"যদি বেঁচে যাও এবারের মতো
যদি কেটে যায় মৃত্যু ভয়,
জেনো বিজ্ঞান একা লড়েছিল
মন্দির মসজিদ নয়"
কথা
গুলো নিয়ে অনেকের আপত্তি আছে। অনেকে একে ব্লাসফেমি মনে করছে, উদ্ধত্য মনে
করছে এই উক্তিতকে। আসলেই কী তেমন মনে করার সুযোগ আছে? আমার মনে হয় না। তবে
কথাটা আমার কাছে সম্পূর্ণ মনে হয়নি। বিজ্ঞান একা লড়েছে ঠিক আছে, তবে মসজিদ
মন্দির একাই যে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে তা না, লড়াই শব্দটার সাথে যা যা জড়িত
সেই সবও তাকিয়ে দেখছে শুধু। কোটি কোটি ডলারের মারণাস্ত্র, নিমিষে দুনিয়া
ধ্বংস করে দেওয়ার মত পারমানবিক বোমা, যুদ্ধ বিমান, যুদ্ধ জাহাজ, কামান,
গোলা- বারুদ এই সমস্ত কিছুও অকেজো হয়ে পরে রইছে।
এখন মসজিদ মন্দির
নয় বলাতে অনেকেই একে ধর্ম বিরোধী বলে মনে করছেন। ধর্ম আর মসজিদ মন্দির এক
জিনিস কী না তা আগে আমাদের বুঝা উচিত। মসজিদ বলতে আমরা যে ঝাঁ চকচকে শানদার
দালান বুঝি তা আসলেই বুঝায় কিনা বা মন্দির বলতেই ধর্ম বুঝায় কিনা তা জানা
দরকার। আমার তা মনে হয় না। ঈশ্বর আর মসজিদ মন্দির এক জিনিস না। এখন মসজিদ
বা মন্দির বন্ধ আছে, তাতে ধর্ম নষ্ট হয়ে যায়নি, যাওয়ার কথাও না। নবী খেজুর
পাতার ছাউনিতে নামাজ পড়ে ধর্ম প্রচার করেছেন আর আমাদের এখন এসি মসজিদ ছাড়া
নামাজ পড়া যায় না।
তবে লেখাটায় মসজিদ মন্দিরকে যে চ্যালেঞ্জ করা
হয়েছে বা বলা যায় কটাক্ষ করা হয়েছে তা মিথ্যা না। এর কারন আমার কাছে যা মনে
হয়েছে তাই বলছি। এখন যখন আমরা সকলেই বিজ্ঞানের একটা ব্রেক থ্রুর জন্য
অপেক্ষা করছি তখন প্রশ্ন জাগতেই পারে আমরা বিজ্ঞান চর্চার জন্য কী করেছি?
কত টাকা দেওয়া হয় গবেষণার জন্য? অন্যদিকে মসজিদ মন্দির বা ধর্ম চর্চার জন্য
কত টাকা খরচ করে সরকার? আমি আমার দেশের কথাই বলছি। সারা পৃথিবীর বড় বড়
বিশ্ববিদ্যালয় গুলো যখন জোরেশোরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ভাইরাসের ঠিকুজি
উদ্ধারে তখন আমাদের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় গুলো হ্যান্ড স্যানিটাইজার বানিয়ে
ফলাও করে তা প্রচার করছে! হ্যান্ড স্যানিটাইজার বানিয়ে দোষ করেনি, মানুষের
উপকারই করেছে, গবেষণার জন্য যে টাকা পায় তাতে এরা যে হ্যান্ড স্যানিটাইজার
বানাতে পেরেছে তাই অনেক!
আচ্ছা, তুলনাটা করেই ফেলি তাহলে। ২০১৯/২০
অর্থ বছরে দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে ইউজিসির গবেষণা বাবদ
বরাদ্দ ছিল ৮০৮৮ কোটি টাকা। আর ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সরকার কেবল একটি
প্রকল্প, মডেল মসজিদ প্রকল্পতে বরাদ্দ দেয় ৮৭৮৮ কোটি টাকা। বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল প্রায় আশি কোটি টাকা। অন্যদিকে (২০১৯
সালে) ঢাকেশ্বরী মন্দির সহ সারা দেশের মন্দির সংস্কারের জন্য বরাদ্দ ছিল
২২৮ কোটি টাকা।চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণার কী অবস্থা দেশে? সবচেয়ে বেশি
বরাদ্দ পেয়েছে সিলেট মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। টাকার অংক শুনে হাসা যাবে না
আগেই বলে দিলাম। তিন কোটি টাকা! খোঁজ নিয়ে দেখা যাবে সিলেটের পাড়া মহল্লার
ওয়াজ মাহফিলে এর চেয়ে কয়েক গুন টাকা খচর হয়।
তো? সংকটকালে যাদের
দিকে সকলেই তাকিয়ে রয়েছে তাদেরকে আমরা এতদিন কী দিয়ে এসেছি বুঝা যাচ্ছে?
সারা দেশে ৩৬০ মসজিদ বানানোর জন্য যে আট হাজার কোটি টাকার ওপরে দেওয়া হল তা
থেকে এই মুহূর্তে কী পাওয়া যাচ্ছে? এমন তো না যে এই ৩৬০ মসজিদ না হলে
আমাদের দেশে নামাজ পড়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আমরা বিজ্ঞানকে থোড়াই
কেয়ার করি।বিজ্ঞান চর্চা হুদা জিনিস।ফালতু খরচ সব!
আচ্ছা, এই
ক্রান্তিকালীন সময়ে যদি মসজিদ কে এগিয়ে আসতে বলা হয়, তারা কী আসবে? কয়েক
লাখ মসজিদ আছে দেশে। যদি বলা হয় মসজিদ গুলোকে আইসলেসন সেন্টার হিসেবে
ব্যবহার করা হোক। সবাই মেনে যাবে? আমাকে লাফ দিয়ে ধরার আগে আরেকবার ভাবুন।
মসজিদ কমিটি লাশ নিয়ে যাওয়ার জন্য খাটিয়া দেয় নাই, এমন খবর দুইদিন আগেই
পাইছি আমরা!
যদি পুরো বিশ্বের হিসেব করি তাহলে আমাদের মত রুগ্ন
অবস্থা হয়ত দেখব না। কিন্তু খুব যে ভাল অবস্থা তাও না। সেখানে তুলনা আসবে
মসজিদ মন্দিরের সাথে না। সেখানে আসবে পৃথিবী চোদ্দ বার করে ধ্বংস করে দেওয়া
মারণাস্ত্র বানানোর বাজেটের সাথে। এই ক্রান্তিকালীন সময় কেটে যাবে। হয়ত
নতুন পৃথিবীর দেখা পাব আমরা। । যেখানে আগামী পৃথিবীর দুর্যোগ সামাল দেওয়ার
জন্য আমরা তৈরি থাকব। সেই আশায় থাকলাম।।
Thursday, April 23, 2020
Sunday, April 12, 2020
করোনা, রাষ্ট্রের দায় কি?
