Monday, March 30, 2020

পৃথিবীও পুষিয়ে নিতে জানে !!!

এক অভূতপূর্ব সময়ে এসে দাঁড়িয়েছে পৃথিবী। লাখ লাখ মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত, প্রাণ যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষের। শুধু মহামারী আর মৃত্যুই নয়, প্রকৃতির কাছে এমন সর্বব্যাপী চপেটাঘাতের ঘটনাও মানুষের ইতিহাসে বিরল। অর্থনীতির ইতিহাসেও সবচেয়ে বড় মন্দার মুখে পড়েছে মানুষ। সেই মন্দায় কত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা কল্পনা করা কঠিন, তবে সেটা যে পৃথিবীর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মৌলিক ভিত্তিকে নড়বড়ে করে দেবে সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
মানুষের এই পরিণতি কি অবধারিত ছিল? গত কয়েক শতকে মানুষ পৃথিবীর উপর কতৃত্ব ফলাতে গিয়ে মাটি-পানি-বাতাসকে বিপন্ন করেছে। পরিবেশের কথা না ভেবে উন্মাদের মত অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে, জিডিপির দিকে ছুটেছে। একটা গবেষণা বলছে, প্রতি ১০ লাখ ডলারের জিডিপির জন্য মানুষ বাতাসে ছাড়ে ৫০০ টন সিএফসি (ক্লোরোফ্লোরোকার্বন) গ্যাস। শুধুমাত্র ২০১৯ সালেই ৮ ট্রিলিয়ন ডলারের জিডিপির জন্য মানুষ পৃথিবীর বাতাসে ছেড়েছে প্রায় ৪০ বিলিয়ন টন সিএফসি গ্যাস। কোটি কোটি বছর ধরে গড়ে উঠা ওজোন স্তর ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়েছে মাত্র কয়েক শতকে। মানুষের বিলাসী খাবার, চিকিৎসা আর বিনোদনের লালসার বলি হয়েছে লাখ লাখ পাখি আর বন্যপ্রাণী। বহু বন্যপ্রাণী চিরতরে বিলুপ্ত হয়েছে। বিপন্ন হয়েছে খাদ্যশৃঙ্খল, নষ্ট হয়েছে বাস্তুসংস্থান।
কিন্তু করোনা নামে এক ভাইরাসের টিকে থাকার লড়াইয়ের রেশ ধরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে পৃথিবী। পৃথিবীর উপর, প্রকৃতির উপর মানুষের দখল তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ছে। তথাকথিত ‘উন্নত’ প্রযুক্তি এবং ‘উন্নত’ সভ্যতার মেকি ক্ষমতার মুখোশ খুলে পড়ছে। করোনা কান ধরে বন্ধ করিয়েছে কলকারখানা, গাড়ির চাকা, জাহাজের ইঞ্জিন, থমকে দিয়েছে পার ক্যাপিটা-জিডিপি আর সর্বস্ব দখলের অর্থনীতি। জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানো কমিয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে দলে দলে ‘গর্তে’ ঢুকছে পৃথিবীর ‘শ্রেষ্ঠ’ জীব।
