Tuesday, November 27, 2018

ভূতাশ্রয়ী ধর্মের দ্বৈতচারন

আপনাদের কতগুলো গল্পো বলিঃ

*১ম গল্পোঃ *
একটা বুড়ো থাকতো উত্তর মেরুতে ...
সাথে বুড়ী বঊ আর কতগুলো এল্ভিস্ .. (ফেরেস্তার মতন কতগুলা পিচ্চি)..
সারাবছর সে আর পিচ্চিগুলা মিলে খেলনা বানায় ..
আর ক্রিস্টমাস্ আসলে সব খেলনা তার যে বিশাল বস্তাটা আছে, তার মধ্যে ভরে ফ্যালে ।
তারপর বস্তাটা সহ তার অলৌকিক রথে চড়ে বসে ।
রথ'টানা আট/নয়'টা অলৌকিক মেরুহরিণ, উড়ে নিয়ে যায় তাকে লোকালয়ে ... বাড়িঘরের
উপর দিয়ে ..
ছাদে রথ নামিয়ে বুড়ো চিমনি বেয়ে বাড়ির ভেতরে ঢোকে ..
প্রতি বাড়িতে সে বাচ্চাদের জন্য একটা করে খেলনা রেখে তারপর আবার চিমনির ভেতর দিয়ে ছাদে উঠে আসে ... এভাবে সব খেলনা বিলিয়ে দিয়ে সে আবার উত্তর মেরুতে তার বাসায় ফিরে যায় ... আর আগাম বছরের জন্য নতুন করে খেলনা বানাতে থাকে ।

বুঝতেই পারছেন আমি কার গল্পো করছি ... হ্যা স্যান্টা ক্লজ'এর গল্পো এটা ।

এখন আমি যদি একজন প্রাপ্তঃবয়স্ক হয়ে'ও এই গল্পোটাকে শতভাগ সত্যি বলে বিশ্বাস করি এবং আপনার মত একজন সুহৃদ বন্ধু পেয়ে আপনাকে আমার বিশ্বাসের কথা বলি এবং আপনাকে সমবিশ্বাসে বিশ্বাসী হতে প্ররোচিত করি .... তখন আপনি কি করবেন ?

নিশ্চয়'ই আমাকে পাগল ভাববেন !
নিশ্চয়'ই আমাকে ভূতেধরা বা প্রবোধাক্রান্ত ভাববেন !

কেন ভাববেন ? কারন ... যত'ই .. ইনিয়ে-বিনিয়ে .. বানিয়ে বানিয়ে ..
বিশ্বাসযোগ্য করে; আমি স্যান্টা ক্লজের কথা বলিনা ক্যানো ... আপনি জানেন এসব রূপকথামাত্র .. উড়ন্ত মেরুহরিণ .. উড়ন্ত রথ .. পিচ্চি-পিচ্চি এল্ভিস .. কখন'ই আপনি দ্যাখেননি .. ছোটবেলায় দাদাদাদির মুখে শুনেছেন মাত্র । আর সত্যি বলতে বাস্তবে এদের দ্যাখা পাওয়াটা'ও অসম্ভব বলেই জানেন ।

নিশ্চয়'ই আমাকে ডিলিউশনাল বা ভুত'গ্রস্থ ভাববেন ।

নিশ্চয়'ই বন্ধুত্বের খাতিরে আমাকে সুস্থ্য করে তুলতে চাইবেন ... কিছু প্রশ্ন করে আমার ভুল ভাঙ্গাতে চাইবেন ... যেমনঃ

- স্যান্টা কিভাবে একটা মাত্র বস্তায় কিম্বা ছোট রথটায় এত খেলনা একসাথে আটায় ?
... আমি উত্তর দিতে পারি - স্যান্টার বস্তা আর রথ যাদুকরী ... সব কিছুই আটানো সম্ভব ।

- যেসব বাড়িঘরের বা এপার্টমেন্টের চিমনি নেই সেসব বাড়িতে স্যান্টা ঢোকে কিভাবে ?
... আমার উত্তর - যাদু দিয়ে স্যান্টা চিমনি তৈরী করতে পারে ...

- ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলতে থাকলে স্যান্টা চিমনি বেয়ে নামে কিভাবে ?
... উত্তর হতে পারে - স্যান্টার স্যুটটি বিশেষ আগুন'নিরোধোক স্যুট ।

- কখন'ও সিকিউরিটি সিস্টেমে স্যান্টাকে দেখা যায় না কেন ?
... স্যান্টা এক্ষেত্রে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে ।

- স্যান্টা একরাতের মধ্য এত দ্রুত পৃথিবীর সব জায়গায় যেতে পারে কিভাবে ?
... স্যান্টা সময়ের ঊর্ধে ... নিমেষের মধ্য সে সব জায়গায় যেতে পারে ।

- খেলনা গুলো বিতরনের সময় স্যান্টা বৈষম্য বা শ্রেনীপ্রভেদ করে কেন ? ধনীর বাচ্চারা দামী খেলনা পায় আর গরীবের বাচ্চারা সস্তা খেলনা পায় কেন ?
... আমি এক্ষেত্রে বলতে'ই পারি - স্যান্টার কার্যপ্রকার মরনশীল আমরা কখন'ই বুজতে পারবনা ... স্যান্টার অবশ্য'ই কোন কারন আছে ... হতে পারে ... "গরীব বাচ্চাদের দামী ইলেক্ট্রিক খেলনা দিলে পরবর্তীতে তার জন্য ব্যাটারী কিনতে আরো পয়সা লাগবে।
... গোদের উপর বিষফোড়া .. তাই স্যান্টা গরীবদের এই বিষফোড়া থেকে বাচাতে তাদের সস্তা খেলনা দেয় ।"

প্রশ্নত্তর পর্ব শেষ ।আপনার প্রশ্ন গুলো খুব'ই যৌক্তিক আর আমি'ও সবগুলোর উত্তর দিয়েছি।
আমি ভেবে পাচ্ছিনা আমি যা দেখি আপনি কেন তা দেখতে পাচ্ছেননা ..
আর আপনি'ও ভেবে পাচ্ছেননা আমি এমন ভূত'গ্রস্থ পাগলা হলাম কি করে !
কারন আমার উত্তর গুলো আপনাকে তৃপ্ত করতে পারেনি ।
কারন আমার উত্তর গুলো আপনার কাছে পাগলের প্রলাপ সমতুল্য ।
কারন আপনি জানেন .. আগুননিরোধোক স্যুট, যাদুকরী বস্তা, রথ, উড়ন্ত মেরুহরিণ ইত্যাদি
একমাত্র ঠাকুর'মার ঝুলি আর হলিউডের মুভিতে'ই সম্ভব .. বাস্তবে না ।


*এবার আসি ২য় গল্পেঃ*

একরাতে ঘরে বসে আছি ..
হঠাত্ ঘর প্রচন্ড আলোকিত হয়ে উঠলো ..
ঠিক তখন এক ফেরেস্তা এসে আমাকে এক অদ্ভুত গল্পো শোনায় ..
" নিউ'ইয়র্কের এক পাহাড়ের পাশে, প্রাচীন কিছু সোনার প্লেট মাটির নিচে চাপা পরে আছে .. তারমধ্যে একটি বই ইহুদীদের একটি বিলুপ্ত জাতির যারা উত্তর আমেরিকায় থাকতো । প্লেটগুলোতে বিজাতীয় ভাষায় তাদের বর্ননা আছে ।" .. এমনকি ফেরেস্তাটি আমাকে সেই প্লেট গুলোর কাছে নিয়ে গেলো এবং আমার বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসতে সাহায্য করলো .. দুর্বোধ্য বিজাতীয় ভাষার বর্ননা উদ্ধারে আমাকে সাহায্য করলো এবং আমি অবাক হয়ে জানতে পারলাম ... দু হাজার বছর আগে ইহুদীদের বিশাল এক সভ্যতা এই যুক্তরাষ্ট্রে ছিল । এমনকি আমি সোনার প্লেটগুলো স্বর্গে ফেরত পাঠানোর পুর্বে আমার নিজের কিছু মানুষকে দেখালাম যেন তারা প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে থাকে এবং তাদের স্বাক্ষরিত প্রমান রাখলাম যে তারা দেখেছে । এসবের উপর একটা বই'ও বের করলাম ।

এখন এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কি ?যদি আপনি সুস্থ্য মানুষ হন অবশ্য'ই কিছু প্রশ্ন করবেন ...
যেমনঃ

- আমেরিকায় দুহাজার বছর আগেকার ইহুদী সভ্যতার নুন্যতম কোন'ও আলামত বা ধংস্বস্তুপ কোথায় যা আমার গ্রন্থে বর্ণিত আছে? কটা পুর্ণ সভ্যতার সাম্ভাব্য জিনিষপত্র ... দৈনন্দিন ব্যবহার্য্য হাড়ি-পাতিল, রথ, যুদ্ধাস্ত্র, এসবের কোন'ও নুন্যতম নিদর্শন নাই কেন ?
... আমার উত্তরঃ এখন'ও এগুলোকে খুজে পাওয়া যায়নি, কিন্তু কোন এক নিকট ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে ।

এরকম গন্ডাখানেক প্রশ্ন আপনি করলেন .. এবং প্রতিটির'ই উত্তর আমি দিলাম । বলাবাহুল্য কোনটাই মানষিকভাবে সুস্থ্য আপনাকে সন্তুষ্ট করতে পারলনা ।


পুরো ব্যাপার'টাই আপনার কাছে একটা "ফাপোড়" ছাড়া আর কিছু না । এবং বেশিরভাগ সুস্থ্য মানুষের কাছে এটা ভুত'গ্রস্থ প্রলাপ ছাড়া আর কিছু নয় । আর এই একই গল্পো যদি অন্যকোন সুস্থ্য মানুষের কাছে বলি, তো স্বাভাবিকভাবে'ই তারা আমাকে ডিলিউশনাল বলবে ... কারন তারা কখন'ই সোনার প্লেটগুলো কিম্বা ফেরেস্তা কোনটাই দেখেনি, এবং ধরে নিবে যে কাহিনিপুরোটা'ই আমার বানানো .. এমনকি প্রত্যক্ষদর্শীদের স্বাক্ষর করাটা'ও তারা ভাববে আমি ঘুষ দিয়ে তাদের প্রত্যক্ষদর্শী বানিয়েছি .. আসলে তারা কিছুই দেখেনি .. সুস্থ্য মানুষমাত্র'ই এরকমটা ভাবা স্বাভাবিক .. তাই নয় কি ?

মজার ব্যাপার হচ্ছে; পৃথিবীতে লক্ষাধিক মানুষ .. হুবহু ঠিক আমার এই গল্পোটার মত একটা গল্পো মনেপ্রানে বিশ্বাস করে .. তাদের ধর্মের মূলভিত্তি বলে মানে - তারা হচ্ছে মর্মন .. আমেরিকার ইয়ুটাহ্ অঞ্চলের সল্টলেক সিটিতে তাদের প্রধান কার্যালয়, মর্মন চার্চ্ । আর আমার মত গল্পোটি যে ফেদেছিলো তার নাম - জোসেফ স্মিথ, আমেরিকাতে ১৮০০ সালের দিকে থাকতো .. মাত্র দুশো বছর আগে । বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, মাত্র দুশো বছর আগে সে এই গল্পোটি বলেছিল আর তার লেখা বইটিতে উল্লেখ করেছিল, " প্লেট থেকে অনুবাদকৃত অংশ" যা আপনি পাবেন " বুক অব মর্মন"-এ ।

এখন আপনি কোন'ও মর্মন'কে জিজ্ঞেস করলে তারা ঘন্টার পর ঘন্টা ইনিয়ে বিনিয়ে একের পর এক উত্তর দিতে পারবে । যদি'ও পৃথিবীর বাকি ৫.৯৯ বিলিয়ন মানুষ তাদের এই প্রচেষ্টা নিতান্ত হাস্যকর, বানোয়াট, এবং মিথ্যাপূর্ণ বলেই ধরে নেবে ।
বস্তুতঃ স্যান্টার গল্পের মতো মর্মন'দের গল্পোটি'ও অসাড় ।


*এবার ৩য় গল্পোঃ*


একবার এক লোক একটি গুহায় বসে আপন ধ্যানে মগ্ন ছিলো ..
হঠাত্ চারদিক আলোয় ভরে গেলো ।
একটি দৈব আওয়াজ আসলো, " পড়ো " !
ধ্যানরত মানুষ'টি অনুভব করলো কে যেনো তাকে জাপটে ধরে পিষে ফেলতে চাইছে ..
কয়েকবার এরকম হল ।
তখন মানুষটি প্রশ্ন করলো, আমি কি পড়বো ?
দৈব আওয়াজ উত্তর দিল, " পড় তোমার প্রভুর নামে .. যে তোমাকে সৃষ্টি করেছেন ..
মানুষটি ঘোরের মধ্যে দৌড়ে বাড়ি ফিরল .. ফেরার পথে আকাশে বিশাল একটি মুখ দেখতে পেল .. যেটি বললো যে "আপনি এখন থেকে ঈশ্বরের দূত, ( বা প্রেরিত পুরুষ বা নবী )
আর মুখা'বয়বটি নিজেকে জীব্রায়েল বলে পরিচিতি দিলো ..

রাত্রে স্বপ্নে জীব্রায়েল আরো'ও কয়েকবার আসলো ... এমনকি দিনের বেলায় রক্ত মাংসের শরীরে'ও আসতে লাগলো .. যদি'ও সেই মানুষ'টি ছাড়া আর কেউ কখন'ও জীব্রায়েলকে দেখেনি বা তার আওয়াজ শোনেনি ।
এরপর জীব্রায়েলের সাথে পরিচয়ের প্রায় ১১ বছর পর জীব্রায়েল একটি ঘোড়া সহ মানুষটির কাছে আসলো .. ঘোড়াটির পাখা ছিলো .. ঘোড়ায় চড়িয়ে তাকে নিয়ে উড়ে চললো .. জেরুজালেম গেলো, সাত আসমান পেরিয়ে বেহেস্তে গেলো, বেহেস্তোবাসীদের সাথে সাক্ষাত করলো .. এরপর জীব্রায়েল আবার তাকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে দিয়ে গেলো।
মজার ব্যাপার হচ্ছে এই পুরো ভ্রমনটা হতে এক সেকেন্ডের'ও কম সময় লেগেছে ..

পরবর্তিতে মানুষটি এই উড়ন্ত ঘোড়ায় চড়ার অভিজ্ঞতা সবাইকে বলেছে .. এমনকি জেরুজালেম এর ঘরবাড়ি, বিশেষ স্থাপনা; বেহেস্তের অবস্থা বিস্তারিত বর্ননা করেছে । এভাবে প্রায় ২৩ বছর ধরে জীব্রায়েলের সাথে তার সাক্ষাত্ হয় .. এবং ঈশ্বর প্রদত্ত জীব্রায়েলের বানীসমুহ একটি বইয়ে লিপিবদ্ধ হয়।

এখন তাহলে এই গল্পোর ব্যাপারে আপনি কি বলবেন ?
আগে কোথাও এ গল্পো শুনে না থাকলে .. আপনার কাছে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক যে এটাও আগের স্যান্টা, সোনার প্লেট - গল্পো গুলোর মত অসাড়, বানোয়াট, মিথ্যাপূর্ণ এবং অবশ্যই মাত্রাতিরিক্ত উর্বর মস্তিস্কের কল্পনাজাত ..

কিন্তু সাবধান !এরকম একটা গল্পোর উপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে ইসলাম ধর্ম .. তথা কয়েক বিলিয়ন মানুষ-মুসলিমদের ধর্ম ।
আর যে মানুষটি গুহায় ধ্যান মগ্ন ছিল তার নাম মুহাম্মদ ।
আর তার বইটির নাম আল- কোরআন ।
আর এই সেই .. কোরআন নাজিলের পবিত্র কাহিনি যা নাজিল হয়ে ছিল মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে ।

যদি'ও কয়েক বিলিয়ন মুসলিম ব্যতিত .. পৃথিবীর আর সবাই এই গল্পোটাকে নিছক " উর্বর মস্তিস্কের কল্পনাজাত " কোন স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয় বলে মনে করে । আর তারা এটাও জানে কোরআন মানুষ্য রচিত বই ছাড়া আর কিছু হতে'ই পারেনা ...

এখন আপনি যদি খৃষ্টান হন তো আপনাকে একটু ফিরে তাকাতে অনুরোধ করছি .. মর্মন এবং মুসলিমদের গল্পো আপনি খুব সহজেই ধরে ফেলেছেন যে মিথ্যা, বানোয়াট .. খানিকটা রূপকথার গল্পো'ও বটে ..
সেই একই কারনঃ
কারন আপনি ভালো করেই জানেন, স্যান্টা মিথ্যা, বানোয়াট বুড়া ।
কারন আপনি ভালো করেই জানেন রূপকথার ব্যাং কিম্বা রাক্ষসের মত উপরোক্ত গল্পের ভৌতিক চরিত্রগুলোর কোন বাস্তবিক প্রমান নেই ।


পূর্বপরিচিত বা পূর্বপ্ররোচিত না হলে যে কার'ও পক্ষে'ই সম্ভব এটি বোঝা যে এই গল্পোগুলো উর্বর মস্তিস্কের কল্পনাজাত ফসল ।অপরদিকে ... কি হাস্যকর ব্যাপার দেখুন;
মুসলিমরা দেখছে এবং বলছে মর্মন'রা ভুত'গ্রস্থ .. তাদের ধর্মটা রুপকথার উপর আশ্রয় ছাড়া আর কিছু নয় ...
আর মর্মন'রাও বলছে মুসলিমরা ভুত'গ্রস্থ কারন তাদের ধর্মটাও রূপকথার উপর দাঁড়িয়ে আছে ।

আর আপনি ... খৃষ্টান হয়ে দিব্যি দেখতে পারছেন, মুসলিম মর্মন উভয়েই ভুত'গ্রস্থ .. কারন দুটো ধর্মই দাঁড়িয়ে আছে রূপকথার উপর ।

এবার আপনার দিকে একটু তাকাই ..

*এটা আমার শেষ গল্পোঃ*

ঈশ্বর তার সন্তানকে পৃথিবীতে আনবে বলে এক কুমারী- ম্যারী'কে সন্তানসম্ভবা করল ..
ম্যারী আর তার হবু বর- জোসেফ বেথেলহেমে গেলো অনাগত ঈশ্বর পুত্রের জন্ম এবং জন্ম পরবর্তী নথিভুক্তকরনের জন্য ... সেখানে ম্যারী ঈশ্বর পুত্রের জন্ম দিল ।
ঈশ্বর তারকা দিয়ে পথ দেখিয়ে কিছু মানুষকে সেখানে আনলো ।
স্বপ্নে ঈশ্বর জোসেফকে পরিবার নিয়ে ইজিপ্ট যেতে বললো ।
আর ঈশ্বর দেখলো, হেরড ইস্রায়েলের হাজার হাজার সদ্যভুমিষ্ট শিশুদের হত্যা করতে যেনো ঈশ্বরের পুত্র'ও তাদের মধ্যে মারা যায় ।
বড় হয়ে ঈশ্বরের পুত্র দাবী করলো সে স্বয়ং ঈশ্বর প্রেরিতঃ " আমি'ই পথ, আমি'ই সত্য,
আমি'ই জীবন ।"
সে অনেক যাদুকরী দৈব ঘটনা ঘটালো .. যেমনঃ অসুস্থ্যকে সুস্থ্য করা, পানিকে শুরায় পরিনত করা , মৃত ব্যক্তিকে জীবন দান .. এই দৈবকান্ডে নিজেকে ঈশ্বর বলে প্রমান করলো ।

কিন্তু শেষতক .. মৃত্যপরোয়ানা নিয়ে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মারা যান । তার শবদেহ রাখা হয় একটি কবরে । তিন দিন পর দেখা যায় কবরটি ফাকা পড়ে আছে, শবদেহটি নেই । এবং মানুষ'টি আবার'ও বেচে উঠে, তার দেহের ক্ষতগুলো তখন'ও ছিল যাতে করে সবাই নিঃসন্দেহ হয় , আর বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন মানুষের সামনে উপস্থিত'ও হয় । এরপর স্বর্গে চলে যায় আর ঈশ্বরের ডান হাতের উপর বসে .. তাকে আর পরবর্তিতে দেখা যায়নি ।

আজ এই সময়ে আপনি সেই ঈশ্বর পুত্রের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরী করতে পারবেন ..
আপনি যদি প্রার্থনা করেন তো সে আপনার প্রার্থনার জবাব দিবে । সে আপনাকে রোগমুক্ত করবে, দুঃসময়ে পাশে দাঁড়াবে ইত্যাদি ইত্যাদি ।

ঈশ্বর পুত্র আপনাকে বেহেস্তি জীবন'ও দিতে পারে আপনার .. আর পুণ্য করলে মৃত্যুর পর আপনাকে বেহেস্তে তার পাশেই জায়গা করে দিতে পারে।

হ্যা, অবশ্য'ই এটা যীশু খৃষ্টের গল্পো ।
আপনি কি এই গল্পোটা বিশ্বাস করেন ?
যদি খৃষ্টান হন তো অবশ্য'ই এটা বিশ্বাস করেন .. তাই না ?
আর আমি যদি সন্দেহঃবশত আপনাকে প্রশ্ন করতে থাকি .. তার বিপরীতে আপনার হাজার হাজার উত্তর'ও আছে ...
ঠিক যেমনটাঃ ১ম গল্পের ক্ষেত্রে, স্যান্টার ব্যাপারে এই আমি'ই আপনাকে হাজার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলাম ।

সত্যি বলতে কি ... আমাকে যেমন আপনি পাগল ভাবছেন .. এ ক্ষেত্রে আমি'ও আপনাকে পাগল ছাড়া আর কিছুই ভাবছি করতে পারছিনা ... কারন একজন খৃষ্টান হয়ে আপনি উপরের শেষ গল্পোটি মনেপ্রানে'ই বিশ্বাস করেন ।

আপনার সাহায্যার্থে বলছি, পৃথিবীর বাকি ৪ বিলিয়ন মানুষ যারা খৃষ্টান নয় তারা ঠিক সেভাবেই আপনার খৃষ্টিয় গল্পোটাকে দেখে,
ঠিক যেভাবে এই আপনি আমার স্যান্টার গল্পোটাকে দেখেছেন ...
ঠিক যেভাবে আপনি মর্মন আর মুসলিমদের গল্পোটাকে দেখেছেন ...

ঠিক সেভাবেই সত্য এবং বাস্তব চোখে আমি, মর্মন কিম্বা মুসলিমরা আপনার খৃষ্টিয় গল্পোটাকে নিছক উর্বর মস্তিস্কের কল্পনাজাত একটি ভৌতিক গল্পো বলেই স্থির করি । কারন .. ঐশ্বরীক ( যাদুকরী) বীর্য্যে ম্যারীর পেটে সন্তান আসা, ঐশ্বরীক (যাদুকরী) তারকার পথ দেখানো .. কিংবা মৃত্যুর পর পুনরায় যীশুর পুনরুত্থান সব'ই স্রেফ চাপাবাজী ছাড়া আর কিছু না ...
দুনিয়ার অখৃষ্টান ৪ বিলিয়ন মানুষ সবাই কিন্তু আমার সাথে একমত ।


খৃষ্টীয় বিশ্বাসের বাইরের লোকজন কিন্তু এই গল্পের ফাক কোকর গুলো ঠিক'ই খুজে পায় ...
শুধু আপ্নি'ই পাননা ।

ঠিক যে কমন সেন্স দিয়ে আপনি বুঝেছেন আমার স্যান্টার গল্পোটা বানোয়াট রুপকথা ..
ঠিক যে কমন সেন্স দিয়ে আপনি বুঝেছেন মর্মন আর মুসলিমদের গল্পোটা বানোয়াট রুপকথা ..
ঠিক এক'ই সুস্থ্য স্বাভাবিক চিন্তা দিয়ে আমি বা একজন মর্মন বা একজন মুসলিম বুঝতে পারছি আপনার খৃষ্টীয় কাহিনীগুলো সম্পূর্ণরূপে ...
" উর্বর মস্তিস্কের কল্পনাজাত রূপকথা " ।

দুঃখজনকভাবে শুধু আপনি আমাদের সত্যোপলব্ধিটাকে গ্রহন করতে পারছেন না । কারন অবশ্য'ই ধর্মের প্রতি অন্ধবিশ্বাস যা হয়তো কিছুটা পিতৃপ্রদত্তভাবে আপনার মাঝে ঢুকে আছে ... যা আপনার সত্য- স্বাভাবিক চিন্তা দিয়ে বস্তুর বিচার করা থেকে বিরত রাখছে ।
... অথচ আপনি ঠিক'ই অন্যদের গল্পের ফাক ধরে ফেলছেন শুধু নিজের বেলায় না ।

... নিজের এই দ্বৈতাচরন থেকে বেড়িয়ে আসতে হলে .. হয় আপনাকে আমার স্যান্টার গল্পো, জোসেফের সোনার প্লেটের গল্পো এবং মুহম্মদের জীব্রায়েলের গল্পোগুলো'কেও বিশ্বাস করতে হবে .. নয়তো সবগুলোকেই ( আপনার খৃষ্টীয় গল্পোগুলো সহ) প্রত্যাখ্যান করতে হবে ।

কোনটা করবেন সেটা আপনার অভিরূচি ।


[মূল লেখাটিঃUnderstanding religious delusion ওয়েবসাইট থেকে নেয়া]

Saturday, November 24, 2018

সত্যায়ন মিথ্যায়ন

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ও অন্যান্য সরকারী চাকুরীর জন্য ছবি এবং ডকুমেন্টে ‘সত্যায়ন’ এর যে বাধ্যবাধকতা তা প্রকৃতপক্ষে একটি অপ্রয়োজনীয় এবং হয়রানিমূলক কার্য।
ছবি ও কাগজপত্রের অধিকাংশ সত্যায়ন আদতে মিথ্যায়নের মাধ্যমে সংগৃহীত হয়। বাংলাদেশের অন্য প্রান্ত থেকে যে ছেলেটি বা মেয়েটি ভর্তি পরীক্ষা দিতে ক্যাম্পাসে এলো সে এখানে এই মুহূর্তে সত্যায়নকারী বিসিএস ক্যাডার কোথায় খুঁজে পাবে? পেলেই বা কী? সেই বিসিএস ক্যাডারের কী এমন ঠেকা পড়েছে এই অচেনা- অজানা ভর্তিচ্ছুকে সত্যবাদী ঘোষনা দেওয়ার? দুরু দুরু বুকে প্রথমবারের মতো ক্যাম্পাসে পা রাখা ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীটি কি পরীক্ষার শেষ প্রস্তুতি নেবে নাকি বিসিএস ক্যাডারের পেছনে রুদ্ধশ্বাস দৌড়াবে? মূল্যবান সময় ও শ্রমের কী নিদারুণ অপচয়!
সরকার আর প্রতিষ্ঠান নানান ভাবে সত্যায়নের নামে মিথ্যায়ন করতে ছাত্রছাত্রীদের বাধ্য করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাও?- সনদপত্র-ছবি সত্যায়িত চাই, ভর্তি হয়ে ফাইনাল পরীক্ষার ফরম ফিলাপ করতে চাও?- বিভাগীয় শিক্ষক কর্তৃক সত্যায়িত চাই, চাকরি পেতে চাও?- প্রথম শ্রেনীর সরকারী কর্মকর্তা কর্তৃক ‘চরিত্র’ প্রত্যায়িত চাই, যোগ্যতার সনদপত্র সত্যায়িত চাই !
সত্যায়নকারী, প্রত্যায়নকারী প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড অফিসার হলেই হল- সে নিজে চরিত্রবান কিনা, সত্য বলছে কিনা তাঁর কোন দায় নেই- অফিসার সাহেব সাইন আর সিল সাপ্পর মেরে দিলেই কারো চরিত্র হয়ে যাবে ফুলের মতো পবিত্র! তদুপরি এই গেজেটেড ‘প্রথম শ্রেণী’র দেখা মেলা বড় ভার- সত্যায়ন করাতে গেলে বেশিরভাগ বিরক্ত হন-‘সিল নাই’ বলে পত্রপাঠ বিদায় আর সত্যিকার সত্যায়ন প্রার্থীর বিড়ম্বনা, দৌড়াদৌড়ি, নাভিশ্বাস।
Necessity Knows No Law. সহজ-সরল একটা সমাধান ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও চাকুরি প্রার্থীরা এর মধ্যে আবিষ্কার করে ফেলেছেন। ৪০-৫০ টাকা দিয়ে একজন প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড অফিসার বা সরকারি কলেজের শিক্ষক বা মেডিকেল অফিসারের নামে সিল বানিয়ে নিলেই খেল খতম, তারপর ধর তক্তা, মার পেরেক অর্থাৎ আবেদনকারী নিজেই নিজের কাগজপত্র সত্যায়ন করছে ! ‘মিথ্যা সত্যায়ন’ তাই বাস্তবতা।
আইনের দৃষ্টিতে নি:সন্দেহে এটি ‘জোচ্চুরি’ এবং প্রতারণা। সদ্য উচ্চ মাধ্যমিকের চৌকাঠ পেরোনো শিক্ষার্থীদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলা শুরু করতে বাধ্য করা হচ্ছে মিথ্যা আর প্রতারণা দিয়ে! এই সত্যায়নের আসলে আইনি ভিত্তি কী? নানান আইন আর বই পত্র ঘেঁটেও আমি এর কোন আইনি উৎস বা ভিত্তি খুঁজে পেলাম না।
আমার মতে- এটি স্রেফ একটি উপনিবেশিক প্রথা, শাসকশ্রেণীকে সুপিরিয়রিটি আর শাসিত কে ইনফিরিয়রিটির মেসেজ দেয়া ছাড়া আর কিছু নয়, এটি বৈষম্যমূলক, বর্ণবাদী, নাগরিক মর্যাদার প্রতি অবমাননামূলক, দুর্নীতি আর অনৈতিকতার আঁতুড়ঘর।

