 3, 2022

স্যার সৈয়দ আহমদের শ্রেণীবৈষম্য

“স্যার সৈয়দ আহমদ খান বাহাদুর ভারতের মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেন। তিনি এই কাজের জন্যই মোহামেডান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন যা পরবর্তীতে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিতি লাভ করে”

>ব্রিটিশ আমলে অনগ্রসর-পশ্চাদপদ মুসলমানদের শিক্ষাবিস্তারে স্যার সৈয়দ আহমদ বিশাল অবদান রেখেছিলেন। উইকিতেও লেখা আছে উপরের লাইনগুলো।

অথচ আবু জাফর শামসুদ্দিনের লেখায় পড়লাম, ‘স্যার সৈয়দ আহমদ সপিরষদ গভর্নর জেনারেলের কাছে লিখিতভাবে সুপারিশ করেছিলেন যে, উচ্চস্তরের প্রশাসনিক চাকরিতে কেবলমাত্র শরিফ পরিবারের মুসলিম যুবকদের নিয়োগ করা উচিত।’

প্রিয় পাঠক এই বাক্যের 'কেবলমাত্র শরিফ পরিবার’ বাক্যাংশে চোখ আটকাতে বাধ্য আমাদের। আজ থেকে ১৫০ বছর আগে ভারতবর্ষের শিক্ষা বিস্তারে সৈয়দ আহমদের অবদান অনস্বীকার্য, কিন্তু যে লোক নিম্নবর্গের মুসলিম পরিবারের উন্নতিতে বাধা দিয়েছিলেন, আশরাফ-আতরাফ বৈষম্য বজায় রাখার চেষ্টা করেছিলেন, তাকে কি খুব একটা শ্রদ্ধার চোখে দেখা যায়?

তথ্যসূত্রঃ স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটির ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত 'বাংলাদেশে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা’ বইয়ের প্রবন্ধ ‘প্রগতিবাদী আন্দোলনের ধারায় আলেম সমাজ-আবু জাফর শামসুদ্দীন’ পৃ-২১ ।

Tuesday, July 26, 2022

সমসাময়িকদের বিচার

সুনীল কোনও একটা লেখায় বলেছিলেন, তিনি তার সমসাময়িকদের বিচার করতে চান না। পূর্বসূরীদের কাজকে মূল্যায়ন করতেই তিনি পছন্দ করেন। সমসাময়িকদের ব্যাপারে চুপ থাকাই ভালো, তাদের বিচার করবে ভবিষ্যত প্রজন্ম। ঠিক কোন লেখায় সুনীল এ কথাগুলো বলেছিলেন তা আপাতত মনে পড়ছে না। তবে কথাগুলোকে ব্যক্তিগত ফিলোসফির অংশ করার চেষ্টা করছি অনেকদিন ধরেই, যদিও পুরোপুরি মেনে চলা সম্ভব হয় না। অনলাইনে এ ওর বিরুদ্ধে বক্তব্য, অমুকের বিরুদ্ধে তমুকের অভিযোগ দেখে দেখে ক্লান্ত। বাংলাদেশে কাউকে অসম্মান করতে প্রমাণ ছাড়াই অভিযোগ করাই যথেষ্ট। বিশ্বাসীরা আছেই তা লুফে নেয়ার জন্য। পুলিশ রেডি হয়ে আছে নির্দোষ-অপরাধী সবাইকেই গ্রেফতার করে মডেলদের মত দুই পাশে দাঁড়িয়ে মিডিয়ার সামনে ফটোসেশন করার জন্য। কে যে ঠিক আর কে যে ভুল তা আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ঢোকে না। এর চেয়ে সুনীলের মত পূর্বসূরীদের নিয়ে ব্যস্ত থাকাটাই মঙ্গলজনক মনে হচ্ছে।

“এখনও বহু বাধা হইতে হবে পার
আত্ম-কলহের বিষম পারাবার…

Tuesday, July 19, 2022

বাঙালী মুসলমান - আবদুল হক

“এক কালে বাঙ্গালী মুসলমানকে এমন কথাও কেউ জিজ্ঞাসা করতে পেরেছিল, ‘আপনি বাঙালী না মুসলমান’?… বাঙালী মুসলমান তার দীর্ঘ দিনের ইতিহাসে নিজেকে প্রবলভাবে এবং অবিচ্ছিন্নভাবে, অকুন্ঠিতভাবে এবং সগৌরবে নিজেকে বাঙালী বলে ঘোষণা করেনি। ঘোষণা করার কথাও তার মনে লক্ষনীয়ভাবে জাগেনি। আর এই কারণে বাঙালী হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তার ইতিহাস ব্যর্থতায় সমাকীর্ণ। এবং এ ব্যর্থতা কোনো এক বিশেষ ক্ষেত্রে নয়, প্রায় সব ক্ষেত্রেই।…

বাঙালী মুসলমান অতীতে সর্বদাই নিজেকে মুসলমান মনে করেছে; কিন্তু সেই সঙ্গে বাঙালীও মনে করেনি এবং এই কারণে তার ইতিহাস পৃথিবীর অন্যান্য ভূভাগ থেকে আগত মুসলমানদের ইতিহাসের অপ্রধান অংশমাত্রে পর্যবসিত হয়েছে। বাঙালী মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় ইতিহাস প্রধানতঃ বাংলায় আগত অবাঙালীদের রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের অঙ্গ মাত্র, এমনকি সে ইতিহাসে লীন। বাংলার ইতিহাস তাই আর যা কিছু হোক, বাঙালী মুসলমানের ইতিহাস নয়।…

এই ইতিহাস নিরীক্ষণ করলে মনে হয়, বাঙালী মুসলমানের ইতিহাস অনেকাংশে পশ্চিমাগত মুসলমানদের কাছে তার আত্মলোপ প্রচেষ্টারই ইতিহাস। বাঙালী মুসলমান যে বাঙালী, পশ্চিমাগত নয়, এই চিন্তার দ্বারা যেন সে পীড়িত হয়েছে; বাঙালী হওয়াটাকে সে যেন একটা অপরাধ বলেই গণ্য করছে; তাই সকল ক্ষেত্রে পশ্চিমাগত মুসলমানদের নেতৃত্বকে-তা ভালোই হোক আর মন্দই হোক-মেনে নেওয়াটাই তার মনে হয়েছে অবশ্যকরণীয়; বাঙালী মুসলমান তার নাম, তার পরিচ্ছদ, তার ধর্মচিন্তা, তার দর্শন-বিজ্ঞান-সংস্কৃতি-চিন্তা পুরোপুরি তাদের কাছ থেকে নেওয়ার চেষ্টা করেছে; সাহিত্যের উপাদান ও উপাখ্যানও প্রধানতঃ নিয়েছে তাদের কাছ থেকে; তার ভাষাকে বদলাবার চেষ্টা করেছে, কখনো কখনো বাংলা বর্ণলিপিও বর্জন করতে চেয়েছে, এমনকি বাঙলা ভাষাকেও অস্বীকার করার প্রয়াস পেয়েছে। সেই সঙ্গে অনেক বাঙালী মুসলমানের প্রবল ঔৎসুক্য দেখা গেছে নিজেকে কোনো আরব অথবা ইরানীর উত্তরপুরুষ বলে প্রমাণ করার জন্য।…

বাঙালী মুসলমান স্বদেশের ইতিহাস থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে অন্য মুসলিম দেশের ইতিহাসের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করতে চেয়েছে; অন্যভাবে বলতে গেলে, বাঙালী মুসলমান অন্যদেশের মুসলমানের ইতিহাসকেই নিজের ইতিহাস মনে করেছে, নিজস্ব ইতিহাস সৃষ্টির চেষ্টা করেনি; অন্য দেশের মুসলমানের জয়ে আনন্দ বোধ করেছে এবং পরাজয়ে বিমর্ষ হয়েছে, নিজে বিজয়ী হতে চায়নি।…

