Monday, June 27, 2022
কবিদের দুঃখ
“"আসলে কবি যেহেতু এগিয়ে থাকা মানুষ তাকে আলাদা ভাবে বাঁচতে হয় ; অন্য জীবনযাপন করতে হয় । এই সমাজ ও সভ্যতা তার হাতে দেগে দিয়েছে অস্বীকারের উল্কি। এবং যা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে তিনি সব কিছুই মেনে নিচ্ছেন। জন্মের জন্য সঙ্গম দরকার হয় । কবিতার জন্য অস্বীকার। যা দরকার তা ক্রোধ, ঘৃণা ও উদ্বেগ । যা দেখতে পাই তা অভিমান ও ক্ষোভ। আর তার সঙ্গে মে দিবসের লহ প্রণাম তো আছেই ।
একটু খতিয়ে দেখলেই দেখা যাবে একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত যে কারণে ক্ষেপে যায়, ঠিক সে কারণেই কবিও ক্ষেপে যায়। কবি যদি সবার হয়ে রাগ করেন, তা স্বতন্ত্র। কিন্তু আমাদের কবি নিজের জন্যই কিছু গোছাতে চান। যথা নাম, টাকা রোজগার ও টুকটুকে বউ কিংবা সুবাতাস যুক্ত ফ্ল্যাট । এসব বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ তিরিশের পর ঠাণ্ডা হয়ে আসে । মন একটা স্থিতাবস্থায় চলে আসে। এর পরেও কবি কবি হতে চান, অর্থাৎ মধ্যবিত্ততার সুবিধা ও বিপ্লবের সম্মান পেতে চান, আশ্চর্য! তাই কখনোও হয় নাকি।
আরও সব সমস্যা আছে। যেমন আমাদের কবি সর্বক্ষণের জন্য কবি। সকালে ও দুপুরে । শীতে ও গ্রীষ্মে । পুজোয় ও পচিশে বৈশাখে । অর্থাৎ সে কোন সময়ই কবি নয়। তার জীবন মানে সকালে লেখা কি রাত্রিতে, মধ্যে কফিহাউস ও পত্রিকা দপ্তর। এমনকি চাকরীর সময়েও সে যথেষ্ট অমনোযোগ সহ কবিতা যুক্ত। তার বন্ধুরা কবি । তার মদ্যপানের সঙ্গী কবি । তার বেশ্যালয় গমনের সঙ্গী কবি । সে কবিতার বই পড়ে। এবং কবিতা ছাড়া আর কিছুই জানে ন।… আমাদের কবি প্রেমিকার ঠোঁটে ঠোট রেখেও কবিতা খোঁজেন যা স্পষ্টভাৰে প্রমাণ করে জীবন তাকে পরিত্যাগ করেছে।
সম্প্রতি যা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে তা হল এই অসহায় মানুষটি প্রতিরোধ পাচ্ছে না। তার জীবনে অপমান নেই। কেননা কবিতার, শুনতে পাচ্ছি, কমোডিটি ভ্যালুও গ্রো করছে। আর ব্যর্থতা ? মেয়ে-পটানো ছাড়া আর ডিকসনারী সন্ধান ছাড়া অন্য কোথাও আছে বলে তো মনে হয় না। অামাদের কবি এত কম চায় !
এক্ষুনি সার্ত্রের কয়েকটা কথা আমার মনে এলো : Poetry is a case of the loser winning, and the genuine poet chooses to loose, even if he has to go so far as to die, in order to win.———– He is certain of the total defeat of the human enterprise and arranges to fail in his own life in order to bear witness, by his individual defeat, to human defeat in general.
এখানে কৰি খুব শান্তিপূর্ণভাবে নিজের ও অন্যের সঙ্গে সমঝোতায় চলে আসছেন। পায়ের তলা থেকে মাটি সরিয়ে দেওয়ার মত রিস্ক নিতে তিনি রাজী নন। অন্যদিকে জীবনানন্দের কথা ভেবে দেখুন। সেই ১৯২১ সালে ইংরেজীতে এম. এ হওয়ার পরেও ভদ্রলোক চাকরী ঠিক রাখতে পারলেন না আমৃত্যু। এই-ই হয় ।
আমি কিন্তু বলতে চাইছি না কবিরা বেকার থাকুন। নানাভাবেই ভাঙচুর করা যায়। তবে, আপাতত মনে হয় কোন বড় সামাজিক সঙ্কটে কবিদের প্যাড ও লেখার টেবিল না পুড়ে গেলে কবিতা লেখা বোধহয় হয়ে উঠবে না বাংলাদেশে।”“
-বইয়ের নামঃ অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন
লেখকের নামঃ জানি না। সম্ভবত সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। (যিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্রবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন)
প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমি। ডিসেম্বর ১৯৭১।
>ভদ্রলোক ১৯৭১ সালে যা লিখে গিয়েছেন তা বর্তমান বাংলাদেশে আরও বেশি সত্য। আমাদের বেশিরভাগ কবিরা কবিতা ছাড়া আর কিছু জানে না, ভাবেও না। ব্লগার হত্যা, জঙ্গিবাদ, যুদ্ধাপরাধ, দুর্নীতি, অবিচার কিছুই তাদের মনে দাগ কাটে না। তাই তাদের ‘কবিতা’ সত্যিকারার্থে কবিতা হয়ে উঠে না। নিজেদের মধ্যে দলাদলি আর পিঠ চুলকোচুল্কি করেই তাদের সময় কেটে যায় দিব্যি।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment