বেহেশতে দক্ষিণ এশীয় নাগরিকেরা নরক রচনা করায় সিদ্ধান্ত হয় ভারতীয় উপমহাদেশের নেতারা পুরো দক্ষিণ এশিয়া ঘুরে এই জনপদের মানুষের নৈতিক বিচ্যুতির কারণ অনুসন্ধান করবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়। দেবদাসের গান্ধীজীর সঙ্গে ভারতে নৈতিকতা অবক্ষয়ের কারন অনুসন্ধানে যাবার কথা থাকলেও তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বাংলাদেশে যাবার আগ্রহ প্রকাশ করেন। গান্ধীজী মুচকি হেসে দেবুদাকে বলেন, মুখ ফুটে বললেই হয় আমার সঙ্গে সময় কাটাতে বোরিং লাগে। শুধু নীতিকথা বলি বলে।
দেবদাস লাজুক হেসে বলেন, কী যে বলেন বাপু! আমি ঢাকাটা ঘুরেই দিল্লীতে আপনার সঙ্গে যোগ দেবো।
বঙ্গবন্ধু দেবুদাকে বলেন, সৈয়দ আশরাফের সদ্য বেহেশতে এসেছে; আমরা তার কাছ থেকে আগে গতিপথ সম্পর্কে জানবো। অন্য কোথাও গেলে আমাদের ভুত ভেবে অজ্ঞান হয়ে যাবে। সৈয়দ আশরাফই আমাদের এই বাংলাদেশ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের ব্যাপারটা বুঝতে পারবে।
--তা ভদ্রলোক কেমন! বঙ্গবন্ধু।
--কাছে গেলেই বুঝবেন। নৈর্ব্যক্তিক একটা অভিমত পাওয়া যাবে।
বেহেশতে নতুন অতিথিদের দরজার কাছে বঙ্গবন্ধুকে দেখে সৈয়দ আশরাফ আনন্দে জড়িয়ে ধরেন। চোখের অশ্রু সংবরণ করে বঙ্গবন্ধু দেবুদার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। ধ্রুপদী নায়ক দেবদাসকে পেয়ে খুবই খুশী হন সৈয়দ আশরাফ। ব্যস্ত হয়ে ওঠেন আপ্যায়নের জন্য।
বঙ্গবন্ধু বলেন, আমরা কিন্তু কাজে এসেছি। দাওয়াত খেতে আসিনি। হেভেনে ফিরে গিয়ে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। এর ওপর নির্ভর করছে বাংলাদেশের যারা হেভেনে আছে তাদের ভবিষ্যত। আর অবশ্যই ভবিষ্যতে যারা হেভেনে যেতে ইচ্ছুক তাদের প্রবেশাধিকার পাওয়া-না পাওয়া।
--মানে।
--হেভেনের পরিবেশ বিষাক্ত করে তুলেছে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ। তুমি সদ্য এসেছো, তাই আমরা জানতে এসেছি এখানকার অবস্থা। কেন এতো এতো বিষাক্ত লোকজন তৈরী হচ্ছে এই জনপদে।
সৈয়দ আশরাফ একটু নার্ভাস বোধ করেন। ভূমিবাস্তবতার যে অবস্থা; তাতো বর্ণনাতীত। জীবনে এতো বড় পরীক্ষার মুখোমুখি হবেন তা কখনো ভাবেন নি।
--আপনি আপনার মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
--দেখো আমি পারসোনাল এবং প্রফেশনাল ব্যাপার আলাদা রাখতে চাই।
দেবুদা হেসে বলেন, বঙ্গবন্ধু তারমানে আমাদের এই সফরে কী কোন আনন্দ থাকবে না। গান্ধীজীর মতো সিরিয়াস থাকবে সবকিছু।
বঙ্গবন্ধু স্বভাবসুলভ হাসিতে ফেটে পড়েন। সৈয়দ আশরাফ একটু নার্ভাসনেস কাটিয়ে ওঠেন।
বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর আমাদের কাছে আছে । আমরা শুধু মিলিয়ে নেবো।
দেবুদা জিজ্ঞেস করেন, আমি কী এখানকার থার্ড ফোর্সের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাবো।
সৈয়দ আশরাফ বলেন, নিশ্চয়ই দেবুদা, আপনাকে সেন্টার ফর পারু ডার্লিং (সিপিডি)-তে আমি নিয়ে যাবো।
বঙ্গবন্ধু হাসেন, সৈয়দ আশরাফ তোমাকে বলতে ভুলে গেছি; দেবুদা হেভেনে থার্ড ফোর্সের আহবায়ক। সাম্যবাদী এবং কাম্যবাদী দলের মনোপলি ভেঙ্গে রাজনীতি ভালোই চালিয়ে যাচ্ছেন।
--তাহলে তো প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারে উনার ইন্টারভিউ দেয়া জরুরী হবে।
দেবুদা বলেন, আহা এটা তো আমাদের সিক্রেট মিশন। ইন্টারভিউ কী করে দিই! তবে বঙ্গবন্ধু যদি অনুমতি করেন, আমার আপত্তি নাই।
বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করেন, মিডিয়ার কী অবস্থা আশরাফ!