বাঙালী মুসলমান যদি নিজেকে বাঙালী মনে করতো, সগৌরবে এবং সবলে নিজেকে বাঙালী বলে ঘোষণা করতো এবং নিজের সত্তা ও ব্যক্তিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইতো তবে তার গোষ্ঠীচেতনা প্রবল হতে পারতো, তার চিন্তা সংহত হতে পারতো এবং অনুকরণবৃত্তি এত প্রবল হতে পারতো না। কিন্তু ঠিক এই বাঙালী হওয়াটাকেই সে একটা অনুচিত কাজ মনে করে এসেছে।…
স্বাধীনতার যুগে এ অবস্থার কিছু পরিবর্তন হয়েছে। এ যুগে অবাঙালী-অধ্যুষিত পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সহ-অবস্থান করতে গিয়ে বাঙালী মুসলমানকে ভাবতে হচ্ছে যে, সে বাঙালী। স্বাধীনতা-পূর্ব কালের তুলনায় এ চেতনার প্রকৃতি পৃথকঃ তখন হিন্দুর সঙ্গে সহ-অবস্থান করতে গিয়ে তাকে ভাবতে হতো সে মুসলমান; স্বাধীনতার যুগে অবাঙালী পাকিস্তানীদের সঙ্গে সহ-অবস্থান করতে গিয়ে স্বার্থ-সংঘাতের তাড়ণায় তাকে ভাবতে হচ্ছে সে বাঙালী। এ ভাবনার একটা প্রবল উজ্জ্বল ঐতিহাসিক উদাহরণ ভাষা আন্দোলন।…

কার ঐতিহ্য কতখানি সমৃদ্ধ এবং গৌরবময় সেটা একটা আপেক্ষিক ব্যাপার-আসল কথা হচ্ছে চেতনা ও গৌরববোধ। অন্যান্য দেশের কথা বাদ দিলেও পাকিস্তানে পাঠান, পাঞ্জাবী এবং সিন্ধীরাও সে-চেতনার অধিকারী, সে-চেতনায় সমৃদ্ধ ও বলবান। বাঙালী মুসলমান কখনই এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন হতে পারেনি। সে সচেতন হতে পারেনি যে তার গৌরববোধ, তার ঐতিহ্যবোধ কখনো অন্য ভূখণ্ডের মতো হতে পারে না। এমনকি অন্য কোনো মুসলিম মানব-গোষ্ঠীরও মতো নয়। সে সচেতন হতে পারেনি যে সে আরব নয়, ইরানী নয়, পাঠান-পাঞ্জাবী-সিন্ধী নয়-বাঙালী। তার প্রাকৃতিক পরিবেশ, তার ভাষা, এবং তার আরও অনেক নিজস্ব সম্পদ তাকে অলঙ্ঘনীয়ভাবে পৃথিবীর আর সব মানব-গোষ্ঠী থেকে স্বতন্ত্র করে দিয়েছে।… শুধু ধর্মের ঐক্য দিয়ে এই স্বাতন্ত্র্যকে মুছে ফেলা সম্ভব না, সম্ভব হয়নি কখনো। কিন্তু বাঙালী মুসলমান ঠিক এই ব্যাপারেই সচেতন থাকতে পারেনিঃ বহুকাল যাবৎ এই একটি কথা মন্ত্রের মতো তার কানের কাছে আওড়ানো হয়েছে যে ধর্ম ছাড়া বিবেচনা করার আর কিছু নেই, গর্ব করার আর কিছু নেই, এবং ধর্মপ্রাণতার বড়ো প্রমাণই হচ্ছে নিজের বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তিত্ব ভুলে আরব-ইরানিয়ার চর্চা করা। নানাভাবে তাকে বোঝানো হয়েছে যে সে যে বাঙালী, একথা ভুলে যাওয়াই মুসলমানত্বের পরম পরিচয়। পুঁথি-সাহিত্য সহ সমগ্র মুসলিম বাংলা সাহিত্যকে পরিমাণগতভাবে দেখলে দেখা যাবে, এই সাহিত্যে বাঙালী মুসলমানের কথা আজ পর্যন্ত যত লেখা হয়েছে, অবাঙালী মুসলমান, অবাঙালী অমুসলমান, এবং আরব-ইরানী সংস্কৃতির কথা লেখা হয়েছে ঢের বেশী”।…

বাঙালী মুসলমানঃ ভূমিকা ও নিয়তি
-আবদুল হক।

>>১৯৭১ সালের আশেপাশের সময়কালে বাঙালী মুসলমান অনেকটাই বাঙালী হয়ে উঠেছিল, ফলস্বরূপ সফলতাও পেয়েছিল হাতেনাতে। আজ তারা আবার বাঙালীয়ানা বাদ দিয়ে মুসলমান হতে ব্যস্ত। অর্থাৎ হাজার বছরের পুরনো রাত আবার বাড়ছে। সিকানদার আবু জাফর সম্পাদিত প্রগতিশীল পত্রিকা ‘সমকাল’-এ ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত এই প্রবন্ধটি তাই এখনও প্রাসঙ্গিক। এই প্রবন্ধটি আবদুল হকের ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ ও অন্যান্য প্রবন্ধ বইতে আছে।

অং-বং ধর্মের সংস্কৃতি ও আদি ঐতিহ্য

আপনি কি জানেন মূর্তি ভাংগা, বাড়িঘর লুটপাট অং-বং ধর্মের সংস্কৃতি ও আদি ঐতিহ্যেরই অংশ। অং-বং ধর্মের অবতার নিজে ভেঙেছিলেন। সুতরাং অং-বং ধর্মের অনুসারীরা প্রতিবার ভুং-চুং ধর্মের উৎসবের সময় মূর্তি ভাংগে,ভাংবে। আবার অং-বংদের অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হলেও এমন হয়। এই নিয়ে অবাক হবার কিছু নেই, প্রতিবাদ করেও লাভ নেই, কারণ অং-বং ধর্মের লোকেরাই হীরক রাজার দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাছাড়া হীরক রাজা নিজেই একজন নিষ্ঠাবান অং-বং। তিনি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে অং-বং ধর্মের মহাপবিত্র গ্রন্থাবলী পাঠ করেন, প্রতি পাঁচ বছর অন্তর-অন্তর তীর্থস্থানেও যান এবং অং-বং সনদের মাধ্যমেই তিনি দেশ পরিচালনা করেন। শুধু তাই না, রাজার প্রতিদ্বন্দ্বীরাও একেকজন আরও সাচ্চা অং-বং।


আমরা সবাই জানি, অং-বং রাই সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় ধর্মগোষ্ঠী এবং আধুনিক বিজ্ঞানের সবকিছুই অং-বং ধর্মগ্রন্থ থেকে আবিষ্কার হয়েছে। এই যে কয়েকদিন আগে জেমস ওয়েবের টেলিস্কোপ ছবি ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগের মহাবিশ্বের গভীরতম এবং পরিষ্কার ইনফ্রারেড ছবি তুলেছে তার কথাও অং-বং মহাধর্মগ্রন্থে আছে। দুর্মুখ নিধর্মী বিদ্বেষীরা ভুং-চুংদের সাথে হাত মিলিয়ে মহাসম্মানিত অং-বংদের নামে উল্টা-পাল্টা মিথ্যা ছড়ালে কিন্তু হীরক রাজার দরবারে অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ দায়ের করা হবে। হীরক রাজার এক সভাসদ যিনি কিনা আবার প্রাক্তন বীরযোদ্ধা তিনিও অনুভূতিতে আঘাতের মত ন্যাক্কারজনক অপরাধ করে বাঁচতে পারেননি। সুতরাং, সাধু সাবধান। মনে রাখবেন, অং-বংদের মন ভাংগা ভুং-চুংদের বাড়িঘর লুটপাট, মূর্তি ভাংগার চাইতেও বড় অপরাধ।

[একটি কাল্পনিক ছোট গল্প, বাস্তবের সাথে কেউ মিল খুঁজে পেলে আমি দায়ী নই।]

