Sunday, June 28, 2020

নেটফ্লিক্সের অশ্বডিম্ব

নেটফ্লিক্সে বুলবুল বলে এক সিনেমা নাকি আলোড়ন ফেলেছে। অনুরাগ কাশ্যপ বলেছেন এই শতকের সেরা সিনেমা। উনবিংশ শতকের বাঙালির গপ্পো বলে উৎসাহিত হয়ে দেখে ফেলা গেল। কিন্তু খুলে যা দেখা গেল, তা হল প্রচন্ড পলিটিকালি কারেক্ট একটি অশ্বডিম্ব। ইদানিং কালে বিন্দুমাত্র চিন্তাভাবনা পড়াশুনো বা সৃষ্টিশীলতার চূড়ান্ত অভাবকে ঢাকতে একটা চড়া দাগের যাহোক 'সঠিক' কথাকে হাঁইমাই করে তীব্র চিৎকার সহকারে জোর গলায় বলতে পারাকেই 'শিল্প' বলে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। এই উচ্চমার্গের 'প্রগতিশীলতা'র বেশ কিছু খদ্দেরও আছেন, ফলে চলছেও ভালই, ব্যবসাপাতিও নিশ্চয়ই ভালই হচ্ছে। সেই ঘরনার একটি নিখুঁত উদাহরণ হল এই সিনেমা।

সেই কারণেই কলম বাগিয়ে এটা লিখতে বসা। নইলে এই সিনেমার রিভিউ করা পন্ডশ্রম। ইতিহাস, ভূগোল সবকিছুকে গোল্লায় পাঠিয়েও কীকরে 'প্রগতিশীল' এবং হিট ছবি বানানো হয় এবং হয়েছে, সেইটুকুই এখানে দেখা হয়েছে। আর অন্য কিছু এই লেখার উদ্দেশ্য নয়।

তো, কাজের কথায় আসা যাক। সিনেমার পটভূমি ১৮৮১ সালের। গোড়াতেই জ্বলজ্বল করে লেখা আছে বলে জানা গেল। একদম গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত দেখা গেল কোনো এক অজ জঙ্গলের জমিদারবাড়ি। সেখানে উনবিংশ শতকের বাঙালি জমিদার কলার দেওয়া পাঞ্জাবি পরে ঘুরছেন। সেই ১৮৮১ সালে। রবীন্দ্রনাথের তখন সবে দাড়ি গজিয়েছে, বছর কুড়ি বয়স, বিদ্যেসাগর তখনও বেঁচে। সেই আমলে কলার দেওয়া পাঞ্জাবি? সেসব তখনও আবিষ্কার হয়নি, বঙ্গীয় পুংদের আটপৌরে পোশাক ছিল ঊর্ধ্বাঙ্গে উড়নি (বিদ্যাসাগরের বিখ্যাত পোট্রেটটি মনে করুন), আর জমকালো পোশাক বলতে ছিল চোগা-চাপকান (এবার বঙ্কিমচন্দ্রের বিখ্যাত পোট্রেটটি স্মরণ করুন), শহরে শার্ট-আর-ধুতিও চালু হয়ে গিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু কলার দেওয়া পাঞ্জাবি? ওরে বাবা। পরিচালক বা চিত্রনাট্যকার বা শিল্পনির্দেশক সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র খবর রাখার প্রয়োজন বোধ করেননি, বোঝা গেল। মেয়েদের পোশাকের খবরটা অন্তত রাখা উচিত ছিল, নারী নিয়েই যখন এত বক্তব্য। কিন্তু সিনেমায় গুষ্টিশুদ্ধ মেয়েদের দিব্যি দেখা গেল হয় ফুলফুল হাতা, কিংবা এমনি ছোটোহাতা ব্লাউজ পরে। যেন চারুলতার দৃশ্য। চারুলতা থেকে সিনেমাটি যে প্রচুর 'অনুপ্রাণিত', সে অবশ্য নায়িকার হাসি, চাউনি দেখেও বোঝা যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল চারুলতা নেহাৎই শহুরে ঘটনা, সত্যজিৎ বাবু সেসময়ের পোশাক নিয়ে বিস্তর রিসার্চ করেছিলেন, কিন্তু দুঃখের বিষয় ১৮৮০-১৮৯০-১৯০০ -- এই সময়কালের গাঁয়ের মেয়েদের পোশাক নিয়ে রিসার্চটা বুলবুলের হয়ে করে দেননি। খুব বেশি রিসার্চ করারও দরকার নেই, বাংলার ইতিহাস যাঁরা একটুও পড়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানেন, যে, বাংলায় শাড়ি পরা হত কোনো ব্লাউজ বা সায়া ছাড়া। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ওই দুইয়ের প্রচলন করেন, শেমিজ নামক একটি বস্তু আবিষ্কার করে। তিনি কলকাতায় ফেরেন ওই ১৮৮০ সাল নাগাদ, তারপর প্রাথমিক ভাবে স্রেফ ব্রাহ্মসমাজের মহিলাদের মধ্যে এর চল শুরু হয়। শহুরে আলোকপ্রাপ্ত মহিলারাও পরতে শুরু করেন। তারই ফল চারুলতার পোশাক। শুধু বাঙালি নারী ব্লাউজ পরেছে বললে পুরোটা বলা হবে না, বাঙালি বিধবা পর্যন্ত ব্লাউজ পরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সিনেমা জুড়ে! কিন্তু সুদূর গ্রামে ১৮৮০-৯০ সালে মহিলারা শাড়ি-ব্লাউজ পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, এ খুবই কষ্টকল্পনা। বস্তুত সেই সময়ের জমিদার মেয়েদের পোশাক নিয়ে আলাদা একটা রিসার্চেরই দরকার, সে এঁয়ারা করেননি, স্রেফ চারুলতা থেকে কপি মেরেছেন, সে বোঝাই যাচ্ছে।