--পাঠকের চেয়ে সংবাদপত্র বেশী, দর্শকের চেয়ে টিভি বেশী, খবরের চেয়ে টকশো বেশী, কাজের চেয়ে উত্তেজনা বেশী, সাংবাদিকের চেয়ে নেতা বেশী।
--আর সংবাদের মান!
--কেউ সারাক্ষণ তৈলব্রতে তো কেউ সারাক্ষণ এসিড ব্রতে।
--নৈর্ব্যক্তিকতা, নিরপেক্ষতা বলে কী কিছু নেই!
--না নেই; হয় আওয়ামী লীগের নেতা সাংবাদিক; নইলে বিএনপির নেতা সাংবাদিক; নয়তো জামায়াতের হুজুর সাংবাদিক। এদের নীচে পিষ্ট সৎ নৈর্ব্যক্তিক সাংবাদিকেরা।
দেবুদা বলেন, সাংঘাতিক বিষয় মশাই!
--সাংবাদিকদের এদেশে সাংঘাতিকও বলা হয়।
--আর শিক্ষকদের কী অবস্থা!
--একই।
--শিল্প-সাহিত্যের লোকজন!
--সবই টিক চিহ্ন দিয়ে নেবার ব্যাপার।
দেবুদা ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, দেখেছেন বঙ্গবন্ধু আমি হেভেনে ঠিক এই জিনিসটার প্রতিবাদী হয়েছিলাম। মানুষ কেন দলদাস হবে।
বঙ্গবন্ধু বলেন, আর রাজনৈতিক আদর্শ।
সৈয়দ আশরাফ উত্তর দেন,বেশ জগাখিঁচুড়ি অবস্থা। সাম্যবাদ ও কাম্যবাদ মিলে মিশে একাকার।
--অন্যধর্মের মানুষের ওপরে নির্যাতন করছে কারা।
--ব্যাপারটা সর্বদলীয় মস্তিষ্কেই ঢুকে গেছে। গবেষণা-পরিসংখ্যান তাই বলছে।
দেবুদা জিজ্ঞেস করেন, আমার জন্য বাংলাদেশ কী নিরাপদ হবে; নাকী ভারত চলে যাবো। এখানকার লিবেরেল বুদ্ধিজীবীরাও বলেন শুনেছি, হিন্দুদের এক’পা বাংলাদেশে তো আরেক’পা ভারতে।
বঙ্গবন্ধু বলেন, দেবুদা আমরা তো গোপনে চলাফেরা করবো। নইলে শুধু আপনি কেন; আমিও তো নিরাপদ নই।
বঙ্গবন্ধু সৈয়দ আশরাফকে জিজ্ঞেস করেন, আর “সততা” ব্যাপারটা কী আছে সমাজে!
--ওটাতো আপনাদের হত্যাকান্ডের সঙ্গে সঙ্গেই হত্যা হয়ে গেছে।
--তা আমার মৃত্যুদিবসকে ঘিরে চাঁদাবাজি কেমন চলছে!
--চলুন ছাদ থেকে দেখাই ব্যাপারটা। বঙ্গবন্ধু আর দেবুদাকে নিয়ে সৈয়দ আশরাফ ছাদে যান। সেখান থেকে নিচে দেখা যায় নানা রকম ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার, বিলবোর্ড। বঙ্গবন্ধুর ছবি বাম দিকে কোণায়। সামনে সব বিরাট বিরাট তালেবরের ছবি।
দেবুদা জিজ্ঞেস করেন, আচ্ছা বড় বড় করে লেখা দেখছি “শোক দিবস”; তা মারা গেছে কী সামনের লোকটি!
বঙ্গবন্ধু হো হো করে হেসে ওঠেন। সৈয়দ আশরাফ হাসবেন না কাঁদবেন তা বুঝতে পারেন না। সৈয়দ আশরাফ বলেন, মুজিব কোট অনেক বিক্রি হচ্ছে; আপনার পোস্টারও।
দেবুদা টিপ্পনী কাটে, বঙ্গবন্ধু আপনি দেখছি সেলিব্রেটি হয়ে গেলেন!
