Tuesday, January 8, 2019

যাত্রী পরিচয়

ঢাকার রাস্তার পথচারী নিয়ে গত কিস্তি লিখে হালকা খিস্তির ভয়ে আছি, অনেকে ধরেই নিবে আমি নির্দয়, পথচারী বিদ্ধেষী মানুষ। ওকে !!!! ব্যাপার না। এই পর্বে আসেন আপনাদের যাত্রী চিনাই। কাটাকাটি হয়ে যাক। তবে, পথচারীর চেয়ে যাত্রীর ক্লাসিফিকেশন এনালাইসিস করা কঠিন। পথচারীদের যেমন মিডিয়াম এক্টাই, রাস্তা পার। বাদ বাকি সব আচরণগত বিভেদ। যাত্রীর বেলায় বিষয়টা এত্ত সোজা না। একই যাত্রী ভিন্ন ভিন্ন বাহনে সওয়ার হলে এ্যাটিচ্যুড পাল্টায়ে যায়। তবুও চেষ্টা করলে হাল্কা দাগে প্যাটার্নটা বোঝার চেষ্টা করা যায়।
যাত্রী যখন রিকশায়ঃ
তাদের মতে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ হচ্ছে বাস ড্রাইভাররা, খালি হুদাই চাপায় ! রিকশায় বসা যাত্রীর ধারনা, রাস্তায় শুধু রিকশারা চললেই ভালো মানায়, যিনি কাজের তাড়ায় রিকশায় উঠেন, তিনি ভুলে জান যে, এই বাহনের সর্বোচ্চ গতি ৩০ কিমি। অধৈর্য হয়ে চালককে টিপ্পনি দেন - ঐ মিয়া কি চালাও তোমারে ওভারটেক করে কেমনে ? বাসের ডাইনে দিয়া আগে যাও না। আরে প্রাইভেটরে সাইড দিলে যাইবা কেম্নে ? ইত্যাদি। যারা প্রেমিকা সহ উঠেন, তারা ঠিক উলটা, - মামা দেখে শুনে আস্তে আস্তে যান, কোনো তাড়া নাই। রিকশার যাত্রী নিজের চালকের ভুলের দায়ে কাধ মিলিয়ে নেন অবলীলায়, সেটা পাশের রিকশার চাকার সঙ্গে চাকা বেধে যাওয়াই হোক, বা উলটা রাস্তায় রিকশা ঢুকে গিয়ে জ্যাম লাগিয়ে দেয়াই হোক, ব্যাপার না। আমার রিকশা অলওয়েজ রাইট !!!! পথচারী থাকা অবস্থায় যেই স্পিডব্রেকারের কারনেই রাস্তাটা পার হতে পারেন, রিকশায় বসে সেই স্পিড ব্রেকারকেই গালি দেন জোরসে।যেই রাস্তায় রিকশা চলা মানা, সেই রাস্তায় ঢুকে গেলে যাত্রীরা একধরনের রোমাঞ্চ অনুভব করতে শুরু করেন। নিজের রিকশাওয়ালার প্রতি গোপন গর্ব এসে পড়ে। এইত্ত মামা চাল্লু আছে, চামে দিয়া আগায়া গেল !!!! ভিআইপি রোডে সাই সাই করে ছুটে চলা গাড়ির রাস্তায় একটা রিকশার যাত্রী হবার ভিতরে বিন্দুমাত্র গ্লানি নাই !!
যাত্রী যখন বাসেঃ
নিজে একবার উঠতে পারলেই হোল, তারপর নিজেকে বাসের মালিক, রাস্তার মালিক, দেশের মালিক ভাবা শুরু। ধুর, বার বার দাড়াইয়া দাড়াইয়া যাত্রী উডায় ক্যান। ধুর ! সিগনাল দিল ক্যান। ধুর ! পীছের বাস আগে গেল কেন। ড্রাইভার ঘন ঘন ব্রেক করে ক্যান। সবশেষে ধুরো বা* এত্ত রিকশা ক্যান !!!! উঠায়া দেয় না ক্যান রিকশাগুলা। বামে মোড় নেয়ার লেনে ঢুকে বাসটা কেন আর একটু এগিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দাঁড়ায় না, বেকুব ড্রাইভার। মোট কথা, পুরা পৃথিবী তখন অন্য ডাইমেনশানে চলে। ট্রাফিক পুলিশ দাড়া করালো, ড্রাইভারের কাগজ নাই, তাতে কী। ছেড়ে দেয় না কেন টাকা নিয়ে। অফিস যাওয়া লাগবে তো !!! ভার্সিটি বাস হলে তো কথাই নেই। বাস ভরা সব গ্ল্যাডিয়েটর !! আমাদের বাস, আমাদের মামা যেখান দিয়ে খুশি সেখান দিয়ে যাবে, কোনো প্রব্লেম ???? !!!! যেহেতু বাস হচ্ছে ঢাকার রাস্তার রাজা, তাই বাসের যাত্রীও রাজা গোত্রের। কোত্থেকে উঠবে, কোথায় নামবে সে নিজে ঠিক করবে। তাকে উঠাতে বা নামাতে গিয়ে ড্রাইভারের ইচ্ছা করে মাঝ রাস্তায় বাস বাকা করে দিয়ে পীছনের দুনিয়া বন্ধ করে দেয়ায় কোন পাপ নেই। ইচ্ছা হল ফ্যাচাত করে কফ বা সর্দি ঝেড়ে ফেল্ল জানালা দিয়ে, মাথা ঘুরান্টি দিলো, দাও বমি করে। কার গায়ে পড়লো কী আসে যায়? রাস্তার মালিকের কফ, রাস্তায়ই তো ফেলার নিয়ম। পাশের দামী প্রাইভেট কারের ভেতরে আরামে বসে যাওয়া যাত্রীর প্রতি এ এক সরব প্রতিবাদ। সবচেয়ে খারাপ হল, বাসের সামনে পথচারীর প্রতি বাসের যাত্রীর কোন করুনা , ক্ষমাবোধ থাকেনা। " হালায় আতকা আইলো ক্যান বাসের সামনে, দিতেন ডইলা। না মারলে এগো শিক্ষা হইব না" আহ ! কি স্পষ্ট বিবেচনা।