আমি করোনা বিশেষজ্ঞ নই। জীবাণু বা জনস্বাস্থ্য বিষয়েও বিশেষজ্ঞতার
ধারেকাছেও যাইনা। তাহলে এটা লিখছি কেন? কারণ, চারদিকে দেখছি, লকডাউনে
হাঁফিয়ে যাওয়া মানুষ, নানারকম পাগলামি করছেন, এবং লকডাউন উঠে গেলেই
করোনামুক্ত পৃথিবীতে আবার নিঃশ্বাস ফেলবেন, এই আশায় দিন কাটাচ্ছেন। এই লেখা
নেহাৎই সাধারণজ্ঞান নির্ভর। কিন্তু স্পষ্ট করে সাধারণ কথাগুলোই বিশেষ কেউ
লিখছেন বলে দেখছি না। তাই এই পুচকে লেখা।
---------
লকডাউন উঠে গেলেই কি করোনা ফিনিশ? স্পষ্ট করে প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার, না। এই ধুন্ধুমার লকডাউন উঠে গেলে পৃথিবী আদপেই পৃথিবী করোনামুক্ত হবেনা। একবার যখন এসে পড়েছে, ভাইরাসটি আছে এবং থাকবে। নির্মূল হবেনা। সে চেষ্টাও পৃথিবীর কোনো দেশের কোনো স্বাস্থ্যসংস্থা বা সরকার করছেনা। অতএব, যদি নেহাৎই প্রশান্ত মহাসাগরের কোনো দ্বীপে গিয়ে একাকী বসবাস না করতে পারেন, আজ হোক বা ছমাস পরে, এর সংস্পর্শে আপনি আসবেনই, যদি না ইতিমধ্যেই এসে গিয়ে থাকেন। তার মধ্যে কোনো টিকা বেরিয়ে যাবার সম্ভাবনা খুবই কম। (যখন বেরোবে তার পরেও, ফ্লুয়ের মতোই ভাইরাসের নতুন কোনো গোষ্ঠী সম্ভবত উদয় হবে, টিকা যার কোনো প্রতিষেধক নয়।) ফলে ভাইরাস নাকের ডগায় এলে আপনার ভরসা আপনার প্রতিরোধক্ষমতা। কোনো লকডাউন, কোনোভাবেই আপনাকে তার থেকে বাঁচাবেনা। গোষ্ঠীগতভাবে মানুষ যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জার বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন করেছে, সেভাবেই করোনার বিরুদ্ধেও করবে। এইটিই একমাত্র পথ। কোনো সরকার, কোনো স্বাস্থ্যব্যবস্থা, অন্য কোনো পথ এখনও দেখায়নি, দেখানোর সুযোগও নেই। এবং এই লকডাউন, তথাকথিত সামাজিক দূরত্ব, এসব কেবল এক সাময়িক ব্যবস্থা। এতে করে ভাইরাস নির্মূল হয়না। ভাইরাল নির্মূল করার কোনো চেষ্টা আদপেও কোথাও করাও হচ্ছেনা।
তাহলে হচ্ছে টা কী? এই দূরত্ব বজায় রাখা, দরজা বন্ধ রাখা, এসব দিয়ে একটাই জিনিস হচ্ছে। খুব কায়দা করে যেটাকে বলা হচ্ছে বক্ররেখাকে সিধে করা। ফ্ল্যাটেনিং দা কার্ভ। অর্থাৎ, ছড়ানোর গতিটা একটু কমানো। নানা জায়গায় লোক সমাগম হলে খুব দ্রুত ভাইরাস ছড়াবে। দরজা বন্ধ করে রাখলে ধীরে। অর্থাৎ, আপিস-কাছারি-দোকান-বাজার করলে আপনি হয়তো আগামী কালই ভাইরাসের সংস্পর্শে আসতেন। এখন দরজা বন্ধ করে রাখার ফলে তিনমাস বা ছমাস পরে আসবেন। কিন্তু আসবেনই যে, এতে বিশেষ কোনো সন্দেহ নেই। ফলে, যারা করোনাক্রান্ত বা তার পরিবারকে কুষ্ঠরোগীর মতো করে দেখছেন, পাড়ায় গিয়ে হামলা করছেন, কীটনাশক দিয়ে স্নান করাচ্ছেন, ডাক্তার-নার্সদের বাড়িছাড়া করছেন, তাঁদের একটাই কথা বলার। উন্মাদনা দিয়ে ভাইরাস আটকায়না। করোনা যদি কুষ্ঠ হয়, তো এই কুষ্ঠের সংস্পর্শে আপনাকে আসতেই হবে। আজ বা কাল। এই লকডাউনে ব্যাপারটা একটু ধীরগতিতে চলছে। এই মাত্র। পরশুদিন আপনার জ্বর হলে, শুকনো কাশি হলে, আপনাকেও অবিকল এইভাবেই দেখা হবে। পাড়ার লোকে আপনাকেও বলবে, দেকেছো কীরকম ভাইরাস ছড়াচ্ছিল ব্যাটা? গণশত্রু কোথাকার। মনে রাখবেন, সাবধানতা আর উন্মাদনা এক জিনিস নয়। সাবধান হয়ে আপনি ভাইরাসকে ধীরগতিকে ছড়াতে দিচ্ছেন। আর উন্মাদ হয়ে যেটা করছেন, সেটা সামাজিক অস্থিরতা তৈরি।
এবার কথা হল, আজ বা কাল, যখন ভাইরাস নাকের ডগায় আসবেই, তখন এই ধীরগতিতে ছড়িয়ে লাভটা কী? দুখানা লাভ।
১। বহু লোক একসঙ্গে ভাইরাসের কবলে পড়লে, বেশিরভাগেরই হয় কিচ্ছু হবেনা, কিংবা সামান্য জ্বর-কাশি হবে, কিন্তু একটা ভগ্নাংশের অবস্থা গুরুতর হবেই। খুব দ্রুতগতিতে ছড়ালে এই ক্ষুদ্র ভগ্নাংশের সংখ্যাই অনেক বেশি হবে। তাদের চিকিৎসা করা যাবেনা। বাংলাদেশে যদি ১০ কোটি লোক ৭ দিনে করোনা ভাইরাসের সংস্পর্শে আসেন, তাঁদের মধ্যে ১০ লাখ লোককে যদি হাসপাতালে যেতে হয়, তাহলে চিকিৎসা দূরস্থান, হাসপাতালের করিডোর পার করে রাস্তায় অবধি রোগশয্যা পাততে হতে পারে। পরিকাঠামোর এমনই হাল। তখন চিকিৎসার অভাবেই বেশ কিছু লোক মারা যাবেন, যারা হয়তো বেঁচে থাকতেন। এই অবস্থা যাতে না হয়, অসুস্থতা যাতে ধীরেসুস্থে ছড়ায়, হাসপাতালে চাপ না পড়ে, সেই কারণেই ধীরগতিতে ছড়ানোর প্রস্তাব।
২। ধীরগতিতে ছড়ালে গোষ্ঠীগত প্রতিরোধক্ষমতা, কোনো অলৌকিক পদ্ধতিতে বেড়ে যেতে পারে। এটা কী করে হবে স্পষ্ট নয়। বিশেষ্জ্ঞরা এ ব্যাপারে আমার আপনার চেয়ে বেশি কিছু জানেন বলেও মনে হয়না। কীকরে কিছু দেশে ভাইরাস কম ছড়াচ্ছে, কিছু দেশে বেশি, যেখানে কম ছড়াচ্ছে, সেখানে আদৌ কম ছড়াচ্ছে কিনা, নাকি মানুষ প্রতিরোধ করে ফেলছে, নাকি অন্য কোনো গূঢ় ব্যাপার আছে, সেসব কেউই জানেননা। কিন্তু, প্রতিতুলনা দিয়ে বলতে গেলে, এক লহমায় সবাইকে বাঘের মুখে ফেলার চেয়ে একটু একটু করে ফেললে হয়তো লোকজন বাঘকে আটকেও দিতে পারে প্রস্তুত হয়ে, চিন্তাপদ্ধতিটা অনেকটা এরকম।
