বিজ্ঞানমনস্কতা আজকাল ভার্চুয়াল বাংলা জগতে স্মার্টনেসের নির্দেশ করার সাথে সাথে বিজ্ঞানমনস্কতার দাবিদার ব্যক্তিকে অন্যান্য সকলের থেকে আলাদা এবং প্রাগ্রসর হিসেবে চিহ্নিত করার অন্যতম পরিমাপক হয়ে উঠেছে। ব্লগে, ফেসবুকে, এমনকি টিভির টকশো’তেও কেউ কেউ নিজেদের বিজ্ঞানমনস্কতার দাবি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটা বিশেষ ধারার জ্ঞানচর্চাকে প্রগতিশীল আর বাদবাকিগুলোকে প্রতিক্রিয়াশীল/পশ্চাৎমুখী/গোড়া ইত্যাদি বর্গে ফেলছে। মানুষ হিসেবে অগ্রগতি আমরা সকলেই চাই। আর এ’ পথের পাথেয় হিসেবে বিজ্ঞানমনস্কতাও একটা অতি প্রয়োজনীয়, ইনফ্যাক্ট অত্যাবশ্যকীয়, গুণ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আশ্চার্যজনক বিষয় হলো এহেন গুরুত্বপূর্ণ+আরাধ্য গুণ বিজ্ঞানমনস্কতা আদতে কি তা’ নিয়ে খুব একটা আলোচনা দেখা যায়না। তবে কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো করে বিজ্ঞানমনস্কতা বোঝার একটা শর্টকাট তরিকা বাজারে চলতি আছেঃ যারা ধর্ম+অলৌকিকতা+প্রথা+ইত্যাদি (যা’ কিছু এম্পিরিক্যালি প্রমাণ করা যায়না) বিষয়াদিতে বিশ্বাস করেনা, তারা বিজ্ঞানমনস্ক। এখানে একটা মজার পর্যবেক্ষণ আছে। বিজ্ঞানমনস্কতা আল্লা-খোদায় বিশ্বাস করেনা কারণ স্রষ্টার অস্তিত্ব এম্পিরিক্যালি প্রমাণ করা যায়না। আবার নাস্তিকও আল্লা-খোদায় বিশ্বাস করেনা। এখান থেকে এই অনুসিদ্ধান্ত আসে যে, নাস্তিকও অনিবার্যভাবেই বিজ্ঞানমনস্ক। বিজ্ঞানমনস্কতা সম্পর্কে প্রচলিত সাধারণ ধারণাও অনেকটা এমন যে, ধর্মকে ছুড়ে ফেলে দেওয়াই বিজ্ঞানমনস্কতা। বিপরীতে, ধর্মকে আশ্রয় করা হলো পশ্চাৎমুখিতা, বা গোড়ামী। অর্থ্যাৎ, বিজ্ঞানমনস্ক হলে তা’র প্রভাব/ফলাফল কি হয়, তা’র উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানমনস্কতা কি তা’ বোঝার প্রয়াস। এই চর্চা অনেকটা এরকম যে, আমি বাংলা ভাষায় কথা বলি বলে আমি বাঙালি। অথচ, প্রকৃত সত্য হল আমি বাঙালি বলেই বাংলা ভাষায় কথা বলি। কারণ, বাঙালির ঘরে জন্ম না-নিয়েও অনেকে বাংলায় কথা বলা শিখে নিতে পারে। কিন্তু বাঙালির ঘরে জন্ম নিলে বাংলায় কথা বলাটা বাই-ডিফল্ট হয়ে যায়।
সাধারণে প্রচলিত বিজ্ঞানমনস্কতা=নাস্তিকতা এ’ই অনুমানকে ভুল দাবি করে। অর্থ্যাৎ, এটা এ’ই প্রমাণ করে যে, বিজ্ঞানমনস্কতা আর নাস্তিকতাকে একাকার করে ফেলার একটা প্রবণতা বর্তমানে বিদ্যমান। বিজ্ঞানমনস্কতা’কে ইংরেজী Scientific Mind ধরে নিয়ে এই সংজ্ঞা বিজ্ঞানমনস্কতার নিম্নোক্ত চারটি বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করেঃ
১। নিরপেক্ষতাঃ কোন বিষয়ে পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্ত থাকা চলবে না।
২। প্রমান_সাপেক্ষতাঃ বিজ্ঞানের রাজ্যে প্রমাণ ছাড়া কোন বিশ্বাসের কানাকড়ি মূল্য নেই, তা সেটা যেই বলুক না কেন।
