Saturday, February 5, 2022

পুলিশ জনগণের বন্ধু।

প্রতিবছর পুলিশ সপ্তাহ আসলে, বিয়াবাড়ির মতন ব্যান্ড বাজায়ে হাতি ঘোড়া বের করে রাস্তায় র‍্যালী করে আমাদেরকে শেখানো হয়। পাবলিকের ট্যাক্সের টাকায় রাষ্ট্র চলে। কোটি টাকা ট্যাক্স দিয়া আমরা শিখি, পুলিশ আমাদের বন্ধু হবার কথা ছিল। কিন্তু পুলিশকে বন্ধু ভাবা আমরা আর শিখতে পারলাম না। পুলিশ হইয়া গেল আমাদের জীবনের বুলি করা ক্লাসমেট এর মতন। যার সাথে মিশাও যায় না। যারে ইগনোরও করা যায় না। এমন কেন হইল ? 

আসলে আমার মনে হয়, আমরা সবাই আসলে ভুল বুইঝা, মিথ্যা অনুভুতির বাবলে আছি। লাইনটার মধ্যেই সত্য লুকায়ে আছে। পুলিশ আসলেই জনগণের বন্ধু। আমার সাথে কেউ একমত হইতে পারবেন না এখনই, আমি জানি। খুলে বলি। এখানে জনগণ বলা হইসে, জনগণ একটা প্লুরাল শব্দ। এর মানে শুধু, আমি বা আপনি না। এইটা দিয়া সমষ্টি বুঝাইসে। পুলিশ আপনার বন্ধু, এমন বলা হয়নাই। পুলিশ জনগণের বন্ধু। তাইলে এবার আসেন জনগণ মানে? জনগণ তো সবাই। তো পুলিশ সবার বন্ধু ? না! তাও তো বলা হয় নাই। জনগণ একটা পলিটিকাল টার্ম। গণতান্ত্রিক দেশে শাসনব্যবস্থা প্রতিনিধিত্বমূলক। জনগণের প্রতিনিধিরাই এখানে জনগণের সামষ্টিক ধারণার ধারক। সো জনপ্রতিনিধি = জনগণ। 

এখন আসেন জনপ্রতিনিধির সাথে পুলিশের সম্পর্ক কি ? ইয়েস, এখন আপনি আমার কথায় কিছুটা লাইনে আসছেন। পুলিশ আর জনপ্রতিনিধির বন্ধুত্ব নিয়া আপনের ডাউট নাই। এই দেশে একজন এমপি নাই, যিনি ডাক দিলে থানার ওসি জিয়াব্বা বলে ফাল দিয়ে চলে আসবেনা। ইনফ্যাক্ট এই রিয়েকশান এত প্রমট, যে ইনফ্যাক্ট আমি তো দেখি পুলিশ সেখানে জনগণের বন্ধু না, রীতিমত কৃতদাসের লেভেলে আছে। আহা !! 

পুলিশ ডিপার্টমেন্টেও এই বাণীকে, আমার বর্নিত পথে শেখানো হয় কিনা জানিনা। তবে পুলিশের বন্ধুত্ব জনপ্রতিনিধি ভিত্তিক এটা দিনের আলোর মতন পরিষ্কার। আর এটাই আসলে হলেও সমস্যা ছিল না। সমস্যাটা পুলিশে না, সমস্যা লাগায়ে ফেলসি আমরাই। আমরা জনপ্রতিনিধি বানাচ্ছি ধরে ধরে এক একটা চীজ ! তো এরা আবার আলো আর অন্ধকার দুই জগতেই বিচরন করেন। ক্রিমিনাল যখন নিজেই জনপ্রতিনিধি হয়, তখন পুলিশের লজিক সিস্টেমে প্যাচ লাগে। কোড অনুযায়ী, পুলিশ অপরাধীর সবচে বড় শত্রু। আবার পুলিশ জনগনের প্রতিনিধির বন্ধু। ক্রিমিনালের হাতে দড়ি পড়বে, জননেতা স্যালুট পাবে । এইটুক মেনে চলা পুলিশের জন্য সোজা। কিন্তু জননেতা ক্রিমিনাল হলে তাকে কি স্যালুট দিয়া হ্যান্ডকাফ হবে, আগে হ্যান্ডকাফ পরে স্যালুট হবে এইটা বলে দেয়ার কেউ নাই। পুলিশের ইশে আটকায়ে গেল ফাঁটা বাঁশের ইয়েতে। আর এই প্যারাডক্সে পড়ে আমরা খুবই আহত হইলাম। একেতো আমরা শুরুতেই ভুল বুঝসি, জনগণ বলতে আমরা ধইরাই নিসি, আমিই তো জনগণ, তাইলে পুলিশ আমার ফ্রেন্ডলিস্টে নাই ক্যান? আর পুলিশ কনফিউজড সে ম্যাস পিপলের কেমন ফ্রেন্ড, সে নিজেও বুঝতেসে না। তাই পুলিশ সপ্তাহের র‍্যালি হইয়া যাচ্ছে, প্রোফাইল লক করে পাঠানো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এর মতন। পুলিশ আর জনগণ আসলেই ফ্রেন্ড হইয়া উঠতে পারতেসেনা। মাঝে মাঝেই জননেতাদের সাথে পুলিশের বন্ধুত্ব তথা ক্রিমিনালের সাথে ফ্রেন্ডশীপ দেখে আমরা জেলাস হইতেসি। আমরা পুলিশকে ঠোলা , তারপর আরো কী কী সব নিকৃষ্ট উপনাম দিতেসি। এতে পুলিশ আরো মাইন্ড খাইতেসে। আম জনতা আর পুলিশ পাশাপাশি বাসার ব্রেকাপ হওয়া লাভ বার্ড এর মতন, অভিমান নিয়া প্রতিদিন দেখা হয়, আর দুজনেই ভাবে, এমন তো হবার কথা ছিল না !! 