নাসার সম্প্রতি বেশ কিছু স্যাটেলাইট চিত্র প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে কীভাবে সারা বিশ্বের শহরগুলিতে দ্রুত দূষণের পরিমাণ কমছে। সবচেয়ে বেশি কার্বন উৎপাদনকারী ও করোনার উৎপত্তিস্থল চীনের শহরগুলোতে ব্যাপকভাবে বায়ু দূষণ হ্রাস পেয়েছে। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি কোপার্নিকাস সেন্টিনেল স্যাটেলাইটের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানাচ্ছে করোনার প্রভাবে ইতালি ও চীনের আকাশে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কমেছে ৪০-৬০
শতাংশ।
ফিনল্যান্ডের সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি এন্ড ক্লিন এয়ার (CREA) বলছে, ১ মার্চ পর্যন্ত চীনে কার্বন ডাইঅক্সাইডের নির্গমন এক চতুর্থাংশ বা ২০ কোটি টন কমে গেছে, যা ব্রিটেনে এক বছরে নির্গমন হওয়া কার্বন ডাইঅক্সাইডের অর্ধেক। তারা আরও জানিয়েছে, ২২ মার্চ টানা ১৪ ঘণ্টার কারফিউর ফলে ভারতের বাতাসে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের পরিমাণ বসন্তকালে ইতিহাসের সর্বনিম্ম পর্যায়ে নেমে গেছে। রেকর্ড না ভাঙলেও অন্যান্য বিষাক্ত কণার পরিমাণও কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে।
কার্বন-সালফার মুক্ত পৃথিবী যেন বহু শতাব্দী পর একটু নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পেয়েছে। কমছে পানি-মাটি-বায়ু-শব্দ দূষণ। ‘সভ্য’ মানুষের কাছ থেকে পৃথিবীর দখল কেড়ে নিয়ে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে পাখি, সমুদ্রের প্রাণী, বনের প্রাণী ও গাছেদের দখল। অতিষ্ঠ খাল-নদী, বনানী, আকাশ কিছুটা হলেও মুক্তি পেয়েছে। একটু একটু করে ধরণী তার অপূরণীয় ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে।
বহুদিন পরে মানুষশূন্য কক্সবাজার সৈকতে ফিরেছে ডলফিনরা। ব্যস্ত মুম্বইয়ের মেরিন ড্রাইভের দখল নিয়েছে পায়রারা। ইতালির ভেনিসের বিখ্যাত খালগুলিতে স্বচ্ছ জলের দেখা মিলেছে। সেখানে ফিরে এসেছে ডলফিন ও নানা প্রজাতির মাছেরা। ইউরোপজুড়ে ফিরে আসছে হাজার হাজার পাখি। পরিবেশবিদরা বলছেন মানুষের এই অভূতপূর্ব ‘বন্দিদশায়’ পৃথিবীর উষ্ণায়নে কিছুটা হলেও বাধা পড়বে। অন্তত ছয় মাস এভাবে চলতে থাকলে উত্তর-দক্ষিণ মেরুর গলে যাওয়া বরফ আবার জমতে শুরু করবে। পৃথিবী আবার শান্ত হয়ে আসবে। আপাতঃস্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে স্থলচর-জলচর প্রাণীরা। হ্যাঁ, এটা অসম লড়াই নিশ্চয়ই। শীঘ্রই টিকা বা রোগ প্রতিরোধ শক্তিতে করোনাকে ‘জয়’ করবে মানুষ। এই লড়াইয়েরও শেষ হবে। মানুষের জীবন ‘স্বাভাবিক’ হবে। আবার জীবাশ্ম জ্বালানী পুড়বে, কল-কারখানার বর্জ্য-ধোঁয়ায় পানি-বাতাস বিষাক্ত হবে, কার্বনে ছেয়ে যাবে আকাশ। তবে
মানুষ কি এই ধাক্কা থেকে শিক্ষা নিয়ে পৃথিবীর প্রতি কিছুটা হলেও সংযমী হবে? নাকি ‘ক্ষতি’ পুষিয়ে নিতে দ্বিগুণ উদ্যমে নতুন ধংসে মাতবে?

