অনেকদিন পর একটা ছবি দেখলাম।হিন্দি ছবি। ‘হাইওয়ে’।পুরো ছবিটা দেখে
কিছুক্ষণ আমি বুদ হয়ে ছিলাম।আর ছবির বিষয়টা আমার মাথায় কুট কুট করে
যন্ত্রণা দিচ্ছিল বেশ কয়েকদিন। ছবির নায়িকা আলিয়া ভাট অভিনয়ও করেছে
দুর্দান্ত।নিজের ঘরের ভেতর বাবার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর হাতে দিনের পর দিন
যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছিল মেয়েটা। একদিন নিজের মাকে বিষয়টা জানানোর পর
মা বলেছিল, চুপ, চুপ কাউকে কিছু বলো না।মেয়েটার বিশ্বাস ভেঙ্গে যায়।কষ্ট
হয়। কিডন্যাপাররা যখন মেয়েটাকে কিডন্যাপ করে কিছুদিন পর ছেড়ে দিতে চায় ,
মেয়েটা যেতে চায় না। কিডন্যাপারকে বলে, যে জীবনটা সে ফেলে এসেছে সে জীবনে
সে আর কখনো ফিরে যেতে চায় না। মহাবীর নামক সেই কিডন্যাপারকে তার অনেক বেশি
বিশ্বস্ত এবং নির্ভরযোগ্য মনে হয়েছে যে, যখন তার প্রভাবশালী বাবা তাকে
উদ্ধারের ব্যবস্থা করে সে ফিরে যেতে চায় না নিজের বাবা- মায়ের কাছে। কারণ
তাদের কাছে তাদের সোশ্যাল স্ট্যাটাস তাদের কন্যার মরন যন্ত্রণা’র(যৌন
নির্যাতনের কারণে) চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।ছবির একটা অংশে আলিয়া ভাট তার
বাবাকে বলে, তোমরা বলেছিলে বাইরে অনেক সমস্যা,বাইরের পৃথিবীটা নিরাপদ না,
কিন্তু তোমরা তো একবার ও বলোনি ঘরের ভেতরও আমরা নিরাপদ না।কেন বলোনি, ঘরের
ভেতরেও আমরা নিরাপদ না?
এরও অনেক আগে ইন্ডিয়াতে আমির খানের ‘সত্যমাভে জয়’ নামে একটা অনুষ্ঠানের
একটা পর্ব সাজানো হয়েছিল সেসব ছেলে-মেয়েকে নিয়ে যারা শৈশব-কৈশোরের বিভিন্ন
সময়ে অত্যন্ত নিকট আত্মীয়ের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। সে অনুষ্ঠান
দেখে সেই ছেলে-মেয়েগুলোর শারীরিক ভাবে নির্যাতিত হওয়ার সময় এবং তার আগে
পরে তাদের যে ভয়াবহ মানসিক যন্ত্রণার মুহূর্ত কেটেছে এবং এখনো কাটছে সে
বর্ণণা শুনে চোখের পানি ফেলে নি এমন একটা মানুষ ছিল না। সেই ছেলে-মেয়েগুলো
এখন যথেষ্ট বড় হওয়া স্বত্ত্বেও স্বাভাবিক জীবন যাপন করার কথা ভাবতে পারে
না। প্রতিটা মুহূর্ত তাদের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়। সেই অনুষ্ঠানে সেই
ছেলে মেয়েগুলোর বাবা-মা সহ অভিভাবকেরা উপস্থিত ছিল।
উপস্থাপক আমির খান অভিভাবকদের মতামত জানতে চাইলে , অভিভাবকেরা প্রায়
সবাই স্বীকার করেছে,ভুল তাদের ছিল। তারা ঘরের ভেতর তাদের সন্তানদের
নিরাপত্তা দিতে পারে নি। এবং তাদের সন্তানরা কেউ কেউ যখন তাদের কাছে এই
বিষয়গুলো বলতে চেয়েছে, তখন তারা গুরুত্ব দেয়নি। নিজের সন্তানের কথাকে
বিশ্বাস করে নি। নিজের সন্তানের কঠিন বিপর্যয়ের সময় তারা তাদের যন্ত্রণা
লাঘব করতে পারেনি। তাই এখনকার বাবা-মায়ের প্রতি তারা অনুরোধ করেছেন নিজের
সন্তানকে বোঝার জন্য। সন্তানের কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনার জন্য। তাদের সমস্যায়
তাদের পাশে থাকার জন্য।
সেই অনুষ্ঠানেই আমির খান বেশ কিছু ছোট ছোট বাচ্চাকে এনে স্বল্প পরিসরে
একটা প্রশিক্ষণের মতো দেখালেন যে, নিজের বাচ্চাকে নিজের একান্ত বিশ্বস্ত