পুলিশ জনগণের বন্ধু, আমরা জানি, কিন্তু মানতে পারলাম না। তাইলে আমাদের বন্ধু কে ? পুলিশের বাইরে অন্য প্রতিষ্ঠান জনগণের বন্ধুত্ব পাওয়াটা ভাল লক্ষণ না, এইটা রাষ্ট্রচিন্তাবিদরা বলেন। কিন্তু কিচ্ছু করার নাই, আইন প্রয়োগ করে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য পুলিশের ভুমিকাকে কার্যকর করতে র‍্যাব জন্ম নিল। র‍্যাব সরাসরি জনগণের বন্ধু না। তবে র‍্যাব যে শক্তিশালী, এইটা প্রমান হইল। যেহেতু শক্তির উতস আবার জনগণ, তাই র‍্যাবও কেমনে জানি জনপ্রতিনিধিদের সাথে বন্ধুত্ব করে ফেললো। আম জনতা কনফিউজড হইয়া গেল আবারো। তাইলে পুলিশ ও আমাদের বন্ধু না, র‍্যাব ও না, আমাদের তাইলে উপায় কী ? 

আমার ধারণা প্রকৃত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবার আগ পর্যন্ত আমাদের আসলে যৌক্তিক কোনো ভরসা নাই। আমাদের পরিচিত প্রতিষ্ঠানগুলা ভেতরে ভেতরে ঘুনে ধরে ক্ষয়ে যা তা অবস্থা হয়ে আছে। পুলিশ, র‍্যাব, মিডিয়া, আইন ব্যবস্থা, শিক্ষা সব কিছু হয়ে গেছে বিকল্প আয়ের মাধ্যম। ক্ষমতা বা টাকা থাকলেই শুধুমাত্র এর সেবা পাওয়া যাবে এমন একটা দিকে আমরা আগায়ে যাচ্ছি। এই বৈরী অবস্থায় ভরসা খুঁজতে এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে উঠছে প্ল্যাটফর্ম। আমরা বর্বর মিডিয়া ট্রায়াল করছি। সরকারও আমাদের পালস বুঝে স্বস্তিতে হাঁফ ছাড়সে। যাক, অন্তত যা কিছু ফেসবুকে আসে নাই, সেসব নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে। বিচারপ্রত্যাশা এখন আদালত বা থানায় না গিয়ে ফেসবুকে কড়া নাড়তেসে। সরকারও ফেসবুক থেকে হ্যান্ডপিক করা ইশু রিসলভ করার চেষ্টা করতেসে। এইটাও কোনো ব্যবস্থা না। যদিও মিডিয়া আইডিয়ালি এডমিনিস্ট্রেশানের সাইড কিক হিসাবে কাজ করাটাই স্বাভাবিক, কিন্তু সামাজিক মাধ্যম তো আর যৌক্তিক অভিভাবক নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া না। সোশাল কমিউনিকেশান প্ল্যাটফর্ম জিনিসটা বড় অদ্ভুত, এখানে সবাই পারফর্মার, সবাই অডিয়েন্স। কেউ তামাসা করতে নেমেছে, কেউ সব কিছুকেই তামাসা ভেবে দেখছে। কেউ আবার একদম তামাসা সহ্য করতে পারবোনা বলে অন্যের ঘরে ঢুকে নিজের জাজমেন্ট ফলায়ে সিরিয়াস জিনিসকে তামাসা বানায়ে ফেলছে। খুন, ধর্ষনের মতন অপরাধকে ধামাচাপার অন্ধকার থেকে টেনে বের করে আনার জন্য ফেসবুক যেমন সফল, আবার নানান বিষয়ে বিষবাষ্পের অন্ধকার দিয়ে ভরায়ে ফেলার জন্যও ফেসবুক দায়ী। 