এর চেয়েও প্রলয়ঙ্কর হল গানের ব্যবহার। সহনায়িকা এখানে গুণগুণ করে গায় রবিবাবুর গান। মোটামুটি ১৮৯৫ সাল নাগাদ। কী গান? সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে। যে গান লেখা হবে এর বছর তিরিশেক পরে। বাঙালি হলেই একটু রবীন্দ্রনাথের পাঞ্চ দিতেই হবে, বাঙালি রবীন্দ্রনাথের জন্মের আগে থেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়, এ তো জানা কথা। যেকোনো দিন পলাশীর যুদ্ধের দৃশ্যায়নেও সিরাজদৌল্লাকে 'ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে' গুণগুণ করতে দেখা যেতে পারে। বলিউডি ওয়েবসিরিজ/সিনেমার কারবার বলে কথা। এর আগে একটি সিরিজে দেখা গিয়েছিল বাঙালি নায়িকা সঙ্গমকালে 'শেষের কবিতা' থেকে আবৃত্তি করে। বলিউডি প্রযোজক-পরিচালকদের নির্ঘাত ধারণা ওতেই বাঙালির অর্গ্যাজম। একে বলিউডি জিকের পরাকাষ্ঠা বলা যেতে পারে। ওঁদের জিজ্ঞাসা করলে হয়তো এও বলবেন, যে, আশা ভোঁসলেকে উদ্দেশ্য করেই রবিবাবু 'বড় আশা করে' গানটি রচনা করেছিলেন।