এবং আপনজন ছাড়া বাইরের কারো কোলে না দিতে, বাইরের কারো সাথে একা না রাখতে।
আর বাচ্চাদের শেখালেন তাদের সেনসিটিভ অঙ্গগুলোতে কেউ হাত দিতে চাইলে, বা
আদর করতে চাইলে তারা যেন দ্রুত সরে যায়, আর সরে যেতে না পারলে জোরে জোরে
চিৎকার করে বাবা-মাকে ডাকে। একটা চমৎকার ব্যাপার হলো সেই অনুষ্ঠানে যতগুলো
বাচ্চা এসেছিল তাদেরকে যখন আমির খান জিজ্ঞেস করল, তাদের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু
কিংবা সবচেয়ে আস্থার মানুষটি কে? প্রায় সবগুলো বাচ্চাই(ছেলে-মেয়ে সব)এক
বাক্যে বলেছে,বাবা।
যদি আমার ভুল না হয়ে থাকে হুমায়ূন আহমেদের ‘নিরন্তর’ উপন্যাস নিয়ে
‘নিরন্তর’ নামে চলচ্চিত্র বানিয়েছিলেন আবু সাইয়ীদ।সেখানে খুব সম্ভবত শাবনুর
অভিনয় করেছিল। শাবনুরের ছোট বেলার চরিত্রে একটা অংশ ছিল বাবার বন্ধু থেকে
টাকা ধার আনতে যাওয়া। অপদার্থ বাবার সন্তান হয়ে বাবার বন্ধুর কাছ থেকে
কিশোরী মেয়েটি যখন বাবার চিঠি নিয়ে টাকা ধার আনতে যায়, সেই বন্ধু মেয়েটির
উপর আদরের নামে যে বিকৃত এবং পাশবিক আচরণ করে এত বছর পর এই লেখাটা লিখতে
গিয়ে সে কথা মনে পড়ে আমার গা টা শির শির করে উঠেছে।
এখন অনেক রাত। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। বাইরে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে।আমার বোনের মেয়েটি আমার বুকের সাথে লেগে ঘুমাচ্ছে। আমায় পেলে তার সারাটি দিনের আনন্দই আমায় জুড়ে। কন্যার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার চোখ দুইটা
ভিজে উঠে। এই কঠিন পৃথিবীতে নিরাপদে,নির্ভয়ে, আনন্দ নিয়ে বড় হতে পারবে তো
আমাদের শিশুরা!!!বিশেষ করে আমাদের কন্যা শিশুরা। আমরা তাদের জন্য একটা
বিশ্বস্ত পৃথিবী গড়তে পারব তো!!! যে পৃথিবীতে তারা ছোট্ট পরীর মতো বেনী
দুলিয়ে হাসবে, খেলবে, গান করবে, আর এভাবেই একদিন বড় হয়ে যাবে।
আমরা যেন যে কোনো অবস্থাতেই আমাদের সন্তানকে গুরুত্ব দেই,তাদের কথা বিশ্বাস
করি, তার আচরণে সামান্যতম অস্বাভাবিকতা যেন আমাদের চোখ না এড়ায়, সে কোনো
বিষয় নিয়ে কষ্ট পাচ্ছে, অথচ আমাদেরকে বলতে পারছে না, এতটা আস্থাহীন অভিভাবক
যেন আমাদেরকে কোনোদিন না হতে হয় আমি শুধু এই কামনা করি। কারণ এত ভালোবাসার
যে সন্তান সে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে মানসিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে
,অথচ তার বাবা-মা জানতেও পারছে না , কিংবা জানলেও সেটা গুরুত্ব দিচ্ছে না
অথবা গুরুত্ব দিতে চাচ্ছে না এমন বাবা-মায়েরা সন্তানদের সুখী মানুষ হিসেবে
দেখতে চাওয়ার আশা করাটাও অপরাধের পর্যায়ে পড়ে যায়।
বৃষ্টি ক্রমশ বাড়ছে। আমার অস্থিরতাও কেন জানি বাড়ছে। ভয় হয়। চারপাশে এত
এত ঘটনা ঘটছে যে ভয় না পেয়ে উপায় নেই। আমরা শুধু বাইরের নিরাপত্তাহীনতার
কথা বলি, কিন্তু ঘরের ভেতরে কি আমাদের সন্তানেরা পুরোপুরি নিরাপদ সে কথা
ক’জন ভাবি।অথচ ভাবাটা জরুরি। খুব জরুরি।
Monday, October 22, 2018
Friday, October 19, 2018
ধর্মীয় অনুষ্টানে নাস্তিকদের কি যাওয়া উচিত?