Monday, June 27, 2022

কবিদের দুঃখ



“"আসলে কবি যেহেতু এগিয়ে থাকা মানুষ তাকে আলাদা ভাবে বাঁচতে হয় ; অন্য জীবনযাপন করতে হয় । এই সমাজ ও সভ্যতা তার হাতে দেগে দিয়েছে অস্বীকারের উল্কি। এবং যা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে তিনি সব কিছুই মেনে নিচ্ছেন। জন্মের জন্য সঙ্গম দরকার হয় । কবিতার জন্য অস্বীকার। যা দরকার তা ক্রোধ, ঘৃণা ও উদ্বেগ । যা দেখতে পাই তা অভিমান ও ক্ষোভ। আর তার সঙ্গে মে দিবসের লহ প্রণাম তো আছেই ।

একটু খতিয়ে দেখলেই দেখা যাবে একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত যে কারণে ক্ষেপে যায়, ঠিক সে কারণেই কবিও ক্ষেপে যায়। কবি যদি সবার হয়ে রাগ করেন, তা স্বতন্ত্র। কিন্তু আমাদের কবি নিজের জন্যই কিছু গোছাতে চান। যথা নাম, টাকা রোজগার ও টুকটুকে বউ কিংবা সুবাতাস যুক্ত ফ্ল্যাট । এসব বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ তিরিশের পর ঠাণ্ডা হয়ে আসে । মন একটা স্থিতাবস্থায় চলে আসে। এর পরেও কবি কবি হতে চান, অর্থাৎ মধ্যবিত্ততার সুবিধা ও বিপ্লবের সম্মান পেতে চান, আশ্চর্য! তাই কখনোও হয় নাকি।
আরও সব সমস্যা আছে। যেমন আমাদের কবি সর্বক্ষণের জন্য কবি। সকালে ও দুপুরে । শীতে ও গ্রীষ্মে । পুজোয় ও পচিশে বৈশাখে । অর্থাৎ সে কোন সময়ই কবি নয়। তার জীবন মানে সকালে লেখা কি রাত্রিতে, মধ্যে কফিহাউস ও পত্রিকা দপ্তর। এমনকি চাকরীর সময়েও সে যথেষ্ট অমনোযোগ সহ কবিতা যুক্ত। তার বন্ধুরা কবি । তার মদ্যপানের সঙ্গী কবি । তার বেশ্যালয় গমনের সঙ্গী কবি । সে কবিতার বই পড়ে। এবং কবিতা ছাড়া আর কিছুই জানে ন।… আমাদের কবি প্রেমিকার ঠোঁটে ঠোট রেখেও কবিতা খোঁজেন যা স্পষ্টভাৰে প্রমাণ করে জীবন তাকে পরিত্যাগ করেছে।
সম্প্রতি যা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে তা হল এই অসহায় মানুষটি প্রতিরোধ পাচ্ছে না। তার জীবনে অপমান নেই। কেননা কবিতার, শুনতে পাচ্ছি, কমোডিটি ভ্যালুও গ্রো করছে। আর ব্যর্থতা ? মেয়ে-পটানো ছাড়া আর ডিকসনারী সন্ধান ছাড়া অন্য কোথাও আছে বলে তো মনে হয় না। অামাদের কবি এত কম চায় !
এক্ষুনি সার্ত্রের কয়েকটা কথা আমার মনে এলো : Poetry is a case of the loser winning, and the genuine poet chooses to loose, even if he has to go so far as to die, in order to win.———– He is certain of the total defeat of the human enterprise and arranges to fail in his own life in order to bear witness, by his individual defeat, to human defeat in general.
এখানে কৰি খুব শান্তিপূর্ণভাবে নিজের ও অন্যের সঙ্গে সমঝোতায় চলে আসছেন। পায়ের তলা থেকে মাটি সরিয়ে দেওয়ার মত রিস্ক নিতে তিনি রাজী নন। অন্যদিকে জীবনানন্দের কথা ভেবে দেখুন। সেই ১৯২১ সালে ইংরেজীতে এম. এ হওয়ার পরেও ভদ্রলোক চাকরী ঠিক রাখতে পারলেন না আমৃত্যু। এই-ই হয় ।
আমি কিন্তু বলতে চাইছি না কবিরা বেকার থাকুন। নানাভাবেই ভাঙচুর করা যায়। তবে, আপাতত মনে হয় কোন বড় সামাজিক সঙ্কটে কবিদের প্যাড ও লেখার টেবিল না পুড়ে গেলে কবিতা লেখা বোধহয় হয়ে উঠবে না বাংলাদেশে।”“
-বইয়ের নামঃ অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন
লেখকের নামঃ জানি না। সম্ভবত সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। (যিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্রবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন)
প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমি। ডিসেম্বর ১৯৭১।

>ভদ্রলোক ১৯৭১ সালে যা লিখে গিয়েছেন তা বর্তমান বাংলাদেশে আরও বেশি সত্য। আমাদের বেশিরভাগ কবিরা কবিতা ছাড়া আর কিছু জানে না, ভাবেও না। ব্লগার হত্যা, জঙ্গিবাদ, যুদ্ধাপরাধ, দুর্নীতি, অবিচার কিছুই তাদের মনে দাগ কাটে না। তাই তাদের ‘কবিতা’ সত্যিকারার্থে কবিতা হয়ে উঠে না। নিজেদের মধ্যে দলাদলি আর পিঠ চুলকোচুল্কি করেই তাদের সময় কেটে যায় দিব্যি।

Friday, June 17, 2022


উপমহাদেশে ধর্মানুভূতিতে আঘাতের অযুহাতে কোনও ইনিডিভিজুয়াল ব্যক্তি কর্তৃক প্রথম যে খুনের ঘটনা হয় সেটা হচ্ছে ‘রঙিলা রসুল’ বই প্রকাশকে কেন্দ্র করে। বইটি হযরত মুহাম্মদ এবং তাঁর ১১ স্ত্রী ও ২ দাসীর ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে স্যাটায়ার।


বইটা কে লিখেছিলেন সেটা আজও জানা যায়না, যদিও অনেকগুলো নাম শোনা যায়। এর প্রকাশক ছিলেন লাহোরের একজন সাংবাদিক, নাম রাজপাল মালহোত্রা। প্রকাশের পর সেটা নিয়ে ভারত বর্ষের নানা স্থানে প্রচন্ড বিক্ষোভ করেন মুসলমানরা। বই নিষিদ্ধ, লেখক-প্রকাশকের শাস্তি দাবী করতে থাকে। মহাত্মা গান্ধী নিজেও এই বই প্রকাশের সমালোচনা করেন। তবে চাপের মুখে পড়েও প্রকাশক বইটির আসল লেখকের নাম প্রকাশ করেননি।
বই নিষিদ্ধের ব্যাপারে মামলা হলে কোর্ট বলে দেয়, এই বইতে যা আছে তা সহিহ হাদিস গ্রন্থ থেকেই নেয়া, মিথ্যা তথ্য নেই। অর্থাৎ নিষিদ্ধের দাবী ব্যর্থ হয়।

'রঙিলা রসুল’ এর প্রতিবাদে মুসলামনরা পাল্টা হিন্দুদের শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর সহস্র গোপিনীকে দুইটা বই প্রকাশ করেন।

ইলমুদ্দিন নামে লাহোরের এক তরুণ মসজিদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ঐ সময় মসজিদের কাছে অনেক লোকের ভীড় করে রাজপালের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছিল।
এ সময় ইলমুদ্দিন সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি রাজপালকে তার দোকানে গিয়ে ছুরিকাঘাতে হত্যা করবেন। অর্থাৎ ইতিহাসের অন্য জঙ্গিদের মত সেও বইটা না পড়েই সে খুনের সিদ্ধান্ত নেয়।