৩। নমনীয়তাঃ প্রকৃত বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষেরা প্রমাণে বিশ্বাস করে, এবং প্রমাণ সাপেক্ষে তাদের মতামত পরিবর্তন করে| সত্যিকারের উন্মুক্ত মনের অধিকারী যুক্তিবাদী বিজ্ঞানীরা।
৪। পদ্ধতিগত_ধাপ_অনুসরণ : বিজ্ঞানমনষ্ক মন হুট করে একটা কিছু চিন্তা করেই উপসংহার টেনে বসেনা। কোন বিষয়ে উপসংহার টানার আগে সেটা পরীক্ষা নিরীক্ষা, গবেষণা, নির্ভরযোগ্য তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ, সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ এবং সঠিকভাবে ফলাফল প্রদর্শনের মাধ্যমেই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।
কারো মধ্যে উল্লিখিত চারটি বৈশিষ্ট্য থাকলে তাকে বিজ্ঞানমনস্ক বলা যাবে। আর বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তি সম্পর্কে তার বক্তব্য ফেলে দেওয়ারও জো’ নাই। তবে এই সংজ্ঞা গ্রহন করার আগে এর ভিত্তিতে যে অনুমান আছে, তার যথার্থতার বিচার ছাড়া এই সংজ্ঞা অর্থহীন। এই অনুমানগুলো নিম্নরূপঃ
১। এম্পিরিক্যালি প্রমাণযোগ্য তথা ইন্দ্রীয়লব্ধ জ্ঞান বিজ্ঞানভিত্তিক, এবং এই জ্ঞানই একমাত্র সত্য।
২। চিন্তাশীল মানুষ (subject) বাস্তব তথ্যের বিচারের মাধ্যমে এই জ্ঞান আহরন করতে, তথা বিষয়কে (object) বুঝতে সক্ষম।
কিন্তু মানুষ যে নিশ্চিৎ জ্ঞান লাভ করছে, তা’র গ্যারান্টি কি?- উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যাবলীর মধ্যে ৪ নম্বরটি তথা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি (তথা, এম্পিরিক্যাল পদ্ধতি) এই নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে বলে আমরা জানতে পারছি । এখন বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশের আলোকে দেখা যাক বিজ্ঞানমনস্কতার ভিত্তিমূলে এসব অনুমানের যথার্থতা কতটুকু।
২
ইউক্লিডের জ্যামিতি, নিউটনের পদার্থ বিজ্ঞান ও ফ্রান্সিস বেকনের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সূত্র ধরে যে বিজ্ঞানচিন্তার উদ্ভব ঘটেছিল ইউরোপে তা পরিপূর্ণ বিকাশ লাভ করে ১৬ থেকে ১৭ শতকের মধ্যে। আধূনিক বিজ্ঞানের সেই যুগে গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতিষবিজ্ঞান, প্রাণবিজ্ঞান, চিকিৎসা শাস্ত্র, রসায়ন শাস্ত্র ইত্যাদি নানান দিক থেকে প্রকৃতিকে প্রত্যক্ষভাবে জানবার তীব্র তাগিদের শুরু। আমরা এইসব বিজ্ঞানকে সাধারণভাবে বলি প্রকৃতি বিজ্ঞান (natural sciences)। উল্লেখ্য যে, এসব বিজ্ঞানের বিকাশের সাথে সাথে শুধু টেকনোলজির বিকাশই ঘটেনি, বিপ্লব ঘটেছে মানুষের চিন্তার জগতেও। আর সেই বিপ্লবের মোদ্দাকথা হচ্ছে, মানুষের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা প্রত্যক্ষ বিষয়ই কেবল সত্য। যা আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে, তার সত্যতা/নির্ভুলতা নির্ণয় অসম্ভব। অর্থাৎ, যে সব বিষয়কে আমরা বস্তুপদার্থ হিসেবে চিহ্নিত