দুটো কারণই সহজবোধ্য। কিন্তু এগুলো ভাইরাস নির্মূল করার পদ্ধতি নয়। লকডাউন দিয়ে ভাইরাস নির্মূল হবেনা। চিকিৎসার পরিকাঠামো যাতে ভেঙে না পড়ে, সে জন্য লকডাউন একটি সাময়িক ব্যবস্থামাত্র। এই সাময়িক ব্যবস্থাপনায় এমনিতে কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অন্য জায়গায়। চিকিৎসা ব্যবস্থা, এই মূহুর্তে, কয়েকটি দেশ বাদ দিলে, প্রায় সারা পৃথিবীতেই একটি লাভজনক ব্যবসা। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে সরকারি ব্যয়বরাদ্দ কোথাওই প্রয়োজনের চেয়ে অনেক নিচে। এবং চিকিৎসা যে মানবাধিকার, এটা প্রায় কেউই স্বীকার করেনা। স্বাস্থ্য এবং জনস্বাস্থ্যব্যবস্থার অপ্রতুলতার যে দায় সরকারের নেবার কথা, লকডাউন করে দিয়ে সেই দায় বস্তুত মানুষের ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে। দিগ্বিদিকে কেবলই শোনা যাচ্ছে লকডাউনই করোনা মোকাবিলার একমাত্র রাস্তা। এবং লকডাউন ভেঙে মানুষ কী দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো কাজ করে ফেলেছে। কিন্তু সরকারের দায়ের আলোচনা কোথাও নেই। কেন হাসপাতালে রোগির ভিড় সামাল না দেবার অসুস্থতার চিকিৎসা স্রেফ লকডাউন দিয়ে করা হবে, কেন চিকিৎসাব্যবস্থা এমন হবে, যে, সতেরো কোটির দেশে সতেরো লাখ লোককে একদিনে জরুরি চিকিৎসা দেওয়া যাবেনা, কেন বাজেট বরাদ্দে স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা বহু বহু নিচে, সে আলোচনা উধাও। এখন সব দায়িত্বই মানুষের। এবং বাদবাকিটা ধীরে-চলো নীতি। এতদ্বারা কোনো অজানা উপায়ে মানুষ যদি প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন করেই ফেলে, তাহলে বলা যাবে, এই ব্যবস্থা দিব্যি কাজ করছে। না পারলে, সব দোষ দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষের। অনেকে একসঙ্গে অসুস্থ হয়ে পড়লে কীকরে সবাইকে চিকিৎসা দেওয়া যাবে? অতএব আপনারই দায়িত্ব অসুস্থ না হওয়া। রাষ্ট্র তাই আপনাকে বন্দী করে রাখবে। চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেনা। রাষ্ট্রের বিশেষ দায় নেই, আপনি অসুস্থ হয়ে যাতে না পড়েন, তার জন্য তো তারা কারফিউ জারি করে রেখেইছে। ব্যস দায়িত্ব খতম।
এবং এটা ভাবা হচ্ছে এমনভাবে, যেন এর কোনো বিকল্প নেই। বলা হচ্ছে এমনভাবে, যেন লকডাউনই এক ও একমাত্র অমোঘ ওষুধ, যা ভাইরাস ঠেকাবে। অথচ, তা আদৌ নয়। লকডাউন ভাইরাস মারেনা। এবং এর বিকল্প বিলক্ষণ আছে। খুব স্বল্পবুদ্ধিতেই, বিকল্প হিসেবে যেটা হতে পারত, বা পারে, সেটা হল স্পষ্ট করে বলা, যে, লকডাউন কোনো চিরস্থায়ী সমাধান দেবেনা। ভাইরাস আছে ও থাকবে। সরকার যেটা করতে পারে, তা হল আক্রান্তদের চিকিৎসার সুযোগ। সেইটুকু করার জন্য লকডাউন কেবল একটু নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ দেবে। এবং সেই সময়ে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোয় বিপুল বিনিয়োগ করে যুদ্ধকালীন প্রস্তুতিতে চিকিৎসার সুবন্দ্যোবস্তো করে ফেলা হবে। সরকার সেই দায়িত্ব নেবে। সমস্ত মানুষের জন্য নেবে। একটা ভাইরাসের জন্য না, আগামীর সমস্ত সমস্যার জন্য নেবে। বাজেট বরাদ্দ বহুগুণ বাড়বে। এবং স্বাস্থ্য যে মানবাধিকার, এটা স্বীকৃত হবে। কিন্তু সেই দাবীই কোথাও নেই, ঘোষণা তো পরের কথা।
এই দাবীগুলো আলোচনায় নেই কেন? তার কারণও পরিষ্কার। পৃথিবী জুড়েই এক যুদ্ধপরিস্থিতি তৈরি করে ফেলা হয়েছে। যুদ্ধের উন্মাদনা তৈরি করে ফেলা হয়েছে। কোনো যুদ্ধ ছাড়াই। রাষ্ট্র সমস্ত ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছে, কিন্তু প্রাথমিক বিষয়গুলো নিয়ে তার আর কোনো দায়িত্ব নেই। কারণ এখন যুদ্ধপরিস্থিতি। এখন শুধু জরুরি ভিত্তিতে শত্রু ঠেকানোর লড়াই। বাকি সবই গৌণ। এই লড়াইয়ে প্রতিটি মানুষই সৈন্য। তাদের শৃঙ্খলাপরায়ণ হতে হবে। শৃঙ্খলা ভাঙলে শাস্তি। কেউ কেউ আবার শৃঙ্খলা ভেঙে ভাইরাস পক্ষের গুপ্তচরও হতে পারেন, তাঁরা গণশত্রু। সেই কারণে প্রয়োজন তীব্র নজরদারি। কারণ এখন যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধের জয়-পরাজয় সবার আগে, সেনার কোর্ট মার্শাল হয়, তাদের জন্য অন্য নিয়ম। তাদের কোনো নাগরিক অধিকার নেই, থাকতে পারেনা। ব্যক্তির যে অধিকারগুলি গত একশ বছরে অর্জন করা গেছে, সেসবের আর কোনো মূল্য নেই। যে অধিকারগুলি, যেমন সবার জন্য স্বাস্থ্য, গণতান্ত্রিক পরিসরে রাষ্ট্রীয় নজরদারি বন্ধ করা, এসব এখন পিছনের আসনে। করোনা তো আগে তাড়াই দাদা।
গত একশ বছরে কোনো যুদ্ধ নিয়ে, পৃথিবী জুড়ে এমন ঐকমত্য দেখা যায়নি। গত পঞ্চাশ বছরে নাগরিক জীবনে রাষ্ট্রের অবাধ হস্তক্ষেপ নিয়ে ডান ও বাম উদারনৈতিক ও রক্ষণশীলদের মধ্যে এমন একমত হওয়া দেখা যায়নি। গোটা পৃথিবী এখন শৃঙ্খলার নিগড়ে বাঁধা। সেনাবাহিনীর মতই শৃঙ্খলিত। শুধু মজা এই, যে, এই যুদ্ধ শত্রুকে নির্মূল করার নয়। ভাইরাস এভাবে নির্মূল হবেনা। স্বাস্থ্যকে মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণার, স্বাস্থ্যের পরিঠামো বাড়ানোর, স্বাস্থ্যে রাষ্ট্রের দায়িত্ব সুনিশ্চিত করার একটা চেষ্টা করলে বরং একটা দীর্ঘমেয়াদি বদল আসতে পারত। কিন্তু সে চেষ্টাও কেউ করছেনা। এখনও যুদ্ধ চলছে।
---------