Saturday, March 28, 2020

মুখোশ

ঘুম ভাঙলে প্রথম কোন জিনিসটা টের পায় মানুষ ?
শব্দ পায় মনে হয়। কিছু দেখার আগে কিছু শুনে ঘুমটা ভাঙ্গে। দেখার চেয়ে শোনার সুবিধা বেশি। কারণ চোখের মত, কানের পর্দা খোলার ব্যাপার নাই। কান সদা খোলা। চোখ খোলার পর চোখে কি পড়বে তা নির্ধারিত হয় শোবার ভঙ্গীর উপরে। চিত শুয়ে যার অভ্যাস, সে চোখ খুলে দেখবে ছাদ আর ফ্যান, পাশ ফিরে যার ঘুম ভাঙবে সে দেখবে দেয়াল বা পর্দা আর কিছু ফার্নিচারের কোনাকানা। কিছু মানুষ চোখ খুলেই দেখে বালিশ, চাদর আর নিজের লোলে ভেজা দাগ। তারা জাগে উপ্তা হয়ে ঘুমন্ত অবস্থা থেকে।
         
আমানত উল্লা মিন্টু ঘুম ভাঙলে দেখে মায়াজাল। পাতলা কাঁথার উপর জানালা দিয়ে আসা আলোয়, খুব সুন্দর একটা আলোছায়ার ছবি হয়। আম্মার পুরানা শাড়ি দিয়ে বানানো পাতলা কাঁথা ৭ বছর ব্যাবহারে আরও পাতলা ন্যাতা ন্যাতা হয়ে গেছে। মাথা সহ কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর অভ্যাসের কারণে মিন্টু সকালে সেই কাঁথার ওপর আলো পড়া একটা এক্সরে ছবি দেখে। কাঁথার ভেতর জায়গায় জায়গায় কাপড় ফেঁসে দলা দলা হয়ে যাওয়া, কোথাও পাতলা কাপড়, কোথাও ভারী। প্রতিদিন সকালে এমন আলাদা আলাদা প্যাটার্ন দেখে ঘুম ভাঙ্গে তার।

প্রাকৃতিক নিয়মে সব মানুষ ঘুমায়, সবাই জেগে উঠে। কিন্তু তারতম্য হয় জীবনযাত্রায়। গ্রামের আর শহরের মানুষের ঘুম ভাঙ্গার তত-তরিকা আলাদা। গ্রামের মানুষের ঘুম ভাঙ্গার সঙ্গে সঙ্গেই চাঞ্চল্য শুরু হয় না। কিন্তু শহরের মানুষের হয়। নগরের অর্ধেকের বেশি মানুষের ঘুম ভাঙ্গে, হয় এলার্মে আর না হয় কারো ডাকে। নিজে থেকে জেগে ওঠার ক্ষমতা নগরের ঘুমন্ত মানুষের কমে যায়। নগরকে জাগাতে হয়। গ্রাম নিজেই জেগে উঠে। ভোরের বাতাস, মোরগের ডাক, খুদার্ত অস্থির বাছুরের ঘোতঘোতানি। ঘরের পাশে সংসার শুরু করা ছোট পাখির কিচমিচ এই সব আয়োজনে ঘুম ভাঙ্গে নগরের বাইরের মানুষের। আমানত উল্লা মিন্টু চোখ খুলে কিছুক্ষণ এই সব খোঁজে। লাভ নাই, তার ঘুমানোর জায়গায় এই সব কানে আসে না। বরং তার কানে দলা পাকায়ে ঢুকে পড়ে, পাড়ার ছোট গলিতে মোড় ঘুরানো প্রাইভেট কারের কর্কশ হর্ন বা রিকশার বেল, মুরগী বা সবজী ওয়ালার চিৎকার, কোন দুই মুখ খারাপ ব্যাক্তির ঝগড়া, কখনো বা ছাদের ট্যাংকি উপচে পড়া পানির শব্দ। মুখ থেকে কাঁথা সরায়ে মিন্টু হাত ঘড়ি দেখে। পৌনে আটটা বাজে। মোবাইলে এলার্ম দেয়া থাকে আটটায়। তবে নিয়ম করে মিন্টুর ঘুম কিছুটা আগেই ভাঙ্গে।

নগরে মানুষ বেশি।
যত বেশি মানুষ, তত বেশি স্বকীয়তা খোঁজার চেষ্টা। সবাই যার যার মত স্বকীয়তা পেতে চায়। কোটি মানুষের ভীড়ে নিজেকে আলাদা করার এই রেসের বাইরে কেউ নাই। সকাল হলেই জেগে উঠে নগরীর মুখগুলা। তারপর আবার ঘুমায়ে পড়ার আগ পর্যন্ত তাদের মুখ আড়াল করে ঝুলতে থাকে মুখোশ। মুখ আর মুখোশের মজার একটা আত্মীয়তা আছে। মুখ মানুষটার আয়না। তার ভেতরের সব কিছুকে সামনে এনে দেয়। আর মুখোশ, মুখের ফ্রেম টা ধার করে ভেতরের সব চাপা দিয়ে ফেলে তাতে চাপায় নতুন ছবি। ভেতরের আনন্দ ঢাকা পড়ে যায় ভার চেহারার মুখোশে, কষ্ট লুকিয়ে যায় হাসি মুখোশে।

