Friday, June 17, 2022


উপমহাদেশে ধর্মানুভূতিতে আঘাতের অযুহাতে কোনও ইনিডিভিজুয়াল ব্যক্তি কর্তৃক প্রথম যে খুনের ঘটনা হয় সেটা হচ্ছে ‘রঙিলা রসুল’ বই প্রকাশকে কেন্দ্র করে। বইটি হযরত মুহাম্মদ এবং তাঁর ১১ স্ত্রী ও ২ দাসীর ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে স্যাটায়ার।


বইটা কে লিখেছিলেন সেটা আজও জানা যায়না, যদিও অনেকগুলো নাম শোনা যায়। এর প্রকাশক ছিলেন লাহোরের একজন সাংবাদিক, নাম রাজপাল মালহোত্রা। প্রকাশের পর সেটা নিয়ে ভারত বর্ষের নানা স্থানে প্রচন্ড বিক্ষোভ করেন মুসলমানরা। বই নিষিদ্ধ, লেখক-প্রকাশকের শাস্তি দাবী করতে থাকে। মহাত্মা গান্ধী নিজেও এই বই প্রকাশের সমালোচনা করেন। তবে চাপের মুখে পড়েও প্রকাশক বইটির আসল লেখকের নাম প্রকাশ করেননি।
বই নিষিদ্ধের ব্যাপারে মামলা হলে কোর্ট বলে দেয়, এই বইতে যা আছে তা সহিহ হাদিস গ্রন্থ থেকেই নেয়া, মিথ্যা তথ্য নেই। অর্থাৎ নিষিদ্ধের দাবী ব্যর্থ হয়।

'রঙিলা রসুল’ এর প্রতিবাদে মুসলামনরা পাল্টা হিন্দুদের শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর সহস্র গোপিনীকে দুইটা বই প্রকাশ করেন।

ইলমুদ্দিন নামে লাহোরের এক তরুণ মসজিদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ঐ সময় মসজিদের কাছে অনেক লোকের ভীড় করে রাজপালের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছিল।
এ সময় ইলমুদ্দিন সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি রাজপালকে তার দোকানে গিয়ে ছুরিকাঘাতে হত্যা করবেন। অর্থাৎ ইতিহাসের অন্য জঙ্গিদের মত সেও বইটা না পড়েই সে খুনের সিদ্ধান্ত নেয়।

তারপর ৬ই সেপ্টেম্বর ১৯২৯ সাল। সে হত্যার উদ্দেশ্যে বাজার থেকে ছুরি কেনে। ছুরিটি প্যান্টের ভেতর নিয়ে সে রাজপালের দোকানে যেয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।
রাজপাল দোকানে এলে ইলমুদ্দিন তাকে খুন করে। এরপর পুলিশ ইলমুদ্দিনকে অকুস্থল থেকেই হাতে-নাতে প্রেপ্তার করে।

কোর্টে ইলমুদ্দিন নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। বিবাদী পক্ষ তার নির্দোষিতার পক্ষে দুজন মিথ্যা সাক্ষীও উপস্থাপন করে। ( ইলমুদ্দীন ঘটনার দিন অন্য জায়গায় ছিলেন এমন)।
কিন্তু কোর্ট ইলমুদ্দিনের ফাঁসির আদেশ দেয়।
মামলা যখন হাইকোর্টে যায় তখন ইলমুদ্দিনের পক্ষে মামলা লড়েন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। মৃত্যুদন্ড আদেশকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে বদলানোর চেষ্টা করেও পারেননি জিন্নাহ।

ফাঁসি কার্যকর হবার পর স্যার আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল ও সৈয়দ দিদার আলি শাহ এর মত সম্ভান্ত্ররা সহ কয়েক লক্ষ লোক লাহোরে ইলমুদ্দিনের জানাজায় অংশ নেয়।

এখানে তিনটা বিষয় লক্ষ্যনীয় যে,

১/ মুহাম্মদকে নিয়ে স্যাটায়ারধর্মী বই প্রকাশের কারণে মুসলমান কর্তৃক হিন্দু প্রকাশক খুন হলেও, কৃষ্ণকে নিয়ে দুইটা স্যাটায়ারধর্মী বই প্রকাশের কারণে হিন্দুরা পালটা খুন করেনি।