তারপর ৬ই সেপ্টেম্বর ১৯২৯ সাল। সে হত্যার উদ্দেশ্যে বাজার থেকে ছুরি কেনে। ছুরিটি প্যান্টের ভেতর নিয়ে সে রাজপালের দোকানে যেয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।
রাজপাল দোকানে এলে ইলমুদ্দিন তাকে খুন করে। এরপর পুলিশ ইলমুদ্দিনকে অকুস্থল থেকেই হাতে-নাতে প্রেপ্তার করে।

কোর্টে ইলমুদ্দিন নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। বিবাদী পক্ষ তার নির্দোষিতার পক্ষে দুজন মিথ্যা সাক্ষীও উপস্থাপন করে। ( ইলমুদ্দীন ঘটনার দিন অন্য জায়গায় ছিলেন এমন)।
কিন্তু কোর্ট ইলমুদ্দিনের ফাঁসির আদেশ দেয়।
মামলা যখন হাইকোর্টে যায় তখন ইলমুদ্দিনের পক্ষে মামলা লড়েন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। মৃত্যুদন্ড আদেশকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে বদলানোর চেষ্টা করেও পারেননি জিন্নাহ।

ফাঁসি কার্যকর হবার পর স্যার আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল ও সৈয়দ দিদার আলি শাহ এর মত সম্ভান্ত্ররা সহ কয়েক লক্ষ লোক লাহোরে ইলমুদ্দিনের জানাজায় অংশ নেয়।

এখানে তিনটা বিষয় লক্ষ্যনীয় যে,

১/ মুহাম্মদকে নিয়ে স্যাটায়ারধর্মী বই প্রকাশের কারণে মুসলমান কর্তৃক হিন্দু প্রকাশক খুন হলেও, কৃষ্ণকে নিয়ে দুইটা স্যাটায়ারধর্মী বই প্রকাশের কারণে হিন্দুরা পালটা খুন করেনি।

২/ খুনীকে মুসলিম কমিউমিনিটি শহীদের উপাধি দেন। লেখার বিপরীতে লেখা চলতে পারে, কিন্তু লেখার বিপরীতে খুন করা যে খারাপ কাজ সেটা অনুধাবন করে মুসলিম কমিউনিটি যদি এ ধরণের খুনকে প্রশ্রয় না দিতেন তবে আজ উগ্রতা কমে আসত অনেকখানি।

ইদানীংকালের মডারেট ধার্মিকরা অবশ্য ধর্মগ্রন্থের এ সংক্রান্ত আদেশ না পড়েই 'ধর্মে খুনের কথা বলা নাই’, 'এইসব উগ্র জঙ্গিরা সহিহ মুসলিম না’ ইত্যাদি তত্ত্ব দিয়ে ফেলেন।
অর্থাৎ এইসব খুনি জঙ্গিকে সরাসরি প্রশ্রয় তারা দিচ্ছেন না। ক্ষুদ্র হলেও মুসলমান কমিউনিটির এই পরিবর্তন প্রশংসনীয়। তবে মডারেটরা মূল কমিউনিটির কত শতাংশের মতামত বহন করেন সেটা প্রশ্নযোগ্য। অন্ধকার সময়ে তারা এই মত পরিবর্তন করে ফেলবেন কিনা সেটাও চিন্তাযোগ্য।

৩/ বাংলা ট্রিবিউন এই ঘটনা সম্পর্কে ভুল তথ্য ছেপেছিলো যা পরবর্তীতে সরিয়ে নেয়।
“সজীব ওয়াজেদ, জাফর ইকবাল এবং ‘স্পর্শকাতর’ ব্লগার ইস্যু” প্রবন্ধে লেখক আনিস আলমগীর লিখেছেন,
“‘রঙ্গিলা রাসুল’। এই নামে ১৯৩৫ সালে কলকাতা থেকে জনৈক দীনেশ ভট্ট একটি বই লিখেন। প্রকাশের পরই তোলপাড় শুরু হয় চারদিকে। মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ চলতে থাকে। আন্দোলন-মিছিল নিত্য ঘটনা। একদিন মিছিল যাচ্ছিল সোনাগাছির বিখ্যাত নিষিদ্ধ পল্লীর পাশ দিয়ে। পতিতালয়ের এক পাঠান দারোয়ান মিছিলের কারণ জানতে চাইল তাদের কাছে। এই অবাঙালিকে বলা হলো- মুসলমানদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (স.)-কে কটাক্ষ করে একজন হিন্দু বই লিখেছেন- তার প্রতিবাদে এই মিছিল। অল্প দিনের মধ্যেই উপর্যুপরি ছুরির আঘাতে খুন হন দীনেশ ভট্ট। তাকে হত্যা করে আর কেউ নয়, সোনাগাজী পতিতালয়ের সেই দায়োয়ান।

দেখুন, সারাদিন যিনি বেশ্যাদের পাহারা দিতেন, তারও ধর্মানুভূতি এতই প্রখর যে, ধর্মের কারণে সে মানুষ খুন করতে দ্বিধা করেনি। নিজে ধর্ম পালন করে কি না সেটা বড় নয়, ধর্মানূভূতিতে টইটুম্বুর।”

৪/ তথ্যসূত্রঃ
https://bn.wikipedia.org/wiki/ইলমুদ্দিন
http://en.wikipedia.org/wiki/Ilm-ud-din
http://en.wikipedia.org/wiki/Rangila_Rasul
http://www.rajpalpublishing.com/About_Us.aspx
http://www.banglatribune.com/সজীব-ওয়াজেদ-জাফর-ইকবাল-এব
http://www.aryasamaj.org/newsite/node/2682
http://www.ummah.com/forum/archive/index.php/t-341121.html

Friday, May 13, 2022

নাস্তিক্যবাদী মানেই কি বিজ্ঞানমনস্ক?

বিজ্ঞানমনস্কতা আজকাল ভার্চুয়াল বাংলা জগতে স্মার্টনেসের নির্দেশ করার সাথে সাথে বিজ্ঞানমনস্কতার দাবিদার ব্যক্তিকে অন্যান্য সকলের থেকে আলাদা এবং প্রাগ্রসর হিসেবে চিহ্নিত করার অন্যতম পরিমাপক হয়ে উঠেছে। ব্লগে, ফেসবুকে, এমনকি টিভির টকশো’তেও কেউ কেউ নিজেদের বিজ্ঞানমনস্কতার দাবি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটা বিশেষ ধারার জ্ঞানচর্চাকে প্রগতিশীল আর বাদবাকিগুলোকে প্রতিক্রিয়াশীল/পশ্চাৎমুখী/গোড়া ইত্যাদি বর্গে ফেলছে। মানুষ হিসেবে অগ্রগতি আমরা সকলেই চাই। আর এ’ পথের পাথেয় হিসেবে বিজ্ঞানমনস্কতাও একটা অতি প্রয়োজনীয়, ইনফ্যাক্ট অত্যাবশ্যকীয়, গুণ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আশ্চার্যজনক বিষয় হলো এহেন গুরুত্বপূর্ণ+আরাধ্য গুণ বিজ্ঞানমনস্কতা আদতে কি তা’ নিয়ে খুব একটা আলোচনা দেখা যায়না। তবে কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো করে বিজ্ঞানমনস্কতা বোঝার একটা শর্টকাট তরিকা বাজারে চলতি আছেঃ যারা ধর্ম+অলৌকিকতা+প্রথা+ইত্যাদি (যা’ কিছু এম্পিরিক্যালি প্রমাণ করা যায়না) বিষয়াদিতে বিশ্বাস করেনা, তারা বিজ্ঞানমনস্ক। এখানে একটা মজার পর্যবেক্ষণ আছে। বিজ্ঞানমনস্কতা আল্লা-খোদায় বিশ্বাস করেনা কারণ স্রষ্টার অস্তিত্ব এম্পিরিক্যালি প্রমাণ করা যায়না। আবার নাস্তিকও আল্লা-খোদায় বিশ্বাস করেনা। এখান থেকে এই অনুসিদ্ধান্ত আসে যে, নাস্তিকও অনিবার্যভাবেই বিজ্ঞানমনস্ক। বিজ্ঞানমনস্কতা সম্পর্কে প্রচলিত সাধারণ ধারণাও অনেকটা এমন যে, ধর্মকে ছুড়ে ফেলে দেওয়াই বিজ্ঞানমনস্কতা। বিপরীতে, ধর্মকে আশ্রয় করা হলো পশ্চাৎমুখিতা, বা গোড়ামী। অর্থ্যাৎ, বিজ্ঞানমনস্ক হলে তা’র প্রভাব/ফলাফল কি হয়, তা’র উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানমনস্কতা কি তা’ বোঝার প্রয়াস। এই চর্চা অনেকটা এরকম যে, আমি বাংলা ভাষায় কথা বলি বলে আমি বাঙালি। অথচ, প্রকৃত সত্য হল আমি বাঙালি বলেই বাংলা ভাষায় কথা বলি। কারণ, বাঙালির ঘরে জন্ম না-নিয়েও অনেকে বাংলায় কথা বলা শিখে নিতে পারে। কিন্তু বাঙালির ঘরে জন্ম নিলে বাংলায় কথা বলাটা বাই-ডিফল্ট হয়ে যায়।