আমানত উল্লা মিন্টুর মত মানুষের দিন কাটে মুখোশের পর মুখোশ পালটে। সকালে বাথরুমে দরজার সামনে মেসের অন্য রুমমেটদের দাঁড়ানো দেখে মিন্টু মুখে একটা হাসি মুখোশ টাঙ্গিয়ে হালকা রসিকতা করার চেষ্টা করে। যদিও তার মনে তখন খচ খচ করছে গতরাতে দেখা মানিব্যাগে শেষ তিনশ তেপ্পান্ন টাকা। বেতন পেতে এখনো আরও ১১ দিন বাকী।
বাথরুমের দেয়ালে ফ্যাকাসে ছোপ ছোপ ছাতা পড়া আয়নায় তাকায়ে মিন্টু নিজেকে যখন দেখে, তখন সে নিজে বুঝে না, এটা তার মুখ, নাকি মুখোশ। খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে তার চেহারা দেখতে অনেকটা তার বাবার কমবয়সের ছবির মত লাগে। তখন সেটা মুখ মনে হয়। শেভ করার পর সেটা হয়ে যায় "সুইট টপিং" রেস্টুরেন্ট এর সকাল ১১ টা থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত হাসিমুখে ফরমায়েশ নেয়া ওয়েটার এর মুখোশ।
            চাকরী চলে যাওয়া প্রাক্তন বিডিআর সৈনিক বাবার সঙ্গে আমানত উল্লা মিন্টুর স্মৃতি খুব বেশি না। বাবা বছরের ১১ মাসই সীমান্তে পাহারা দিয়েছে সৈনিকের মুখোশ পরে। যদিও মিন্টু জানে, তার বাবার ভেতরে লুকায়ে থাকে একটা রাখাল কিশোর। ছুটিতে একমাস বাড়ি আসলে, বাবা মাঝে মাঝে লাজুক মুখে দুপুর বেলায় পুকুর ঘাটলায় বসে বাঁশী বাজাতো। তখন বাবার মুখ থেকে মুখোশ খুলে পড়তো। ক্লাস টু বা থ্রিতে পড়া মিন্টু তখন বাবার কোলের কাছে, বাবার হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে অসীম মুগ্ধতায় বাবার আদর নিত। সেই আদরের ভাষা নাই। মুখোশের আড়াল নাই। বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে বাবার হাঁটুতে মুখ ঠেকিয়ে বসে আদর নেয়াটা হয় না। অনেক কিছু দিতে না পারার অভিযোগ জমে, অনুযোগ বের হয়ে আসে। দিনে দিনে বাবার মুখে, সৈনিকের মুখোশের মতন আরও অনেক বেমানান মুখোশ চড়ে। সেই ছোটবেলায় মাঝ রাতের ট্রেনে বাড়ি ফেরা বাবা তাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে নিজের বেরেট ক্যাপটা মিন্টুকে পরিয়ে দিয়ে স্যালুট দিত। সেই ক্যাপ পরে মিন্টু মনে মনে নিজেকে বন্দুক চালানো সৈনিক ভাবতো। বলতো "আমি বড় হইলে গুল্লি করুম"। তার বাবা এক গাল হেসে বলতো
" না রে বাবা, তুমি কুট টাই পিন্দা ডিউটিত যাইবা"।
   