লকডাউন উঠে গেলেই কি করোনা ফিনিশ? স্পষ্ট করে প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার, না। এই ধুন্ধুমার লকডাউন উঠে গেলে পৃথিবী আদপেই পৃথিবী করোনামুক্ত হবেনা। একবার যখন এসে পড়েছে, ভাইরাসটি আছে এবং থাকবে। নির্মূল হবেনা। সে চেষ্টাও পৃথিবীর কোনো দেশের কোনো স্বাস্থ্যসংস্থা বা সরকার করছেনা। অতএব, যদি নেহাৎই প্রশান্ত মহাসাগরের কোনো দ্বীপে গিয়ে একাকী বসবাস না করতে পারেন, আজ হোক বা ছমাস পরে, এর সংস্পর্শে আপনি আসবেনই, যদি না ইতিমধ্যেই এসে গিয়ে থাকেন। তার মধ্যে কোনো টিকা বেরিয়ে যাবার সম্ভাবনা খুবই কম। (যখন বেরোবে তার পরেও, ফ্লুয়ের মতোই ভাইরাসের নতুন কোনো গোষ্ঠী সম্ভবত উদয় হবে, টিকা যার কোনো প্রতিষেধক নয়।) ফলে ভাইরাস নাকের ডগায় এলে আপনার ভরসা আপনার প্রতিরোধক্ষমতা। কোনো লকডাউন, কোনোভাবেই আপনাকে তার থেকে বাঁচাবেনা। গোষ্ঠীগতভাবে মানুষ যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জার বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন করেছে, সেভাবেই করোনার বিরুদ্ধেও করবে। এইটিই একমাত্র পথ। কোনো সরকার, কোনো স্বাস্থ্যব্যবস্থা, অন্য কোনো পথ এখনও দেখায়নি, দেখানোর সুযোগও নেই। এবং এই লকডাউন, তথাকথিত সামাজিক দূরত্ব, এসব কেবল এক সাময়িক ব্যবস্থা। এতে করে ভাইরাস নির্মূল হয়না। ভাইরাল নির্মূল করার কোনো চেষ্টা আদপেও কোথাও করাও হচ্ছেনা।
তাহলে হচ্ছে টা কী? এই দূরত্ব বজায় রাখা, দরজা বন্ধ রাখা, এসব দিয়ে একটাই জিনিস হচ্ছে। খুব কায়দা করে যেটাকে বলা হচ্ছে বক্ররেখাকে সিধে করা। ফ্ল্যাটেনিং দা কার্ভ। অর্থাৎ, ছড়ানোর গতিটা একটু কমানো। নানা জায়গায় লোক সমাগম হলে খুব দ্রুত ভাইরাস ছড়াবে। দরজা বন্ধ করে রাখলে ধীরে। অর্থাৎ, আপিস-কাছারি-দোকান-বাজার করলে আপনি হয়তো আগামী কালই ভাইরাসের সংস্পর্শে আসতেন। এখন দরজা বন্ধ করে রাখার ফলে তিনমাস বা ছমাস পরে আসবেন। কিন্তু আসবেনই যে, এতে বিশেষ কোনো সন্দেহ নেই। ফলে, যারা করোনাক্রান্ত বা তার পরিবারকে কুষ্ঠরোগীর মতো করে দেখছেন, পাড়ায় গিয়ে হামলা করছেন, কীটনাশক দিয়ে স্নান করাচ্ছেন, ডাক্তার-নার্সদের বাড়িছাড়া করছেন, তাঁদের একটাই কথা বলার। উন্মাদনা দিয়ে ভাইরাস আটকায়না। করোনা যদি কুষ্ঠ হয়, তো এই কুষ্ঠের সংস্পর্শে আপনাকে আসতেই হবে। আজ বা কাল। এই লকডাউনে ব্যাপারটা একটু ধীরগতিতে চলছে। এই মাত্র। পরশুদিন আপনার জ্বর হলে, শুকনো কাশি হলে, আপনাকেও অবিকল এইভাবেই দেখা হবে। পাড়ার লোকে আপনাকেও বলবে, দেকেছো কীরকম ভাইরাস ছড়াচ্ছিল ব্যাটা? গণশত্রু কোথাকার। মনে রাখবেন, সাবধানতা আর উন্মাদনা এক জিনিস নয়। সাবধান হয়ে আপনি ভাইরাসকে ধীরগতিকে ছড়াতে দিচ্ছেন। আর উন্মাদ হয়ে যেটা করছেন, সেটা সামাজিক অস্থিরতা তৈরি।
এবার কথা হল, আজ বা কাল, যখন ভাইরাস নাকের ডগায় আসবেই, তখন এই ধীরগতিতে ছড়িয়ে লাভটা কী? দুখানা লাভ।
১। বহু লোক একসঙ্গে ভাইরাসের কবলে পড়লে, বেশিরভাগেরই হয় কিচ্ছু হবেনা, কিংবা সামান্য জ্বর-কাশি হবে, কিন্তু একটা ভগ্নাংশের অবস্থা গুরুতর হবেই। খুব দ্রুতগতিতে ছড়ালে এই ক্ষুদ্র ভগ্নাংশের সংখ্যাই অনেক বেশি হবে। তাদের চিকিৎসা করা যাবেনা। বাংলাদেশে যদি ১০ কোটি লোক ৭ দিনে করোনা ভাইরাসের সংস্পর্শে আসেন, তাঁদের মধ্যে ১০ লাখ লোককে যদি হাসপাতালে যেতে হয়, তাহলে চিকিৎসা দূরস্থান, হাসপাতালের করিডোর পার করে রাস্তায় অবধি রোগশয্যা পাততে হতে পারে। পরিকাঠামোর এমনই হাল। তখন চিকিৎসার অভাবেই বেশ কিছু লোক মারা যাবেন, যারা হয়তো বেঁচে থাকতেন। এই অবস্থা যাতে না হয়, অসুস্থতা যাতে ধীরেসুস্থে ছড়ায়, হাসপাতালে চাপ না পড়ে, সেই কারণেই ধীরগতিতে ছড়ানোর প্রস্তাব।
২। ধীরগতিতে ছড়ালে গোষ্ঠীগত প্রতিরোধক্ষমতা, কোনো অলৌকিক পদ্ধতিতে বেড়ে যেতে পারে। এটা কী করে হবে স্পষ্ট নয়। বিশেষ্জ্ঞরা এ ব্যাপারে আমার আপনার চেয়ে বেশি কিছু জানেন বলেও মনে হয়না। কীকরে কিছু দেশে ভাইরাস কম ছড়াচ্ছে, কিছু দেশে বেশি, যেখানে কম ছড়াচ্ছে, সেখানে আদৌ কম ছড়াচ্ছে কিনা, নাকি মানুষ প্রতিরোধ করে ফেলছে, নাকি অন্য কোনো গূঢ় ব্যাপার আছে, সেসব কেউই জানেননা। কিন্তু, প্রতিতুলনা দিয়ে বলতে গেলে, এক লহমায় সবাইকে বাঘের মুখে ফেলার চেয়ে একটু একটু করে ফেললে হয়তো লোকজন বাঘকে আটকেও দিতে পারে প্রস্তুত হয়ে, চিন্তাপদ্ধতিটা অনেকটা এরকম।
দুটো কারণই সহজবোধ্য। কিন্তু এগুলো ভাইরাস নির্মূল করার পদ্ধতি নয়। লকডাউন দিয়ে ভাইরাস নির্মূল হবেনা। চিকিৎসার পরিকাঠামো যাতে ভেঙে না পড়ে, সে জন্য লকডাউন একটি সাময়িক ব্যবস্থামাত্র। এই সাময়িক ব্যবস্থাপনায় এমনিতে কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অন্য জায়গায়। চিকিৎসা ব্যবস্থা, এই মূহুর্তে, কয়েকটি দেশ বাদ দিলে, প্রায় সারা পৃথিবীতেই একটি লাভজনক ব্যবসা। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে সরকারি ব্যয়বরাদ্দ কোথাওই প্রয়োজনের চেয়ে অনেক নিচে। এবং চিকিৎসা যে মানবাধিকার, এটা প্রায় কেউই স্বীকার করেনা। স্বাস্থ্য এবং জনস্বাস্থ্যব্যবস্থার অপ্রতুলতার যে দায় সরকারের নেবার কথা, লকডাউন করে দিয়ে সেই দায় বস্তুত মানুষের ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে। দিগ্বিদিকে কেবলই শোনা যাচ্ছে লকডাউনই করোনা মোকাবিলার একমাত্র রাস্তা। এবং লকডাউন ভেঙে মানুষ কী দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো কাজ করে ফেলেছে। কিন্তু সরকারের দায়ের আলোচনা কোথাও নেই। কেন হাসপাতালে রোগির ভিড় সামাল না দেবার অসুস্থতার চিকিৎসা স্রেফ লকডাউন দিয়ে করা হবে, কেন চিকিৎসাব্যবস্থা এমন হবে, যে, সতেরো কোটির দেশে সতেরো লাখ লোককে একদিনে জরুরি চিকিৎসা দেওয়া যাবেনা, কেন বাজেট বরাদ্দে স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা বহু বহু নিচে, সে আলোচনা উধাও। এখন সব দায়িত্বই মানুষের। এবং বাদবাকিটা ধীরে-চলো নীতি। এতদ্বারা কোনো অজানা উপায়ে মানুষ যদি প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন করেই ফেলে, তাহলে বলা যাবে, এই ব্যবস্থা দিব্যি কাজ করছে। না পারলে, সব দোষ দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষের। অনেকে একসঙ্গে অসুস্থ হয়ে পড়লে কীকরে সবাইকে চিকিৎসা দেওয়া যাবে? অতএব আপনারই দায়িত্ব অসুস্থ না হওয়া। রাষ্ট্র তাই আপনাকে বন্দী করে রাখবে। চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেনা। রাষ্ট্রের বিশেষ দায় নেই, আপনি অসুস্থ হয়ে যাতে না পড়েন, তার জন্য তো তারা কারফিউ জারি করে রেখেইছে। ব্যস দায়িত্ব খতম।
এবং এটা ভাবা হচ্ছে এমনভাবে, যেন এর কোনো বিকল্প নেই। বলা হচ্ছে এমনভাবে, যেন লকডাউনই এক ও একমাত্র অমোঘ ওষুধ, যা ভাইরাস ঠেকাবে। অথচ, তা আদৌ নয়। লকডাউন ভাইরাস মারেনা। এবং এর বিকল্প বিলক্ষণ আছে। খুব স্বল্পবুদ্ধিতেই, বিকল্প হিসেবে যেটা হতে পারত, বা পারে, সেটা হল স্পষ্ট করে বলা, যে, লকডাউন কোনো চিরস্থায়ী সমাধান দেবেনা। ভাইরাস আছে ও থাকবে। সরকার যেটা করতে পারে, তা হল আক্রান্তদের চিকিৎসার সুযোগ। সেইটুকু করার জন্য লকডাউন কেবল একটু নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ দেবে। এবং সেই সময়ে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোয় বিপুল বিনিয়োগ করে যুদ্ধকালীন প্রস্তুতিতে চিকিৎসার সুবন্দ্যোবস্তো করে ফেলা হবে। সরকার সেই দায়িত্ব নেবে। সমস্ত মানুষের জন্য নেবে। একটা ভাইরাসের জন্য না, আগামীর সমস্ত সমস্যার জন্য নেবে। বাজেট বরাদ্দ বহুগুণ বাড়বে। এবং স্বাস্থ্য যে মানবাধিকার, এটা স্বীকৃত হবে। কিন্তু সেই দাবীই কোথাও নেই, ঘোষণা তো পরের কথা।
এই দাবীগুলো আলোচনায় নেই কেন? তার কারণও পরিষ্কার। পৃথিবী জুড়েই এক যুদ্ধপরিস্থিতি তৈরি করে ফেলা হয়েছে। যুদ্ধের উন্মাদনা তৈরি করে ফেলা হয়েছে। কোনো যুদ্ধ ছাড়াই। রাষ্ট্র সমস্ত ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছে, কিন্তু প্রাথমিক বিষয়গুলো নিয়ে তার আর কোনো দায়িত্ব নেই। কারণ এখন যুদ্ধপরিস্থিতি। এখন শুধু জরুরি ভিত্তিতে শত্রু ঠেকানোর লড়াই। বাকি সবই গৌণ। এই লড়াইয়ে প্রতিটি মানুষই সৈন্য। তাদের শৃঙ্খলাপরায়ণ হতে হবে। শৃঙ্খলা ভাঙলে শাস্তি। কেউ কেউ আবার শৃঙ্খলা ভেঙে ভাইরাস পক্ষের গুপ্তচরও হতে পারেন, তাঁরা গণশত্রু। সেই কারণে প্রয়োজন তীব্র নজরদারি। কারণ এখন যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধের জয়-পরাজয় সবার আগে, সেনার কোর্ট মার্শাল হয়, তাদের জন্য অন্য নিয়ম। তাদের কোনো নাগরিক অধিকার নেই, থাকতে পারেনা। ব্যক্তির যে অধিকারগুলি গত একশ বছরে অর্জন করা গেছে, সেসবের আর কোনো মূল্য নেই। যে অধিকারগুলি, যেমন সবার জন্য স্বাস্থ্য, গণতান্ত্রিক পরিসরে রাষ্ট্রীয় নজরদারি বন্ধ করা, এসব এখন পিছনের আসনে। করোনা তো আগে তাড়াই দাদা।
গত একশ বছরে কোনো যুদ্ধ নিয়ে, পৃথিবী জুড়ে এমন ঐকমত্য দেখা যায়নি। গত পঞ্চাশ বছরে নাগরিক জীবনে রাষ্ট্রের অবাধ হস্তক্ষেপ নিয়ে ডান ও বাম উদারনৈতিক ও রক্ষণশীলদের মধ্যে এমন একমত হওয়া দেখা যায়নি। গোটা পৃথিবী এখন শৃঙ্খলার নিগড়ে বাঁধা। সেনাবাহিনীর মতই শৃঙ্খলিত। শুধু মজা এই, যে, এই যুদ্ধ শত্রুকে নির্মূল করার নয়। ভাইরাস এভাবে নির্মূল হবেনা। স্বাস্থ্যকে মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণার, স্বাস্থ্যের পরিঠামো বাড়ানোর, স্বাস্থ্যে রাষ্ট্রের দায়িত্ব সুনিশ্চিত করার একটা চেষ্টা করলে বরং একটা দীর্ঘমেয়াদি বদল আসতে পারত। কিন্তু সে চেষ্টাও কেউ করছেনা। এখনও যুদ্ধ চলছে।
শক্তির সংজ্ঞা ও পরিবর্তন
মুখস্থ বিদ্যাটা বরাবরের কম। তবুও ক্লাস সেভেনে হেগেমেতে কোনরকমে শক্তির
সংজ্ঞাটা মুখস্থ করেছিলাম -- শক্তি অবিনেশ্বর, ইহার সৃষ্টি বা বিনাশ নেই,
শক্তি এক শক্তি থেকে অন্য শক্তিতে রূপান্তরিত হয় মাত্র । সংজ্ঞাটিকে এবার
ফেসবুকে পোষ্ট করা কোনো আপাত "মৌলিক" লেখার ক্ষেত্রে খাপে খাপে বসিয়ে দেন ।
ফেসবুকের পোষ্ট করা লেখা অবিনেশ্বর, ইহার সৃষ্টি বা বিনাশ নেই , এক
টাইমলাইন থেকে অন্য টাইমলাইনে স্থানান্তরিত হয় মাত্র । ধরুন, আপনি অনেক
ভেবে ভেবে আপনার সৃষ্টিশীল স্বত্বা দিয়ে একটি চমৎকার মনোগ্রাহী কিছু লিখলেন
। পোষ্টালেন । সেটা এবার আপনার ফ্রেন্ডলিষ্টে থাকা পাঠকের মনে ধরার মতো
হলে শেয়ার ও কপিপেষ্ট হতে থাকল । সেই লেখা টাইমলাইন থেকে টাইমলাইন ঘুরতে
ঘুরতে সোশাল মিডিয়ার গন্ডী ছাড়িয়ে কোনো বন্ধু মারফত কুম্ভমেলায় হারিয়ে
যাওয়া মেজ ছেলের মতো হোয়াটসঅ্যাপ এর চ্যাট গ্রুপে খুঁজে পেলেন । লেখার শেষে
ততদিনে "সৌজন্য" ধর্ষিতা হয়ে আপনার নামটাই উবে গেছে, বা শেষ পোষ্টকারী
শেষে ছোট্ট একটা হ্যাজ সহযোগে "collected" লিখে রেখেছেন। এতেই আপনাকে
সন্তুষ্ট হতে হবে আপনাকে। 'collected' লিখে কিছুটা হলেও কৃপা তো করেছে,
সেটাই কম কি!
