দাদু বলতেন, অসুরই মহিষের রূপ ধরেছিল। শাস্ত্রে তাই আছে। .আচ্ছা বেশ, তাহলে অসুর = মহিষ যদি হয়, তবে ওয়াই ইজিকুয়াল টু জিরো'র হিসেবে এক্স ইজিকুয়াল টু জিরো হওয়ার কথা, মানে মহিষ খতম তো অসুরও খতম! একবার মহিষটাকে কাটার পর ফের ঐ মাসলম্যান কালো লোকটা কোত্থেকে এল, তাকে ফের ত্রিশূল খুঁচিয়ে মারার দরকার পড়ল কীজন্যে?
এই বেয়াড়া বীজগাণিতিক জেরায় রেগে যেতেন দাদু। বলতেন, যা যা, ডেঁপোমি করিস নি। ইশকুলের মাস্টারমশাই আবার প্রশ্নের উত্তরে গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন, শোনো। মিথোলজির মধ্যে বাস্তব খুঁজো না। সব রূপক। ঐ যে অসুর, ও হল গিয়ে অশুভের প্রতীক। অন্ধকার, অজ্ঞানতা, পাপ, অন্যায়, অশান্তি ইনকারনেটেড। তাই কালো। আর গৌরাঙ্গী অসুরনাশিনী হলেন আলো। শুভ চেতনা। যা অন্ধকার দূর করে, পাপবুদ্ধির বিনাশ ঘটায়। শোনোনি, বীরেন ভদ্র? বুদ্ধিরূপেণ সংস্থিতা, শান্তিরূপেণ সংস্থিতা?
ওহ্, সবই তবে প্রতীকী? একটু হতাশ হতাম। কেমন জলজ্যান্ত লাগে সব, আকারে-প্রকারে কী অবিকল মানুষ-মানুষ মতো, রাগ-দুঃখ-আঘাত রক্ত-ঘাম-অশ্রু সমেত- সব রূপক?
কিন্তু তারপরেই চোখে পড়ল, বঙ্কিমচন্দ্রের সেই বিখ্যাত উক্তি, "আমি স্বীকার করি, হিন্দুদিগের শাস্ত্রগ্রন্থ সকলে- বেদে, ইতিহাসে, পুরাণে, কাব্যেও রূপকের অতিশয় প্রাবল্য।. কিন্তু তাই বলিয়া এমন স্বীকার করিতে পারি না যে, হিন্দুশাস্ত্রে যাহা কিছু আছে, সবই রূপক- যে রূপক ছাড়া শাস্ত্রগ্রন্থে আর কিছুই নাই।. রামের নামের ভিতর 'রম্' ধাতু পাওয়া, এবং সীতার নামের ভিতর 'সি' ধাতু পাওয়া যায়, এই জন্য রামায়ণ কৃষিকার্যের রূপকে পরিণত হইয়াছে। .চেষ্টা করিলে, বোধ করি, পৃথিবীতে যাহা কিছু আছে, তাহা এইরূপ উড়াইয়া দেওয়া যায়।" তাই, রূপকে তেষ্টা মেটেনি, জিজ্ঞাসাটা জ্বালিয়ে মারত। অতএব গোঁফের রেখা পুরু হওয়ার আগেই জোগাড় করা গেল দেবী ভাগবত, শ্রী শ্রী চন্ডী, কালিকাপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ। কল্প-কল্পান্তরের পরিক্রমা-শেষে জানা গেল পুরো গল্পটা। নানা অলৌকিক অনৈসর্গিক মিথ দিয়ে মোড়া কাহিনী, টেক্সট-কাউন্টারটেক্সটের জাল, বয়ানও সর্বত্র এক নয়। কিন্তু সে-সব ছাড়িয়ে নিলে এ এক করুণ-মনোহর মানবিক গল্প।
#
গল্পের শুরু মহিষাসুরের পিতৃদেব রম্ভাসুরকে দিয়ে। তিনি কঠোর তপস্যা করে শিবকে তুষ্ট করেছিলেন। আদায় করেছিলেন মনোমত এক পুত্রলাভের বর। কেমন পুত্র? ত্রিলোকবিজয়ী, অপরাজেয়, মহাজ্ঞানী, সর্বপূজ্য যেন হয় সে-ছেলে।