           টাই মিন্টু পরে, সাদা হাফ শার্টের সাথে লাল টাই। সাদা শার্টের বুক পকেটের উপর সোনালী প্লেটে কালো হরফে ইংরেজিতে তার নাম লেখা "মিন্টু"। এই পোশাকের উপরে তার ওয়েটারের মুখোশ চেপে বসে। ১২ ঘণ্টা এসি চলা রেস্টুরেন্টে সেই মুখোশে ঘাম হয় না। মুখোশের পেছনে মিন্টু ছোটবেলার দুরন্ত দুপুরে কাটা ঘুড্ডির পিছনে ছুটে ঘেমে নেয়ে উঠে, কানের পাশ দিয়ে ঘামের গড়ায়ে পড়া মিস করে।
সকালের রোদেই ভাপিয়ে ওঠা সিটি বাসে দাঁড়িয়ে, বা কোনো দিন কপাল ভালো থাকলে পাছা ঠেকানোর মত বসার একটু যায়গা পেলে মিন্টু মুখে রাগী-গম্ভীর মুখোশ চাপিয়ে বসে। এই শহরে যেসব জিনিস বাকী নাগরিকদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে হয়, সেসব জিনিসের সামনে সবাই রাগী মুখোশেই থাকে। সেই মুখোশে হঠাত চোখে পড়া ছোট্ট বাচ্চার হাসি দেখে মায়া ঝরে না। হাঁটুর ব্যাথায় কষ্ট পাওয়া ৬৩ বছরের মহিলার জন্য সহমর্মিতা জাগে না। ভীড় বাসে, ঘেমে উঠে মানুষের আলাদা আলাদা গন্ধ গুলা মিলেমিশে গুমোট হয়ে সেই মুখোশে রং দেয়। আরও রাগী আরও গম্ভীর করে তুলে। মুখোশের সঙ্গে মানানসই গলার আওয়াজে কেউ কেউ বাসের কন্ডাক্টারকে ধমক মারে
"ঐ হালারপুত গুতাস ক্যান ? ভাড়া না একবার দিলাম?"

রেস্টুরেন্টে ভরা নগরীর কোনো এক অংশে, অখ্যাত এক রেস্টুরেন্টের ৩ টা টেবিলের দেখভাল করার দায় কাঁধে মাঝারী শ্যামলা, পাঁচ ফুট সাড়ে আট ইঞ্চির ২৭ বছরের যুবক আমানত উল্লা মিন্টু কাজ শুরু করে সকাল সাড়ে দশটায়। বাসের ভেতরের রাগী মুখোশ খুলে, রেস্টুরেন্টের ফ্লোরে ঢুকার সময় মিন্টু মুখে চড়ায় একটা বেচারা মুখোশ। তাতে আত্মবিশ্বাস থাকে না। কোনো অভিব্যাক্তি থাকে না। সেই মুখোশ শুধু পারে, সামনের মানুষের মুখোশের অভিব্যাক্তির বিপরীতে একটা মাপা মেকী হাসি দিতে। সেই হাসি মিন্টুর ঠোটের পেশীতে জন্ম নেয়। সেই হাসিতে তার চোখ অংশ নেয় না, মন অংশ নেয় না। মাপা সেই হাসি ঝুলানো মুখোশের পেছনে কখনো মিন্টু খেপে থাকে, কখনো অপমানিত হয়, কখনো বিরক্ত, হতাশ, কখনো বা খুব অভিমান।