ফেসবুকে লিখে সমাজ বদলের ভাবনা অনেকাংশেই দূরারোপিত কষ্টকল্পিত কল্পনা । সেটা ফেবু লেখক বিলক্ষন জানেন। তবুও লেখেন। লেখার করুণ বেওয়ারিশ পরিনতির কথা জেনেও লেখেন। কেন ? ঐ যে, লেখার জন্য লেখা, শিল্পের জন্য শিল্প। জীবনমুখীনতায় শিল্পের একমাত্র উদ্দেশ্য হলে লেখক বা শিল্পীকে সমাজকর্মীই বলা হোক, লেখক বা শিল্পী নয়। লেখকের প্রাপ্তি শুধু লেখার আনন্দটুকু। সৃষ্টিসুখের উল্লাস । সৃষ্টির আনন্দের সঙ্গে অন্য কোনো জাগতিক আনন্দের তুলনা করা চলে না । রোঁলা বার্থ যতই লেখকের মৃত্যুর তত্ত্ব শোনান, নিজের সন্তানতূল্য লেখার প্রতি অধিকারবোধ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না কোনো লেখকই, বাৎসল্য রস বলে একটা জিনিস আছে তো নাকি ! ঠিক যেমন পিতা নিজ সন্তানের দন্ত বিগলিত হাসি আর অস্ফুট কথায় যারপরনাই পুলকিত ও আহ্লাদিত হন, তেমনি ফেবু লেখক নিজের পুরোনো লেখাও অবসর সময়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পড়েন , পুনঃপুনঃ সৃষ্টির আনন্দ তাঁকে তুষ্ট করে । সেই আনন্দ ও ভাবনা শেয়ার করতেই ফেসবুকে পোষ্টানোর বাসনা জাগে । কিন্তু, সন্তানতূল্য নান্দনিক সৃষ্টি যদি অন্য কেউ অপহরণ করে নিজের সন্তান বলে চালায়, তাহলে? বেদনাদায়ক তো বটেই।
কিন্তু, দুঃখ পাবেন না । ভার্চুয়াল দুনিয়ার হার্ডকোর বাস্তবতা, না মেনে উপায় নেই । ভারচুয়ালি চেঁচিয়েও কোনো লাভ নেই । তার থেকে বরং এক কাজ করুন, ক্লাস সেভেনে পড়া শক্তির সংজ্ঞাটা টাইমলাইনের পোষ্টে বসিয়ে সকাল দুপুর জপ করুন । সঙ্গে, একটা সান্ত্বনা বাক্য মনে গেঁথে নেবেন -- নিজের লেখা (ধরুন কবিতা) শেষ করে ফেসবুকে পোষ্ট করার সাথে সাথে সেটা আর আপনার সম্পত্তি থাকে না, ফেসবুকের পাঠক আর সমালোচকের জিম্মায় চলে যায় । লেখক যদি পোষ্টের কমেন্ট বক্সে তার উপস্থিতি ক্ষনে ক্ষনে জানান দিতে থাকেন এবং পাঠক বা সমালোচকদের সঙ্গে সমালোচনায় অংশগ্রহন করতে থাকেন তাহলে সেই কবিতার বচন বহুমাত্রিকতার বদলে একমাত্রিক হিসাবে চলতে শুরু করবে । অর্থ সংকুচিত হয়ে লেখকের ব্যক্তিজীবনের চারদিকে ঘুরঘুর করবে । আপনার কষ্ট লাঘব হবে যদি আপনি "খুব ভাল হয়েছে" বা "দারুন লিখেছেন" জাতীয় স্তুতি বাক্য সযত্নে এড়িয়ে যেতে পারেন। আপনার লেখা কবিতাটিকে খাঁচায় বন্দি না রেখে বরং ছেড়ে দেন মুক্ত বিহঙ্গের মতো। উড়তে দেন নিজের মতো করে । এরপরেও কেউ যদি সেটাকে নিজের সম্পত্তি বলে কেউ চালায় তবে সেটা তার নৈতিক দৈনতা, আপনার নয় । লেখাটিকে নিজের খাঁচাবন্দী সম্পত্তি ভাববেন না। ভাবলে কষ্ট পাবেন।
আর একটি কথা মনে রাখবেন, আপনার সৃজনাত্মক আপাত "মৌলিক" লেখাটা মৌলিক মনে হলেও সেটা মৌলিক নয়, মৌলিকের মতো । বস্তুতঃ বিশ্বের কোনো সৃজনশীল লেখাই আগমার্কা "মৌলিক" নয়, আপনি জানেন। সবটাই ভাষার মোচড় আর ব্যবহারের খেলা । ভাষাই মূখ্য প্রতিবাদক, লেখকের ভূমিকা গৌন । লেখক বা একজন টাইপিষ্ট, যে ভাবনা গুলো প্রাথমিক অনুকরণ করে টাইপ করে মাত্র । ভাষার বাইরে তাই লেখকের সেভাবে কোনো অস্তিত্ব নেই । কবি বা সাহিত্যিক কেবল জানেন ভাষা সাজিয়ে গুছিয়ে, দুমড়েমুচড়ে কিভাবে কথ্য ও সাধারণ কথোপকথনের ভাষা থেকে বিপরিচিতিকরন করা যায়। আমাদের বস্তুজগতকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিই পাল্টে দিতে পারে লেখকের লেখনি বা কবির কবিসত্ত্বা। সাহিত্যিক বা কবির এই লেখনি সত্তা বা লেখায় সাহিত্যিক বা কবির জন্ম দেয়, উল্টোটা নয় । কবি ও কবিমানসকে গুলিয়ে ফেলার বিদঘুটে প্রবনতা আমাদের মধ্যে আবহমান কাল ধরে বিদ্যমান । কিন্তু কবি বা লেখকের ব্যক্তিসত্তা থেকে দূরে কবি বা লেখক হল সামাজসাংস্কৃতিক আদল ও ঐতিহাসিক বচনে নির্মিত একটি সত্ত্বা। যার সঙ্গে লেপটে থাকে কবি বা লেখকের নান্দনিক বোধ ও প্রাক্ষোভিক বুদ্ধি । লেখকসত্ত্বা বা কবিসত্ত্বা কখনই সমাজ ও সাংস্কৃতিক কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।
লেখার আগে সব লেখক বা কবি গর্ভবতী মায়ের মতো প্রসববেদনা অনুভব করেন । মাথার মধ্যে থাকা একগুচ্ছ ভাবনা কেঁচোর মতো কিলবিল করে। ভাবনা গুলো বেরিয়ে আসতে চাই । লেখ্যরুপেই ভাবনার মুক্তি, ভাবনার মুক্তিতেই সৃষ্টির আনন্দ । লেখ্যরুপের মধ্য দিয়ে ভাবনার মুক্তির পরেও লেখক লেখার সঙ্গে নাড়ীর টান অনুভব করেন । সন্তানের প্রতি মায়ের যেমন তীব্র অধিকারবোধ থাকে তেমন লেখার প্রতি লেখকেরও । তাই সেই লেখার নেতিবাচক সমালোচনা বা আঁচড় লেখক বা কবির কাছে অসহিষ্ণু মনে হয় । নাড়ীর যোগ না কাটলে লেখার বহুত্ব , বহুবাচনিকতা বা বহুমাত্রিকতা রুদ্ধ হয়, সাহিত্য সমালোচনা ও চর্চার ক্ষেত্রেও সেটা বাধাস্বরুপ । এই প্রসংঙ্গে মনে পড়ছে কয়েক বছর আগে দেখা একটা ফরাসী সিনেমা - রুবি স্পার্কস । সেরকম গতেবাঁধা একরৈখিক গল্প এখানে না থাকলেও বিষয়বস্তু ভারী অদ্ভুত । কেন্দ্রীয় চরিত্র কেলভিন বছর কুড়ির ধারেপাশের একজন তরুন ঔপন্যাসিক । সে "রাইটার্স ব্লকে" আক্রান্ত (সৃষ্টিশীলতায় লেখকের কোষ্ঠকাঠিন্যের পর্যায় আর কি)। সাইকোলজিষ্ট দেখিয়েও সুরাহা হয় নি । পরে স্বপ্নে দেখা স্বপ্নপরী রুবিই তাঁর উপন্যাসের নায়িকা হয় । উপন্যাসে রুবির চরিত্র নির্মান করতে গিয়ে ঔপনাসিক নিজে তাঁরই তৈরি করা চরিত্র রুবির প্রেমে পড়ে যান । লেখাকে মুক্তি দেওয়া তো দূরের কথা, লেখক নিজেই গল্পের ফ্রেমে ঢুকে গল্পের নায়িকার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে গল্পের গতিপথকে প্রভাবিত করতে থাকেন ।