চিন্তায় নবারুনের কবিতা

এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না

যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায়
আমি তাকে ঘৃণা করি-
যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক হয়ে আছে
আমি তাকে ঘৃণা করি-
যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরাণী
প্রকাশ্য পথে এই হত্যার প্রতিশোধ চায় না
আমি তাকে ঘৃণা করি-
আটজন মৃতদেহ
চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে
আমি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাচ্ছি
আট জোড়া খোলা চোখ আমাকে ঘুমের মধ্যে দেখে
আমি চীৎকার করে উঠি
আমাকে তারা ডাকছে অবেলায় উদ্যানে সকল সময়
আমি উন্মাদ হয়ে যাব
আত্মহ্ত্যা করব
যা ইচ্ছা চায় তাই করব।
কবিতা এখনই লেখার সময়
ইস্তেহারে দেয়ালে স্টেনসিলে
নিজের রক্ত অশ্রু হাড় দিয়ে কোলাজ পদ্ধতিতে
এখনই কবিতা লেখা যায়
তীব্রতম যন্ত্রনায় ছিন্নভিন্ন মুখে
সন্ত্রাসের মুখোমুখি-ভ্যানের হেডলাইটের ঝলসানো আলোয়
স্থির দৃষ্টি রেখে
এখনই কবিতা ছুঁড়ে দেওয়া যায়
’৩৮ ও আরো যা যা আছে হত্যাকারীর কাছে
সব অস্বীকার করে এখনই কবিতা পড়া যায়
লক-আপের পাথর হিম কক্ষে
ময়না তদন্তের হ্যাজাক আলোক কাঁপিয়ে দিয়ে
হত্যাকারীর পরিচালিত বিচারালয়ে
মিথ্যা অশিক্ষার বিদ্যায়তনে
শোষণ ও ত্রাসের রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে
সামরিক-অসামরিক কর্তৃপক্ষের বুকে
কবিতার প্রতিবাদ প্রতিধ্বনিত হোক
বাংলাদেশের কবিরাও
লোরকার মতো প্রস্তুত থাকুক
হত্যার শ্বাসরোধের লাশ নিখোঁজ হওয়ার স্টেনগানের গুলিতে সেলাই হয়ে
যাবার জন্য প্রস্তত থাকুক
তবু কবিতার গ্রামাঞ্চল দিয়ে
কবিতার শহরকে ঘিরে ফেলবার একান্ত দরকার।
এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না
এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না
এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না
আমি আমার দেশকে ফিরে কেড়ে নেব
বুকের মধ্যে টেনে নেব কুয়াশায় ভেজা কাশ বিকেল ও ভাসান
সমস্ত শরীর ঘিরে জোনাকি না পাহাড়ে পাহাড়ে জুম
অগণিত হৃদয় শস্য, রূপকথা ফুল নারী নদী
প্রতিটি শহীদের নামে এক একটি তারকার নাম দেব ইচ্ছে মতো
ডেকে নেব টলমলে হাওয়া রৌদ্রের ছায়ায় মাছের চোখের মত দীঘি
ভালোবাসা-যার থেকে আলোকবর্ষ দুরে জন্মাবধি অচ্ছুৎ হয়ে আছি-
তাকেও ডেকে নেব কাছে বিপ্লবের উৎসবের দিন।
হাজার ওয়াট আলো চোখে ফেলে রাত্রিদিন ইনটারোগেশন
মানি না
নখের মধ্যে সূঁচ বরফের চাঙড়ে শুইয়ে রাখা
মানি না
পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা যতক্ষণ রক্ত ঝরে নাক দিয়ে
মানি না
ঠোঁটের ওপরে বুট জ্বলন্ত শলাকায় সারা গায় ক্ষত
মানি না
ধারালো চাবুক দিয়ে খন্ড খন্ড রক্তাক্ত পিঠে সহসা আ্যালকোহল
মানি না
নগ্নদেহে ইলেকট্রিক শক কুৎসিৎ বিক্রত যৌন অত্যাচার
মানি না
পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা খুলির সঙ্গে রিভলবার ঠেঁকিয়ে গুলি
মানি না
কবিতা কোন বাধাকে স্বীকার করে না
কবিতা সশস্ত্র কবিতা স্বাধীন কবিতা নির্ভীক।
চেয়ে দেখো মায়কোভস্কি হিকমেত নেরুদা আরাগঁ এলুয়ার
তোমাদের কবিতাকে আমরা হেরে যেতে দিইনি
বরং সারাটা দেশ জুড়ে নতুন একটা মহাকাব্য লেখবার চেষ্টা চলছে
গেরিলা ছন্দে রচিত হতে চলেছে সকল অলংকার।
গর্জে উঠুক দল মাদল
প্রবাল দ্বীপের মত আদিবাসী গ্রাম
রক্তে লাল নীলক্ষেত
শঙ্খচূড়ের বিষ-ফেনা মুখে আহত তিতাস
বিষাক্ত মৃত্যুসিক্ত তৃষ্ঞায় কুচিলা
টণ্কারের সূর্য অন্ধ উৎক্ষিপ্ত গান্ডীবের ছিলা
তীক্ষ্ম তীর হিংস্রতম ফলা-
ভাল্লা তোমার টাঙ্গি পাশ
ঝলকে ঝলকে বল্লম চর-দখলের সড়কি বর্শা
মাদলের তালে তালে রক্তচক্ষু ট্রাইবাল টোটেম
বন্দুক কুরকি দা ও রাশি রাশি সাহস
এত সাহস যে আর ভয় করে না
আরো আছে ক্রেন, দাঁতালো বুলডজার বনভয়ের মিছিল
চলামান ডাইনামো টারবাইন লেদ ও ইনজিন
ধ্বস-নামা কয়লার মিথেন অন্ধকারে কঠিন হীরার মতো চোখ
আশ্চর্য ইস্পাতের হাতুড়ি
ডক জুটমিল ফার্ণেসের আকাশে উত্তোলিত সহস্র হাত
না ভয় করে না
ভয়ের ফ্যাকাশে মুখ কেমন অচেনা লাগে
যখন জানি মৃত্যু ভালোবাসা ছাড়া কিছু নয়।
আমাকে হ্ত্যা করলে
বাংলার সব কটি মাটির প্রদীপে শিখা হয়ে ছড়িয়ে যাব
আমার বিনাশ নেই-
বছর বছর মাটির মধ্য হতে সবুজ আশ্বাস হয়ে ফিরে আসব
আমার বিনাশ নেই-
সুখে থাকব, দুঃখে থাকব সন্তান-জন্মে সৎকারে
বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিন
মানুষ যতদিন থাকবে ততদিন।