৮ হাজার টাকা বেতন আর অনির্ধারিত অংকের টিপসের এই চাকরী করতে এসে, এই নগরে পা রাখার পর থেকে, নরোত্তমপুরের গনী হাজির বাড়ির মেঝ ছেলে নেয়ামত উল্লার বড় ছেলে আমানত উল্লা মুখোশ জমিয়ে চলেছে। কত কত মুখোশ তার জমছে দিন দিন। মাঝ রাতে মেসে ফেরার পথে গলিতে হেঁটে যাবার সময় টহল পুলিশের সামনে এক মুখোশ, আবার একি জায়গায় সস্তা চাকু হাতে নব্য ইয়াবাখোর ঠেকবাজ তরুণের সামনে অন্য মুখোশ। যদিও দুইবেলাতেই ফলাফল সমান। পকেটে যে কটা টাকা থাকে তা চলে যায়। ২০ টাকা টিপস পাবার হাসি মুখের মুখোশ। তার চেয়ে আলাদা হাসি মুখোশ ১০০ টাকা টিপসে। মাঝে মাঝে কিছু রেগুলার কাস্টমার, রেগুলার নির্দিষ্ট টেবিলে বসে, রেগুলার একই মেনু অর্ডার করার আগে পরিচিত হাসি দিয়ে বলে "ভালো আছেন ?" তখন একটা মুখোশ, যেটা অনেকটাই মিন্টুর মুখের হাসির কাছাকাছি। রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার বাদল ভাই যখন গালাগালি করে, তখন এক ধরনের অপরাধী মুখোশ। আবার টেবিল থেকে এঁটো প্লেট তুলে নেবার সময়, প্লেটে জমানো মুরগীর হাড্ডি যখন হাত কেঁপে টুক করে পড়ে যায় তরুণী কাস্টোমারের কোলে বিছানো জামার উপরে, তখন সঙ্গে থাকা বীর প্রেমিকের হিংস্র বিরক্ত চেহারায় বলা " আরে স্টুপিড নাকি, দেখে কাজ করেন না কেন ?" এর উত্তরে ভিন্ন ধরনের অনুশোচনার মুখোশ। কোনার দিকের টেবিলটায় বিশেষ কিছু কাস্টোমার আসে, তারা অন্তরঙ্গ হয়। তাদের কাছে যাবার সময় এক ধরনের অভিব্যাক্তিহীন মুখোশ, সেই মুখোশে চোখ থাকলেও যেন অন্ধ। সেই মুখোশ যেন দেখেও দেখেনা ছেলেটার একটা হাত লুকিয়ে ব্যাস্ত লিনেনের নীচে, অজ্ঞাতে। সেই মুখোশ দেখেনা তরুণীর ঠোঁটে ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া লিপস্টিকের রং বা তরুণের গালের কাছে সেই রং এর ছোপ। রাতে মেসে খাবার খাবার সময় সবাই মিলে নোংরা রসিকতা হয়। তখন মিন্টুও তাতে যোগ দেয় মুখোশ এঁটে। সেই মুখোশ এক অতৃপ্ত কামুকের। তাতে কথায় গোপনে লালা ঝরে। ৬ তরুণের ঘরে যৌনতার অদৃশ্য কুয়াশা ভাসে। তারা তাদের কথায় ছিঁড়ে খুড়ে ব্যাবচ্ছেদ করে অস্পৃষ্য কোনো যুবতীর। টিউব লাইটের ঘোলা সাদা আলোয় মিন্টুর বিছানায় বা বায়িং হাউসে চাকরি করা ভোলার সুজনের বিছানায় বসে 2 টাকা বোর্ড নাইন কার্ড খেলার আসর। চারজন খেলোয়াড় যার যার মুখে চতুরতার মুখোশ আঁটে। কেউ কাউকে জিততে দিবে না।

        আমানত উল্লা মিন্টু গভীর ঘুমে স্বপ্নে মাঝে মাঝে দেখে,  জুলাই মাসের এক বিকালে অরেঞ্জ জুস আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেতে খেতে বই পড়তে থাকা ছিপছিপে চশমা পরা সেই তরুণীকে। যে তার দিকে তাকিয়ে বলেছিল "আপনার হাসিটা খুব সুইট"।
স্বপ্নে মিন্টু দেখে সেই তরুণীর সামনে বসে আছে সে, তরুণী টান মেরে মেরে তার এক একটা মুখোশ খুলে ফেলছে, আর অভিমানী স্বরে বলছে
"এই হাসি টাও না, না, এইটাও না। তোমার ওই হাসিটা কই ?"
ফেরিওয়ালা মিন্টুর কাঁধে মুখোশের বোঝা, মিন্টু চীৎকার করে বলতে চায় তার হাসিটা তার মুখে, বলা যায় না। তরুণী মুখোশের পর মুখোশ টান মেরে মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিতে থাকে।

... শেষ রাতে নগরীর রাস্তায় পড়ে থাকে নানা রং এর মুখোশ। দিনের আলো ফুটতেই সেই মুখোশ মিলিয়ে যায়... কারা যেন তুলে নিয়ে যায়... মুখে পরে ফেলে...

Friday, March 27, 2020

করোনা দিনযাপন

মড়ক উছিলায় ঘরবন্দী আপনি। স্বজাতি দেখলে আতকায়া উঠেন। ভিতরে করোনা নাই তো? মিডিয়ায় ফেনা তুলেন। বাইত তাহুইন, বাইত তাহুইন। স্টে হোম, স্টে হোম। বাট হাউ ফানি, অনেকের হোম নাই এই শহরে। ভরসা নাই ভাসানচরে। এলাহী ভরসায় তারা ছুটে গ্রামে। গ্রাম যেখানে, হোম সেখানে। এই গণ মুভমেন্টে আপনার রাগ উঠে। হোয়াট দ্য গ্রাম? এত বুঝানোর পরেও অশিক্ষিত গাইয়াগুলা যে কী করে, পিটা ওগো। পিটায়া ছাল তুল অসভ্যগুলার। চাইয়া দ্যাখ, কেমনে পিটা দিতাছে পুলিশ-আর্মি। কত তাদের ক্ষমতা। প্রমাণস্বরূপ ভিডিও শেয়ার দেন। ফলে অনেকে পিটা খায়। পিতার জন্মশতবর্ষে।