তা, এ তো গেল বলিউডের রবীন্দ্রচর্চা। এছাড়াও আরেকটি দ্বিতীয় গান সিনেমায় ব্যবহৃত। সে হল 'কলঙ্কিনী রাধা'। এর উৎস নিশ্চিত করে জানা যায়না, রাধারমণ দত্তর লেখা হলে পুরোনো, কিন্তু শাহ আবদুল করিমের রচনা হলে অনেক পরে লেখা। সিনেমার সময়কালে ব্যবহার করা যায়না। কিন্তু ওসব নিয়ে কে আর কী ভাববে, একটা পপুলার গান পেয়েছি, লেঃ সালা ব্যবহার করে দি, এই তো অ্যাটিটিউড। তাও রক্ষে, কোনো চরিত্র 'বঙ্গাল কি মিট্টি বাঙ্গাল কি পানি' গেয়ে বসেনি। হ্যাঁ হিন্দিতে। কারণ এই সিনেমা দেখে নিশ্চিত ভাবে জানা গেল গ্রাম বাংলায় ১৮৮০-১৯০০ সালে সব্বাই হিন্দিতে কথা বলত তো বটেই এমনকি গপ্পো টপ্পোও লিখত দেবনাগরীতে। বড় বড় অক্ষরে এই সিনেমার অমল আর চারু দেবনাগরীতে গদ্য লিখেছে, পরিষ্কার ক্যামেরায় দেখা গেল। এরপর যেকোনো দিন জানা যাবে বঙ্কিমচন্দ্র আনন্দামাঠ লিখেছিলেন হিন্দিতে, আর জানাগাণামানার রচয়িতা দেবনাগরী ছাড়া অন্য কিছুতে লিখবেনই বা কীকরে? বাঙালি মানে হল, দু-ইঞ্চি রবীন্দ্রসঙ্গীত, শাড়ি-পাঞ্জাবি, রাসগুল্লা আর দুর্গাপুজা। ব্যস। বাকি সব ইতিহাস বলিউডের। ইতিপূর্বে আমরা সুভাষ বসুকে হরবখৎ হিন্দি বলতে দেখেছি, মাস্টারদা আর গণেশ ঘোষকে চট্টগ্রামে হিন্দিতে বাক্যালাপ করতে শুনেছি, ফলে এ আর নতুন কি। আসল কথা হল পলিটিকাল কারেক্টনেসের পরীক্ষা। সেই পরীক্ষায় এই ফিলিম ১০০ তে ২০০ পেয়েছে। অনুরাগ কাশ্যপ ঢেলে প্রশংসা করেছেন। বাঙালিও ঢেলে তালি মেরেছে। কে কবে পাঞ্জাবি পরেছে, রবিবাবু কবে জন্মেছেন, আর বাঙালি বাংলায় কথা বলে না হিন্দিতে, এই তুচ্ছ জিনিসে কার কী এসে যায়? বলিউডে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। এই হল নেটফ্লিক্সের কামাল। এই হল অনুষ্কা শর্মা প্রযোজনা। যেখানে একবর্ণও রিসার্চ না করে, স্রেফ ঝা চকচকে তিনটে দামী ক্যামেরা এনে শুট করে ফেললেই কম্মো খতম, বাকিটা পোস্ট প্রোডাকশন সামলে দেবে।
জয় বাবা বলিউড। জয় মা কারেক্টনেস।