যাত্রী যখন ব্যাক্তিমালিকানাধীন গাড়িতেঃ
কেউ আইন মানেনা !!! এমন হলে কিভাবে হবে, এই ড্রাইভার ডানে থাকো, সাইড দিও না। টেনে যাও সিগনালে পড়বা। ঐ রিকশা ওয়ালাটাকে মারো এক চড় !! নেমে গিয়ে এই ব্যাটাকে কানটা ধরে জিজ্ঞেস করতো, এভাবে রাস্তা পার হয়? এদের কথা হল, চৌরাস্তা কেন হয় ? সব রাস্তায় ফ্লাইওভারের মতন হাইস্পিড ট্র্যাক কেন হয় না। কেন পথচারী রাস্তা পার হয়, আন্ডার, ওভার কিছু একটা দিয়ে সব সময় পার হতে পারে না কেন? যেখানে ফুটওভার ব্রীজ নাই, সেখানে পার হবারই বা দরকার কী ??? বাসগুলা বেয়াদব ড্রাইভারে চালায়, রিকশাওয়ালাগুলা দুনিয়ার হারামী, অন্য গাড়ির ড্রাইভাররাই শুধু বামে চাপ দেয় এই ধারনার বাইরে এসে নিজের দোষ এরা দেখতে পায় না কখনোই।ভীম ভীড়ের রাস্তার পাশে টুপ করে নেমে শপিং মলে ঢুকে যাবার সময় এরা একবারও ভাবে না, তার গাড়িটাই আটকে দিল একটা আস্ত লেন। আর যদি হয় সরকারী গাড়ি !!! তাহলে তো রাস্তার দুই পাশই রাইট, সিগনালে সব বাতিই গ্রিন। এশুধু প্রাইম মিনিস্টারের বেলায় হবার কথা ছিল, কিন্তু এই সুবিধা ৩য় শ্রেণীর স্টাফবাসের যাত্রীদেরও প্রাণের দাবী।
যাত্রী যখন সিএনজিতেঃ
জোরে, আরো জোরে, আরো... ৪০ মিনিটের পথে ২ মিনিট আগে যেতে পারলেও তো জীবনে একটা লাভ হল, এই ধারনা মনে হয় সব সিএনজি যাত্রীরই আছে। ২ হাত চিপা পেলে গায়ে তেল মেখে সিএনজিটা সেই চিপা গলে বের হয়ে যাবে এই ধারনা চালকের মতন যাত্রীরও থাকে। ওঠা আর নামার জন্য যে কোন অবস্থানই সিএনজি যাত্রীর জন্য বৈধ। সামনে জ্যাম? ব্যাপারনা, গাড়ি ঘুরিয়ে ঢুকিয়ে দাও রংরোডে, সিএনজি যাত্রীর ধৈর্য মনে হয় সব থেকে কম। শেয়ারের সিএনজী যাত্রীদের দেখলে এটা সবচেয়ে ভালো বোঝা যায়। বনানী সৈনিক ক্লাব টু মিরপুর ১০ নাম্বারের সিএনজি যাত্রীরা একটা সিএঞ্জিতে যেভাবে ঝাপিয়ে পড়ে, এক দরজা দিয়ে  জন ঢুকে ঠেলা মেরে অন্য দরজা দিয়ে সামনের ২ জন কে ফেলে দিয়ে  জন টিকে যায়। তারপর জামা ঠিক করে ভদ্রলোকের মতন ড্রাইভারকে বলে, টান দাও। আর যারা পড়ে যায়, তারাও ভদ্রলোক, কাপড় ঝাড়তে ঝাড়তে "স্টুপিড নাকি !!" এইটুক বলে ছুটে যায় পরের সিএনজি ধরতে।
যাত্রী যখন দুরন্ত, চ্যাম্পিয়ান ইত্যাদি নামক নব্য টেম্পুতেঃ
এরা শুধু মনে মনে আল্লাহকে ডাকে কত দ্রুত এই যাত্রা শেষ হবে। এরা সাধারনত কোন কিছুতে অভিযোগ করার অবকাশ পায়না। ৪ বছরের বাচ্চার বসার সাইজের যায়গায় এর নিজেদের দেহটাকে কোনোমতে আটিয়ে নিয়ে ইয়া নফসি ইয়া নফসি করতে থাকে, ভাড়া দেবার জন্য মানিব্যাগে হাত ঢোকানোর উপায় নাই বলে মাঝে মাঝে হেল্পারের সঙ্গে ঝাড়ি, বড়জোড় এইটুকুই।

বাহন যায় হোক, যাত্রী মাত্রই এক সংকল্প, আমি আগে যাব, ব্যাস!!! গোল্লায় যাক বাকি দুনিয়া। গোল্লায় যাক সিস্টেম। নিজেকে আগে নেবার জন্যে যাত্রীদের এই ব্যাকুলতার চাপ পড়ে চালকের উপর। ফলে সেই চাপ রাস্তার সব নিয়মকে করে এলোমেলো। আপাত দৃষ্টিতে রাস্তার জ্যাম তৈরীতে যাত্রীর সরাসরি হাত না থাকলেও ভুমিকা খারাপ না।

No comments:

Post a Comment