অশ্লীলতার আকর্ষন

‘অশ্লীল’ শব্দটির মধ্যেই একটি অমোঘ আকর্ষণ আছে বৈকি- ‘অশ্লীল’ বলে প্রচার পাওয়া বইয়ের কাটতি বেশি, অশ্লীল সিনেমার বাড়তি দর্শক, অশ্লীল গানের শ্রোতার আধিক্য, অশ্লীল কৌতুকে বর্ধিত আনন্দযোগ! প্রেক্ষাগৃহগুলো ‘এক টিকিটে দুই সিনেমা’র রমরমা যুগ পেরিয়ে এসেছে- ক’দিন হলো! অশ্লীলতার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ নগ্নতা আর নগ্নতার হাত ধরে হাজির হয় ‘কাম’ ও ‘যৌনতা’।
অশ্লীলতা- একটি অমীমাংসিত বিতর্ক ; এটির অসংজ্ঞায়িত সংজ্ঞার মতোই। অশ্লীলতা’ বা Obscenity কে অধিকাংশে পর্নোগ্রাফির সাথে গুলিয়ে ফেলে। জেনে রাখা ভালো- পর্নোগ্রাফি মাত্রই অশ্লীল কিন্তু অশ্লীল মাত্রই পর্নোগ্রাফি নয়, পর্নোগ্রাফি একটি বেআইনি কারবার- ওদিকে সব অশ্লীলতাই আবার অবৈধ নয়। পর্নোগ্রাফিতে নগ্নতা ও যৌনতার যুগপৎ উপস্থিতি থাকলেও ‘নগ্নতা ও যৌনতা’র কিছু রূপ ‘অশ্লীলতা’ কিংবা ‘পর্নোগ্রাফি’র আওতার বাইরে রেখে এটিকে শিল্পের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে যেমন- নগ্নতা ও যৌনতা কে উপজীব্য করে শিল্পীর আঁকা পেইন্টিং, ভাস্কর্য, ক্যামেরার ছবি, নাটক, সিনেমার বিশেষ দৃশ্য, গানের লিরিক্স আর সাহিত্য। শিল্প মাধ্যমে অশ্লীলতার এমন রূপের নাম- ‘ইরোটিকা’ (Erotica) । তাই সব নগ্নতা যৌনতা কিংবা অশ্লীলতার প্রকাশ নয়, বরং সৌন্দর্য, প্রেম ও বীরত্বের প্রকাশ।
ইরোটিক শিল্প- সাহিত্য-সিনেমা কিংবা শিল্প- সাহিত্য-সিনেমায় ‘ইরোটিকা’র ব্যবহারের ইতিহাস অতি পুরাতন এবং দুর্দান্ত প্রতাপে বর্তমান। নগ্নতা ও যৌনতা যেহেতু জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ তাই শিল্প-সাহিত্যে এটি অবধারিতভাবে প্রতিফলিত হয়েছে সেই গ্রিক সভ্যতায় নগ্ন ভাস্কর্য নির্মাণের আমল থেকেই। সৌন্দর্যের দেবী ভেনাস কিংবা প্রেমের দেবী আফ্রোদিতির মতো নগ্ন নারী ভাস্কর্য ছাড়াও গ্রিক ভাস্কর্যে ফুটে উঠেছে বীর গ্রিক যোদ্ধাদের নগ্ন রূপ। গ্রিকরা মনুষ্য দেহের সৌন্দর্যের নিরিখে সবকিছুর সৌন্দর্য মূল্যায়ন করত। মানুষ দেখতে কেমন তা নয়, বরং মানুষের দেখতে কেমন হওয়া উচিত- সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তার চিত্রায়ণ হওয়া প্রয়োজন বলে তারা মনে করতো।
প্রাচীন বাংলার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের দিকে তাকালেও ভাস্কর্যের এই নগ্নরূপ দেখা যায়। আমরা টিকিট কেটে টাকা খরচ করে মিউজিয়ামে ঢুকে মাটির তলা থেকে তুলে আনা নারী বিভঙ্গের এই নগ্ন ভাস্কর্য দেখি, মুগ্ধ হই কিন্তু কামার্ত হওয়ার প্রশ্ন তাতে উত্থিত হয়না- কারনটা স্পষ্ট- এই নগ্ন ভাস্কর্যের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় ও দার্শনিক ধারণা বিকশিত হয়েছিল। ফরাসী শিল্পী রোঁদ্যার তৈরি দু’জন নগ্ন নর-নারীর গভীর আলিঙ্গনের প্রকাশ ‘The Kiss’ নামক বিখ্যাত ভাস্কর্যের শিল্প- সৌন্দর্যে শতাব্দী ধরে বুঁদ হয়ে আছে পৃথিবীর মানুষ।
চিত্রকর্ম বা পেইন্টিং এ শিল্পীরা উদারভাবে তুলে এনেছেন বিবসনা নারীদের- নানা বিভঙ্গ, দেহবল্লরী ও বৈভবে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মাইকেল অ্যানজেলো’র চিত্রকর্মের ইরোটিক, উলঙ্গ নারীরা ঝুলে আছে পৃথিবীর দেয়ালে দেয়ালে। আবার ক্রুশবিদ্ধ যিশুর যতো পেইন্টিং ও ছবি আছে তাতে দেখা যায় নগ্ন যিশুকে। না, এটি যৌনতার বহিঃপ্রকাশ বিবেচিত হয় না।
পেইন্টিং এ প্রকাশিত ‘উলঙ্গতা’ প্রসঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ কেও আমরা পাই একেবারে নিঃসংকোচ। বিদেশের মিউজিয়ামে নগ্ন নারী চিত্র দেখে আপ্লুত রবীন্দ্রনাথ ১৮৯০ সালের ‘য়ুরোপ যাত্রীর ডায়েরী’ তে লিখেছেন-
“সেদিন ফ্রেঞ্চ এক্‌জিবিশন-এ একজন বিখ্যাত আর্টিস্ট-রচিত একটি উলঙ্গ সুন্দরীর ছবি দেখলুম। কী আশ্চর্য সুন্দর! দেখে কিছুতেই তৃপ্তি হয় না। সুন্দর শরীরের চেয়ে সৌন্দর্য পৃথিবীতে কিছু নেই—কিন্তু আমরা ফুল দেখি, লতা দেখি, পাখি দেখি, আর পৃথিবীর সর্বপ্রধান সৌন্দর্য থেকে একেবারে বঞ্চিত। মর্ত্যের চরম সৌন্দর্যের উপর মানুষ স্বহস্তে একটা চির অন্তরাল টেনে দিয়েছে। কিন্তু সেই উলঙ্গ ছবি দেখে যার তিলমাত্র লজ্জা বোধ হয় আমি তাকে সহস্র ধিক্কার দিই। আমি তো সুতীব্র সৌন্দর্য-আনন্দে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলুম, আর ইচ্ছে করছিল আমার সকলকে নিয়ে দাঁড়িয়ে এই ছবি উপভোগ করি। বেলি যদি বড় হত তাকে পাশে নিয়ে দাঁড়িয়ে আমি এ ছবি দেখতে পারতুম। এ রকম উলঙ্গতা কী সুন্দর! “
নগ্ন স্তন বা নিদেনপক্ষে ক্লিভেজ কামোদ্দীপক অশ্লীল দৃশ্য হিসেবেই সাধারণত পরিগণিত হয়। ক্যামেরার জুমিং এর কেরামতিতে বাংলা সিনেমায় এটির সবচেয়ে উর্বর, অশ্লীল ও যৌন আবেদনময় ব্যবহার দেখা যায়। অথচ প্রসঙ্গের প্রয়োজনে অনাবৃত স্তন ও স্তন্যদানের দৃশ্যও হয়ে উঠতে পারে যৌনতাহীন, নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ, শৈল্পিক। এটি পুরোপুরি দৃষ্টিভঙ্গি, প্রসঙ্গ, প্রয়োজন ও উপস্থাপনার ব্যাপার। শিশুকে স্তন পান করানোর যে দৃশ্য হামেশাই মানুষ প্রত্যক্ষ করে থাকে তার মধ্যে যৌনতা নেই, আছে মাতৃত্ব- সেটি বাস্তবের পৃথিবীতে হোক কিংবা সিনেমার দৃশ্যে-
নায়িকা মৌসুমি অভিনীত ‘মাতৃত্ব’ (২০০৪) নামের ছবিতে মৌসুমি কর্তৃক শিশুকে স্তন্যদানের দৃশ্য তাই সহজাত, স্বাভাবিক ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে- এটি যৌনতা বা অশ্লীলতার প্রকাশ হয়নি। তারো বহু আগে ১৯৭৮ সালে আবদুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত বিখ্যাত ছবি ‘সারেং বউ’ এর শেষ দৃশ্যে দেখা যায়- প্রলয়ংকরী জলোচ্ছ্বাসের পরে নায়ক ফারুক তৃষ্ণায় মরতে বসেছে। নায়িকা কবরী তৃষ্ণার্ত স্বামীকে পানি খাওয়ানোর নানান চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় চারদিকের নোনা পানির কারনে। প্রিয়তমের জীবন রক্ষার আর কোন উপায় না দেখে মাতৃত্বকে জাগিয়ে স্বামীকে দুধের শিশুর মতো বুকে জড়িয়ে নিজ স্তন পান করায় কবরী। স্বামী কদম (ফারুক) চোখ মেলে দেখে চমকে উঠে বলে- নবিতন, তুই আমারে পর কইরা দিলি! নবিতন (কবরী) বলে- না, জীবন বাঁচানো ফরজ।”
– মানবিকতার কী অসাধারণ দৃশ্য! যদি এই দৃশ্য দেখে কারো মনে যৌনাকাঙক্ষা জাগে তাহলে পাপ সেই ব্যক্তির মনে, স্তন্যদানকারী নারীর চিত্রে নয়।
অশ্লীল সাহিত্যের উপযোগিতা কিংবা সাহিত্যে অশ্লীলতার অনুপ্রেবেশ নিয়ে জল কম ঘোলা হয়নি। সেই বিতর্কের বিষ জল গড়িয়েছে আদালত অব্দি, নির্বাসনে গিয়েছে অনেক সাহিত্যিক এমনকি মৃত্যু তাড়া করে ফিরেছে তাদের- কারুর গিয়েছে জীবনই! নোংরা চটি ও সাহিত্যে যৌনতার প্রকাশ- এই দুটো ব্যাপার যে আলাদা তা বুঝতে সময় লাগে, সমকাল কে অতিক্রম করতে হয়। সাহিত্যকে যদি জীবনের দর্পন মানি, যৌনতা যদি হয় মানুষের তীব্রতম অনুভূতি, তাহলে সেই দর্পনে নিজের ও অন্যের কাম-ঘামের ক্লেদাক্ত রূপটিও উঠে আসবে- এই সত্যটি হজম করতে সমাজ অনিচ্ছুক। কিন্তু প্রাচীন বাংলা সাহিত্য থেকে মধ্যযুগ পেরিয়ে আধুনিক ও উত্তারাধুনিক বাংলা সাহিত্যে অশ্লীলতা বা যৌনতা প্রবল দাপটে স্থান করে নিয়েছে। শরীর, কাম, যৌনতা অনুষঙ্গ হয়ে তীব্রভাবে প্রতিফলিত হয়েছে সাহিত্যে, যুগে যুগে-
“মানুষ যে সময়টুকু যাপন করে সেটি জীবন নয়, জীবন হল সেটুকুই যা মানুষ মনে রাখে”
– গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের এই উক্তির কথা মাথায় রেখে বলা যায়- লেখকের মৃত্যু হলেও যৌনতা কে উপজীব্য করে রচিত সাহিত্য ঠিকই বেঁচে আছে, প্রবল বিক্রমে, তীব্র জনপ্রিয়তায়। মধ্যযুগে রচিত “শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন” এ রাধা- কৃষ্ণের প্রণয় কিংবা মধ্যযুগের শাহ মুহাম্মদ সগীরের লেখা “ইউসুফ- জুলেখা” এই প্রবণতার উন্মেষ মাত্র। যদিও অমিয়ভূষণ মজুমদার মত দিয়েছিলেন- ‘যৌনতা গাইনোকলজির বিষয়; লেখকের কারবার এটি নয়’- অথচ তিনি নিজেই এ থেকে বেরোতে পারেন নাই। সৈয়দ শামসুল হকের ‘খেলারাম খেলে যা’- বাংলা সাহিত্যের অস্বস্তিকর উপন্যাসের একটি, তীব্র বিতর্কিত, যৌনতার উন্মুক্ত ব্যবহার হয়েছে এখানে অথচ নিষিদ্ধ পাঠের মতো আজো তুমুল আকর্ষনীয় এর প্রতি পৃষ্ঠা, যৌনতাকে ছাপিয়ে এটি হয়ে উঠেছে মানুষের অন্তর্গত ক্ষয়, ক্ষরণ ও বিষাদের দলিল। কিন্তু সাহিত্যে যৌনতার অভিযাত্রায় শামসুল হক কি একা, নিঃসঙ্গ শেরপা? মোটেই নয়, দেশে এবং বিদেশে।
ডিএইচ লরেন্স, জেমস জয়েস, গুন্টার গ্রাস থেকে মিলান কুন্দেরা হয়ে পশ্চিম বঙ্গের বুদ্ধদেব বসু, সমরেশ কিংবা বাংলাদেশের হুমায়ূন আজাদ বা আল মাহমুদ সাহিত্যে যৌনতা ও শরীর কে আশ্রয় করেছেন- কী তীব্র সৌন্দর্য ও শিল্পে! বিতর্ক হয়েছে, সমালোচনা হয়েছে, নিষিদ্ধ হয়েছে, লেখক কে আইনের কাঠগড়ায় দাড়াতে হয়েছে কিন্তু তাতে জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি; বানের জলের মতো হুহু করে বেড়েছে পাঠ ও পাঠক। আজ যে বইটি অশ্লীলতার দায়ে নিষিদ্ধ হয়, নিন্দিত হয়- কালের পরিক্রমায় সেটিই নন্দিত হয়, শিল্পোত্তীর্ণ হয়।
ডি এইচ লরেন্স এর “The Lady Chatterly’s Lover” বইটি অশ্লীলতার দোষে নিষিদ্ধ হয়েছিল, কারণ সেখানে সঙ্গমের বর্ণনা তীব্রভাবে ছিল। কিন্তু পরে মানুষ বুঝতে পেরেছে যে, এই বিবরণ আসলেই পরিস্থিতি বিশ্লেষণের জন্য অপরিহার্য ছিল। সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’ নিষিদ্ধ ছিল ১৮ বছর! হুমায়ূন আজাদের “নারী” নিষিদ্ধ হয়েছিল কয়েক বছরের জন্য। আদালতের আদেশে নিষেধাজ্ঞা রদ হলো এক সময়- উভয় ক্ষেত্রে।
বুদ্ধদেব বসু ১৯৬৭ সালে টর্নেডোর মতো এসে তাঁর বিখ্যাত “রাত ভ’রে বৃষ্টি” উপন্যাসে নির্ভয়ে ঘোষণা দিলেন-
“– ভালোবাসায় শরীরই আসল— আরম্ভ, শেষ, সব ঐ শরীর। ভালোবাসা জৈব, ভালোবাসা যৌন, শরীর না-থাকলে কিছুই থাকে না ভালোবাসার।” এই উপন্যাসের প্রথম বাক্যটিই আরম্ভ হয়েছে প্রথমবারের মতো বাংলা সাহিত্যের এক আশ্চর্য সাহসী, দুর্বিনীত, উত্তেজক ‘যৌন স্বীকারোক্তি’র মধ্য দিয়েঃ
“– হয়ে গেছে, ওটা হয়ে গেছে, এখন আর কিছু বলার নেই। আমি, মালতী মুখোপাধ্যায়, একজনের স্ত্রী আর একজনের মা, আমি ওটা করেছি। জয়ন্তর সঙ্গে, জয়ন্ত আমাকে চেয়েছে, আমিও তাকে।”
“রাত ভ’রে বৃষ্টি” নিষিদ্ধ হলো যথারীতি- অশ্লীলতার দায়। মামলা উঠলো আদালতে। নিম্ন আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট উপন্যাসের পান্ডুলিপি পর্যন্ত ধ্বংসের আদেশ দিলেন। এক সময় এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হলো, অশ্লীলতার দায় কী মোচন হলো? আজো এই উপন্যাস “বেস্ট সেলার” বইয়ের একটি।
কবিতায় যৌনতা ও শারীরবৃত্তের তীব্রতম প্রকাশের কৃতিত্ব আল মাহমুদের। ‘সোনালি কাবিন’ এ আমরা আল মাহমুদ কে পাই যৌনতায় খাপ খোলা তলোয়ারের মতো ধারালো-
“তারপর তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি নারী
খেতের আড়ালে এসে নগ্ন করো যৌবন জরদ/ 
শস্যের সপক্ষে থেকে যতটুকু অনুরাগ পারি
তারো বেশী ঢেলে দেবো আন্তরিক রতির দরদ”
“নগ্নতা বা যৌনতা শিল্পের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ’- কিনা এটির বিতর্ক অমীমাংসিত। তবে নগ্নতা মাত্রই অশ্লীলতা নয়, ‘অশ্লীলতা মানেই নৈতিকতার ধ্বস’- আইন দিয়ে জোর করে নিষিদ্ধ করা হোক- এই দাবির ভিত্তিও বড্ড নড়বড়ে। কোনটি শিল্প, কোনটি প্রয়োজন আর কোনটি নয়- সেটি স্পষ্ট হয় শিল্পীর বা ব্যবহারকারীর উদ্দেশ্য হতেঃ নগ্নতা বা যৌনতার ব্যবহার যদি হয় সৌন্দর্য বিনির্মাণে, নিরেট সত্য প্রকাশে- সেটি শিল্প। জ্ঞান তৈরির প্রয়োজনে যদি হয়- সেটি প্রাসঙ্গিক, নিরপরাধ। আর স্রেফ কামোদ্দীপনা জাগানোই যদি উদ্দেশ্য হয়- সেটি শিল্প নয়- অশ্লীলতা, পর্নোগ্রাফি, বিকৃত, দণ্ডনীয়। এক্ষেত্রে শিল্পীর দায়িত্ববোধের পাশাপাশি পাঠক বা দর্শকের বুদ্ধিবৃত্তিক মান, বয়স ও মানসিক পরিপক্কতাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটি শিল্পোত্তীর্ণ চিত্র, ভাস্কর্য, সাহিত্য অথবা শিক্ষক কর্তৃক প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় ক্লাস-পাঠ দর্শক, পাঠক কিংবা শিক্ষার্থীর কাছে ‘অশ্লীল’ মনে হতে পারে যদি তাঁর মানসিক পরিপক্কতা অগভীর হয় অথবা তাঁর নিজস্ব মুল্যবোধ যদি সাংস্কৃতিকভাবে সাংঘর্ষিক হয়। যে কখনো ইংরেজি মুভি দেখেনি- ‘টাইটানিক’ সিনেমায় নায়ক জ্যাক কর্তৃক নায়িকা রোজ এর নগ্ন স্তনের পোর্ট্রেট আঁকার দৃশ্য তাঁর কাছে চরম অশ্লীল বিবেচিত হবেই। সুতরাং, সব কিছু সবার জন্য নয়।অশ্লীলতার ধারণা এভাবেই আপেক্ষিক।

নগ্ন শরীরে একটি শারীরবৃত্ত তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ কর্মের ফলপ্রসূত যে মানুষ- যে মানুষের জীবনের দীর্ঘ ব্যাধিঘোর জুড়ে নিষিদ্ধ অবদমিত যৌনতার বসবাস- সাহিত্য, শিল্প, সিনেমা, ভাস্কর্য, ছবি, কথা, মেডিকেল সায়েন্স বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ থেকে সেই আবশ্যকীয় ‘যৌনতা’ ছেঁটে ফেলে, শিল্পী কিংবা শিক্ষক কে শাস্তির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে কোন মুক্তি কি সম্ভব?
‘অন্ধ হলেই কী প্রলয় বন্ধ থাকবে?!’