মহাজ্ঞানী, সর্বপূজ্য? মানে, ঐ অসুর, যাকে পাপিষ্ঠ দুরাত্মা খলনায়ক বলে জানি, গ্রামাঞ্চলে যাকে 'চোরা' বলে ডাকা হয়- সে-ই? আজ্ঞে। শুধু তাই নয়, তিনি ছিলেন সুশাসক ও সুদর্শন এক দিগ্বিজয়ী রাজা। গ্রন্থ তাই বলছে।
অসুর/দৈত্য মানেই ভাঁটার মতো চোখ কুলোর মতো কান মুলোর মতো দাঁত আর পটাপট মানুষের মুণ্ডু ছিঁড়ে খাচ্ছে, কষ বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে- এই সব খোকা-জুড়নো কনসেপ্ট ঝেড়ে ফেলেই এ গল্পে ঢোকা ভাল। পুরাণেও দৈত্যদের পরিচয় এইই যে, তাঁরা দেবতাদের বৈমাত্রেয় ভাই ; দেব-জননী অদিতি আর দৈত্য-জননী দিতি ছিলেন সপত্নী, দেব-দানবের পিতৃপরিচয় অভিন্ন। একটা সহজ বাস্তব ব্যাখ্যায় বলা যায়, সম্ভবত কোনও আদি আর্য ঋষিপুরুষের আর্য-পত্নীর গর্ভজাত গৌরবর্ণ সন্ততিগণ দেবতা আর অনার্য-পত্নী-সম্ভূত কৃষ্ণাঙ্গ বা ঘোর তাম্রাভ (অস্ট্রিক বৈশিষ্ট্যের ইঙ্গিতও মেলে) সন্তানেরা দৈত্য বলে পরিচয় লাভ করেছিল।
দুই গোষ্ঠী ছিল বিবদমান, তাদের বিচরণক্ষেত্রও ছিল আলাদা। দেবতারা আর্যাবর্তে আর দৈত্যরা দাক্ষিণাত্যে রাজত্ব করতেন, মাঝেমাঝেই এ ওর টেরিটরিতে গিয়ে হামলা করেও আসতেন- দৈত্যরা যেহেতু বেশি বলশালী, এই দুষ্টুমিটা বেশি করতেন তাঁরাই। আবার স্বার্থের টানে দু'দল কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছেন- এও আমরা দেখি সমুদ্রমন্থনের গল্পে।
যাক, সে অন্য কথা। আপাতত, বাপ রম্ভাসুরের কথায় ফেরা যাক। কী মতি হয়েছিল তাঁর, তিনি শিবের বর পেয়ে ডগমগ হয়ে এক স্ত্রী-মহিষকে সঙ্গম করে ফেললেন। সেই 'মহিষী' যথাসময়ে জন্ম দিল এক বলবান রূপবান পুত্রের, নাম হল মহিষাসুর। মহিষ আর অসুরের 'ব্রিড'।
কথা হচ্ছে, এই গাঁজাখুরির কোনও গ্রহণযোগ্য বাস্তব ভার্সন আছে?
আছে বইকি। একদল পুরাণ-গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বলেন, রম্ভাসুর যাকে সঙ্গম করেছিলেন সে বস্তুত এক আরণ্য উপজাতির কন্যা, মহিষ যাদের 'টোটেম'। যেমন রামায়ণে বানর 'টোটেম'-ধারী বন্য জাতি রামের হয়ে লড়েছিল, 'ভল্লুক' জাম্বুবান ছিল তাদের পরামর্শদাতা, যেমন 'নাগ' জাতি মহাভারতে পরীক্ষিতের উপর প্রতিশোধ নিয়েছিল- এ ঠিক তেমনই এক বন্য পশুপূজক সম্প্রদায়কেই ইঙ্গিত করে। মহিষাসুর বড় হয়ে মাতৃকুলের সেই চিহ্ন ধারণ করেন। সম্ভবত মহিষ-শৃঙ্গের শিরস্ত্রাণ বা মহিষ-মুণ্ডের মুখোশ ছিল তাঁর ধর্মাচরণ বা রণসজ্জার অঙ্গ। টোটেম যেমনটি হয়।