সাধারণে প্রচলিত বিজ্ঞানমনস্কতা=নাস্তিকতা এ’ই অনুমানকে ভুল দাবি করে। অর্থ্যাৎ, এটা এ’ই প্রমাণ করে যে, বিজ্ঞানমনস্কতা আর নাস্তিকতাকে একাকার করে ফেলার একটা প্রবণতা বর্তমানে বিদ্যমান। বিজ্ঞানমনস্কতা’কে ইংরেজী Scientific Mind ধরে নিয়ে এই সংজ্ঞা বিজ্ঞানমনস্কতার নিম্নোক্ত চারটি বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করেঃ

১। নিরপেক্ষতাঃ‬ কোন বিষয়ে পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্ত থাকা চলবে না।
২। প্রমান_সাপেক্ষতাঃ‬ বিজ্ঞানের রাজ্যে প্রমাণ ছাড়া কোন বিশ্বাসের কানাকড়ি মূল্য নেই, তা সেটা যেই বলুক না কেন।
৩। নমনীয়তাঃ‬ প্রকৃত বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষেরা প্রমাণে বিশ্বাস করে, এবং প্রমাণ সাপেক্ষে তাদের মতামত পরিবর্তন করে| সত্যিকারের উন্মুক্ত মনের অধিকারী যুক্তিবাদী বিজ্ঞানীরা।

৪। পদ্ধতিগত_ধাপ_অনুসরণ‬ : বিজ্ঞানমনষ্ক মন হুট করে একটা কিছু চিন্তা করেই উপসংহার টেনে বসেনা। কোন বিষয়ে উপসংহার টানার আগে সেটা পরীক্ষা নিরীক্ষা, গবেষণা, নির্ভরযোগ্য তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ, সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ এবং সঠিকভাবে ফলাফল প্রদর্শনের মাধ্যমেই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।

কারো মধ্যে উল্লিখিত চারটি বৈশিষ্ট্য থাকলে তাকে বিজ্ঞানমনস্ক বলা যাবে। আর বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তি সম্পর্কে তার বক্তব্য ফেলে দেওয়ারও জো’ নাই। তবে এই সংজ্ঞা গ্রহন করার আগে এর ভিত্তিতে যে অনুমান আছে, তার যথার্থতার বিচার ছাড়া এই সংজ্ঞা অর্থহীন। এই অনুমানগুলো নিম্নরূপঃ

১। এম্পিরিক্যালি প্রমাণযোগ্য তথা ইন্দ্রীয়লব্ধ জ্ঞান বিজ্ঞানভিত্তিক, এবং এই জ্ঞানই একমাত্র সত্য।
২। চিন্তাশীল মানুষ (subject) বাস্তব তথ্যের বিচারের মাধ্যমে এই জ্ঞান আহরন করতে, তথা বিষয়কে (object) বুঝতে সক্ষম।

কিন্তু মানুষ যে নিশ্চিৎ জ্ঞান লাভ করছে, তা’র গ্যারান্টি কি?- উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যাবলীর মধ্যে ৪ নম্বরটি তথা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি (তথা, এম্পিরিক্যাল পদ্ধতি) এই নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে বলে আমরা জানতে পারছি । এখন বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশের আলোকে দেখা যাক বিজ্ঞানমনস্কতার ভিত্তিমূলে এসব অনুমানের যথার্থতা কতটুকু।




ইউক্লিডের জ্যামিতি, নিউটনের পদার্থ বিজ্ঞান ও ফ্রান্সিস বেকনের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সূত্র ধরে যে বিজ্ঞানচিন্তার উদ্ভব ঘটেছিল ইউরোপে তা পরিপূর্ণ বিকাশ লাভ করে ১৬ থেকে ১৭ শতকের মধ্যে। আধূনিক বিজ্ঞানের সেই যুগে গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতিষবিজ্ঞান, প্রাণবিজ্ঞান, চিকিৎসা শাস্ত্র, রসায়ন শাস্ত্র ইত্যাদি নানান দিক থেকে প্রকৃতিকে প্রত্যক্ষভাবে জানবার তীব্র তাগিদের শুরু। আমরা এইসব বিজ্ঞানকে সাধারণভাবে বলি প্রকৃতি বিজ্ঞান (natural sciences)। উল্লেখ্য যে, এসব বিজ্ঞানের বিকাশের সাথে সাথে শুধু টেকনোলজির বিকাশই ঘটেনি, বিপ্লব ঘটেছে মানুষের চিন্তার জগতেও। আর সেই বিপ্লবের মোদ্দাকথা হচ্ছে, মানুষের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা প্রত্যক্ষ বিষয়ই কেবল সত্য। যা আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে, তার সত্যতা/নির্ভুলতা নির্ণয় অসম্ভব। অর্থাৎ, যে সব বিষয়কে আমরা বস্তুপদার্থ হিসেবে চিহ্নিত করি তা’ই সত্য এবং এদেরকে ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ ভাবে দেখে+জেনে যে বিজ্ঞান গড়ে উঠেছে সেই বিজ্ঞানই সত্যের একমাত্র দাবীদার। আর এই সত্যকে জানবার জন্য প্রকৃতি বিজ্ঞানের মধ্য দিয়ে আমাদের যে যুক্তি+বুদ্ধির অভ্যাস গড়ে উঠেছে (তথা পদ্ধতি, প্রকরণ, ইত্যাদি) সেসবই সত্য নির্ণয়ের একমাত্র পদ্ধতি বা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলে স্বীকৃতি পেতে পারে।

আধুনিক দর্শনের জনক হিসেবে স্বীকৃত ফ্রান্সের দার্শনিক রেনে দেকার্তে তার বিখ্যাত Discourse on the Method (১৬৩৬) গ্রন্থে ‘মানুষের ইন্দ্রিয় সঠিক তথ্য সংগ্রহ+সরবরাহ করে’ এই অনুমানকে ভুল প্রমাণ করলেন। স্বপ্নের মধ্যে আগুনের উত্তাপ উপলব্ধির উদাহরণ দিয়ে দেকার্তে ব্যাখ্যা করলেন কিভাবে আমাদের ইন্দ্রিয় সঠিক তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়। তিনি বললেন যে, আমাদের ইন্দ্রিয় আগুনের তাপ উপলব্ধি করার মাধ্যমে আমাদেরকে এই জ্ঞানদান করে যে, ধারেকাছে কোথাও আগুন আছে। কিন্তু তিনি নিজেই স্বপ্নে আগুন দেখেছেন এবং উত্তাপও উপলব্ধি করেছেন। তাহলে জাগ্রত অবস্থায় তার ইন্দ্রিয় তাপ অনুভবের মাধ্যমে আগুনের উপস্থিতিকে জানান দিল। আবার স্বপ্নের মধ্যে তার ইন্দ্রিয় আগুনের বাস্তবিক অনুপিস্থিতি সত্বেও আগুনের উপস্থিতি সম্পর্কে তথ্য দিল। অর্থ্যাৎ, ইন্দ্রিয় নিশ্চিত করে বলতে ব্যর্থ কোনটা বাস্তব আর কোনটা স্বপ্ন, তথা, অবাস্তব। দেকার্তে (এবং তার অনুসারীরা) এম্পিরিসিস্টদের ‘ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান একমাত্র সত্যজ্ঞান’ এই দাবীকে বাতিল করে বললেন যে, সত্য জ্ঞান আসে কেবলমাত্র নির্ভেজাল যুক্তির (pure reason) মাধ্যমে। দেকার্তের মতে, যুক্তি মানুষের মজ্জাগত (Essence)। [এ প্রসঙ্গেই দেকার্তে করেছিলেন পাশ্চাত্য দর্শনের অন্যতম বিখ্যাত উক্ত- I think, therefore, I exist]। আর এই যুক্তির পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রায়োগই (strict application) কেবল সত্যজ্ঞানের সন্ধান দিয়ে পারে। দেকার্তে যুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের জন্য একটা সিস্টেম্যাটিক প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করলেন যা’কে নিম্নোক্ত চারটি ল’ এর মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়ঃ