২/ খুনীকে মুসলিম কমিউমিনিটি শহীদের উপাধি দেন। লেখার বিপরীতে লেখা চলতে পারে, কিন্তু লেখার বিপরীতে খুন করা যে খারাপ কাজ সেটা অনুধাবন করে মুসলিম কমিউনিটি যদি এ ধরণের খুনকে প্রশ্রয় না দিতেন তবে আজ উগ্রতা কমে আসত অনেকখানি।

ইদানীংকালের মডারেট ধার্মিকরা অবশ্য ধর্মগ্রন্থের এ সংক্রান্ত আদেশ না পড়েই 'ধর্মে খুনের কথা বলা নাই’, 'এইসব উগ্র জঙ্গিরা সহিহ মুসলিম না’ ইত্যাদি তত্ত্ব দিয়ে ফেলেন।
অর্থাৎ এইসব খুনি জঙ্গিকে সরাসরি প্রশ্রয় তারা দিচ্ছেন না। ক্ষুদ্র হলেও মুসলমান কমিউনিটির এই পরিবর্তন প্রশংসনীয়। তবে মডারেটরা মূল কমিউনিটির কত শতাংশের মতামত বহন করেন সেটা প্রশ্নযোগ্য। অন্ধকার সময়ে তারা এই মত পরিবর্তন করে ফেলবেন কিনা সেটাও চিন্তাযোগ্য।

৩/ বাংলা ট্রিবিউন এই ঘটনা সম্পর্কে ভুল তথ্য ছেপেছিলো যা পরবর্তীতে সরিয়ে নেয়।
“সজীব ওয়াজেদ, জাফর ইকবাল এবং ‘স্পর্শকাতর’ ব্লগার ইস্যু” প্রবন্ধে লেখক আনিস আলমগীর লিখেছেন,
“‘রঙ্গিলা রাসুল’। এই নামে ১৯৩৫ সালে কলকাতা থেকে জনৈক দীনেশ ভট্ট একটি বই লিখেন। প্রকাশের পরই তোলপাড় শুরু হয় চারদিকে। মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ চলতে থাকে। আন্দোলন-মিছিল নিত্য ঘটনা। একদিন মিছিল যাচ্ছিল সোনাগাছির বিখ্যাত নিষিদ্ধ পল্লীর পাশ দিয়ে। পতিতালয়ের এক পাঠান দারোয়ান মিছিলের কারণ জানতে চাইল তাদের কাছে। এই অবাঙালিকে বলা হলো- মুসলমানদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (স.)-কে কটাক্ষ করে একজন হিন্দু বই লিখেছেন- তার প্রতিবাদে এই মিছিল। অল্প দিনের মধ্যেই উপর্যুপরি ছুরির আঘাতে খুন হন দীনেশ ভট্ট। তাকে হত্যা করে আর কেউ নয়, সোনাগাজী পতিতালয়ের সেই দায়োয়ান।

দেখুন, সারাদিন যিনি বেশ্যাদের পাহারা দিতেন, তারও ধর্মানুভূতি এতই প্রখর যে, ধর্মের কারণে সে মানুষ খুন করতে দ্বিধা করেনি। নিজে ধর্ম পালন করে কি না সেটা বড় নয়, ধর্মানূভূতিতে টইটুম্বুর।”

৪/ তথ্যসূত্রঃ
https://bn.wikipedia.org/wiki/ইলমুদ্দিন
http://en.wikipedia.org/wiki/Ilm-ud-din
http://en.wikipedia.org/wiki/Rangila_Rasul
http://www.rajpalpublishing.com/About_Us.aspx
http://www.banglatribune.com/সজীব-ওয়াজেদ-জাফর-ইকবাল-এব
http://www.aryasamaj.org/newsite/node/2682
http://www.ummah.com/forum/archive/index.php/t-341121.html

No comments:

Post a Comment