করি তা’ই সত্য এবং এদেরকে ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ ভাবে দেখে+জেনে যে বিজ্ঞান গড়ে উঠেছে সেই বিজ্ঞানই সত্যের একমাত্র দাবীদার। আর এই সত্যকে জানবার জন্য প্রকৃতি বিজ্ঞানের মধ্য দিয়ে আমাদের যে যুক্তি+বুদ্ধির অভ্যাস গড়ে উঠেছে (তথা পদ্ধতি, প্রকরণ, ইত্যাদি) সেসবই সত্য নির্ণয়ের একমাত্র পদ্ধতি বা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলে স্বীকৃতি পেতে পারে।
আধুনিক দর্শনের জনক হিসেবে স্বীকৃত ফ্রান্সের দার্শনিক রেনে দেকার্তে তার বিখ্যাত Discourse on the Method (১৬৩৬) গ্রন্থে ‘মানুষের ইন্দ্রিয় সঠিক তথ্য সংগ্রহ+সরবরাহ করে’ এই অনুমানকে ভুল প্রমাণ করলেন। স্বপ্নের মধ্যে আগুনের উত্তাপ উপলব্ধির উদাহরণ দিয়ে দেকার্তে ব্যাখ্যা করলেন কিভাবে আমাদের ইন্দ্রিয় সঠিক তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়। তিনি বললেন যে, আমাদের ইন্দ্রিয় আগুনের তাপ উপলব্ধি করার মাধ্যমে আমাদেরকে এই জ্ঞানদান করে যে, ধারেকাছে কোথাও আগুন আছে। কিন্তু তিনি নিজেই স্বপ্নে আগুন দেখেছেন এবং উত্তাপও উপলব্ধি করেছেন। তাহলে জাগ্রত অবস্থায় তার ইন্দ্রিয় তাপ অনুভবের মাধ্যমে আগুনের উপস্থিতিকে জানান দিল। আবার স্বপ্নের মধ্যে তার ইন্দ্রিয় আগুনের বাস্তবিক অনুপিস্থিতি সত্বেও আগুনের উপস্থিতি সম্পর্কে তথ্য দিল। অর্থ্যাৎ, ইন্দ্রিয় নিশ্চিত করে বলতে ব্যর্থ কোনটা বাস্তব আর কোনটা স্বপ্ন, তথা, অবাস্তব। দেকার্তে (এবং তার অনুসারীরা) এম্পিরিসিস্টদের ‘ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান একমাত্র সত্যজ্ঞান’ এই দাবীকে বাতিল করে বললেন যে, সত্য জ্ঞান আসে কেবলমাত্র নির্ভেজাল যুক্তির (pure reason) মাধ্যমে। দেকার্তের মতে, যুক্তি মানুষের মজ্জাগত (Essence)। [এ প্রসঙ্গেই দেকার্তে করেছিলেন পাশ্চাত্য দর্শনের অন্যতম বিখ্যাত উক্ত- I think, therefore, I exist]। আর এই যুক্তির পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রায়োগই (strict application) কেবল সত্যজ্ঞানের সন্ধান দিয়ে পারে। দেকার্তে যুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের জন্য একটা সিস্টেম্যাটিক প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করলেন যা’কে নিম্নোক্ত চারটি ল’ এর মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়ঃ
১। নিজে যা’ প্রমাণ করতে সক্ষম, তা ব্যাতীত অন্য কিছু কখনোই বিশ্বাস না করা,
২। যেকোন জটিল সমস্যাকে তা’র সবথেকে সরল (বিমূর্ত) পর্যায়ে বিশ্লেষণ করা,
৩। যুক্তির সুবিন্যস্ত নিয়মের মধ্যে চিন্তাকে চালিত করা এবং সরল থেকে ক্রমান্বয়ে জটিল পর্যায়ে বিশ্লেষণকে এগিয়ে নেওয়া,
৪। সমস্যা সমাধানের বেলায় সর্বদা যুক্তির দীর্ঘ মালা (Chain of reasoning) তৈরী করা যেন বিষয়ের (object) কোনকিছুই বাদ না-থেকে যায়।