Sunday, June 21, 2020

বাস্তবে সব প্রশ্নের উত্তর হয় না

যে কোনো সময়ে যে কোনো জায়গায় সময় পার করা মতিনের জন্য কোনো ব্যাপারই না।
যে কোন জায়গায় বসে চোখ খোলা রেখেই মতিন নিজের মনের মধ্যে ডুব মারে। মাঝে মাঝে মতিনের মনে হয় তার মনের মধ্যে একটা দিঘী আছে। ছোট মোটো না। বড় সাইজের দিঘী। হাজার হাজার লাখ লাখ ছোট বড় চিন্তা সেই দিঘীতে নানা সাইজের মাছের মত ঘুরে বেড়ায়। দিঘীর মাছেরা যেমন মাঝে মাঝে সারফেসের পানিতে ঘাঁই মারে, বা পানির সীমানার খুব কাছ দিয়ে সাতরিয়ে গিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়, তেমন করে মতিনের মনেও চিন্তারা এভাবে ঢেউ তোলে, তখন মতিন কাজের ভেতরেও টুপ করে মনের ভেতরে সেই দিঘীতে নেমে পড়ে। চিন্তার এই দিঘীর জল খুব স্বচ্ছ। মতিন ঘন্টার পর ঘন্টা হারিয়ে যেতে পারে চিন্তা নামের মাছেদের পিছে ডুব সাঁতার দিতে দিতে। কখনো তার দম আটকে আসেনা। চিন্তার এই দিঘীটা মতিনের বয়সের সাথে সাথে দিকে পাশে বাড়ছে, বাড়ছে এর ভেতরে নতুন নতুন চিন্তা। চেনা চিন্তা ছাড়াও নতুন অজানা অচেনা চিন্তা। মতিনের বাস্তব দৈনন্দিন জীবনের সাথে সমান্তরাল তার মনের ভেতর বয়ে নেয়া এই চিন্তার দিঘী।
বাস্তব খুব অস্থির, রুক্ষ, বৈষয়িক, ব্যস্ত। মতিন নিয়ম মেনে বাস্তবের সাথে তাল মেলায়, কিন্তু একা একা ভাবে, বাস্তব জীবনটা যেন ব্যস্ত চৌরাস্তার মাঝখানে পথ খুঁজে না পাওয়া পথচারী। যেন কোথায় যেতে হবে, তা ভাল ভাবে না জেনে এসে নেমে পড়া নতুন শহরে ঠিকানা হারিয়ে ফেলা। যেন কোন বাসে উঠতে হবে বুঝতে না পেরে বার বার পথ চেনা মানুষের সাথে ধাক্কা খেতে খেতে জেনে নেয়ার চেষ্টা। বাস্তব জীবন যেন আশংকা পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখতে থাকা ভীড় বাস এসে চলে যাওয়া, তাতে নতুন করে গুতাগুতি করে চড়ে বসা চালু শহরের মানুষের ভীড়ে নিজেকে খুঁজে না পাওয়া। তাই বাস্তবকে মতিনের খুব সাফোকেটিভ লাগে। বাস্তব জীবনের এই ঠাঁসাঠাঁসির ভেতরে তাই মতিনের সুযোগ পেলেই চিন্তা মাছের সাথে খেলা করাই অভ্যাস।
দিন দিন মতিনের মনে হয় তার বাস্তব জীবনের স্পেস কমে আসছে, আর তার চিন্তার দিঘী বড় হচ্ছে। বাস্তবের হিসাবের চিন্তায় বেশিক্ষন মনকে আটকাতে ভালো লাগেনা তার এখন। গুনে গুনে চিন্তা করার জীবনের চেয়ে অনেক স্বাধীনতা আছে দায়বোধবিহীন অবাধ চিন্তায়। কোনো হিসাবের ছাতামাথা নাই। ইচ্ছা হল, ভাবতে শুরু হল। আবার ছেদ পড়লে লেজ ভাঁজ করে সেই চিন্তা ডুব দেয় জলের তলায়।
ইদানিং মাঝে মাঝে মতিনের খুব অদ্ভুত একটা সমস্যা হচ্ছে। তার প্রতিদিন একটু একটু করে মনে হচ্ছে, তার কম্ফোর্ট জোন হচ্ছে মনের দিঘীটায়। রিয়েলিটি বলে প্রতিদিন তাকে যে জীবনটা পার করতে হচ্ছে, তার ভেতরেও সে দিঘীর জলেই গলা ডুবিয়ে বসে থাকে। দিঘীর পানি বাড়তে বাড়তে মনের গভীর থেকে এখন যেন তার বাস্তবতার চৌরাস্তায় উঠে আসতে চাইছে। মাঝে মাঝেই কাজের ভেতরেই কিভাবে কিভাবে যেন মতিন চিন্তার দিঘীতে নেমে যাচ্ছে। আচ্ছা এভাবে চলতে থাকলে একসময় কি পুরা বাস্তব জগতটাই একসময় চিন্তার গভীর দিঘীর জলে তলিয়ে যাবে? ব্যাপারটা এইভাবে ভাবলে কেমন হয় ? যে আমাদের বাস্তব জীবনটা ত্রিমাত্রিক বস্তুজীবন। আমাদের শরীর হচ্ছে আমাদের ত্রিমাত্রিক অস্তিত্ব। আর আমাদের মন বা চিন্তা হচ্ছে মাত্রাহীন জগত। মতিনের মাত্রাহীন চিন্তার জগত যেভাবে পরিধি বাড়িয়ে মাঝে মাঝেই মতিনের বস্তু জগতের ভেতরেও চলে আসছে, এভাবে একসময় মতিনের পুরো অস্তিত্ব কি মাত্রাহীন চিন্তা দিয়ে ডুবে যেতে পারে ? তখন তো তাহলে মতিনের ত্রিমাত্রিক দেহটা আর প্রয়োজন পড়ে না। মাত্রাহীন মন আর মাত্রাহীন চিন্তার জগতের সেই পূর্ণ অবস্থাটাই কি তাহলে মৃত্যু ? ত্রিমাত্রিক বস্তুজগতের অবসান, শরীরের বিদায় ?
ইন্টারেস্টিং তো ।
আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে মতিন বারান্দার গ্রীল ধরে জুত করে দাঁড়ায়ে খুব আয়েশে টান দিল। এই যে, মৃত্যুবিষয়ক খুব ভালো একটা চিন্তার সুতা পাওয়া গেল। এই জাতীয় চিন্তা নিয়ে মাথায় ঘোরাতে মতিনের ভাল লাগে। যদিও দ্বিতীয় কারো চোখ দিয়ে দেখলে বিষয়টা বোঝার কোনো কায়দাই নাই । দেখা যাবে শহরের ঘিঞ্জি ফ্ল্যাটবাড়িগুলার কোনো এক বারান্দায় নীল রং এর প্লাস্টিকের মগ হাতে দাঁড়ায়ে এক উস্কোখুস্কো চুলের লোক সিগারেট খাচ্ছে বাইরের দিকে তাকিয়ে।
মতিনের বারান্দার বাইরে ৩ তলা নীচে বাড়িটার ছাদে কাপড় নাড়তে আসা বুয়াটা যেমন মতিনকে দেখে ভাবছে, মতিন হয়ত তাকে লক্ষ করবে। ইচ্ছা করেই সে কাপড় শুকাতে দেয়ার পরও খালি বালতি হাতে আরো কিছুক্ষন ছাদে পায়চারী করে।
উল্টা পাশের দুরের সমান উচ্চতার বারান্দায় বসে থাকা বুড়ো লোকটা, চিন্তায় মগ্ন সিগারেট হাতে বারান্দায় দাড়ানো মতিন কে দেখে ভাবে, বউ এর সাথে ঝগড়া করা স্বামী। মনে মনে ভাবে,
এসব কত দেখলাম। দুইটা সিগারেট খাবে, তারপরে তো ঠিকই বেডরুমে ফিরা গিয়া বউ এর কাছে মাফ চাবে, ঝগড়া মিটমাট। সন্ধায় দুইজন সাইজা গুইজা একসাথে বের হইয়া ডিনার করে আসবে। সাচ ইজ লাইফ।
আর এসবের বাইরে, যেই বারান্দায় মগ হাতে দাড়ায়ে মতিন চিন্তায় হারিয়ে গেছে, সেই বারান্দার পেছনের দরজা দিয়ে ভেসে আসে, মতিনের স্ত্রীর গলা
- ২ টা টবে পানি দিতে গিয়া আধাঘন্টা খাড়ায়া থাকলা, নাস্তা খাবে কখন ?