এরপর, দুটো বয়ান আছে। একটা হল, মহিষাসুর নিজেই মরণান্তিক তপস্যার পর সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার কাছে বর পান যে, ত্রিভুবনের কোনও পুরুষ তাঁকে পরাস্ত করতে পারবে না। হ্যাঁ, শুধুই 'পুরুষ'। বর-প্রার্থনার সময় মদমত্ত হয়ে নারীর প্রসঙ্গ তিনি বিস্মৃত হয়েছিলেন সম্ভবত, কিংবা বাদ দিয়েছিলেন ইচ্ছে করেই। ঐ রন্ধ্র রয়ে গেল তাঁর অজেয় বর্মে! অন্য বয়ান বলে, দুষ্টুমি করে এক সুন্দরী রমণীর বেশ ধরে ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে ঢুকে, শিষ্যদের ভুলিয়ে যজ্ঞ পণ্ড করে দেন মহিষাসুর। ক্রুদ্ধ কাত্যায়ন শাপ দেন, সুন্দরী রমণীর হাতেই বিনাশ হবে স্পর্ধিত দৈত্যের! আমরা শাপ/বর ইত্যাদি অলৌকিক আপাতত সরিয়ে রাখি বরং। এইটুকু সহজ ইঙ্গিতই আমাদের সামনে ভেসে থাক যে, মহিষাসুর সর্বগুণসম্পন্ন হলেও তাঁর একটি মারাত্মক দুর্বলতা ছিল- নারী! নারী থেকেই হবে তাঁর ধ্বংসের বীজবপন, যেমন বহু বীরপুরুষের নিয়তি লেখা থাকে।
কিন্তু ধ্বংসের তো দেরি আছে! তার আগে রণকুশল ও উচ্চাভিলাষী রাজা মহিষাসুর তার প্রতাপ বিস্তার করতে লাগলেন। অপ্রতিরোধ্য সেনাদল গড়লেন, রাজ্য বেড়ে চলল তাঁর। এমনকী দেবতাদের নিজস্ব রাজ্য স্বর্গটিও নিলেন অধিকার করে। না, এতে যতটা ক্ষুব্ধ হয়ে থাকি আমরা, "অ্যাঁ, ইকী অনাসৃষ্টি, দেবতাদের হঠিয়ে দিয়ে." ইত্যাদি বলে- অতটা আঁতকে ওঠার কিছু নেই। দেব-দৈত্য চিরকালের বৈরী, যে যখন যাকে পায় ঠেসে ধরে, এ চিরকেলে গল্প। দেবতারাও দৈত্য-দানবদের সঙ্গে অন্যায় করেছেন বিস্তর, মেরে ধরে ঠকিয়ে নিয়েছেন ঢের। পালটা সুযোগে দৈত্যরাও মাঝেমধ্যে জ্ঞাতিভ্রাতাদের ভিটেমাটি চাঁটি করবেন, এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই- বিশেষত বলে-বুদ্ধিতে-জ্ঞানে-সাধনায় তাঁরাও যখন কমতি কিছু নন। বহুবার অসুর-পরাক্রমে রাজ্যছাড়া হয়েছেন অমরবৃন্দ। কিন্তু এবার দেবতারা কিছুতেই আর স্ববলে উদ্ধার করতে পাছিলেন না হৃতরাজ্য। তখন তাঁরা অভিযোগ জানাতে ছুটলেন মুশকিল-আসান হরি-হরের কাছে, ব্রহ্মাকে মুখপাত্র করে।
এইবার ঘটল আর-এক অলৌকিক! মহিষসুরের অত্যাচারের সাতকাহন ব্যাখ্যান শুনে বিষ্ণু-মহেশ্বরের ক্রুদ্ধ আনন থেকে তেজ নির্গত হল। ব্রহ্মা ও ইন্দ্রাদি দেবতারাও নির্গত করলেন 'পবিত্র মন্যুজনিত তেজ'- সোজা কথায়, ক্রোধাগ্নি। সেই তেজোসমষ্টি সংহত হয়ে এক অপরূপা গৌরাঙ্গী স্ত্রীমূর্তি সৃষ্টি করল। তাঁর দশ হাতে প্রহরণ ও দেহে অলঙ্কারাদি দিলেন দেবতারাই- শিব দিলেন ত্রিশূল, বিষ্ণু দিলেন চক্র, রুদ্র তাঁর ধনু, যম দণ্ড, কালভৈরব খড়গ, বসুগণ অভেদ বর্ম ইত্যাদি। বাসুকি দিলেন সর্প, ব্রহ্মা দিলেন অক্ষমালা কমন্ডলু, কুবের রত্নহার, বরুণ পদ্ম-মালিকা, সূর্য দিলেন রশ্মিগুচ্ছ, চন্দ্র অর্ধেন্দুশোভা- আর হিমালয় দিলেন বাহন সিংহটিকে। এই দৈব-তেজোসম্ভূতা, দৈব-আয়ুধ-সজ্জিতা, সর্বাভরণভূষিতা বরবর্ণিনী রমণীই দেবী দুর্গা, যিনি অচিরেই হবেন মহিষাসুরমর্দিনী।