Thursday, November 22, 2018

অমিয়ভূষণের উপন্যাস ভাবনা (সুস্মিতা কৌশিকীর লেখা)

   গড়পড়তা বাঙালি পাঠকের উপন্যাস ভাবনা যে উচ্চতায় শেষ হয়, তারও অনেক  উচ্চতায়  অমিয়ভূষণের উপন্যাস ভাবনার শুরু তাই হয়তো তাঁর উপন্যাস পাঠকের সুস্বাদু (মুচমুচে মুখরোচক তিনি কোনদিন লেখেনই নি) মনে হয়নি যারাও বা সাহস করে দু' চারটি উপন্যাস  পড়েছেন, বুঝেছেন হজমকরা সহজসাধ্য নয় তবে তাতে এই ঔপন্যাসিকের কিছু যায় আসেনি তিনি বেঁচে থাকতেও কারণ তিনি সুনীল, হুমায়ূন, শীর্ষেন্দুর মতো শুধু সাহিত্য চর্চা করতে চাননি তিনি আমৃত্যু শিল্পের অনুরাগী ছিলেন, এক নির্বিণ্ণ সাধক বই লিখে টাকা করে ফুলে ফেঁপে ওঠা যায় ঠিকই কিন্তু তাতে শিল্প হয় না শিল্প নিভৃত চর্চার বিষয়  সমসাময়িক পাঠকের খোঁজে তিনি লেখেন নি কোনদিনই কুচবিহারের আর এক বিশিষ্ট সাহিত্যিক অরুনেশ ঘোষকে  দেওয়া সাক্ষাৎকারে অমিয়ভূষন তাঁর সমকালীন ঔপন্যাসিকদের বিখ্যাত লেখা সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন তাতে বাঙালি পাঠকের একশো ভাগ  বিস্ময়ের উদ্রেগ হয় বিভূতি বন্দ্যোর আরন্যক পড়েছি, ভালো বই তবে একে উপন্যাস বলা চলে না " তারাশঙ্করের কালিন্দী'র গল্প তাঁর ভালো লেগেছিল, ভালো লেগেছিল মানিক বন্দোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা র ' আরম্ভ আর প্রস্থান'  তবে ' পড়ে আলোড়িত হওয়ার মতো কিছু নয় ' অবশ্য এসবের কারণ দর্শিয়েছেন তিনি " রাশিয়ান, ফরাসী, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান, ইটালিয়ান ( ইংরেজি অনুবাদে ) এবং বহু ইংরেজি ও আমেরিকান উপন্যাস পড়া থাকায় হয়তো এরকম হয়েছে এসবের তুলনায় বাংলা উপন্যাসকে জোলো মনে হতো"
    বলা বাহুল্য শুধু তত্ত্বে নয় অমিয়ভূষনের উপন্যাস- ভাবনা উপস্থাপনেও ব্যতিক্রমী তাঁর ভাবনা ছকে বাঁধা পথে আটকে থাকেনি কারণ তিনি নিজেই বলতে ভালোবাসতেন 'Boy meets a girl '  এর মধ্য দিয়ে উপন্যাসের পরিক্রমা তা তিনি কখনোই  ভাবতে পারেননি"প্রকৃতপক্ষে  উপন্যাস পোর্টম্যান্টো নয় যে তার মধ্যে একই সঙ্গে মায়ের চিঠি, ফুটো মোজা ও ইস্তেহার পুরে আধুনিকতার গাড়িতে চড়া যাবে উপন্যাস আমাদের কৌতূহল নিবারণ করে না এবং আমাদের অ্যাডোলেসেন্ট যৌনপ্রবৃত্তির পরিতৃপ্তির উপায়ও নয় " "উপন্যাস তত্ত্ব নয়এবং বোধহয় সেজন্যই উপন্যাসের ভাষাও  বাক্যের পর বাক্য বসানো নয় উপন্যাস গল্প নয় যে গল্পটা পাঠকের মাথায় ঢুকেছে কি না তা জানলেই ভাষা সম্বন্ধে সব জানা হল উপন্যাস ইনসেস্ট ইত্যাদির বর্ননা নয় যে সাংবাদিক মাত্রেই ঔপন্যাসিক হয়ে যাবেন ওদিকে আবার উপন্যাস ভাষাচর্চাও নয় যে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন বলেই 'শেষের কবিতা ' উপন্যাস হয়ে উঠবে অন্যদিকে উপন্যাস বড় করে বলা গল্প নয় যে কেউ এ বিষয়ে চালাকি করে বলবে উপন্যাস বড়ও বটে গল্পও বটে " উপন্যাস,একজন বিলিতি রসিকের কথা এনে বলা যায়,  " গল্প থাকায় আমরা দুঃখিত, এবং  গল্প যে রাখা হয় তা গল্প বলার উদ্দেশ্যে নয়, কোনটা আগে কোনটা পরে  ঘটেছে তা ধরিয়ে দিতে" "প্রকৃতপক্ষে একটা থিম যা আমাদের চোখের নীচে ফুটিয়ে তোলা হয় একটা থিম  যা হয়ে ওঠেঅর্থাৎ থিম নামে এক জীবন্ত বিষয়ের ভাব"
           অমিয়ভূষণের উপন্যাস সংখ্যা খুব বেশি নয় তবে একথা হলপ করে বলা যায় প্রত্যেকটি উপন্যাস বিষয়ে,ভাবনায়, উপস্থাপনের মাধুর্য্যে সাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে তিনি যে বিষয়কে উপন্যাসের উপজিব্য করে তুলতে চেয়েছেন তা একান্ত ভাবে জীবনের সাথে সম্পৃক্ত ঔপন্যাসিকের প্রত্যক্ষ সংযোগ না থাকলে তাঁর উপন্যাস কৃত্রিমতার দোষে দুষ্ট হতো কিন্তু তা তিনি হতে দেন নি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে খন্ডে খন্ডে ধরে নিজের কল্পনায়, বোধে, হৃদয়বত্তার প্রলেপে সঞ্জাত করে সম্পৃক্ত ও সংযুক্ত করেছেন তাই তো তিনি অনায়াসে বলতে পারেন     "আমি‌ শরৎচন্দ্রের মতো  বাসন - মাজা সাহিত্য লিখি না আমি মহাশ্বেতা দেবীর মতো সেকেন্ডারী অভিজ্ঞতা দিয়ে লিখি না বিবর আমি দু - পাতা পড়েছি হাস্যকর আমার স্ত্রী  আমাকে হাসুলি বাঁকের উপকথা তিনপাতা পড়ে শুনিয়ে ছিলেন তারপর আর পড়িনি রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ ছাড়া আর গুলো কিছুই হয়নি সুনীল গাঙ্গুলীর তো অনেক টাকা, কিন্তু বলার মতো লেখা ক'টা খুঁজে পাবেন? "
            এসব  উচ্চারণ কোন সাহিত্যিকের আত্মম্ভরিতা নয়, এ হলো শিল্পীর আভিজাত্য তিনি সাহিত্য করে টাকা রোজগার করতে চাননি, তাই তো তিনি কোনদিনই প্রতিষ্ঠানের মুখাপেক্ষী ছিলেন না তিনি অনায়াসে বলতে পারেন " আমি এক প্রতিষ্ঠিত প্রৌঢ় ", দৌড়ে তাঁর কোন স্পৃহাই ছিল নাঅমিয়ভূষণ জাত শিল্পীআর একজন শিল্পীর মনন সবসময় ঝুঁকে থাকে ধ্রুপদী পাঠে অমিয়ভূষণের তরুণ বয়সে গোটা ইউরোপিয় গদ্য সাহিত্যে বিপুল আলোড়নের সময় জার্মানিতে টমাস মান আর তাঁর ঠিক বিপরীতে ফানৎস্ কাফকা, ফরাসিতে আলবেয়ার কাম্যু ও জাঁ পল সার্ত্র, ইংরেজি ভাষায় জেমস্ জয়েস সাহিত্য তাঁর নতুন দিশা খুঁজছে এঁদের অনুসিন্ধিৎসু কলমের আঁচড়ে অমিয়ভূষণের সাথে ইউরোপিয় নতুন গদ্য সাহিত্যের যোগাযোগ কতটা ছিল --- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন --- " এই লেখক গুলি প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র এঁদের কোন গোষ্ঠী ছিল  না যে আন্দোলন বা আলোড়ন হবে এঁদের উপন্যাস পড়ে সত্যিকারের পাঠক দম মেরে যায়, হয়তো তেমন সাহসী হলে তেমন কোনও ধৈর্যশীল দু- একটা অন্তর্গূঢ় প্রবন্ধ লেখেন এখানে বলে রাখা ভালো সার্ত্র ও কাম্যুর নাম মান, কাফকা, জয়েসের সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে  বলা বোধ হয় সংগত হয় না ফরাসি নাম সেরকম বলতে হলে প্রুস্তের নাম করা যায় বরং আসলে কাফকার বই ছাপা হয়েছে তাঁর মৃত্যুর পরে তা কী বিষয়ে এ বুঝতেই এখনও সময় চলে যায়মানের বেলায় পাঠক বুঁদ হয়ে মানেই ডুবে যায় এদের নিয়ে আলোড়ন করার মতো জনতা কোথায় সার্ত্র ও কাম্যু প্রচারবিদ্ ছিলেন তাঁদের দর্শন ছিল তাঁদের দর্শন যত সোচ্চার তাঁদের শিল্প রং - চটা" কতটা সমৃদ্ধ পাঠগ্রহন করে থাকলে একজন সাহিত্যিক অন্য জনপ্রিয় ও প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যের সম্পর্কে এমন উক্তি করতে পারেন ভাবলে অবাক হতে হয় বৈকি তবে এসব শুধু বলার জন্য বলা নয়, বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে তিনি হাতেকলমে কাজ করে দেখিয়েছেন নিজের লেখা সম্পর্কেও তিনি দীপ্তকন্ঠী তাঁর সাথে একমত হতেই হয় যখন তিনি বলেন " আমার লেখা বিছানায় শুয়ে শুয়ে পড়ার জন্য নয়।।।আমার পঞ্চাশটা রিফাইড পাঠক হলেই চলবে আমি লিখি পঞ্চাশ বছর পরের পাঠকের জন্য আমার আদর্শ ব্যাসদেব তিনি লিখেছিলেন কালো মানুষদের কথা মহাভারত ব্যাসের নাতিপুতিদের গল্প তিনিও কালো মানুষ ছিলেন আমি লিখি হলুদ মানুষদের কথা রাভা, কোচ, মেচ, রাজবংশীদের কথা আমি তাদের হাতের পাতার মত চিনি" আসলে ১৯৬০ এর শেষ থেকে ১৯৬৩ এর গোড়ার দিক পর্যন্ত কোচবিহার ডাকঘরে টাউন ইন্সপেক্টর এবং কখনো ইন্সপেক্টর অব পোস্ট অফিসেস হিসাবে দায়িত্ব পালন কালে অমিয়ভূষন চষে বেড়িয়েছেন সংলগ্ন এলাকাগুলি, সাইকেলে, গ্রামের অলিগলি, বনের পথ, পথের ধারে বন, বনের নদী, নদীর সন্নিকটে অনুচ্চ পাহাড় সবই তার খুব পরিচিত, সবই তার লেখার বিষয়বস্তু
    কুচবিহার- আলিপুরদুয়ার আসাম সংলগ্ন বনঘেরা ডুয়ার্স অঞ্চলের এমনই এক চির পরিচিত হলুদ মানুষ, এক অকিঞ্চন আসফাক,  যে তার একমাত্র রত্ন রমনী ও তার ঔরসজাতকে নিজের করে রাখতেও ব্যর্থ তারই কাহিনী 'মহিষকুড়ার উপকথা '  কিন্তু কথায় কথা বাড়ে আকারে ছোট কিন্তু ভাবে গভীর এই উপন্যাস বা উপন্যাসিকাটি ডালপালা বিস্তার করে বহুধা বিস্তৃত ও ব্যাপক অর্থে উঠে আসে পাঠকের কাছে সমাজের নিম্নবর্গের গাথা থেকে হয়ে ওঠে চিরন্তনী মানবের কাহিনী -- তারই এক সজল পাঠ নিতে ইচ্ছুক এই আলোচনায়
      মহিষকুড়া কোন সম্ভ্রান্ত জনপথ নয় এক নগন্য গ্রাম, বিস্তীর্ণ সবুজ সাগরে একটা বিচ্ছিন্ন ছোট দ্বীপ, জঙ্গলে ঘেরা সবুজ অরণ্যানীর কোলে বাস করা এক মানবগোষ্ঠির একান্ত আশ্রয়স্থল, যারা শুধু বিচ্ছিন্নতার ধারক নয় বাহকও কিন্তু বৈপরিত্য এখানেই মাথাচারা দিয়ে ওঠে দূর থেকে দেখলে মনে হওয়া আশ্চর্য নয় যে মহিষকুড়া, ছোটশালবাড়ি,ভোটমারি, তুরুককাটা গ্রামগুলি সবুজের কোলে ঘুমিয়ে আছে সেখানেও আসলে কিন্তু জীবনচর্চার অদৃশ্য শৃঙ্খলগুলি বিদ্যমান কারণ বনের বুক চিরে চলে যাওয়া মেটে পথ কিছুক্ষণের মধ্যেই সমঝোতা করে নেয় ঘনপিচের সড়কের সাথে কালো পিচের রাস্তাগুলি যেন এইখানে বসবাসকারী বাসিন্দাদের জীবনের সীমাবদ্ধতা গুলির নির্ণায়ক শক্তি এখানে অরণ্য অরণ্য নয়, সারল্য সারল্য নয়, জটিলতার জালে আবদ্ধ এক অবোধগম্যতা কারণ যারা বনের বুকে ফুটন্ত কালো গরম পিচ ঢেলে সড়ক তৈরী করে আর যারা লাঙলের পিছনে ধৈর্য নিয়ে এগোয় তারা একই জাতের আগুনে পুড়লে তবু আশা থাকে, ছাইয়ের তলা থেকে নবাঙ্কুর দেখা দেয়; লোভের লাঙলে পড়লে তেমন যে শাল - পদাতিকের নিরেট নিশ্চিদ্র ব্যূহ, এক বনস্পতির এলাকা থেকে অন্য বনস্পতির এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত বিষমুখ কাঁটালতার তেমন যে সব ব্যারিকেড --- সব ধ্বসে যায়, তফাৎ শুধু আমাদের ভাবনায় লাঙলের সঙ্গে লোভ শব্দটি যোগ করতে অনিচ্ছা উৎপাদন হয় এই কৃষিভিত্তিক দেশের প্রেক্ষিতে