১। নিজে যা’ প্রমাণ করতে সক্ষম, তা ব্যাতীত অন্য কিছু কখনোই বিশ্বাস না করা,
২। যেকোন জটিল সমস্যাকে তা’র সবথেকে সরল (বিমূর্ত) পর্যায়ে বিশ্লেষণ করা,
৩। যুক্তির সুবিন্যস্ত নিয়মের মধ্যে চিন্তাকে চালিত করা এবং সরল থেকে ক্রমান্বয়ে জটিল পর্যায়ে বিশ্লেষণকে এগিয়ে নেওয়া,
৪। সমস্যা সমাধানের বেলায় সর্বদা যুক্তির দীর্ঘ মালা (Chain of reasoning) তৈরী করা যেন বিষয়ের (object) কোনকিছুই বাদ না-থেকে যায়।

এই থেকে পরবর্তীতে উদ্ভব হয় বৈজ্ঞানিক গবেষণা পদ্ধতির, যা’ আজও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানচর্চার প্রধান রীতি। উল্লিখিত পদ্ধতিগত ল’ গুলোতে একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলেই আমরা দেখতে পাবো কিভাবে দেকার্তে আধূনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা পদ্ধতির সূচনা করেছিলেন। প্রথম ল’ আমাদেরকে অনিবার্যভাবেই সংস্কার (prejudice) ত্যাগ করতে বলে, সেযব সংস্কার আমাদের মধ্যে চলে আসে বয়স+শিক্ষা বাড়ার সাথে সাথে। দ্বিতীয় ল’ আমাদেরকে বলে প্রত্যেক সমস্যাকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে সবথেকে সরল পর্যায়ে নিয়ে আসতে, যা’ গাণিতিক সমস্যা সমাধানের রীতি। তৃতীয় ল’ মূলতঃ যা’কে গাণিতের ভাষায় বলে order of operation; অর্থ্যাৎ, বিষয়ের সরল পর্যায়কে ব্যাখ্যা করা শুরু করে ক্রমান্বয়ে জটিল পর্যায়ে যাওয়া। আর চতুর্থ ল’ আসলে ডিটেইল এর প্রতি মনোযোগী হওয়াকে নির্দেশ করে।

দেকার্তের মূল শিক্ষাটি হলো- বস্তুজগৎ মানুষের অস্তিত্বের বাইরের বিষয় এবং কেবলমাত্র এম্পিরিক্যাল বা ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ তথ্যে জ্ঞান লাভ হয়না। এম্পিরিক্যাল বা ইন্দ্রিয়লব্ধ তথ্যকে আমাদের স্বভাবজাত বুদ্ধির প্রয়োগের দ্বারা যুক্তিভিত্তিক ব্যাখ্যা+বিশ্লেষণের মধ্য দিয়েই কেবল সত্যজ্ঞানে উপনীত হওয়া সম্ভব। পরবর্তী প্রায় এক শতাব্দী দেকার্তের এই ধারা বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের চর্চাকে চালিত করেছে।


দেকার্তের প্রায় একশতক পরে আঠার শতাব্দীর মধ্যভাগে এসে জার্মান দার্শনিক ইমান্যুয়েল কান্ট এম্পিরিক্যাল বা ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ বিজ্ঞানচর্চায় আরেকটা সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করলেন। বিজ্ঞান চর্চায় বিষয়ী (Subject) আর বিষয়ের (Object) মধ্যে যে পারস্পারিক বিচ্ছিন্নতা (অর্থ্যাৎ জ্ঞানানুসন্ধিৎসু ব্যক্তিসত্বা অধীত বস্তুসত্বা থেকে আলাদা), কান্ট সেই অনুমানকে ভুল প্রমাণ করলেন। তিনি দেখালেন যে, বস্তুজগৎ আমাদের জ্ঞানের বিষয় (Object) ঠিকই, তবে এই জগৎকে আমরা যেভাবে আমাদের সত্বার থেকে বাইরে আছে বলে জানি তা পুরোটা ঠিক না। এটা এইজন্য যে, জ্ঞানচর্চার প্রক্রিয়ার মধ্যে আমরা যে জ্ঞানার্জন করি, তা’ শুধুমাত্র অধীত বস্তুর উপর ভিত্তি করে নয়, এরসাথে অনিবার্যভাবেই যুক্ত হয়ে পড়ে অবস্তুগত কিছু উপাদান যা’র উৎস আমাদের বুদ্ধি। যেমন কোন বস্তুকে আমরা যখন প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করি তখন তাকে বিশেষ সময়ে বা বিশেষ কালে উপলব্ধি করি। আমার সামনে এখন একটা ল্যাপটপ আছে, জানালার ঠিক বাইরেই একটা সবুজ পাতাভরা গাছ দেখছি, সেই গাছের একটু দুরে আমাদের গাড়ি পার্ক করা। এই যে তিনটা ভিন্ন ভিন্ন বস্তু দেখছি, এর সবই বিশেষ সময়ে এবং বিশেষ কালে আছে। ল্যাপটপটা লেনোভো থিংকট্যাংক, গাছে পাতার রঙ ঘন সবুজ, গাড়িটা হোন্ডা সিভিক মডেলের। উল্লিখিত এসব গুণাবলী এইসব বস্তুর নিজস্ব গুণ। কিন্তু যে সময় এবং যে স্থানে এই বস্তুগুলো প্রত্যক্ষ করছি, সেগুলো এসব বস্তুর নিজস্ব গুণ বা বৈশিষ্ট্য নয়। যেভাবে আমরা বলছি ল্যাপটপ বা গাড়ির মডেল, গাছের পাতার রঙ তাদের নিজ সত্বার মধ্যে ‘আছে’, সেইভাবে বলতে পারছি না যে তাদেরকে প্রত্যক্ষ করার নির্দিষ্ট মুহূর্ত বা স্থানটিও তাদের মধ্যে ‘আছে’। অর্থ্যাৎ, সময় বা স্থান বস্তুর অন্তর্গত নয়, বরং এই উপাদানগুলোকে আমাদের বুদ্ধি জ্ঞানার্জনের প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে বস্তুর উপর আরোপ করে।