বঙ্গবন্ধু হাসেন, আমার তো ফেসবুকে ফলোয়ারও নেই; ভেরিফায়েড পেজও নেই; আমি সেলিব্রেটি হই কীভাবে!
সৈয়দ আশরাফ বলেন, আপনাকে নিয়ে পেজ-টেজও আছে। রীতিমত পেজ খোলার প্রতিযোগিতাও আছে।
--তা আমাকে নিয়ে লেখা বইপুস্তক কী কেউ পড়ে।
--বই বিক্রিটা কম হয়। বই উপহার দিলে এক দুই লাইন পড়ে ফেসবুকে “রিডিং বঙ্গবন্ধু” লিখে দিয়ে কয়েকদিনের মধ্যে বঙ্গবন্ধু বিদ হয়ে পড়ে কেউ কেউ ।
দেবুদা বিস্মিত হন, এতো দেখছি সব রোদ্দুর রায়ের মতো প্রতিভা মশাই! সে যেমন রবীন্দ্রবিদ হয়ে কবিগুরুর সব্বোনাশ করেছে।
বঙ্গবন্ধু সৈয়দ আশরাফকে জিজ্ঞেস করেন, তা আমার মৃত্যুদিবস পালন করছে কারা কারা!
--এটা নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে। আওয়ামী লীগ এটা পালনের সুযোগই পাছে না। পালন করছে বারো রকম লীগ।
--বারো রকম লীগ মানে। প্রধান দু’তিনটার নাম বলো।
--সাইড কিক লীগ, ছুটা বুয়া লীগ, জন্মদিন লীগ ইত্যাদি।
--সাইড কিক লীগ মানে!
--এরা সজীব ওয়াজেদ জয় লীগ। জয়ের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় যাদের আছে, তারা সুচিন্তিতভাবে গড়ে তুলেছে এই সেলফি ফাউন্ডেশন। জয় থাকে তথ্যপথ্য নিয়া; আর এরা বসে নাম বিক্রি করে বা নেম ড্রপিং করে ক্ষমতা দেখায় এবং টাকা-পয়সা চুরির সিন্ডিকেট তৈরী করেছে।
---ঐ যে সেই চোরের খনির লেটেস্ট সংস্করণ আর কী!
--আর ছুটা বুয়া লীগটা কী!
--এরা ঐ সাইড কিক লীগের পক্ষে ফেসবুকে নৈর্ব্যক্তিক মানুষদের গালাগাল করে বেড়ায়। কাভারে আপনার ছবি থাকে।
দেবুদা আক্ষেপ করেন, বঙ্গবন্ধুর ছবির প্রচ্ছদ লাগিয়ে এমন গালাগাল করে বেড়ালে যে নেতারই অপমান হয়; এটা বোঝে না ছুটা বুয়া লীগ।
সৈয়দ আশরাফ বলেন, ঐ কমনসেন্স সাইড কিক লীগ, ছুটা বুয়া লীগ এদের কারোরই নেই। কমনসেন্স থাকলে তো কিছু করে খেতে পারে মানুষ। নইলে চোরের খনি আর চাটার দলে কী কেউ নাম লেখায়!
বঙ্গবন্ধু হাসেন, সাইড কিক লীগ আর ছুটা বুয়া লীগ তাহলে চোরের খনি আর চাটার দলের সমন্বয়ে একটি “চোরচাট্টা” প্রজাতি।
দেবুদা মন্তব্য করেন, বঙ্গবন্ধু এদের সঙ্গে মুশতাক প্রজাতির মিল পাওয়া যাচ্ছে। এরা মুজিববাদী সেজে থাকলেও আসলে মুশতাকবাদী।
বঙ্গবন্ধু মাথা নাড়েন, এই মুশতাকবাদীরা আমাকে দ্বিতীয়বার হত্যা করতে মরিয়া এতো বোঝাই যাচ্ছে।
তো আশরাফ আরেকটা কী লীগ বললে!
--জন্মদিন লীগ।
দেবুদা খুবই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, পাগল হয়েছেন মশাই! বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু দিনে জন্মদিন লীগের কাজ কী!
--কাজ আছে। ঐদিন এই জন্মদিন লীগ জন্মদিন পালন করে।
--কার জন্মদিন!
--খালেদা জিয়ার।
--এও কী সম্ভব! বঙ্গবন্ধুর হত্যা দিবসে জন্মদিন পালন।
--কয়েকটা দিন ঢাকায় থাকলেই বুঝবেন দেবুদা এখানে আর কী কী সম্ভব!
বঙ্গবন্ধু বলেন,
যাই সম্ভব হোক দেবদাস আমার আর এখানে প্রত্যাবর্তন সম্ভব নয়; চল ফির্যা যাই।
No comments:
Post a Comment