করোনার কান নাই। তাই জনস্বার্থে যারা পিটা খায়, তাদের কান্না শুনতে পায় না সে। সে ব্যস্ত তার মলিকিউলার কারবারিতে। তবু আপনি যে ভাইরাস থেকে সভ্য+আশরাফ+বহুকোষী প্রাণী, তা বুঝাইতেও রাগ জারি রাখতে হয়।

কিন্তু কার উপর যে রাগ, বুইঝা উঠেন না। খালি বুঝেন, উপনিবেশ থেইকা মুক্তি নাই। ছিল ব্রিট্রিশ। তার রেপ্লিকা ও হ্যাংওভার। এখন করোনা। করোনা ছোট। সাবান-কোহল দিয়া কচলাইলে সে মইরা যায়। ফলে, করোনার উপর রাগ কইরা মাটিতে ভাত খাইলে তা প্রবাদের অপমান। বড়জোড় করতে পারেন বিরাগ।

তবে রাগ করা যায় সভ্যতার উপর। সে আকারে বেশ বড়। ফলে, বড় রাগ করা জায়েজ। কী আজব এই সভ্যতা, আপনি ভাবেন। মানুষ যত না স্বজাতির জন্য, তার চেয়ে বেশি অ্যান্টিভাইরাস বানাইয়া গেছে কম্পিউটারের জন্য। এখন করোনা সামলাও। রাগে-দুঃখে, পারলে এখনই, ডেটল বা ক্লোরোকুইন খান দুই বেলা। ভাইরাস না মরুক, নিজে তো মইরা বাঁচবেন!

অথবা, ধরেন, মাথায় মার্কিন ক্যারা উঠলে, রাগ উঠে চীনের উপর। চীন নিয়া যত গুজব পান, ছড়ান। যথা, এক, এইটা ল্যাবপ্রসূত; এইটা তাদের জৈবিক অস্ত্র মামলা। দুই, এইটা তাদের বাণিজ্যযুদ্ধের গুপন কৌশল। সারা দুনিয়ায় উহান ভাইরাস ছড়াইয়া, ফাঁকতালে আম্রিকা-ইয়ুরোপের শেয়ার কিন্না, সে নিরোগ হয়। করোনা বিস্তারের এই ন্যারেটিভ বুঝতে হাত পাতেন মিডিয়ায়। পান আখখেচরা সংখ্যা ও পরিসংখ্যা। তাতে রাগ কমে। আবার মিডিয়া দেয় স্বজাতি মরার সংবাদ। তাতে রাগ বাড়ে। সভ্যতা শিখাইছে, রাগ মেদের মতো। তা ঝাড়তে হয়। কার উপর তা ঝাড়বেন?

ইয়েস। সরকার। তার প্রতি আপনার বহুতল প্রতি+আশা। আপনি চান, সে হোক আপনার লোকাল ঈশ্বর। যেহেতু ভোট বা ভ্যাট দিছেন। যেহেতু নগরের নাগর আপনি। ফলে বুকভরা আশা নিয়া শুনেন জাতির উদ্দেশে ভাষণ। শুইনা হতাশ হন। ভাবেন, ইস, বৈশ্বিক এই সমরকালে বেসামরিক যন্ত্রের যাবতীয় গাফিলতির দায় স্বীকার কইরা একবার যদি তিনি, মাত্র একবার যদি তিনি মন থেইকা সরি বলতেন, আপনার স-অ-ব রাগ নাইমা যাইতো। সবাই তাইলে হাতে-হাত-না-মিলাইয়া হু মোতাবেক স্টে হোম করতো। তাতে বাঁইচা যায় ঘরের বুড়া মা-মুরুব্বি-বাপ। বাঁচতো অসুখে ভোগা অসুখী পরিবার। সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস সমাধান। কত সহজে করোনা খেদানো যায় বাকি সবাই ঘরে বইসা থাকলে। ঘরে বইসা কফি লাটে খাইতে খাইতে তা ভাবেন।