কান্ট মনে করেন যে, এইসব বহিঃস্থ উপাদান বস্তুকে জানার আবশ্যিক শর্ত যা’ ছাড়া বস্তুকে প্রত্যক্ষ করা অসম্ভব। যেমন, একটা গাছকে বাস্তবে প্রত্যক্ষ করতে হলে অবশ্যম্ভাবীরূপেই আমরা তাকে দেখি একটা বিশেষ সময়ে। এখন বর্ষাকাল বলে পাতার রঙ সবুজ; আবার শীতকালে গাছে কোন পাতাই থাকেনা। অর্থ্যাৎ, গাছের পাতা যে সবুজ তা’ বর্তমানের এই বিশেষ সময়েই (বর্ষাকালে) সত্য, অন্যসময় নয়। একইভাবে, গাছের সবুজ পাতা এইসময়ে শুধুমাত্র এই স্থানের ক্ষেত্রেই সত্য, অন্য কোথাও নয়। অতএব, স্থান (দেশ) বা সময় (কাল) বস্তুর অন্তর্গত গুণ না হলেও দেশ+কালের শর্ত ছাড়া আমাদের পক্ষে কোন বস্তু প্রত্যক্ষ বা উপলব্ধি করা কার্যতঃ অসম্ভব। একারণে, কোন কিছুর উপলব্ধি করার অর্থ তাকে বিশেষ দেশ+কালে উপলব্ধি করা। উপরন্তু, কান্ট আরো দেখান যে, আমরা বস্তুজগতের ততোটুকুই জানি যতোটুকু দেশ+কালের শর্তের মধ্যে থেকে আমাদের কাছে প্রত্যক্ষ হয়ে ধরা দেয়, যাকে কান্ট বলেছেন phenomenon। বস্তুজগতের আরেকটা অংশ আমাদের ইন্দ্রিয়ের কাছে অধরাই রয়ে যায়, যাকে কান্ট বলেছেন noumenon।

মোটকথা, ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে এম্পিরিক্যাল বা প্রকৃতি বিজ্ঞান যে জ্ঞান অর্জন করে, তা সমগ্র জগৎকে ধারণ করে না। অর্থ্যাৎ, এরূপ জ্ঞান একমাত্র সত্যজ্ঞান হতে পারেনা। জগতের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এই বিজ্ঞানের অধরা থেকে যায়। অতএব, এম্পিরিক্যাল বিজ্ঞানের জ্ঞানই চুড়ান্ত সত্য নয়। একইভাবে, প্রকৃতি বিজ্ঞানের আবিস্কৃত জগৎই একমাত্র বাস্তব জগৎ নয়, বরং এর একটা খন্ডিত অংশমাত্র।

অর্থ্যাৎ, এপর্যায়ে এই বিষয়টা পরিস্কার যে, “বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিমাত্রই সত্যজ্ঞানে জ্ঞানী, আর বিপরীতে বিজ্ঞানমনস্ক নয় এমন ব্যক্তির জ্ঞান ধর্তব্যই নয়”- এই ধারণা যুক্তির নিরিখে উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ। অতএব, বিজ্ঞানমনস্কতাকে সত্যজ্ঞানের একমাত্র নির্দেশক হিসেবে বিবেচনা করাটা যুক্তির বিচারে অগ্রহনযোগ্য।

Saturday, February 5, 2022

পুলিশ জনগণের বন্ধু।

প্রতিবছর পুলিশ সপ্তাহ আসলে, বিয়াবাড়ির মতন ব্যান্ড বাজায়ে হাতি ঘোড়া বের করে রাস্তায় র‍্যালী করে আমাদেরকে শেখানো হয়। পাবলিকের ট্যাক্সের টাকায় রাষ্ট্র চলে। কোটি টাকা ট্যাক্স দিয়া আমরা শিখি, পুলিশ আমাদের বন্ধু হবার কথা ছিল। কিন্তু পুলিশকে বন্ধু ভাবা আমরা আর শিখতে পারলাম না। পুলিশ হইয়া গেল আমাদের জীবনের বুলি করা ক্লাসমেট এর মতন। যার সাথে মিশাও যায় না। যারে ইগনোরও করা যায় না। এমন কেন হইল ? 

আসলে আমার মনে হয়, আমরা সবাই আসলে ভুল বুইঝা, মিথ্যা অনুভুতির বাবলে আছি। লাইনটার মধ্যেই সত্য লুকায়ে আছে। পুলিশ আসলেই জনগণের বন্ধু। আমার সাথে কেউ একমত হইতে পারবেন না এখনই, আমি জানি। খুলে বলি। এখানে জনগণ বলা হইসে, জনগণ একটা প্লুরাল শব্দ। এর মানে শুধু, আমি বা আপনি না। এইটা দিয়া সমষ্টি বুঝাইসে। পুলিশ আপনার বন্ধু, এমন বলা হয়নাই। পুলিশ জনগণের বন্ধু। তাইলে এবার আসেন জনগণ মানে? জনগণ তো সবাই। তো পুলিশ সবার বন্ধু ? না! তাও তো বলা হয় নাই। জনগণ একটা পলিটিকাল টার্ম। গণতান্ত্রিক দেশে শাসনব্যবস্থা প্রতিনিধিত্বমূলক। জনগণের প্রতিনিধিরাই এখানে জনগণের সামষ্টিক ধারণার ধারক। সো জনপ্রতিনিধি = জনগণ। 

এখন আসেন জনপ্রতিনিধির সাথে পুলিশের সম্পর্ক কি ? ইয়েস, এখন আপনি আমার কথায় কিছুটা লাইনে আসছেন। পুলিশ আর জনপ্রতিনিধির বন্ধুত্ব নিয়া আপনের ডাউট নাই। এই দেশে একজন এমপি নাই, যিনি ডাক দিলে থানার ওসি জিয়াব্বা বলে ফাল দিয়ে চলে আসবেনা। ইনফ্যাক্ট এই রিয়েকশান এত প্রমট, যে ইনফ্যাক্ট আমি তো দেখি পুলিশ সেখানে জনগণের বন্ধু না, রীতিমত কৃতদাসের লেভেলে আছে। আহা !! 

পুলিশ ডিপার্টমেন্টেও এই বাণীকে, আমার বর্নিত পথে শেখানো হয় কিনা জানিনা। তবে পুলিশের বন্ধুত্ব জনপ্রতিনিধি ভিত্তিক এটা দিনের আলোর মতন পরিষ্কার। আর এটাই আসলে হলেও সমস্যা ছিল না। সমস্যাটা পুলিশে না, সমস্যা লাগায়ে ফেলসি আমরাই। আমরা জনপ্রতিনিধি বানাচ্ছি ধরে ধরে এক একটা চীজ ! তো এরা আবার আলো আর অন্ধকার দুই জগতেই বিচরন করেন। ক্রিমিনাল যখন নিজেই জনপ্রতিনিধি হয়, তখন পুলিশের লজিক সিস্টেমে প্যাচ লাগে। কোড অনুযায়ী, পুলিশ অপরাধীর সবচে বড় শত্রু। আবার পুলিশ জনগনের প্রতিনিধির বন্ধু। ক্রিমিনালের হাতে দড়ি পড়বে, জননেতা স্যালুট পাবে । এইটুক মেনে চলা পুলিশের জন্য সোজা। কিন্তু জননেতা ক্রিমিনাল হলে তাকে কি স্যালুট দিয়া হ্যান্ডকাফ হবে, আগে হ্যান্ডকাফ পরে স্যালুট হবে এইটা বলে দেয়ার কেউ নাই। পুলিশের ইশে আটকায়ে গেল ফাঁটা বাঁশের ইয়েতে। আর এই প্যারাডক্সে পড়ে আমরা খুবই আহত হইলাম। একেতো আমরা শুরুতেই ভুল বুঝসি, জনগণ বলতে আমরা ধইরাই নিসি, আমিই তো জনগণ, তাইলে পুলিশ আমার ফ্রেন্ডলিস্টে নাই ক্যান? আর পুলিশ কনফিউজড সে ম্যাস পিপলের কেমন ফ্রেন্ড, সে নিজেও বুঝতেসে না। তাই পুলিশ সপ্তাহের র‍্যালি হইয়া যাচ্ছে, প্রোফাইল লক করে পাঠানো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এর মতন। পুলিশ আর জনগণ আসলেই ফ্রেন্ড হইয়া উঠতে পারতেসেনা। মাঝে মাঝেই জননেতাদের সাথে পুলিশের বন্ধুত্ব তথা ক্রিমিনালের সাথে ফ্রেন্ডশীপ দেখে আমরা জেলাস হইতেসি। আমরা পুলিশকে ঠোলা , তারপর আরো কী কী সব নিকৃষ্ট উপনাম দিতেসি। এতে পুলিশ আরো মাইন্ড খাইতেসে। আম জনতা আর পুলিশ পাশাপাশি বাসার ব্রেকাপ হওয়া লাভ বার্ড এর মতন, অভিমান নিয়া প্রতিদিন দেখা হয়, আর দুজনেই ভাবে, এমন তো হবার কথা ছিল না !! 

