বাঙালী মুসলমান অতীতে সর্বদাই নিজেকে মুসলমান মনে করেছে; কিন্তু সেই সঙ্গে বাঙালীও মনে করেনি এবং এই কারণে তার ইতিহাস পৃথিবীর অন্যান্য ভূভাগ থেকে আগত মুসলমানদের ইতিহাসের অপ্রধান অংশমাত্রে পর্যবসিত হয়েছে। বাঙালী মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় ইতিহাস প্রধানতঃ বাংলায় আগত অবাঙালীদের রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের অঙ্গ মাত্র, এমনকি সে ইতিহাসে লীন। বাংলার ইতিহাস তাই আর যা কিছু হোক, বাঙালী মুসলমানের ইতিহাস নয়।…
এই ইতিহাস নিরীক্ষণ করলে মনে হয়, বাঙালী মুসলমানের ইতিহাস অনেকাংশে পশ্চিমাগত মুসলমানদের কাছে তার আত্মলোপ প্রচেষ্টারই ইতিহাস। বাঙালী মুসলমান যে বাঙালী, পশ্চিমাগত নয়, এই চিন্তার দ্বারা যেন সে পীড়িত হয়েছে; বাঙালী হওয়াটাকে সে যেন একটা অপরাধ বলেই গণ্য করছে; তাই সকল ক্ষেত্রে পশ্চিমাগত মুসলমানদের নেতৃত্বকে-তা ভালোই হোক আর মন্দই হোক-মেনে নেওয়াটাই তার মনে হয়েছে অবশ্যকরণীয়; বাঙালী মুসলমান তার নাম, তার পরিচ্ছদ, তার ধর্মচিন্তা, তার দর্শন-বিজ্ঞান-সংস্কৃতি-চিন্তা পুরোপুরি তাদের কাছ থেকে নেওয়ার চেষ্টা করেছে; সাহিত্যের উপাদান ও উপাখ্যানও প্রধানতঃ নিয়েছে তাদের কাছ থেকে; তার ভাষাকে বদলাবার চেষ্টা করেছে, কখনো কখনো বাংলা বর্ণলিপিও বর্জন করতে চেয়েছে, এমনকি বাঙলা ভাষাকেও অস্বীকার করার প্রয়াস পেয়েছে। সেই সঙ্গে অনেক বাঙালী মুসলমানের প্রবল ঔৎসুক্য দেখা গেছে নিজেকে কোনো আরব অথবা ইরানীর উত্তরপুরুষ বলে প্রমাণ করার জন্য।…
বাঙালী মুসলমান স্বদেশের ইতিহাস থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে অন্য মুসলিম দেশের ইতিহাসের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করতে চেয়েছে; অন্যভাবে বলতে গেলে, বাঙালী মুসলমান অন্যদেশের মুসলমানের ইতিহাসকেই নিজের ইতিহাস মনে করেছে, নিজস্ব ইতিহাস সৃষ্টির চেষ্টা করেনি; অন্য দেশের মুসলমানের জয়ে আনন্দ বোধ করেছে এবং পরাজয়ে বিমর্ষ হয়েছে, নিজে বিজয়ী হতে চায়নি।…
বাঙালী মুসলমান যদি নিজেকে বাঙালী মনে করতো, সগৌরবে এবং সবলে নিজেকে বাঙালী বলে ঘোষণা করতো এবং নিজের সত্তা ও ব্যক্তিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইতো তবে তার গোষ্ঠীচেতনা প্রবল হতে পারতো, তার চিন্তা সংহত হতে পারতো এবং অনুকরণবৃত্তি এত প্রবল হতে পারতো না। কিন্তু ঠিক এই বাঙালী হওয়াটাকেই সে একটা অনুচিত কাজ মনে করে এসেছে।…