কিন্তু চাকরি-ব্যবসা সব লাটে উঠায়া কতকাল ঘরে বইসা থাকতে হবে? হু ন‍ৌজ? মেইবি হু নোজ। তখন চিঠি খসড়া করেন হু বরাবর। হু জানে কচু। সে জানে না আপনার কামাই কেমনে হবে। সে জানে না আগামী মন্দায় আপনার খাওন কে জুটাবে। কথা তার একটাই: এইটা মড়ক। ঘরে মটকা মাইরা থাকতে হবে অনির্দিষ্টকাল। তাইলে স্বাস্থ্যসেবা সামলানো যাবে। কার্ভ ফ্ল্যাট হবে। ইত্যাদি। ফলে হু নিয়া আপনার হুতাশ বাড়ে। বহুকোষী রাগ ফিরা আসে। সভ্যতা শিখাইছে, রাগ মেদের ম...

রাগ কমলে আবার বুঝেন, আপনার লাইগ্যা স্টে হোম অনিবার্য। ফলে ধারদেনা কইরা হইলেও তড়িঘড়ি কিনেন বাড়তি চালডালসাবান। আর অচেনা লোকের দেখাদেখি অচেনা স্যানিটাইজার। ঘরে তো আর অনির্দিষ্টকাল না খাইয়া, হাইগা-হাত-না-ধুইয়া থাকা যায় না। সেইটা অসভ্যতা। সদাই শেষে ফেসবুকে আইসা দেখেন, সভ্যতর লোকেরা এই কিনাকাটার নাম দিছে, প্যানিক বাই। চিরকাল আপনার দৌড় টাটাবাইবাই বা শুচিবাই পর্যন্ত। এই প্যানিক বাই নামের গালি মায়ের জন্মে শুনছেন নাকি, মনে করতে থাকেন আপনি। ফলে আপনি প্যানিক ইটিং শুরু করেন। সাতদিনের খানা তিনদিনে শেষ। আর টেনশন কমাইতে প্যানিক স্মোকিং। সভ্যতা বলে, জনস্বাস্থ্যের পক্ষে তা ক্ষতিকর।

জন ও স্বাস্থ্যের মায়েরে বাপ। খুব তো দেখলেন দুনিয়াজোড়া জনস্বাস্থ্যের সার্কাস, বিশ্বমুরুব্বিদের বাহাদুরি। টাট্টিখানায় হাগতে হাগতে এইসব ভাবেন। হাগায় রাগা কমে। তখন আবিস্কার করেন, পৃথিবীতে টাট্টিখানাই সবচেয়ে ইনক্লুসিভ; আপন; সভ্যতার বড় কেরামত। কারণ, সে বিচার করে না কে অসভ্য আর কে সভ্য। নিজেরে উদাম করা যায়। কান্নাকাটি করা যায়। করোনার মতো সে নির্বিচারে সবাইরে আপন কইরা নিতে পারে।

আপনি আরও টের পান : এই বানায়া তোলা সভ্যতা — যা না শিখলে অপমানিত হন আর "নোংরা অপর" হওয়ার উপলব্ধিতে অপরাধবোধে ভুগেন — সে নিজেই একটা ব-অ-ড় ভাইরাস; প্যারাসাইট। যতই ঘরে বইসা নিরাপদ মনে করেন, আপনারে এই নভেল সভ্যতাভাইরাস রোগে ধরছে। আপনি নিজেই তার বাহক পোষক তোষক যা-তা। এমনকি যাদের উপর আপনার এত রাগ, তারাও একইভাবে সংক্রমিত।

বালের দোহাই, বেয়াদবি মাফ কইরেন, আপনার+স্বজাতির দরকার একটা অসভ্য নভেল অ্যান্টিভাইরাস। যতদিন না পান তারে, সাবান ডলেন। কম খান। আর স্টে হোম। যেহেতু সভ্যতা বলছে, হোমো স্যাপিয়েন্স আপনি।