এই দেশে আর্মি অফিসার, ক্ষমতাবান সিভিল ফ্যামিলির কাছে নিগৃহীত হবার ঘটনা বিরল না। পেশীবলে বলিয়ান জনপ্রতিনিধির সন্তান বুক পকেটে কলম নিয়ে চপ্পল পায়ে দিয়ে রিকশায় ঘুরবে এমনটাও নিশ্চয়ই কেউ ভাবেন না। যতই কিতাবে আইন থাকুক, সাংসদ স্টিকার লাগানো কালো কাঁচের গাড়িকে চ্যালেঞ্জ করার জোর পুলিশের নাই। তো হ্যাডম দেখায়ে বাপের গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গ্যাঞ্জাম করে ফেলাটা এই দেশে নৈমিত্তিক ঘটনা। আম জনতা ঘাড়ানী খেয়ে চুপ করে থাকে, কারন এসবের বিচার চাইতে নাই। নেভির এই অফিসার ভদ্রলোক ভিডিও না করে চুপচাপ থানায় জিডি করলে কিন্তু কিছুই হইত না। শুধু ভিডিও ভাইরাল হয়ে একটু অসুবিধা হয়ে গেল। র‍্যাব রেইড দিয়ে তালিকা করতেসে হাজী সাহেবের ছেলের কাছে হ্যান্ডগান, হ্যান্ডকাফ, ওয়াকিটকি, গানম্যান, টর্চারসেল সবই নাকি আছে। আরে ভাই, এ আর নতুন কী ? এসব যে আছে, তা তো বাচ্চারাও জানে। আপনাদের থানায় যা যা আছে, তার বেশি এদের খাটের তলায় আছে বলেই তো এরা পাওয়ারে আসে যায়। 

কী অদ্ভুত এক সমাজ ব্যবস্থায় আমরা ঢুকসি, বেসিক জাস্টিসের জন্য এখন ফেসবুকে ভাইরাল হতে হয় আগে। আর এই ভাইরাল হবার বিষয়টা পুরো নির্ভর করে ডিজিটাল জনতা কোন ইশুটাকে নিয়ে ইন্টারেস্টেড হবে তার উপর। কেউ মরে গেসে মাইর খেয়ে, সেই খবর তেমন ভাইরাল হল না তাই খুনী ঘুরে বেড়াচ্ছে আরামে, আর কেউ এক চটকানা খেয়ে বিচার চাইলো সেটা জনতার কাছে বেশি আলোচিত মনে হল, তাতে রাজপুত্রের ঘরে সান্ত্রী সেপাই হানা দিলো। তড়িঘড়ি করে খুব আইন দেখানো হচ্ছে এখন । আমি ঠিক জানিনা, এমন তামাসার উপর ভরসা করে কী একটা দেশ বা জাতি আসলেই আগাতে পারে ?

ব্যক্তিগত চিন্তাপ্রসুত সিদ্ধান্ত থেকে আমি ফেসবুককে ফোনে থাকা অন্য সব এ্যাপের মতই দরকারী প্রয়োজনে ব্যাবহার লেভেলে নিয়ে আসছি। কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, বাঁচতে হলে ভাইরাল হওয়া শিখতে হবে। পাবলিক সেন্টিমেন্ট না কুড়াইতে পারলে এই দেশে কেউ বাল দিয়াও পুছে না। এতেও যদি শেষ হইতো তাহলেও হইতো। আমার মনে হয় এখানেই শেষ না, এমন দিন সামনে আসবে, ফেসবুকেই কোর্ট বসবে, সোশাল মিডিয়া ট্রায়াল করে আম জনতা নিজেই নিজের হকদার সাজা শুরু করবে। এই দিন বেশি দুরে নাই।

 

No comments:

Post a Comment