যাই হোক, এবার ফেসবুকের কথায় যদি ধরি, যারা ফেসবুকে লিখছে তারা ভিন্ন ভিন্ন সমাজ ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল থেকে উঠে এসেছে, এবং সেই বিশেষ সমাজ ও সংস্কৃতিভিত্তিক চিন্তাপ্রণালী বা ভাবাদর্শ আইডিওলজি) অবচেতনভাবেই মাথায় গেঁথে থাকে । প্রাক সোশালমিডিয়া বা তারও আগে বিশ্বায়নপূর্ব যুগে কবি বা লেখকের মগজে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ভাবনার মেলবন্ধন হত, কিন্তু তার গতি ছিল খুব মন্থর । সোশাল মিডিয়ার যুগে যেখানে বিভিন্ন রকম বচন ও প্রতিবচন, ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিগত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভাবনা একঘাটে সকাল বিকাল জল খায় সেরকম একটি পরিমন্ডলে লেখক বা কবির মগজে ভিন্ন ভিন্ন সামজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র থেকে আসা ভাবনাগুলো খুব দ্রুত মিথোস্ক্রীয়া ঘটায় । যাদের লেখা লেখক বা কবি পড়েন তাদের ভাষা ও ভাবনার সঙ্গে লেখকের ভাবনা ভাবাবেগ বিক্রিয়াসদৃশ জারিত হয়ে নতুন ভাবনার সংশ্লেষ হয়, ঠুনকো প্রেষনায় সেই ভাবনা গুলো ঠেলে বেরিয়ে আসে লেখার আদলে । তাই লেখক বা কবির লেখায় ঐ সবকিছুর অদৃশ্য ছায়া পড়তে বাধ্য । কাঠামো তাত্ত্বিকরা তাই বলেন যেকোনো পাঠই অসংখ্য সমাজ ও সংস্কৃতি থেকে আসা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বচনের সমাহার, তাই কোনো লেখাই আপাদমস্তক মৌলিকতা দাবি করতে পারে না । আবার ঐ পাঠ যখন আইডিওলজির ও প্রজন্ম ভেদে পাঠকের কাছে পৌঁছায় তখন লেখায় ভাসমান বচন গুলোর রং রুপ বদলে নতুন রুপে আত্মপ্রকাশ করে, পাঠকের মগজ ও হৃদয়ে নতুন করে রচিত হয় হাজার হাজার সংস্করণ । বিকল্প পঠন আর পঠনের বহুত্ব বদলে দেয় উপন্যাস বা কবিতার বহুবিধ বচনের চরিত্র। যে বচন গুলো নিয়ে লেখক তার লেখায় নিজেও ওয়াকিবহাল থাকে না সেই অবদমিত বচনগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে, ভাষার কংক্রিট রুপটা অক্ষুন্ন রয়ে গিয়ে খুলে যায় নতুন নতুন ভাবনার দ্বার, রচিত হয় সমান্তরাল আখ্যান।
ফেসবুকে লিখে সমাজ বদলের ভাবনা অনেকাংশেই দূরারোপিত কষ্টকল্পিত কল্পনা । সেটা ফেবু লেখক বিলক্ষন জানেন। তবুও লেখেন। লেখার করুণ বেওয়ারিশ পরিনতির কথা জেনেও লেখেন। কেন ? ঐ যে, লেখার জন্য লেখা, শিল্পের জন্য শিল্প। জীবনমুখীনতায় শিল্পের একমাত্র উদ্দেশ্য হলে লেখক বা শিল্পীকে সমাজকর্মীই বলা হোক, লেখক বা শিল্পী নয়। লেখকের প্রাপ্তি শুধু লেখার আনন্দটুকু। সৃষ্টিসুখের উল্লাস । সৃষ্টির আনন্দের সঙ্গে অন্য কোনো জাগতিক আনন্দের তুলনা করা চলে না । রোঁলা বার্থ যতই লেখকের মৃত্যুর তত্ত্ব শোনান, নিজের সন্তানতূল্য লেখার প্রতি অধিকারবোধ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না কোনো লেখকই, বাৎসল্য রস বলে একটা জিনিস আছে তো নাকি ! ঠিক যেমন পিতা নিজ সন্তানের দন্ত বিগলিত হাসি আর অস্ফুট কথায় যারপরনাই পুলকিত ও আহ্লাদিত হন, তেমনি ফেবু লেখক নিজের পুরোনো লেখাও অবসর সময়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পড়েন , পুনঃপুনঃ সৃষ্টির আনন্দ তাঁকে তুষ্ট করে । সেই আনন্দ ও ভাবনা শেয়ার করতেই ফেসবুকে পোষ্টানোর বাসনা জাগে । কিন্তু, সন্তানতূল্য নান্দনিক সৃষ্টি যদি অন্য কেউ অপহরণ করে নিজের সন্তান বলে চালায়, তাহলে? বেদনাদায়ক তো বটেই।
কিন্তু, দুঃখ পাবেন না । ভার্চুয়াল দুনিয়ার হার্ডকোর বাস্তবতা, না মেনে উপায় নেই । ভারচুয়ালি চেঁচিয়েও কোনো লাভ নেই । তার থেকে বরং এক কাজ করুন, ক্লাস সেভেনে পড়া শক্তির সংজ্ঞাটা টাইমলাইনের পোষ্টে বসিয়ে সকাল দুপুর জপ করুন । সঙ্গে, একটা সান্ত্বনা বাক্য মনে গেঁথে নেবেন -- নিজের লেখা (ধরুন কবিতা) শেষ করে ফেসবুকে পোষ্ট করার সাথে সাথে সেটা আর আপনার সম্পত্তি থাকে না, ফেসবুকের পাঠক আর সমালোচকের জিম্মায় চলে যায় । লেখক যদি পোষ্টের কমেন্ট বক্সে তার উপস্থিতি ক্ষনে ক্ষনে জানান দিতে থাকেন এবং পাঠক বা সমালোচকদের সঙ্গে সমালোচনায় অংশগ্রহন করতে থাকেন তাহলে সেই কবিতার বচন বহুমাত্রিকতার বদলে একমাত্রিক হিসাবে চলতে শুরু করবে । অর্থ সংকুচিত হয়ে লেখকের ব্যক্তিজীবনের চারদিকে ঘুরঘুর করবে । আপনার কষ্ট লাঘব হবে যদি আপনি "খুব ভাল হয়েছে" বা "দারুন লিখেছেন" জাতীয় স্তুতি বাক্য সযত্নে এড়িয়ে যেতে পারেন। আপনার লেখা কবিতাটিকে খাঁচায় বন্দি না রেখে বরং ছেড়ে দেন মুক্ত বিহঙ্গের মতো। উড়তে দেন নিজের মতো করে । এরপরেও কেউ যদি সেটাকে নিজের সম্পত্তি বলে কেউ চালায় তবে সেটা তার নৈতিক দৈনতা, আপনার নয় । লেখাটিকে নিজের খাঁচাবন্দী সম্পত্তি ভাববেন না। ভাবলে কষ্ট পাবেন।
