অনেকদিন পর একটা ছবি দেখলাম।হিন্দি ছবি। ‘হাইওয়ে’।পুরো ছবিটা দেখে
কিছুক্ষণ আমি বুদ হয়ে ছিলাম।আর ছবির বিষয়টা আমার মাথায় কুট কুট করে
যন্ত্রণা দিচ্ছিল বেশ কয়েকদিন। ছবির নায়িকা আলিয়া ভাট অভিনয়ও করেছে
দুর্দান্ত।নিজের ঘরের ভেতর বাবার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর হাতে দিনের পর দিন
যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছিল মেয়েটা। একদিন নিজের মাকে বিষয়টা জানানোর পর
মা বলেছিল, চুপ, চুপ কাউকে কিছু বলো না।মেয়েটার বিশ্বাস ভেঙ্গে যায়।কষ্ট
হয়। কিডন্যাপাররা যখন মেয়েটাকে কিডন্যাপ করে কিছুদিন পর ছেড়ে দিতে চায় ,
মেয়েটা যেতে চায় না। কিডন্যাপারকে বলে, যে জীবনটা সে ফেলে এসেছে সে জীবনে
সে আর কখনো ফিরে যেতে চায় না। মহাবীর নামক সেই কিডন্যাপারকে তার অনেক বেশি
বিশ্বস্ত এবং নির্ভরযোগ্য মনে হয়েছে যে, যখন তার প্রভাবশালী বাবা তাকে
উদ্ধারের ব্যবস্থা করে সে ফিরে যেতে চায় না নিজের বাবা- মায়ের কাছে। কারণ
তাদের কাছে তাদের সোশ্যাল স্ট্যাটাস তাদের কন্যার মরন যন্ত্রণা’র(যৌন
নির্যাতনের কারণে) চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।ছবির একটা অংশে আলিয়া ভাট তার
বাবাকে বলে, তোমরা বলেছিলে বাইরে অনেক সমস্যা,বাইরের পৃথিবীটা নিরাপদ না,
কিন্তু তোমরা তো একবার ও বলোনি ঘরের ভেতরও আমরা নিরাপদ না।কেন বলোনি, ঘরের
ভেতরেও আমরা নিরাপদ না?
এরও অনেক আগে ইন্ডিয়াতে আমির খানের ‘সত্যমাভে জয়’ নামে একটা অনুষ্ঠানের
একটা পর্ব সাজানো হয়েছিল সেসব ছেলে-মেয়েকে নিয়ে যারা শৈশব-কৈশোরের বিভিন্ন
সময়ে অত্যন্ত নিকট আত্মীয়ের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। সে অনুষ্ঠান
দেখে সেই ছেলে-মেয়েগুলোর শারীরিক ভাবে নির্যাতিত হওয়ার সময় এবং তার আগে
পরে তাদের যে ভয়াবহ মানসিক যন্ত্রণার মুহূর্ত কেটেছে এবং এখনো কাটছে সে
বর্ণণা শুনে চোখের পানি ফেলে নি এমন একটা মানুষ ছিল না। সেই ছেলে-মেয়েগুলো
এখন যথেষ্ট বড় হওয়া স্বত্ত্বেও স্বাভাবিক জীবন যাপন করার কথা ভাবতে পারে
না। প্রতিটা মুহূর্ত তাদের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়। সেই অনুষ্ঠানে সেই
ছেলে মেয়েগুলোর বাবা-মা সহ অভিভাবকেরা উপস্থিত ছিল।
উপস্থাপক আমির খান অভিভাবকদের মতামত জানতে চাইলে , অভিভাবকেরা প্রায়
সবাই স্বীকার করেছে,ভুল তাদের ছিল। তারা ঘরের ভেতর তাদের সন্তানদের
নিরাপত্তা দিতে পারে নি। এবং তাদের সন্তানরা কেউ কেউ যখন তাদের কাছে এই
বিষয়গুলো বলতে চেয়েছে, তখন তারা গুরুত্ব দেয়নি। নিজের সন্তানের কথাকে
বিশ্বাস করে নি। নিজের সন্তানের কঠিন বিপর্যয়ের সময় তারা তাদের যন্ত্রণা
লাঘব করতে পারেনি। তাই এখনকার বাবা-মায়ের প্রতি তারা অনুরোধ করেছেন নিজের
সন্তানকে বোঝার জন্য। সন্তানের কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনার জন্য। তাদের সমস্যায়
তাদের পাশে থাকার জন্য।
সেই অনুষ্ঠানেই আমির খান বেশ কিছু ছোট ছোট বাচ্চাকে এনে স্বল্প পরিসরে