       এই মহিষকুড়া অঞ্চলেরই অলিখিত মালিক বছর ষাটের জাফরুল্লা ব্যাপারি সম্ভ্রান্ত কৃষক তার গোয়াল ভর্তি গোরু মোষ, ঘরে চার বিবি, এক ছেলে, বাড়ি ভর্তি চাকরবাকর প্রত্যেকেই জাফরুল্লার শাসনের কাছে জুবুথুবু আবার প্রত্যেকেই তার অধিনস্থ মূকপ্রাণের উপর নিজের শক্তি প্রদর্শন করতে উদ্যতব্যতিক্রম শুধু আসফাক, এক বিচ্ছিন্ন,অন্তর্মুখী হলুদ গাত্রবর্ণের ভিন্ন মানুষ সে মহিষকুড়ার উপকথা এমন এক কাহিনীকে তুলে ধরে ( নিছক গল্প বলা বা কাহিনীর ঘনঘটা অমিয়ভূষনের উপন্যাসে সর্বদাই অনিপস্থিত আর এই‌বিষয়েই তিনি এক ও অদ্বিতীয় ) যার জন্য এমন এক প্রক্ষিতের প্রয়োজন যেখানে দ্বৈত সত্ত্বা  বিদ্যমান রয়েছে মানুষ, মানবেতর, প্রকৃতি সকলেই দ্বৈতসত্তার অধিকারী এখানে চাউটিয়া জাফরুল্লার একান্ত অনুগত ও বিশ্বস্ত চারকদের মধ্যে অন্যতম, মোষের বাথানের কঠিন কাজগুলোর ভার তার উপরে, দুধ দোয়া ও শহরে চালান করাও তার কাজের মধ্যে পড়ে বুনোমোষদের শাসনকরার বিশেষ কায়দা সে রপ্ত করেছে সে এখন এই এলাকার বিশিষ্ট ফান্দি  ( বুনোমোষ ধরার লোক ) ছমির নিতান্ত সাধারণ কর্মী -- 'খড়িফাড়া ' 'তরকারি বাগান তদ্বির' করে, হাঁস মুরগি দেখা কামলাখাটা লোক কিন্তু সেও তার ক্ষমতা প্রদর্শন করে মোষ, গরু, পাঠা খাসি করার সময় নাসির ও সাত্তার লাঙলদার, মূলত তামাকের ক্ষেতে তাদের কাজ বঞ্জর জমিতে আশাতিরিক্ত ফসল ফলিয়ে তারা তাদের শ্রেষ্টত্বের দাবিদার আসফাকের দ্বৈত সত্তা একেবারে ভিন্ন সে কখনো মহিষ হয়ে যায় না, এ রূপান্তর কাফকান মেটামরফোসিস নয়, এখানে মার্কেজের ম্যাজিক রিয়ালিজমও নেই, বা  ভার্জিনিয়া উলফের split personality,এ একেবারে বুনো গন্ধযুক্ত এক বনেচরের মনজগতের বিচিত্ররূপ হরিণ হরিণীর বিচরণ ক্রিয়া যেমন মুহূর্তে শেষ হয়ে যেতে পারে বাঘের তীঘ্ন দাঁতের আঘাতে আবার সেই বাঘের জয়ও শেষ কথা নয় তাকেও দ্বন্দ্ব যুদ্ধে আহ্বান করে রক্তচক্ষু মহিষরাজ তার কালো,ছড়ানো প্রকান্ড এক জোড়া শিং এর দম্ভে অযুত বিচিত্র চিত্রদেহ পাখপাখালি যেমন আছে, তেমনী অভাব নেই বিষধর অহিকুলের ক্ষমতা যেমন আছে, তাকে দ্রুত উৎখাত করে নতুন ক্ষমতায়নও আছে আবার এখানেই অরণ্য তার সতন্ত্র চরিত্র ঝেরে ফেলে ঢুকে যায় মানুষের চরিত্রের ভেতর, জীবনে, যাপনে পশুদের নির্বীজ করার কাজটি একটু বাড়তি উৎসাহ নিয়েই করে থাকে ছমির আসফাক লক্ষ্য করেছে ছমির মিঞা একটুও বিচলিত না হয়ে, বেশ আনন্দের সঙ্গেই চোখের নিমেষে কাজটা সেরে ফেলে  কিন্তু পশুটির যন্ত্রনা আসফাকের মনবেদনাকে ছুঁয়ে যায় -- সে পশুটির চোয়ালের দিকে চেয়ে থাকে, তার মনে হয় " সেই মোষের এঁড়ের বড় বড় চোখ দিয়ে জল পড়ে সর্দির মতো শুকিয়ে আছে চোয়ালে " কোথাও কী আসফাক নিজেকে দেখতে পায় এই মূক পশুর মধ্যে? তার অদম্য যৌবন, পৌরুষ বাঁধা পড়ে আছে, অকেজ হয়ে আছে জাফরুল্লার "পায়োর " এর কাছে, ইংরেজি পাওয়ার শব্দটিকেই আসফাক যতদূর পারে উচ্চারণ করে -- অনুধাবন করতে চেষ্টা করে কী আজব এই শব্দ - কত বিচিত্র তার অর্থ ও অর্থের প্রসারণ ঔপন্যাসিক মজুমদার এখানেই জাফরুল্লার  পৌরুষের প্রকৃতিগত অভাবকেই  যেন ইঙ্গিতে   দেখিয়েে দিতে  চেয়েছেন  তার বহিরাঙ্গের পাওয়ারের  আস্ফালনের মধ্য দিয়ে
       ছমির বলে 'পায়োর 'বদলাতে গঞ্জে গিয়েই জাফরুল্লা তিসরা বিবিকে দেখতে পায় এবং এও বোধগম্য হয় যে তার বড় ও মেজ বিবির বয়স হয়েছে কিন্তু জাফরুল্লার পাওয়ার তখনও বর্তমান যদিও এই তিন বিবিই দীর্ঘ পতিত একমাত্র কমরুনই জাফরুল্লা কে একটি সন্তান দিয়েছে বছর সাতেক আগে এবং তারপর থেকে দীর্ঘ দিন সেও পতিত আর এই কমরুনই কোন এক অজ্ঞাত কারনে তার আত্মজকে শিখিয়ে দেয় আসফাককে  অন্যান্য চাকরের  মতো নাম ধরে না ডাকতে তাই মুনাফ আসফাককে " মিঞাসাহেব " বলে ডাকে এই সূত্র ধরেই আমরা ফিরে দেখতে পারি আসফাকের ধূসর অতীত এবং বুধাই রায়ের পাওয়ার ছ বিঘা জমির ভাগচাষি আসফাকের বাপ বাবার মৃত্যুর পর বুধাই জমিতে নতুন আধিয়ার দিল আধিয়ার জমিবাড়ির দখল নিতে এলে ভয়ে গ্রাম ছেড়ে বনের পথে পা বাড়ায় আসফাক সেই বনেই বেদিয়ার দলে সদ্য বিধবা কমরুনের সাথে তার দেখা ও ভাব ভালোবাসা " বিস্ময়ের মতো শোনালেও জন্মদরিদ্র আসফাক সেই প্রথম এক রত্ন দেখেছিল নীলাভ বেগুনি রঙের মতো মেঘ - মেঘ পাহাড়ের কোলে সবুজ মেঘ মেঘ বনের মাথা বাদামি রঙের সমান্তরাল সরলরেখার মতো গাছের গুঁড়ি, তার কোলে হালকা নীল নদীর জল সেই নদী যেখানে সবুজে নীলে মিশানো কখনো মোষ - রঙের পাথরের আড়ালে বাঁক নিয়েছে, সেখানে সকালের চকচকে আলোয় নিরাবরণ এক বাঁকে ভরা জলে চকচকে মেয়েমানুষের শরীর কমরুনের শরীরের উত্তাপ পেয়েছিল আসফাক চেয়েছিল কমরুনকে নিয়েই বনে বনে ঘুরে বেদিয়ার জীবন কাটাবে কিন্তু সেদিনও সে জানতো না পৃথিবীর সব জমিরই মালিক আছে, এমনকি বনও কারো না কারো মালিকানাধীন  যেমন তাকে একদিন জানায়  জাফরুল্লার বড়বিবি  "  তা আসফাক, এই পিথিমিতে যত জমি দেখো, তা সবই কোনো না কোনো জাফরের এই বন দেখো, তাও একজনের" আর এই তথাকথিত মালিকরাই জাফরুল্লার মতো পায়োরের অধিকারী তাই কমরুনেরও বুড়ো হেঁড়ে মাথা একবুক দাড়ির জাফরুল্লার মধ্যে বেদিয়া- দলপতিকে খুঁজে পেতে খুব বেশি দেরী হয়নি  জাফরুল্লার পাওয়ার সর্বগ্রাসী, নির্বাক পশু থেকে শুরু করে নিশ্চলা বনপ্রকৃতি সবই তার ক্ষমতার নীচে স্তব্ধ আর এই ক্ষমতার অন্যতম হাতিয়ার তার বন্দুক ও সরু লাঠির মতো কালো চকচকে সেই নলটা থেকে যা বের হয় উচ্চপদস্থ আমলাদের পোষাকের পাওয়ারও তো জাফরুল্লার পায়োরেরই অনুকুলে তবু এই সবের বিপরীতে আছে আদি অকৃত্রিম পুরুষের শক্তি -- আসফাকের মতো আর বুনো মোষটার মতো --- যে দশ বছর আগে একবার এসেছিল, আর এ অঞ্চলের অনেক মোষই আকারে প্রকারে এখন অন্য মোষ থেকে পৃথক হয়ে যাচ্ছে যেমন হয়েছে মুনাফ জাফরুল্লা, সরকারী আমলারা জাফরুল্লার অধিনস্থ সকলকর্মির ক্ষমতা ও নতুন ক্ষমতায়নের বিপরীতে আছে এক কোমলমতির মানুষ তার সমস্ত সহানুভুতি ও অন্ত:স্থিত বিদ্রোহ নিয়ে -- যা প্রকাশ্যে আনার সাহসটুকু  সঞ্চয় করেও সে ব্যর্থ হয়,এই বিশাল ক্ষমতাজালের মধ্যে  আবদ্ধ হয়ে ছটফট করে কিন্তু একই সঙ্গে মনে মনে জাফরুল্লার  পাওয়ায়ের বিরুদ্ধাচারণ করে নিজের মনেই এক অদ্ভুত সুখ অনুভব করে
        জাফরুল্লার ওষুধ আনতে শহরে যায় আসফাক রাতের মধ্যেই ফিরে আসার কথা বুড়ো  জাফরুল্লার হাত পা অবশ হয়ে আসে এই ওষুধের অভাবেছমির মিঞা অবশ্য মশকরা করে বলে বিবিদের ( বিশেষ করে ছোট বিবি আর কমরুনের ) ঘরে যেতেই মালিকের এই ওষুধের বিশেষ প্রয়োজন মুহূর্তে আসফাকের মনে ঘুরে দাঁড়াবার ইচ্ছে বিদ্যুতের মতো চমক দিয়ে যায় --- "এ ওষুধটা কি তেমন নয়,যার অভাবে মানুষ মরে? ধক করে উঠল আসফাকের বুকের মধ্যে " কি ইঙ্গিত দিয়ে যান ঔপন্যাসিক? আসফাক ইচ্ছে করেই বনের পথ ধরে এবং পথ ভুলে সারারাত বনের মধ্যেই এলোপাথারি ঘুরে বেড়ায় সে যেন নিজেকে নতুন ভাবে আবিস্কার করে সেই বনে, সেই নির্জন পরিবেশে লটা ( ঘাস ) তুলে গোড়াটা মুখে দিয়ে মিষ্টি স্বাদে খুঁতখুত করে হাসে " সে তাড়াতাড়ি চলতে লাগল আর সেই অবস্থায় গাছের পাতার ছায়া যেমন তার গায়ের উপরে ছায়ার ছবি আঁকছিল, তার মধ্যেও ভয় আর সাহস, আনন্দ আর উত্তেজনা, নানা রেখা এঁকে নাচতে থাকল সে এবার আরো জোরে আরো টেনে আঁ - আঁ- আঁ ড় শব্দ করে ডেকে উঠল কান পেতে শুনল, প্রতিধ্বনি যেন একটা উঠছে আর সেই মুহূর্তে সে অনুভব করল সে মোষ হয়ে গিয়েছে একটা বুনো মোষ সে নিজেই, এই ভেবে তার নিঃশ্বাস গরম হয়ে ফোঁসফোঁস করতে লাগল সে প্রাণভরে ডেকে উঠল আঁ আঁ ড়।।।আর ঠিক এখানেই গল্পটা আর অকিঞ্চনের একমাত্র রত্ন রমনী আর তার আত্মজ কে হারিয়ে ফেলার গল্প থাকে না যে মানুষ প্রেম শব্দটি পর্যন্ত শোনেনি তার মধ্যেও জ্ঞানবৃক্ষের ফলের আভাস উঁকি দিয়ে যায় আসফাক নিজে নিজেই বলতে থাকে " কিন্তুক মোর দেরিটা থাকি গেইল " নির্বিষ প্রতিশোধের হাসি খুঁতখুত করে হাসে " তো ব্যাপারি, তোমরা থাপ্পর মারছেন, দশবিঘা ভুঁই দিছেন, মুইও চাষ দেং নাই " "মুইও দেরি করছং, তোমরা মারেন নাই তামাম শুধ
           কাহিনীর একটানা ন্যারেটিং থেকে মুক্তি দিয়ে ঔপন্যাসিক অসংখ্য খন্ড চিত্রে, উপকাহিনীতে, ইতিহাস কথায় উপন্যাসকে গতিশীল  করেছেন, যা  আদতে এই উপকথাকে অনন্যতা দান করে জনমানুষের কথায় পরিনত করেছে আর এই কাজে সবচেয়ে বেশি সহায়ক হয়েছে উপন্যাসে ব্যবহৃত ভাষা অমিয়ভূষণের উপন্যাস সম্পর্কে দুটি লাইন লিখলেও একটি লাইন অবশ্য তার ভাষাশৈলী নিয়ে কথা বলবে উপন্যাসের কাহিনী বিন্যাসে যে ভাষার তিনি ব্যবহার করেছেন বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে তা শুধু কমলকুমার মজুমদারের  সঙ্গেই তুলনীয় তবে কমলকুমারের বাংলার মতো তা ফরাসীগন্ধী নয় মোটেও, অমিয়ভূষনের ভাষা আদ্যান্ত বাংলা একটি আঞ্চলিক ভাষাকে তিনি এমন মিষ্টতা দান করেছেন যে তা বিশিষ্টের ভাষা বলেই বোধ হয় মহিষকুড়ার উপকথা য় তিনি  কথোপকথনের জন্য রাজবংশী ভাষার ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত সতর্কভাবে যেন পুরো উপন্যাসটি আঞ্চলিক উপন্যাসে পরিগনিত না হয় একদিকে যেমন চরিত্রকে সজীব ও অকৃত্রিম রাখতে, অন্যদিকে তাঁর thought process কেও চালনা করতে তিনি রাজবংশী ভাষায় dialogue ব্যবহার করেছেন স্থানে স্থানে কিন্তু   নিয়ন্ত্রিত ভাবে  যাতে পাঠকের সাথে কমিউনিকেশন ইনকমপ্লিট না থাকে ১৯৬২ সালের শারদীয় গণবার্তায় 'একটি খামারের গল্প 'নামে যে গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল তাই ছিল মহিষকুড়ার উপকথা উপন্যাসিকার বীজস্বরূপ ১৯৭৯ সালে শারদীয় পরিচয় পত্রিকায় মহিষকুড়ার উপকথা র প্রকাশকাল, এই মধ্যবর্তী সময়ে লেখক যে তাঁর শব্দ ভান্ডার কে পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত করেছেন তা দুটি লেখা পাঠেই স্পষ্ট হয়ে যায়এইখানেও  অমিয়ভূষনের অনন্যতা তিনি এক ও অদ্বিতীয়