আর একটি কথা মনে রাখবেন, আপনার সৃজনাত্মক আপাত "মৌলিক" লেখাটা মৌলিক মনে হলেও সেটা মৌলিক নয়, মৌলিকের মতো । বস্তুতঃ বিশ্বের কোনো সৃজনশীল লেখাই আগমার্কা "মৌলিক" নয়, আপনি জানেন। সবটাই ভাষার মোচড় আর ব্যবহারের খেলা । ভাষাই মূখ্য প্রতিবাদক, লেখকের ভূমিকা গৌন । লেখক বা একজন টাইপিষ্ট, যে ভাবনা গুলো প্রাথমিক অনুকরণ করে টাইপ করে মাত্র । ভাষার বাইরে তাই লেখকের সেভাবে কোনো অস্তিত্ব নেই । কবি বা সাহিত্যিক কেবল জানেন ভাষা সাজিয়ে গুছিয়ে, দুমড়েমুচড়ে কিভাবে কথ্য ও সাধারণ কথোপকথনের ভাষা থেকে বিপরিচিতিকরন করা যায়। আমাদের বস্তুজগতকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিই পাল্টে দিতে পারে লেখকের লেখনি বা কবির কবিসত্ত্বা। সাহিত্যিক বা কবির এই লেখনি সত্তা বা লেখায় সাহিত্যিক বা কবির জন্ম দেয়, উল্টোটা নয় । কবি ও কবিমানসকে গুলিয়ে ফেলার বিদঘুটে প্রবনতা আমাদের মধ্যে আবহমান কাল ধরে বিদ্যমান । কিন্তু কবি বা লেখকের ব্যক্তিসত্তা থেকে দূরে কবি বা লেখক হল সামাজসাংস্কৃতিক আদল ও ঐতিহাসিক বচনে নির্মিত একটি সত্ত্বা। যার সঙ্গে লেপটে থাকে কবি বা লেখকের নান্দনিক বোধ ও প্রাক্ষোভিক বুদ্ধি । লেখকসত্ত্বা বা কবিসত্ত্বা কখনই সমাজ ও সাংস্কৃতিক কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।
লেখার আগে সব লেখক বা কবি গর্ভবতী মায়ের মতো প্রসববেদনা অনুভব করেন । মাথার মধ্যে থাকা একগুচ্ছ ভাবনা কেঁচোর মতো কিলবিল করে। ভাবনা গুলো বেরিয়ে আসতে চাই । লেখ্যরুপেই ভাবনার মুক্তি, ভাবনার মুক্তিতেই সৃষ্টির আনন্দ । লেখ্যরুপের মধ্য দিয়ে ভাবনার মুক্তির পরেও লেখক লেখার সঙ্গে নাড়ীর টান অনুভব করেন । সন্তানের প্রতি মায়ের যেমন তীব্র অধিকারবোধ থাকে তেমন লেখার প্রতি লেখকেরও । তাই সেই লেখার নেতিবাচক সমালোচনা বা আঁচড় লেখক বা কবির কাছে অসহিষ্ণু মনে হয় । নাড়ীর যোগ না কাটলে লেখার বহুত্ব , বহুবাচনিকতা বা বহুমাত্রিকতা রুদ্ধ হয়, সাহিত্য সমালোচনা ও চর্চার ক্ষেত্রেও সেটা বাধাস্বরুপ । এই প্রসংঙ্গে মনে পড়ছে কয়েক বছর আগে দেখা একটা ফরাসী সিনেমা - রুবি স্পার্কস । সেরকম গতেবাঁধা একরৈখিক গল্প এখানে না থাকলেও বিষয়বস্তু ভারী অদ্ভুত । কেন্দ্রীয় চরিত্র কেলভিন বছর কুড়ির ধারেপাশের একজন তরুন ঔপন্যাসিক । সে "রাইটার্স ব্লকে" আক্রান্ত (সৃষ্টিশীলতায় লেখকের কোষ্ঠকাঠিন্যের পর্যায় আর কি)। সাইকোলজিষ্ট দেখিয়েও সুরাহা হয় নি । পরে স্বপ্নে দেখা স্বপ্নপরী রুবিই তাঁর উপন্যাসের নায়িকা হয় । উপন্যাসে রুবির চরিত্র নির্মান করতে গিয়ে ঔপনাসিক নিজে তাঁরই তৈরি করা চরিত্র রুবির প্রেমে পড়ে যান । লেখাকে মুক্তি দেওয়া তো দূরের কথা, লেখক নিজেই গল্পের ফ্রেমে ঢুকে গল্পের নায়িকার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে গল্পের গতিপথকে প্রভাবিত করতে থাকেন ।
যাই হোক, এবার ফেসবুকের কথায় যদি ধরি, যারা ফেসবুকে লিখছে তারা ভিন্ন ভিন্ন সমাজ ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল থেকে উঠে এসেছে, এবং সেই বিশেষ সমাজ ও সংস্কৃতিভিত্তিক চিন্তাপ্রণালী বা ভাবাদর্শ আইডিওলজি) অবচেতনভাবেই মাথায় গেঁথে থাকে । প্রাক সোশালমিডিয়া বা তারও আগে বিশ্বায়নপূর্ব যুগে কবি বা লেখকের মগজে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ভাবনার মেলবন্ধন হত, কিন্তু তার গতি ছিল খুব মন্থর । সোশাল মিডিয়ার যুগে যেখানে বিভিন্ন রকম বচন ও প্রতিবচন, ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিগত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভাবনা একঘাটে সকাল বিকাল জল খায় সেরকম একটি পরিমন্ডলে লেখক বা কবির মগজে ভিন্ন ভিন্ন সামজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র থেকে আসা ভাবনাগুলো খুব দ্রুত মিথোস্ক্রীয়া ঘটায় । যাদের লেখা লেখক বা কবি পড়েন তাদের ভাষা ও ভাবনার সঙ্গে লেখকের ভাবনা ভাবাবেগ বিক্রিয়াসদৃশ জারিত হয়ে নতুন ভাবনার সংশ্লেষ হয়, ঠুনকো প্রেষনায় সেই ভাবনা গুলো ঠেলে বেরিয়ে আসে লেখার আদলে । তাই লেখক বা কবির লেখায় ঐ সবকিছুর অদৃশ্য ছায়া পড়তে বাধ্য । কাঠামো তাত্ত্বিকরা তাই বলেন যেকোনো পাঠই অসংখ্য সমাজ ও সংস্কৃতি থেকে আসা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বচনের সমাহার, তাই কোনো লেখাই আপাদমস্তক মৌলিকতা দাবি করতে পারে না । আবার ঐ পাঠ যখন আইডিওলজির ও প্রজন্ম ভেদে পাঠকের কাছে পৌঁছায় তখন লেখায় ভাসমান বচন গুলোর রং রুপ বদলে নতুন রুপে আত্মপ্রকাশ করে, পাঠকের মগজ ও হৃদয়ে নতুন করে রচিত হয় হাজার হাজার সংস্করণ । বিকল্প পঠন আর পঠনের বহুত্ব বদলে দেয় উপন্যাস বা কবিতার বহুবিধ বচনের চরিত্র। যে বচন গুলো নিয়ে লেখক তার লেখায় নিজেও ওয়াকিবহাল থাকে না সেই অবদমিত বচনগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে, ভাষার কংক্রিট রুপটা অক্ষুন্ন রয়ে গিয়ে খুলে যায় নতুন নতুন ভাবনার দ্বার, রচিত হয় সমান্তরাল আখ্যান।
Subscribe to:
Posts (Atom)