সোজা সরল মানেটা কী দাঁড়াল? এক সুন্দরী অথচ তেজীয়ান কাঞ্চণবর্ণা পাহাড়ী মেয়েকে (নগ-দুহিতা, স্মর্তব্য) বেশ করে জাঁদরেল মিলিটারি ট্রেনিং দিলেন সব দেবতা মিলে- অস্ত্রশস্ত্র কলাকৌশল সৈন্যসামন্ত সব দিয়ে রীতিমত 'ফার্নিশ' করে পাঠালেন অসুর নিধনে? নারীই মহিষাসুরের 'আকিলিস হীল', হয়তো ললনা দেখে সে 'আন্ডারএস্টিমেট' করবে কিংবা অতুল সৌন্দর্য দেখে মনঃসংযোগ খুইয়ে বসবে, তেমন গা লাগিয়ে লড়বে না, এই অর্ধমনস্কতার সুযোগে তাকে নিকেশ করা সম্ভব-
এই কি ছিল স্ট্র্যাটেজি?
এই জায়গায় ফের গোলযোগ। সমস্ত দেবতার 'অবদান' রয়েছে এই স্ত্রীমূর্তির গঠনে, এই বার্তাটিকে বাঁকিয়ে-চুরিয়ে দুর্গাকে বহুদেবভোগ্যা স্বর্বেশ্যা বলে ব্যাখ্যা করে হাল্লা মাচিয়ে দিয়েছেন একদল সমাজতত্ত্ববিদ। যৌনতার মোহিনী-মায়ার ছলে কালো চামড়ার দলিত-নেতা মহিষাসুরকে ফাঁসিয়ে অসতর্ক অবস্থায় হত্যা করেছিল দেবপ্রেরিত অর্থাত্ আর্য-শক্তির বোড়ে হিসেবে ব্যবহৃত সেই স্বৈরিণী, এই হল তাঁদের থিওরি। দুর্গার সৌন্দর্য-বর্ণনার মধ্যে প্রকট সেন্সুয়াস ঝোঁকই সম্ভবত তাঁদের বক্তব্যের সপক্ষে অন্যতম স্তম্ভ। গোটা দেশে সম্প্রতি এ নিয়ে তুমুল কোলাহল, আইনসভায় পর্যন্ত পৌঁছেছে ঢেউ।
পণ্ডিতদের বিচারটি অবশ্য নেহাত মূর্খোচিত মনে হয় একটু তলিয়ে দেখলেই। আর্য-অনার্য বিবাদের একটা লাইন থাকতেই পারে এ-আখ্যানে, কিন্তু 'গণিকা-তত্ত্ব' একেবারেই আবর্জনা। মোহিনী-মায়ায় জব্দ করতে হলে অতশত ঢাল-তলোয়ার নিয়ে দেবীকে অমন যুদ্ধ করতে হল কেন? অমৃত-বিতরণকালে বিষ্ণুর সেই মোহিনী মূর্তিধারণের উপাখ্যান মনে পড়ে যায়, বিনা সংঘর্ষেই কার্যসিদ্ধি ; তার পাশে এ কাহিনী কত আলাদা! সমস্ত প্রামাণ্য গ্রন্থেই বিস্তারিত যুদ্ধবর্ণনা, মহিষাসুরের সেনাপতিদের একে-একে পতন, সেনাদলের বিদ্রাবণ ইত্যাদির পুঙ্খানুপুঙ্খ রেকর্ড রয়েছে। দেবী নিজে একাধিকবার রূপ পরিবর্তন করেছেন, করাল কালীমূর্তিও ধারণ করেছেন প্রয়োজনে, সে রূপ বীভত্স, যৌন-আকর্ষণী নয় মোটেই। রূপে ভোলাতে মোটেই মহিষাসুর-সকাশে যাননি তিনি। তা-ই যদি তাঁর অভিসন্ধি হত- ভুলিয়ে বশ করে বেকায়দায় ফেলে মুণ্ডুটি কেটে