Tuesday, November 20, 2018

চর্মচক্ষু

গরু একটি গৃহপালিত প্রাণী। গরু গোয়ালঘরে থাকে।
এর চারটি পা আছে, দুইটি কান, চোখ ও একটি লেজ আছে।
মেয়ে গরুর ওলান আছে, ওলান থেকে দুধ বের হয়, মেয়ে গরুকে গাই গরু বলে।
ছেলে গরুর বিচি থাকে। বিচিওলা ছেলে গরুকে ষাঁড় আর বিচিকাটা গরুকে বলদ বলা হয়।
বলদ দিয়া হাল চাষ করা হয়।
সব রকম গরুই ঘাস খায়, আর গোবর লাদে।
** স্যার আমি গরুর রচনা শিখি নাই। প্রাইভেটে স্যার বলসে সংবাদ পত্র আর শ্রমের মর্যাদা রচনা আসবে। দয়া করিয়া ফেল করাইবেন না, আপনার পা দুইটা ধরি।

ক্লাস সেভেনের বার্ষিক পরীক্ষার বাংলা খাতায় আমার টিউবলাইট মস্তিস্কজাত লেখা ছিল এইটুকুই । প্রশ্ন অনুযায়ী উত্তর না থাকার পরও শুধু সুন্দর হাতের লেখার কারণে গরুর রচনায় ১৫ তে ৫ পাই। মাথায় বিদ্যা না ঢুকলেও বিদ্যালয় থেকে একটা জিনিস শিখেছি, সেটা হল গুন না থাকলেও সৌন্দর্য্য দিয়ে অনেক কিছু অর্জন সম্ভব। উলটো করে তখন অনুধাবন করেছিলাম "অন্ধকারের সৌন্দর্য বুঝার জন্য শুধু অন্তর্চক্ষুই যথেষ্ট নয় চর্মচক্ষুও প্রয়োজন"।

আসলে কাউকে হার্ট করার জন্য বলিনি। কয়েকমাস আগে একটি খবর পড়ে আমার এমনটা মনে হচ্ছে। খবরে বলা ছিল 'উচ্চ শিক্ষিত' পুরুষের শুক্রাণু চাই। আর ডিম্বাণুর জন্য প্রয়োজন সুন্দরী মহিলা।মনিতে বন্ধ্যাত্ব বা অন্য শারীরিক কারণে স্বাভাবিক ভাবে যে সব নারী পুরুষের বাবা মা হওয়ার সুযোগ কম, পিতৃত্ব ও মাতৃত্বের অভাব মেটাতেই তাঁরা সন্তান লাভের জন্য স্পার্ম ব্যাঙ্কয়ের দারস্থ হন। প্রথম দিকে ইচ্ছুক বাবা মা'দের প্রধান চাহিদাই ছিল সন্তান যেন সুস্থ ও সবল হয়। সেই হিসেবে শুক্রাণুদাতা ও ডিম্বাণুদাত্রীর নীরোগ ও সম্পূর্ণ সুস্থতাই ছিল বিচার্য। কিন্তু এখন সেই চাহিদাতেও বদল ঘটছে।
আমি খুব আশ্চর্য হব না যদি অদূর ভবিষ্যতেই কোনও বাঙালি পরিবারে দেখা যায় - শ্যামবর্ণ, খর্বকায়, খুব সাধারণ দেখতে বাবা মায়ের সন্তানের গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা, ৬ ফিট লম্বা, নীল চোখ। অন্যান্য দেশেও হয়তো দেখা যাবে বাবা মা বাঙালি হলেও ঘরে ঘরে ককেশিয়ান বা ইউরোপিয়ান চেহারার কোনও সন্তান ভূমিষ্ঠ হচ্ছে। আবার উল্টোটাও হয়তো ঘটছে, কারণ ইউরোপ ও আমেরিকায় নাকি ভারতীয় শুক্রাণুদাতার চাহিদা বাড়ছে।
আমার মনে পড়ে যাচ্ছে, 'ভিকি ডোনার' সিনেমাটির কথা। যেখানে দেখেছিলাম একটি ফারটিলিটি ক্লিনিকের ডাক্তার নিঃসন্তান দম্পতির জন্য হন্যে হয়ে একজন স্মার্ট স্বাস্থ্যবান যুবক খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কিছুতেই রাজি না হওয়ায় - ডোনার হওয়া যে ‍'একটা মহৎ সামাজিক কাজ' - তা নানা ভাবে সেই যুবক তথা নায়ককে বুঝিয়ে শেষ পর্যন্ত স্পার্ম ডোনার হতে তাকে রাজি করিয়েছিলেন।

এখন অবশ্য ধরে বেঁধে নয়, অনেকেই যেমন উপযাচক হয়ে ‍'মহৎ কাজ'-এর উদ্দেশ্যে শুক্রাণু দান করছেন, তেমনি কেউ দিচ্ছেন টাকা রোজগারের জন্য। তবে অনেক শুক্রাণু ও ডিম্বাণু গ্রহীতার মনে ‍ইদানীং যেন এই ভাবনা চলে আসছে যে, সন্তান যখন তৈরি‍ই করা হবে, তাহলে যেমন চাই ঠিক তেমনটাই বা পাবো না কেন? আর ওই ভাবনার হাত ধরেই ‍ইচ্ছুক বাবা মায়ের মনে ‍উঁকি দিয়ে যাচ্ছে, কখনও ‍ইউরোপীয় চেহারা কখনও বা সুন্দর ও মেধাবী সন্তানের আকাঙ্ক্ষা।

চাষিরা যেমন ভাল ফসলের আশায় ‍উন্নত মানের বীজ মাটিতে পোঁতেন। ঠিক তেমনি হবু বাবা মা'ও যেন মেধাবী সন্তানের খোঁজে উচ্চ শিক্ষিত পুরুষের বীজ তথা শুক্রাণু খুঁজে বেড়াচ্ছেন।তাঁদের বিশ্বাস উচ্চ শিক্ষিত বা কৃতী পুরুষের শুক্রাণু থেকে জাত সন্তানও মেধাবী বা কৃতী হবে। কৃতী মানে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট ‍ইত্যাদি। তার জন্য বেশি দাম দিতেও পিছপা নয় গ্রহীতারা।

এমনও ঘটেছে যে, একজন ইচ্ছুক চার্টার্ড অ্যাক্যাউন্টেন্ট শুক্রাণু গ্রহীতা নাকি কেবল তাঁর সমপেশার দাতারই শুক্রাণু খুঁজে বেড়াচ্ছেন। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, তাঁর বদ্ধমূল ধারণা তাঁর সন্তানও ভবিষ্যতে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টই হবে। আসলে জিনের মধ্যে যে প্রফেশনের কোনও দলিল লেখা থাকে না, যা ‍উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁদের সন্তানেও তা বর্তাবে সেই ব্যাপারে অজ্ঞতাই তাঁদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে।

তবে ডিম্বাণুর ক্ষেত্রে মেয়েদের সৌন্দর্যই যেন একমাত্র মাপকাঠি। ইচ্ছুক গ্রহীতারা ভাবছেন সুন্দরী মেয়ের কাছ থেকে পাওয়া ডিম্বাণুর জিন'এ নিশ্চয়ই সৌন্দর্যের বারতা লেখা থাকবে, যার দৌলতে সন্তানও হবে সুন্দর।
হায় হায়, মেধাবী সন্তান জন্মের জন্য নারীর তবে কোনও অবদান নেই? নারী মানেই তবে মেধাহীন বা কম মেধার মানুষ? আর যত মেধার সত্ত্ব লুকিয়ে থাকে ওই পুরুষেরই জিন'এ? আমার মনে হচ্ছে এই 'কু'-বিশ্বাসের পরম্পরা আমাদের সমাজে এতটাই দৃঢ়মূল যে, সেই কারণেই গোটা উপমহাদেশে এই 'উচ্চ শিক্ষিত'-এর শুক্রাণুর চাহিদা হু হু করে বেড়ে চলেছে।

অবশ্য এও বোঝা যাচ্ছে যে, চাহিদা অনুযায়ী জোগান কম, বিশেষ করে ওই '‍উচ্চ শিক্ষিত'র। তাই আমেরিকা ও অন্যান্য দেশের মতো ভারতে-বাংলাদেশেও এর চাহিদা বা বাজার এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, শুক্রাণুর দামও লাগামছাড়া ভাবে বাড়ছে। দেশের প্রায় সমস্ত ফারটিলিটি ক্লিনিক জানাচ্ছে যে, গত ৫/৬ বছরে শুক্রাণুর দাম বেড়েছে ৫০%-১০০%। এবং সেখানে ডাক্তারি ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিগ্রিধারীদের শুক্রাণুর দাম‍ই সব থেকে বেশি। 'কম শিক্ষিত' দাতাদের কাছ থেকে যেখানে এক ভায়েল শুক্রাণু ২০০০ টাকায় মিলছে। ‍'উচ্চ শিক্ষিত'দের জন্য প্রতি ভায়েল শুক্রাণুর দাম অনায়াসে উঠে যাচ্ছে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা‍। দেখে শুনে মনে হচ্ছে বিয়ের বাজারের মতোই ‍ভারতে শুক্রাণুদাতাদের ক্ষেত্রেও ডাক্তার ‍ইঞ্জিনিয়ারের বাজার দর চড়চড়িয়ে বাড়ছে।

আসলে বাজার অর্থনীতিতে তো সবই কমোডিটি। তাই মনে হচ্ছে প্রোডাক্ট, সে সন্তান বা পোশাক যাই হোক না কেন বিনিয়োগের অর্থ যাতে সুদে আসলে উঠে আসে, বিনিয়োগকারীর সতত দৃষ্টি রয়েছে সেখানে। তাই অর্ডার দিয়ে পছন্দ অনুযায়ী জামা কাপড় বা খাবার কেনার মতোই‍ বেশি অর্থ খরচ করলেই মিলে যেতে পারে সুন্দর মেধাবী সন্তানও।
কিন্তু প্রশ্ন একটা থেকেই যাচ্ছে - এই আব্দার কি সবার মেটানো সম্ভব?

Sunday, November 18, 2018

বিবর্তন

টানা বেশ কিছুদিন সময় পেলেই হাইপোথিসিস আর আন্সল্ভড থিওরীর ভিডিও দেখতেসি। ইউটিউব এর বিশাল খনি। এক একটা টপিক নিয়ে ডিগ করতে শুরু করলে থামা যায় না। হাজার হাজার রেফারেন্স আর লাখ লাখ মিনিটের ডকুমেন্টারীতে ডুবতে ডুবতে একসময় বিশাল এক প্রশ্নবোধকের সামনে গিয়ে চিন্তা শেষ হয়।