পুলিশ জনগণের বন্ধু, আমরা জানি, কিন্তু মানতে পারলাম না। তাইলে আমাদের বন্ধু কে ? পুলিশের বাইরে অন্য প্রতিষ্ঠান জনগণের বন্ধুত্ব পাওয়াটা ভাল লক্ষণ না, এইটা রাষ্ট্রচিন্তাবিদরা বলেন। কিন্তু কিচ্ছু করার নাই, আইন প্রয়োগ করে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য পুলিশের ভুমিকাকে কার্যকর করতে র‍্যাব জন্ম নিল। র‍্যাব সরাসরি জনগণের বন্ধু না। তবে র‍্যাব যে শক্তিশালী, এইটা প্রমান হইল। যেহেতু শক্তির উতস আবার জনগণ, তাই র‍্যাবও কেমনে জানি জনপ্রতিনিধিদের সাথে বন্ধুত্ব করে ফেললো। আম জনতা কনফিউজড হইয়া গেল আবারো। তাইলে পুলিশ ও আমাদের বন্ধু না, র‍্যাব ও না, আমাদের তাইলে উপায় কী ? 

আমার ধারণা প্রকৃত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবার আগ পর্যন্ত আমাদের আসলে যৌক্তিক কোনো ভরসা নাই। আমাদের পরিচিত প্রতিষ্ঠানগুলা ভেতরে ভেতরে ঘুনে ধরে ক্ষয়ে যা তা অবস্থা হয়ে আছে। পুলিশ, র‍্যাব, মিডিয়া, আইন ব্যবস্থা, শিক্ষা সব কিছু হয়ে গেছে বিকল্প আয়ের মাধ্যম। ক্ষমতা বা টাকা থাকলেই শুধুমাত্র এর সেবা পাওয়া যাবে এমন একটা দিকে আমরা আগায়ে যাচ্ছি। এই বৈরী অবস্থায় ভরসা খুঁজতে এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে উঠছে প্ল্যাটফর্ম। আমরা বর্বর মিডিয়া ট্রায়াল করছি। সরকারও আমাদের পালস বুঝে স্বস্তিতে হাঁফ ছাড়সে। যাক, অন্তত যা কিছু ফেসবুকে আসে নাই, সেসব নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে। বিচারপ্রত্যাশা এখন আদালত বা থানায় না গিয়ে ফেসবুকে কড়া নাড়তেসে। সরকারও ফেসবুক থেকে হ্যান্ডপিক করা ইশু রিসলভ করার চেষ্টা করতেসে। এইটাও কোনো ব্যবস্থা না। যদিও মিডিয়া আইডিয়ালি এডমিনিস্ট্রেশানের সাইড কিক হিসাবে কাজ করাটাই স্বাভাবিক, কিন্তু সামাজিক মাধ্যম তো আর যৌক্তিক অভিভাবক নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া না। সোশাল কমিউনিকেশান প্ল্যাটফর্ম জিনিসটা বড় অদ্ভুত, এখানে সবাই পারফর্মার, সবাই অডিয়েন্স। কেউ তামাসা করতে নেমেছে, কেউ সব কিছুকেই তামাসা ভেবে দেখছে। কেউ আবার একদম তামাসা সহ্য করতে পারবোনা বলে অন্যের ঘরে ঢুকে নিজের জাজমেন্ট ফলায়ে সিরিয়াস জিনিসকে তামাসা বানায়ে ফেলছে। খুন, ধর্ষনের মতন অপরাধকে ধামাচাপার অন্ধকার থেকে টেনে বের করে আনার জন্য ফেসবুক যেমন সফল, আবার নানান বিষয়ে বিষবাষ্পের অন্ধকার দিয়ে ভরায়ে ফেলার জন্যও ফেসবুক দায়ী। 

এই দেশে আর্মি অফিসার, ক্ষমতাবান সিভিল ফ্যামিলির কাছে নিগৃহীত হবার ঘটনা বিরল না। পেশীবলে বলিয়ান জনপ্রতিনিধির সন্তান বুক পকেটে কলম নিয়ে চপ্পল পায়ে দিয়ে রিকশায় ঘুরবে এমনটাও নিশ্চয়ই কেউ ভাবেন না। যতই কিতাবে আইন থাকুক, সাংসদ স্টিকার লাগানো কালো কাঁচের গাড়িকে চ্যালেঞ্জ করার জোর পুলিশের নাই। তো হ্যাডম দেখায়ে বাপের গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গ্যাঞ্জাম করে ফেলাটা এই দেশে নৈমিত্তিক ঘটনা। আম জনতা ঘাড়ানী খেয়ে চুপ করে থাকে, কারন এসবের বিচার চাইতে নাই। নেভির এই অফিসার ভদ্রলোক ভিডিও না করে চুপচাপ থানায় জিডি করলে কিন্তু কিছুই হইত না। শুধু ভিডিও ভাইরাল হয়ে একটু অসুবিধা হয়ে গেল। র‍্যাব রেইড দিয়ে তালিকা করতেসে হাজী সাহেবের ছেলের কাছে হ্যান্ডগান, হ্যান্ডকাফ, ওয়াকিটকি, গানম্যান, টর্চারসেল সবই নাকি আছে। আরে ভাই, এ আর নতুন কী ? এসব যে আছে, তা তো বাচ্চারাও জানে। আপনাদের থানায় যা যা আছে, তার বেশি এদের খাটের তলায় আছে বলেই তো এরা পাওয়ারে আসে যায়। 

কী অদ্ভুত এক সমাজ ব্যবস্থায় আমরা ঢুকসি, বেসিক জাস্টিসের জন্য এখন ফেসবুকে ভাইরাল হতে হয় আগে। আর এই ভাইরাল হবার বিষয়টা পুরো নির্ভর করে ডিজিটাল জনতা কোন ইশুটাকে নিয়ে ইন্টারেস্টেড হবে তার উপর। কেউ মরে গেসে মাইর খেয়ে, সেই খবর তেমন ভাইরাল হল না তাই খুনী ঘুরে বেড়াচ্ছে আরামে, আর কেউ এক চটকানা খেয়ে বিচার চাইলো সেটা জনতার কাছে বেশি আলোচিত মনে হল, তাতে রাজপুত্রের ঘরে সান্ত্রী সেপাই হানা দিলো। তড়িঘড়ি করে খুব আইন দেখানো হচ্ছে এখন । আমি ঠিক জানিনা, এমন তামাসার উপর ভরসা করে কী একটা দেশ বা জাতি আসলেই আগাতে পারে ?

ব্যক্তিগত চিন্তাপ্রসুত সিদ্ধান্ত থেকে আমি ফেসবুককে ফোনে থাকা অন্য সব এ্যাপের মতই দরকারী প্রয়োজনে ব্যাবহার লেভেলে নিয়ে আসছি। কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, বাঁচতে হলে ভাইরাল হওয়া শিখতে হবে। পাবলিক সেন্টিমেন্ট না কুড়াইতে পারলে এই দেশে কেউ বাল দিয়াও পুছে না। এতেও যদি শেষ হইতো তাহলেও হইতো। আমার মনে হয় এখানেই শেষ না, এমন দিন সামনে আসবে, ফেসবুকেই কোর্ট বসবে, সোশাল মিডিয়া ট্রায়াল করে আম জনতা নিজেই নিজের হকদার সাজা শুরু করবে। এই দিন বেশি দুরে নাই।