স্বাধীনতার যুগে এ অবস্থার কিছু পরিবর্তন হয়েছে। এ যুগে অবাঙালী-অধ্যুষিত পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সহ-অবস্থান করতে গিয়ে বাঙালী মুসলমানকে ভাবতে হচ্ছে যে, সে বাঙালী। স্বাধীনতা-পূর্ব কালের তুলনায় এ চেতনার প্রকৃতি পৃথকঃ তখন হিন্দুর সঙ্গে সহ-অবস্থান করতে গিয়ে তাকে ভাবতে হতো সে মুসলমান; স্বাধীনতার যুগে অবাঙালী পাকিস্তানীদের সঙ্গে সহ-অবস্থান করতে গিয়ে স্বার্থ-সংঘাতের তাড়ণায় তাকে ভাবতে হচ্ছে সে বাঙালী। এ ভাবনার একটা প্রবল উজ্জ্বল ঐতিহাসিক উদাহরণ ভাষা আন্দোলন।…
কার ঐতিহ্য কতখানি সমৃদ্ধ এবং গৌরবময় সেটা একটা আপেক্ষিক ব্যাপার-আসল কথা হচ্ছে চেতনা ও গৌরববোধ। অন্যান্য দেশের কথা বাদ দিলেও পাকিস্তানে পাঠান, পাঞ্জাবী এবং সিন্ধীরাও সে-চেতনার অধিকারী, সে-চেতনায় সমৃদ্ধ ও বলবান। বাঙালী মুসলমান কখনই এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন হতে পারেনি। সে সচেতন হতে পারেনি যে তার গৌরববোধ, তার ঐতিহ্যবোধ কখনো অন্য ভূখণ্ডের মতো হতে পারে না। এমনকি অন্য কোনো মুসলিম মানব-গোষ্ঠীরও মতো নয়। সে সচেতন হতে পারেনি যে সে আরব নয়, ইরানী নয়, পাঠান-পাঞ্জাবী-সিন্ধী নয়-বাঙালী। তার প্রাকৃতিক পরিবেশ, তার ভাষা, এবং তার আরও অনেক নিজস্ব সম্পদ তাকে অলঙ্ঘনীয়ভাবে পৃথিবীর আর সব মানব-গোষ্ঠী থেকে স্বতন্ত্র করে দিয়েছে।… শুধু ধর্মের ঐক্য দিয়ে এই স্বাতন্ত্র্যকে মুছে ফেলা সম্ভব না, সম্ভব হয়নি কখনো। কিন্তু বাঙালী মুসলমান ঠিক এই ব্যাপারেই সচেতন থাকতে পারেনিঃ বহুকাল যাবৎ এই একটি কথা মন্ত্রের মতো তার কানের কাছে আওড়ানো হয়েছে যে ধর্ম ছাড়া বিবেচনা করার আর কিছু নেই, গর্ব করার আর কিছু নেই, এবং ধর্মপ্রাণতার বড়ো প্রমাণই হচ্ছে নিজের বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তিত্ব ভুলে আরব-ইরানিয়ার চর্চা করা। নানাভাবে তাকে বোঝানো হয়েছে যে সে যে বাঙালী, একথা ভুলে যাওয়াই মুসলমানত্বের পরম পরিচয়। পুঁথি-সাহিত্য সহ সমগ্র মুসলিম বাংলা সাহিত্যকে পরিমাণগতভাবে দেখলে দেখা যাবে, এই সাহিত্যে বাঙালী মুসলমানের কথা আজ পর্যন্ত যত লেখা হয়েছে, অবাঙালী মুসলমান, অবাঙালী অমুসলমান, এবং আরব-ইরানী সংস্কৃতির কথা লেখা হয়েছে ঢের বেশী”।…
বাঙালী মুসলমানঃ ভূমিকা ও নিয়তি
-আবদুল হক।
>>১৯৭১ সালের আশেপাশের সময়কালে বাঙালী মুসলমান অনেকটাই বাঙালী হয়ে উঠেছিল, ফলস্বরূপ সফলতাও পেয়েছিল হাতেনাতে। আজ তারা আবার বাঙালীয়ানা বাদ দিয়ে মুসলমান হতে ব্যস্ত। অর্থাৎ হাজার বছরের পুরনো রাত আবার বাড়ছে। সিকানদার আবু জাফর সম্পাদিত প্রগতিশীল পত্রিকা ‘সমকাল’-এ ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত এই প্রবন্ধটি তাই এখনও প্রাসঙ্গিক। এই প্রবন্ধটি আবদুল হকের ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ ও অন্যান্য প্রবন্ধ বইতে আছে।
No comments:
Post a Comment