সিভিলাইজেশান আর নলেজ নিয়ে হাজার হাজার হাইপোথিসিস এর মধ্যে খুব শক্তিশালী একটা ধারা হচ্ছে, আমাদের সভ্যতার ক্রমবিকাশে ভিন গ্রহের উন্নত প্রজাতির অবদান থাকার বিশ্বাস। মিসর, মেসোপটেমিয়া, সুমেরিয়ান সভ্যতা, ব্যাবিলন এই সব বিলুপ্ত সভ্যতার যা কিছু প্রাপ্ত উপাদান, নিদর্শন আছে, সেসবের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে নানা মূণি  নানা মতে হেটে এসে একটা কমন ধারনায় ঠেকে যায়, যে, এইসব সভ্যতায় উন্নত বিজ্ঞান এর সমন্বয় ঘটায়ে দেয়ার ক্ষেত্রে তারার সন্তান ( ভিন্ন সৌরজগত থেকে আসা উন্নত প্রজাতি) দের অবদান স্পষ্ট। বিশেষ করে জ্যোতির্বিদ্যার বিকাশ হবার মত যথেষ্ট সুযোগ বা প্রয়োজন না থাকার সময়ে আকাশে দেখা তারার অবস্থান, হিসাব, গুরুত্ব মাথায় রেখে নক্ষত্রমন্ডলী চিহ্নিত করার কাজটার আর কোনো ব্যাখ্যা নাই। 
কেইভ পেইন্টিং এর সময়ে মানুষের জীবন কেমন ছিল, এমন একটা প্রাথমিক ধারণা আমরা স্কুলের বইতেই পেয়ে আসছি। গুহাবাসী মানব বললেই আমাদের চোখে ভাসে, স্কুলের পরিবেশ পরিচিতি সমাজ বই এর ইলাস্ট্রেশান। গায়ে বড় বড় লোমওয়ালা, কিছুটা গরিলা সদৃশ চেহারার মানব মূর্তি। যারা মাত্র খড় কুটা থেকে আগুন জ্বালানো শিখেছে।মূলত জীবন যাপন করার চেয়ে, জীবন ধারণ করার প্রতিদিনের পরীক্ষাই তাদের নিত্যভ্যাস। খেতে হবে তাই শিকার করা, মাথা গোজার জন্য গুহা খুজে বের করা, শিকারের সুবিধার জন্য পাথর, হাড়, গাছের ডাল দিয়ে অস্ত্র বানানো, আগুন জ্বালানো, সেই আগুনে খাবার পুড়িয়ে খাওয়া। এই সব প্রাথমিক ধারার বাইরে তাদের কোন প্রযুক্তি বা বিজ্ঞান চর্চা ছিল এমন কথা কেউ কখনো ভাবেনা।গুহাবাসী সেই মানুষরা বহু ঝক্কি ঝামেলা করে বল্লম টল্লম দিয়ে একটা বাইসন বা এল্ক মেরে সেটার আধপোড়া মাংস চাবাতে চাবাতে আকাশের দিকে তাকায়ে হুদাকামে জোতির্বিদ্যা চর্চা শুরু করার কথা না। সেই সময় জ্ঞান বা প্রযুক্তি চর্চাই করা হত যেটা দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারিক প্রয়োগ করা সম্ভব। সেই গুহাবাসী মানবেরা ৩০ -৪০ হাজার বছর টেকসই হবার মত করে রং ব্যবহার করে আঁকা ছবিতে নক্ষত্রমন্ডলির স্পষ্ট উপস্থাপনকে কাকতালীয় মনে হতেই পারে। গ্রেট বিয়ার, দ্যা বুল বা ওরাইয়নের মত নক্ষত্রমন্ডলিকে হাজার বছরের ব্যবধানে নানা সভ্যতায় বার বার উপস্থাপন করার বিষয়টা আসলেই ভাববার মত। ঘোড়া না চিনেই, গোল চাকা ব্যাবহার করে পরিবহন সুবিধা বুঝে উঠার আগেই মিসরীয় সভ্যতায় নিখুত জোতির্বিদ্যা, বিশাল পিরামিড বানায়ে ফেলা বা অদ্ভুত সব ধর্মাচার এর পেছনে কি কারণ হতে পারে ? ব্যাখ্যা নাই কোনো। সব প্রাচীন সভ্যতায় দেখা যায়, মানুষ দৈনন্দিন জীবনের উপযোগীতার বাইরেও হঠাত হঠাত অদ্ভুত কিছু প্রযুক্তি আর জ্ঞান নিয়ে মাথা ঘামায়ে হাজার হাজার বছর ব্যস্ত ছিল। মায়ান সভ্যতায় খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার বিজ্ঞান নিয়ে অগ্রগতি হবার আগে জ্যোতির্বিজ্ঞানে হাত পাকায়ে ফেলাটা খুব একটা মনে খটকা লাগার মত জিনিস না ? কেন ? বার বার, হাজার হাজার বছর ব্যবধানে মানুষ আকাশ, জ্যোতিষ্ক, তারা আর ব্যাখ্যাতীত ক্ষেত্রে প্রযুক্তির প্রয়োগে কেন ব্যস্ত ছিল ? কিসের টানে ? 
যাইহোক, আমরা মানুষরা অন্য নক্ষত্রের উন্নতজীবদের হাত ধরে এই পৃথিবীতে আসছি, নাকি আমরা হাফ বানর টাইপ জীব হয়ে বনে বাদারে ঘোরাঘুরি করার সময় সসার দিয়ে নেমে আসা এলিয়েনরা আমাদেরকে কিছু অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আর জ্ঞান দিয়ে এক লাফে কয়েক মিলেনিয়াম আগায়ে দিয়ে রেখে চলে গেছে, এসবের কোন মিমাংসা নাই। হাজার হাজার ধরনের হাইপোথিসিস আছে। 
তবে একটা ভাবে চিন্তা করলে আগে কি হয়েছে জানার উপায় যেমন নাই, সামনে কি হবে, সেটা কল্পনা করতে গেলেও কিন্তু সমীকরণটা একটা চক্রে এসেই ঠেকে যাবে। 
মানুষের সভ্যতা গত ৩০ হাজার বছরে যতটুকু গড়ে উঠসে, তার শেষ দুই হাজার বছরের প্রামাণ্য দলিল আছে, সভ্যতা আর আর তার সাথে হাত ধরে আগানো জ্ঞান এর চর্চা, আবিষ্কার আর প্রযুক্তিগত প্রয়োগ এর ক্রমবিকাশ খুব সুন্দর করে চোখের সামনে আছে আমাদের। 
শেষ ২০০ বছরে এই অগ্রগতির এমন গতিশীল হল, জ্ঞান এমন পৌনপুণীক ভাবে বিকশিত হল, প্রযুক্তি আর উতকর্ষ এমন জোরালো হল যে আগের সব কিছুকে এক পলকে লং লস্ট মনে হয়। শেষ দুই শতাব্দীর আবিষ্কার বিগত ৩০ হাজার বছরের মোট আবিষ্কারের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। 
মানুষ আগুনের মত প্রাথমিক শক্তিকে আকড়ে ধরে কত শত বা হাজার বছর টিকে থাকার সংগ্রাম করতে হয়েছে সেই অংকটা এক কথায় কেউ দিতে পারবে না। 
কিন্তু এখন,  মানুষ শক্তির কতরকম বিকল্প আর কত রকমের উপযোগীতা বের করে প্রতিনিয়ত আগায়ে যাচ্ছে সেটা দেখে কল্পনা করতেও কষ্ট হয়, আদী মানবের টানা ১০ প্রজন্ম হয়ত আগুনের দিকেই তাকায়ে তাকায়ে জিন্দেগী পার করে ফেলসে।
আর আমাদের সময়ে এসে আমাদের আগের ৫ম পুরুষ ঘোড়া, গরুর গাড়ি চড়তো, তার পরের পুরুষ স্টিম ইঞ্জিনের স্টিমারে।তার পরের প্রজন্ম জ্বালানীতেলের পরিবহনে, এখন গুটিগুটি পায়ে ইলেক্ট্রিক এনার্জির উপর নির্ভরতা আগাচ্ছে, নিউক্লিয়ার এনার্জী হাতে আছে, প্রয়োগের উপযোগীতা নিয়ে নিরন্তর গবেষণা চলতেসে। 
গত ২০ বছরে প্রযুক্তি যে গতিতে বিবর্তিত হয়ে নতুন নতুন সম্ভাবনা খুলে দিচ্ছে, এখন, খুব কঠিন এটা বলা বা ভাবা, যে আগামী ১০ বছর পর আমাদের একেক্টা দিন কেমন হবে, কিভাবে কাটবে, আমরা কি খাব, কিভাবে খাব, কি করবো, কিভাবে করবো, আমাদের চিন্তা কি হবে? 
মানুষ গত ৩০ হাজার বছরে জ্ঞান এর বিকাশ করে জীবনযাত্রায় আমূল বিবর্তন এনে ফেলসে। যদিও দৈহিকভাবে আমরা দৃশ্যমান বিবর্তনের চিহ্ন খুব বেশি দেখিনা। এই ৩০ হাজার বছরের বিকশিত জ্ঞানের উপর ধারণা রেখেই আমরা এখন বুঝি, এই গ্রহে আমরাই প্রভু। আমাদের জ্ঞান আমাদেরকে বাকি সব প্রজাতির উপর শ্রেষ্ঠত্ব এনে দিসে। নবজাতক শিশু ১ বছর পার করার পর দাঁত উঠতে শুরু করলে যত্র তত্র কামড়ায়। নিজের হাত পায়ের আঙ্গুল কামড়ায়। এটাকে বলে টিদিং প্রবলেম। সভত্যার বিচারেও মানবজাতি টিদিং প্রবলেমে আছে। তাই প্রযুক্তি আর উতকর্ষের প্রাথমিক প্রয়োগ হচ্ছে নিজের প্রজাতির মধ্যে নিজের শক্তি সামর্থ্য প্রদর্শন। মানবজাতি নানা ভাগে ভাগ হয়ে ভুখন্ডের সীমারেখা টেনে বিভাজিত স্বত্বা একে অন্যের উপর শ্রেষ্ঠত্বের হুমকী দিচ্ছে। 
ডায়নোসর কোনো রকম জ্ঞান বা প্রযুক্তির বিকাশ ছাড়াই শুধুমাত্র দৈহিক সামর্থ্যের উপর ভর করে পৃথিবীতে টিকেছিল ১৬৫ মিলিয়ন বছর। মানুষের বয়স টেনে টুনে ৬০ হাজার বছর হবে কিনা তাও সন্দেহ। আর এই ২০১৮ তে দাড়ায়ে কেউ যদি একবার ভাবে ২ লাখ বছর পর মানব সভ্যতা আসলে কেমন হতে পারে, তাহলে কি মনে হয় ? 
অলরেডি, মানুষ যেটুকু জ্ঞান রপ্ত করে ফেলসে, যেভাবে একজন সাধারণ মানুষের নিত্যদিন কাটে, তা যদি ৪০০ বছর আগের একটা মানুষকে বলা হত, তাহলে সে পাগল বলে উড়ায়ে দিত। 
এমনটা ভাবা কি খুব দোষের হবে? যদি বলা হয় জ্ঞান ও প্রযুক্তির এই পৌনপূনিক অগ্রগতি একময় মানব জাতিকে নিজেদের ভেতর গুতাগুতি বাদ দিয়ে সামগ্রিকভাবে আরো বড় শ্রেষ্ঠত্বের দিকে আগ্রহী করবে। 
পদার্থ, রসায়ন, গনিত, প্রকৌশল, চিকিতশা, এইসব বিজ্ঞান ধারায় আগামী ১০ , ২০ বা ৫০ হাজার বছরে কি পরিমান অগ্রগতি হতে পারে কারো কোনো ধারণা আছে ? আজ থেকে ৫০ হাজার বছর পর মিলিয়ন মিলিয়ন লাইট ইয়ার দূরত্বের কোনো গ্রহে মানবজাতি নিজেদের বিস্তৃত করবেনা, এই কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। 
মানুষের হাতে বর্তমান শক্তি যা আছে সেসবের চেয়ে বহুগুণ উন্নত নবায়নযোগ্য শক্তি আসবেনা, বলার উপায় নাই। নভোবিজ্ঞান উন্নত হয়ে শুধু দুরত্ব অতিক্রম করার পরিবহনে আটকে না থেকে সময় আর দুরত্ব সমান ভাবে ট্র্যাভেল করার ক্ষমতা আসবেনা, তাও বলা যায় না। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং উন্নত হয়ে, মানুষ নিজেই নতুন নতুন জীব উতপাদনে হাত দিবে এমন ও হতে পারে। খুব অল্প কথায় বললাম, আমি বিজ্ঞানের লোক না। হাইপোথিসিস দেখতে দেখতে আমারো সামান্য কল্পনাবিলাসী হতে ইচ্ছা হল শুধু
আমার মনে হয় এখন থেকে ৫০ হাজার বছর পর মানুষ মিলিয়ন মিলিয়ন লাইট ইয়ার দুরত্বের কোনো নক্ষত্রের পাশে কোনো গ্রহে গিয়ে যদি দেখে, আদর্শ আবহাওয়ায় সেখানেও মানব সদৃশ কোনো প্রজাতি মাত্র বিকশিত হয়ে নিজেকে টিকায়ে রাখার জন্য প্রাথমিক জ্ঞান আহরণ করছে। মাত্র আগুন টাগুন জ্বালানো শিখছে, তাদের সামনে পকেট থেকে ছোট্ট পারমানবিক পিস্তল দিয়ে গুলি করে একটা পাহাড় উড়ায়ে দিলে, অথবা খুব প্রাথমিক ভাইরাল ডিজিজে আক্রান্ত কাউকে হাইপার এন্টিবায়োটিক দিয়ে সুস্থ করে দিয়ে, প্রাথমিক কিছু জ্ঞান তাদেরকে শিখিয়ে দিয়ে চলে আসলে, সেই গ্রহের সেই প্রজাতিও গরুর হাড্ডী চাবাইতে চাবাইতে পাথরে খোদাই করে মিল্কি ওয়ে গ্যালেক্সীর সান এর পাশের ৩ নাম্বার গ্রহ থেকে যাওয়া উন্নত প্রজাতিকে নিজের স্রষ্ঠা বা প্রভু ভেবে উপাসনা করার চিন্তা করতেই পারে। অভাবনীয় জ্ঞানের বিকাশ সমৃদ্ধ একটা প্রজাতি, আপাত অনুন্নতদের চোখে প্রভুত্ব অর্জন করে নেয় সেটা তো আমরা জানিই। 
আমরা পোষা কুকুর, বিড়াল এর প্রভু হই। 
কুকুর বা বিড়াল মানুষ পুষতে পারে না। এই নিয়ম কেউ করে দেয় নাই। বিজ্ঞান আর চিন্তাই এই সীমা নির্ধারণ করে দিসে। যদি কোনো বিড়াল কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বড় কোন পরিবর্তন করার ক্ষমতা পেতো, তাহলে সে কুকুর পুষতে পারতো, এমনকি মানুষও পুষতে পারতো হয়তো।
যদি বর্তমান জ্ঞান এর উপর আস্থা রেখে বলা যায় ১০ ২০ হাজার বছর পর আমরা আসলে বর্তমান অবস্থার চেয়ে অকল্পনীয় মাত্রায় উন্নত বিজ্ঞানআশ্রয়ী একটা প্রজাতী হব। তাহলে মানব জাতীর চেয়ে মাত্র ১ লাখ বছর আগে জ্ঞান বিকশিত হওয়া একটা প্রজাতিকে ১০ হাজার বছর আগে দেখতে পেলে তাকে স্রষ্ঠা বা প্রভু ভেবে ফেলায় তো কোন হিসাবের ভুল নাই। 
১ হাজার বছর আগেও মানব জাতি ভাবতো পৃথিবী হচ্ছে সমান। গোল ভাবার মত জ্ঞান তখন ছিলনা। 
৫০০ বছর আগে মানুষ ভাবতো পৃথিবী স্থির, সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিন করে। গ্যালিলিও সে ধারনায় পানি ঢেলে দেয়। 
বর্তমান মানুষ জানে আমাদের জগত ত্রিমাত্রিক। সময়কে নিয়ন্ত্রন করার ক্ষমতা মানুষের নাই। 
১০০০ বছর পর মানুষ কি ভাববে আমরা জানি ? 
হয়ত চতুর্মাত্রিক বিজ্ঞানের জগতে থাকা কেউ আজকের আমাদের কথা হয়ত ভাববে এভাবে, ২০০০ সালে মানুষ কি বোকা ছিল !!! ফসিল ফুয়েলের ইঞ্জিন ইউজ করে মাটিতে সারি বেধে চলতো, আর পথ না পেলে পোঁ পোঁ করে হর্ন বাজাতো। হা হা হা 
আকাশ থেকে নেমে আসা প্রভুর কথা নানা সভ্যতায় নানা ভাবে বলা আছে। ধর্মেও প্রভুর অবস্থান আকাশে। প্রভুর সান্নিধ্যে স্বর্গ। তার অবস্থান ও নক্ষত্রের মত আকাশে। নিজের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাবান কাউকে প্রভু ভেবে এই এত হাজার বছর পার করা মানব জাতি হয়ত কোনো এক সময়ে অন্য কোন এক প্রজাতির চোখে প্রভুত্ব অর্জন করে নিবে।