নেওয়া- সে-সুযোগ তো তাঁর হাতের মুঠোয় চলে এসেছিল! একেবারে প্রথমবার দূর থেকে তাঁকে দেখেই টলে গিয়েছিলেন অসুররাজ। এমন নারী তো ত্রিভুবনে দেখেননি কখনও! আক্রমণকারিণীকেই দূত মারফত্ প্রণয়-প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। এমনকী, যুদ্ধক্ষেত্রে মুখোমুখি হয়েও, আহ্বান করেছিলেন প্রেমাস্পদ হিসেবে স্বীকার করতে। প্রলুব্ধ করেছিলেন নানাভাবে। দেবী প্রতিবার প্রত্যাখ্যান করেছেন রূঢ় ভঙ্গিমায়, শেষ পর্যন্ত তীব্রতম প্রতিদ্বন্দ্বিতার অন্তে বাহুবলেই পরাস্ত করেছেন দুর্দান্ত প্রতিপক্ষকে। সমাজতত্ত্ব-নৃতত্ত্বের চোখে দুর্গা-বৃত্তান্তের যেমন ব্যাখ্যাই হোক না কেন, তাঁর উত্পত্তি নিয়ে যতই জল ঘোলা হোক, কাহিনিতে তাঁর ভূমিকা যে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যোদ্ধারই, মোহিনীর নয়- এ নিয়ে এতটুকু সন্দেহ নেই।
আমার বরং এই কাহিনির প্রসঙ্গে দুর্গাকে নিয়ে নয়, মহিষাসুরকে নিয়েই একটু বেশি ভাবতে ইচ্ছে করে।নারী ছিল একমাত্র দুর্বলতা- এই অমিত শক্তিধর অনার্য (না কি, অস্ট্রিক?) পুরুষের। কতটা দুর্বল হয়েছিলেন তিনি, অতসীপুষ্প-বর্ণাভা সুপ্রতিষ্ঠা সুলোচনা সুচারুদশনা পীনোন্নতপয়োধরা সেই অলোকসামান্যা যৌবনবতীর প্রতি? কতটা প্রণয়মথিত হলে তবে, সমস্ত সৈন্য-সেনাপতির নির্মম নিধন স্বচক্ষে দেখেও, রক্তাক্ত রণক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে সেই নিহন্ত্রীর কাছেই প্রেম নিবেদন করা যায়?এই প্রেম কি কপট চাতুরী ছিল অসুরের? প্রতিপক্ষকে ঠকানোর ছল? গ্রন্থে তেমন ইঙ্গিত আছে বটে, কিন্তু যুক্তিপরম্পরা বিচারে তা মনে হয় না আদৌ। ছলনার উদ্ভব হতে পারত পরাজয়ের ভয় থেকে। দূর থেকে দুর্গার রণংদেহি মূর্তি দেখে রাজা একবিন্দু ভীত হননি, ভয় বস্তুটি তাঁর রক্তে ছিলই না। বরং, প্রথমে বার্তাবহ অমাত্যকে ও পরবর্তীকালে সৈন্যদলকে বার বার বলে দিয়েছিলেন, যদি প্রেম-প্রস্তাবে রাজি না হন ঐ অপরূপা- তবে তাঁকে যেন 'সযত্নে' বন্দী করা হয়, গায়ে যেন আঁচড় না লাগে!
ছলনার দরকারই বা কী? দেবপ্রেরিতা সুন্দরী যে তাঁর কোনও ক্ষতি করতে পারবেন এমন সম্ভাবনা তো কল্পনাতেও আনেননি আত্মবিশ্বাসী মহাবল পুরুষ। একটিও বাণ বিনিময়ের আগেই তিনি প্রেমে পড়েছিলেন সেই নারীর, প্রথম দর্শনেই। এমনকী, সমস্ত সৈন্যবিনাশের পর সম্মুখসমরে নামতে বাধ্য হলেন যখন, তখনও সেই প্রেমেই তিনি আকণ্ঠ নিমজ্জিত। আসন্ন পতনের সম্ভাবনা কোনও বিপদ-সংকেতই দেয়নি তাঁর অন্তরে, এতই প্রগাঢ় সেই কাঙ্ক্ষা!