মতিন বাস্তবে ফিরে আসে, তার চিন্তাটা টুপ করে ল্যাজ গুটায়ে জলের নীচে চলে যায়, চিন্তার জলে ভেজা মতিন বলে
- সরি, রাতে বৃষ্টি হইসে তো, পানি দেয়া লাগবেনা।
- এটা আবিষ্কার করতে তোমার পাক্কা আধঘন্টা লাগলো ?

মতিন উত্তর দেয়না।
আসলে বাস্তবতার মূল সমস্যাটাই মতিনের কাছে লাগে এইখানে।
বাস্তবে সব প্রশ্নের উত্তর হয় না।

Friday, June 5, 2020

স্বাস্থ্য একটি মাল - এবং মালের দায়িত্ব আরোহীর।

অনেক অনেএক বছর আগে শহরের রাস্তায় চকচকে রুপোলি টিনের বাস চলত। সিটের উপরে লেখা থাকত চমৎকার কিছু উপদেশ - সদুপদেশ। তেমনই এক উপদেশের কথা মনে পড়ে গেল - মালের দায়িত্ব আরোহীর।

এতদিনে নিশ্চয়ই এটা বুঝেছেন, যে, স্বাস্থ্য একটি ক্রয়যোগ্য সামগ্রী - কেননা, সরকার উত্তরোত্তর তেমন দিকেই এগোচ্ছেন, যেখানে অসুস্থতা থেকে সুস্থতা কিনে নিতে হবে - সরকারের দায় বলতে, গরীবের ক্ষেত্রে সেই খরচ সরকার বহন করবেন (কদিন করবেন, সেটা বলা মুশকিল)। অর্থাৎ, স্বাস্থ্য যে নাগরিকমাত্রেরই অধিকার, এমন আশ্চর্য কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলাই ভালো। বুঝে নিন, স্বাস্থ্য স্রেফ একটি পণ্য - খরচে পোষালে কিনবেন - না পোষালে...থাক সেসব কুকথা।

অতএব, স্বাস্থ্য একটি মাল - এবং জানেনই তো, মালের দায়িত্ব আরোহীর।

স্বাস্থ্যকর্মী-চিকিৎসক তাঁরাও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নন। সে যতোই বড় বড় লোকজন বলে থাকুন না কেন, যে, স্বাস্থ্যকর্মী-চিকিৎসক এনারা হলেন গিয়ে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার সবচেয়ে মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ, এবং এই সঙ্কটকালে তো বটেই, হুঁ হুঁ বাবা, আমাদের সরকার হলেন গিয়ে এক্কেবারে নো ননসেন্স।

সুপ্রীম কোর্ট যখন জিজ্ঞেস করেছেন, চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সরকার কী ভাবছেন বা কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন, দেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক পষ্টাপষ্টি লিখিত জানিয়েছেন -

"While the Hospital Infection Control Committee in the health facility is responsible for implementing the Infection Prevention and Control activities, but the final responsibility lies with healthcare workers. It is their responsibility to train themselves and take all measures in preventing the infection."