এই থেকে পরবর্তীতে উদ্ভব হয় বৈজ্ঞানিক গবেষণা পদ্ধতির, যা’ আজও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানচর্চার প্রধান রীতি। উল্লিখিত পদ্ধতিগত ল’ গুলোতে একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলেই আমরা দেখতে পাবো কিভাবে দেকার্তে আধূনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা পদ্ধতির সূচনা করেছিলেন। প্রথম ল’ আমাদেরকে অনিবার্যভাবেই সংস্কার (prejudice) ত্যাগ করতে বলে, সেযব সংস্কার আমাদের মধ্যে চলে আসে বয়স+শিক্ষা বাড়ার সাথে সাথে। দ্বিতীয় ল’ আমাদেরকে বলে প্রত্যেক সমস্যাকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে সবথেকে সরল পর্যায়ে নিয়ে আসতে, যা’ গাণিতিক সমস্যা সমাধানের রীতি। তৃতীয় ল’ মূলতঃ যা’কে গাণিতের ভাষায় বলে order of operation; অর্থ্যাৎ, বিষয়ের সরল পর্যায়কে ব্যাখ্যা করা শুরু করে ক্রমান্বয়ে জটিল পর্যায়ে যাওয়া। আর চতুর্থ ল’ আসলে ডিটেইল এর প্রতি মনোযোগী হওয়াকে নির্দেশ করে।
দেকার্তের মূল শিক্ষাটি হলো- বস্তুজগৎ মানুষের অস্তিত্বের বাইরের বিষয় এবং কেবলমাত্র এম্পিরিক্যাল বা ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ তথ্যে জ্ঞান লাভ হয়না। এম্পিরিক্যাল বা ইন্দ্রিয়লব্ধ তথ্যকে আমাদের স্বভাবজাত বুদ্ধির প্রয়োগের দ্বারা যুক্তিভিত্তিক ব্যাখ্যা+বিশ্লেষণের মধ্য দিয়েই কেবল সত্যজ্ঞানে উপনীত হওয়া সম্ভব। পরবর্তী প্রায় এক শতাব্দী দেকার্তের এই ধারা বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের চর্চাকে চালিত করেছে।
৩
দেকার্তের প্রায় একশতক পরে আঠার শতাব্দীর মধ্যভাগে এসে জার্মান দার্শনিক ইমান্যুয়েল কান্ট এম্পিরিক্যাল বা ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ বিজ্ঞানচর্চায় আরেকটা সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করলেন। বিজ্ঞান চর্চায় বিষয়ী (Subject) আর বিষয়ের (Object) মধ্যে যে পারস্পারিক বিচ্ছিন্নতা (অর্থ্যাৎ জ্ঞানানুসন্ধিৎসু ব্যক্তিসত্বা অধীত বস্তুসত্বা থেকে আলাদা), কান্ট সেই অনুমানকে ভুল প্রমাণ করলেন। তিনি দেখালেন যে, বস্তুজগৎ আমাদের জ্ঞানের বিষয় (Object) ঠিকই, তবে এই জগৎকে আমরা যেভাবে আমাদের সত্বার থেকে বাইরে আছে বলে জানি তা পুরোটা ঠিক না। এটা এইজন্য যে, জ্ঞানচর্চার প্রক্রিয়ার মধ্যে আমরা যে জ্ঞানার্জন করি, তা’ শুধুমাত্র অধীত বস্তুর উপর ভিত্তি করে নয়, এরসাথে অনিবার্যভাবেই যুক্ত হয়ে পড়ে অবস্তুগত কিছু উপাদান যা’র উৎস আমাদের বুদ্ধি। যেমন কোন বস্তুকে আমরা যখন প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করি তখন তাকে বিশেষ সময়ে বা বিশেষ কালে উপলব্ধি করি। আমার সামনে এখন একটা ল্যাপটপ আছে, জানালার ঠিক বাইরেই একটা সবুজ পাতাভরা গাছ দেখছি, সেই গাছের একটু দুরে আমাদের গাড়ি পার্ক করা। এই যে তিনটা ভিন্ন ভিন্ন বস্তু দেখছি, এর