একটা প্রশিক্ষণের মতো দেখালেন যে, নিজের বাচ্চাকে নিজের একান্ত বিশ্বস্ত
এবং আপনজন ছাড়া বাইরের কারো কোলে না দিতে, বাইরের কারো সাথে একা না রাখতে।
আর বাচ্চাদের শেখালেন তাদের সেনসিটিভ অঙ্গগুলোতে কেউ হাত দিতে চাইলে, বা
আদর করতে চাইলে তারা যেন দ্রুত সরে যায়, আর সরে যেতে না পারলে জোরে জোরে
চিৎকার করে বাবা-মাকে ডাকে। একটা চমৎকার ব্যাপার হলো সেই অনুষ্ঠানে যতগুলো
বাচ্চা এসেছিল তাদেরকে যখন আমির খান জিজ্ঞেস করল, তাদের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু
কিংবা সবচেয়ে আস্থার মানুষটি কে? প্রায় সবগুলো বাচ্চাই(ছেলে-মেয়ে সব)এক
বাক্যে বলেছে,বাবা।
যদি আমার ভুল না হয়ে থাকে হুমায়ূন আহমেদের ‘নিরন্তর’ উপন্যাস নিয়ে
‘নিরন্তর’ নামে চলচ্চিত্র বানিয়েছিলেন আবু সাইয়ীদ।সেখানে খুব সম্ভবত শাবনুর
অভিনয় করেছিল। শাবনুরের ছোট বেলার চরিত্রে একটা অংশ ছিল বাবার বন্ধু থেকে
টাকা ধার আনতে যাওয়া। অপদার্থ বাবার সন্তান হয়ে বাবার বন্ধুর কাছ থেকে
কিশোরী মেয়েটি যখন বাবার চিঠি নিয়ে টাকা ধার আনতে যায়, সেই বন্ধু মেয়েটির
উপর আদরের নামে যে বিকৃত এবং পাশবিক আচরণ করে এত বছর পর এই লেখাটা লিখতে
গিয়ে সে কথা মনে পড়ে আমার গা টা শির শির করে উঠেছে।
এখন অনেক রাত। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। বাইরে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে।আমার বোনের মেয়েটি আমার বুকের সাথে লেগে ঘুমাচ্ছে। আমায় পেলে তার সারাটি দিনের আনন্দই আমায় জুড়ে। কন্যার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার চোখ দুইটা
ভিজে উঠে। এই কঠিন পৃথিবীতে নিরাপদে,নির্ভয়ে, আনন্দ নিয়ে বড় হতে পারবে তো
আমাদের শিশুরা!!!বিশেষ করে আমাদের কন্যা শিশুরা। আমরা তাদের জন্য একটা
বিশ্বস্ত পৃথিবী গড়তে পারব তো!!! যে পৃথিবীতে তারা ছোট্ট পরীর মতো বেনী
দুলিয়ে হাসবে, খেলবে, গান করবে, আর এভাবেই একদিন বড় হয়ে যাবে।
আমরা যেন যে কোনো অবস্থাতেই আমাদের সন্তানকে গুরুত্ব দেই,তাদের কথা বিশ্বাস
করি, তার আচরণে সামান্যতম অস্বাভাবিকতা যেন আমাদের চোখ না এড়ায়, সে কোনো
বিষয় নিয়ে কষ্ট পাচ্ছে, অথচ আমাদেরকে বলতে পারছে না, এতটা আস্থাহীন অভিভাবক
যেন আমাদেরকে কোনোদিন না হতে হয় আমি শুধু এই কামনা করি। কারণ এত ভালোবাসার
যে সন্তান সে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে মানসিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে
,অথচ তার বাবা-মা জানতেও পারছে না , কিংবা জানলেও সেটা গুরুত্ব দিচ্ছে না
অথবা গুরুত্ব দিতে চাচ্ছে না এমন বাবা-মায়েরা সন্তানদের সুখী মানুষ হিসেবে
দেখতে চাওয়ার আশা করাটাও অপরাধের পর্যায়ে পড়ে যায়।
বৃষ্টি ক্রমশ বাড়ছে। আমার অস্থিরতাও কেন জানি বাড়ছে। ভয় হয়। চারপাশে এত
এত ঘটনা ঘটছে যে ভয় না পেয়ে উপায় নেই। আমরা শুধু বাইরের নিরাপত্তাহীনতার
কথা বলি, কিন্তু ঘরের ভেতরে কি আমাদের সন্তানেরা পুরোপুরি নিরাপদ সে কথা
ক’জন ভাবি।অথচ ভাবাটা জরুরি। খুব জরুরি।
No comments:
Post a Comment