মোদ্দা কথা, চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদেরই দায় সংক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচানো - অর্থাৎ, নিজের দায়িত্ব নিজেরই।

এদিকে, কী গেরো দেখুন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছেন -

"Because occupational hazards arise at the workplace, it is the responsibility of employers to ensure that the working environment is safe and healthy. This means that they must prevent, and protect workers from, occupational risks. But employers’ responsibility goes further, entailing knowledge of occupational hazards and a commitment to ensure that management processes promote safety and health at work….Adequate arrangements should also be made for compensation of work-related injuries and diseases, as well as for rehabilitation and to facilitate a prompt return to work."

সরকারবাহাদুরকে যদি স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিচালক ও নিয়ামক মানতে হয়, তাহলে তো, অন্তত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার নিয়ম অনুসারে, স্বাস্থ্যকর্মী-চিকিৎসকদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে কিছু দায়িত্ব সরকারের থাকে। তাই না?

একই বক্তব্যে সরকার এও জানাচ্ছেন, যে, কোভিড পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যকর্মীদের সংক্রমণের ঝুঁকি আমজনতার চেয়ে বেশী নয়। এবং, প্রোটেক্টিভ পোষাক পরলে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের সংক্রমণের ঝুঁকি তেমন নেই - এবং তাঁদের থেকে তাঁদের পরিজন সংক্রামিত হতে পারেন, এমন সম্ভাবনা স্রেফ কষ্টকল্পনা।

অথচ, নার্সদের আন্তর্জাতিক কাউন্সিল গতমাসের শুরুতেই জানিয়েছিলেন, তাঁদের হিসেবে বিশ্ব জুড়ে অন্তত নব্বই হাজার স্বাস্থ্যকর্মী সংক্রামিত (আবারও বলি, এই হিসেব মে মাসের শুরুর) - এবং, তাঁদের নিজেদেরই কথায়, এই তথ্য অসম্পূর্ণ - কেননা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও জানিয়েছেন, সদস্য দেশগুলির অধিকাংশই চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে সংক্রমণের হার জানাচ্ছেন না।

অথচ, একজন সংক্রামিত সাধারণ নাগরিক এবং একজন সংক্রামিত স্বাস্থ্যকর্মী - দেশে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের পক্ষে দ্বিতীয়জন অনেক বেশী বিপদ। কেননা, প্রথমত, তিনি অনেক বেশী মানুষকে সংক্রামিত করতে পারেন এবং দ্বিতীয়ত, একসাথে অনেক চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী সংক্রামিত হয়ে ঘরবন্দি হয়ে পড়লে সমগ্র স্বাস্থ্যব্যবস্থাটিই ভেঙে পড়ার পরিস্থিতি।

একদিকে লকডাউন আচমকা তুলে দিয়ে সংক্রমণের আশঙ্কা বহুগুণ বাড়িয়ে ফেলা - সবরকম অফিস-কাছাড়িতে হাজিরা বাড়ানোর কথা বলে মানুষকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করা - গণপরিবহন ব্যবস্থা আধাআধি খুলে সেই সীমিত যানবাহনে গাদাগাদি ভিড় নিশ্চিত করা - আর আরেকদিকে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সংক্রমণের দায় থেকে হাত ধুয়ে ফেলা - কী কিউট না!!!

কিন্তু, সেসব কথা থাক। সৎ দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে আমাদের গুরুদায়িত্ব সরকারেরব কথাকে বেদবাক্য বলে মেনে নেওয়া।

এই পরিস্থিতিতে, নিজের স্বাস্থ্য নিজের সুরক্ষার দায় এক এবং একমাত্র নিজের, এমত সরকারি ঘোষণায় উদবুদ্ধ হয়ে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের একটি বড় অংশ যদি বাড়িতে বসে থাকতে চান, তাহলে নিশ্চয়ই তাঁদের দোষ দেওয়া যায় না। তাই না??

তাহলে কী করবেন?

কী আবার!!! সবাই হাত ধুচ্ছেন তো? সরকারও হাত ধুয়ে নিলেন।

আপনি থালা বাজান। বাতি জ্বালুন।

কোনো এক শুভদিনে সন্ধ্যা আট ঘটিকায় পরবর্তী ঘোষণার অপেক্ষায় থাকুন।