সবই বিশেষ সময়ে এবং বিশেষ কালে আছে। ল্যাপটপটা লেনোভো থিংকট্যাংক, গাছে পাতার রঙ ঘন সবুজ, গাড়িটা হোন্ডা সিভিক মডেলের। উল্লিখিত এসব গুণাবলী এইসব বস্তুর নিজস্ব গুণ। কিন্তু যে সময় এবং যে স্থানে এই বস্তুগুলো প্রত্যক্ষ করছি, সেগুলো এসব বস্তুর নিজস্ব গুণ বা বৈশিষ্ট্য নয়। যেভাবে আমরা বলছি ল্যাপটপ বা গাড়ির মডেল, গাছের পাতার রঙ তাদের নিজ সত্বার মধ্যে ‘আছে’, সেইভাবে বলতে পারছি না যে তাদেরকে প্রত্যক্ষ করার নির্দিষ্ট মুহূর্ত বা স্থানটিও তাদের মধ্যে ‘আছে’। অর্থ্যাৎ, সময় বা স্থান বস্তুর অন্তর্গত নয়, বরং এই উপাদানগুলোকে আমাদের বুদ্ধি জ্ঞানার্জনের প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে বস্তুর উপর আরোপ করে।
কান্ট মনে করেন যে, এইসব বহিঃস্থ উপাদান বস্তুকে জানার আবশ্যিক শর্ত যা’ ছাড়া বস্তুকে প্রত্যক্ষ করা অসম্ভব। যেমন, একটা গাছকে বাস্তবে প্রত্যক্ষ করতে হলে অবশ্যম্ভাবীরূপেই আমরা তাকে দেখি একটা বিশেষ সময়ে। এখন বর্ষাকাল বলে পাতার রঙ সবুজ; আবার শীতকালে গাছে কোন পাতাই থাকেনা। অর্থ্যাৎ, গাছের পাতা যে সবুজ তা’ বর্তমানের এই বিশেষ সময়েই (বর্ষাকালে) সত্য, অন্যসময় নয়। একইভাবে, গাছের সবুজ পাতা এইসময়ে শুধুমাত্র এই স্থানের ক্ষেত্রেই সত্য, অন্য কোথাও নয়। অতএব, স্থান (দেশ) বা সময় (কাল) বস্তুর অন্তর্গত গুণ না হলেও দেশ+কালের শর্ত ছাড়া আমাদের পক্ষে কোন বস্তু প্রত্যক্ষ বা উপলব্ধি করা কার্যতঃ অসম্ভব। একারণে, কোন কিছুর উপলব্ধি করার অর্থ তাকে বিশেষ দেশ+কালে উপলব্ধি করা। উপরন্তু, কান্ট আরো দেখান যে, আমরা বস্তুজগতের ততোটুকুই জানি যতোটুকু দেশ+কালের শর্তের মধ্যে থেকে আমাদের কাছে প্রত্যক্ষ হয়ে ধরা দেয়, যাকে কান্ট বলেছেন phenomenon। বস্তুজগতের আরেকটা অংশ আমাদের ইন্দ্রিয়ের কাছে অধরাই রয়ে যায়, যাকে কান্ট বলেছেন noumenon।
মোটকথা, ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে এম্পিরিক্যাল বা প্রকৃতি বিজ্ঞান যে জ্ঞান অর্জন করে, তা সমগ্র জগৎকে ধারণ করে না। অর্থ্যাৎ, এরূপ জ্ঞান একমাত্র সত্যজ্ঞান হতে পারেনা। জগতের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এই বিজ্ঞানের অধরা থেকে যায়। অতএব, এম্পিরিক্যাল বিজ্ঞানের জ্ঞানই চুড়ান্ত সত্য নয়। একইভাবে, প্রকৃতি বিজ্ঞানের আবিস্কৃত জগৎই একমাত্র বাস্তব জগৎ নয়, বরং এর একটা খন্ডিত অংশমাত্র।
অর্থ্যাৎ, এপর্যায়ে এই বিষয়টা পরিস্কার যে, “বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিমাত্রই সত্যজ্ঞানে জ্ঞানী, আর বিপরীতে বিজ্ঞানমনস্ক নয় এমন ব্যক্তির জ্ঞান ধর্তব্যই নয়”- এই ধারণা যুক্তির নিরিখে উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ। অতএব, বিজ্ঞানমনস্কতাকে সত্যজ্ঞানের একমাত্র নির্দেশক হিসেবে বিবেচনা করাটা যুক্তির বিচারে অগ্রহনযোগ্য।
No comments:
Post a Comment