এইই হল তাঁর দুর্বলতা, এই রন্ধ্রপথেই তাঁর নিয়তি গ্রাস করেছিল তাঁকে।
মহিষ, হস্তী, সিংহ- পর পর অনেক রূপ ধারণ করে, অর্থাত্ একাধিক পশু-টোটেমের আশ্রয়ে সংগ্রাম করে চলেছিলেন পরাক্রান্ত অসুররাজ। সহজ হয়নি দেবীর পক্ষেও, তাঁকে পরাস্ত করা। গ্রন্থে বলা হয়েছে, অনেকবার বধ করার পরেও ফের বেঁচে উঠে যুদ্ধ করেছে মায়াবী অসুর! অর্থাত্, মৃত্যুর কাছে পৌঁছে গিয়েও, নিপুণ কায়দায় আত্মরক্ষা করেছেন দৈত্যরাজ। টক্কর চলছিল সমানে সমানে। কিন্তু, গ্রন্থ বলছে- এর মধ্যেই একবার এক নয়ন-বিমোহন পুরুষের রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন মহিষাসুর। হ্যাঁ, মহিষ-হস্তী-সিংহ নয়, মানব-রূপ!
আমি অনুমান করি, ঐ সুদর্শন অবয়বটিই তাঁর আসল আকার। ডার্ক অ্যান্ড হ্যান্ডসাম এক রোমান্টিক বীর। টোটেম হিসেবে ব্যবহৃত যাবতীয় পশুমুণ্ড বা পশুচর্ম তিনি হয়তো সাময়িক ভাবে ত্যাগ করে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তখন, নিজমূর্তিতে স্বপ্রকাশ! না, ঐ রূপে তিনি আক্রমণ করতে আসেননি, এনেছিলেন সেই নাছোড় প্রেম-প্রস্তাব, শেষবারের মতো। প্রাণঘাতী যুদ্ধের মধ্যে দাঁড়িয়ে, হয়তো বা রক্তাক্তদেহেই, সম্ভাব্য ঘাতিকাকে তিনি হৃদয় দিতে চেয়েছিলেন। বিনিময়ে পেয়েছিলেন কঠিন প্রত্যাখ্যান। ধারালো শূলে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাওয়ার আগেই হয়তো শতধা বিদীর্ণ হয়েছিল তাঁর হৃদয়- ঐ প্রত্যাখ্যানেই! কে জানে, হয়তো যুদ্ধজয়ের তাগিদই ছিল না আর। ঐ মৃত্যু হয়তো স্বেচ্ছামৃত্যুই একরকম!
পুজোমণ্ডপে দাঁড়িয়ে শূলবিদ্ধ অসুরকে দেখি যখন, দীনের মতো দেবীর পদতলে রক্তলিপ্ত, মুমূর্ষু- অথচ অপলক দৃষ্টিখানি অবধারিতভাবে নিবদ্ধ দেবীর মুখের দিকে- মনের মধ্যে কতরকম ভাবনাই যে চলকে ওঠে! ঐ দৃষ্টির কতরকম অর্থই না খুঁজে পাওয়া সম্ভব, যদি নির্জিতের দিক থেকে কাহিনীটার দিকে তাকানো যায়।জয়ী পক্ষের বয়ানে লেখা সব পুরাণ ও ধর্মশাস্ত্র, সেখানে অসুরকে অত্যাচারী পাপাত্মা কামান্ধ হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। তাই আমাদের চোখে সে 'চোরা', সে ভিলেইন, তার বুকে বিঁধে থাকা শূল আমাদের অনুভবে আঘাত দেয় না, আমরা তাকে অন্ধকার-অন্যায়-অজ্ঞানতার রূপকে মুড়ে রেখে তার মৃত্যুর উদযাপন করি । অথবা, উল্টোপথে, তাকে জবরদস্তি হিরো বানাতে যাই- বৈপ্লবিক টেক্সট-সাবটেক্সটের দোহাই দিয়ে দলিত-শোষণের নয়া পোলিটিক্যাল কিস্সা বাজারে ছাড়ি, বাজার খায় ভালো। এসব নিয়ে কথা বলতে না চাওয়া সুশীলগন আবার অনেকটা শবেবরাতের ফকিরের মতো! পাবলিক কী চায় বা খায় বা খাচ্ছে সেদিকে খেয়াল রাখে! সেভাবেই পাল তুলে।
এক ব্যতিক্রমী প্রেমিকের ট্র্যাজিক উপাখ্যান চাপা পড়ে থাকে অন্ধকারে।।
No comments:
Post a Comment