বাংলাদেশের মত একটা রক্ষণশীল দেশে যেখানে সমাজ একজন ব্যক্তির জীবনে খুব গুরূত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, সেখানে একজন নাস্তিকের পক্ষে সমাজের বাকি দশ জনের সাথে মিলিয়ে চলা মাঝে মাঝে বেশ কষ্টকরই হয়ে পড়ে। এখানে ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তো নেইই, বরং আছে ভিন্ন মতাবলম্বীদের প্রতি অসহনীয় মানসিক নির্যাতন, কখনো কখনো যা আবার শারীরিক পর্যায় পর্যন্ত চলে যায়! নাস্তিকরা এখনো এখানে প্রকাশ্যে তাদের বিশ্বাসের কথা বলতে পারে না (ব্যতিক্রম আছে বইকি), ঈশ্বরে বিশ্বাস না করা সত্ত্বেও তাদেরকে অনেকসময় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে অংশ নিতে হয়।
এখানেই একটা বড় প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় আমাদেরকে, নাস্তিকদের পক্ষে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত? অথবা, যে নাস্তিক ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে অংশ নেয়, তাকে কি আমরা আদৌ নাস্তিক বলতে পারি?
সংকীর্ণভাবে চিন্তা করতে গেলে, যেহেতু নাস্তিকতা মানে ‘স্রষ্টায় অবিশ্বাস’, সেহেতু কোন ব্যক্তি ধর্মীয় কোন অনুষ্ঠানে অংশ নিলে তত্ত্বগতভাবেই তাকে ‘নাস্তিক’ বলা ঠিক হবে না। যে ব্যক্তি ‘স্রষ্টা’য় অবিশ্বাস করছে, সে আবার কিভাবে সেই ‘স্রষ্টা’রই আরাধনা করছে? – এই পরস্পরবিরোধীতার কারণেই আমাদের সমাজের গুটিকয়েক নাস্তিকদের এক বিশাল অংশকেই আর ‘নাস্তিক’ বলা যাবে না। কিন্তু, বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিলে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম হয়ে যায়। আমি একটা ব্যক্তিগত উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা পরিষ্কার করছি।
দুই বছর আগের কথা। তখন আমি পুরোদস্তুর নাস্তিক। আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও ব্যাপারটা জানা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তারপরও তারা (বিশেষ করে আমার মা) ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে অংশ নিতে পীড়াপীড়ি করত। আমি স্বভাবতই রাজি হতাম না, কিন্তু রাজি না হওয়ার মানে হচ্ছে একপ্রকার লঙ্কাকান্ড হয়ে যাওয়া (এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, আমার পরিবার বেশ রক্ষণশীল)! তাই কখনো তাদের রোষানল থেকে বাঁচার জন্য, কখনো বা তাদের মনে কষ্ট না দেওয়ার জন্য, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে প্রায়ই অংশ নিতাম। তত্ত্বগতভাবে, তখন আমি নাস্তিক ছিলাম না!
আমি কিন্তু মনে করি তখনও আমি নাস্তিকই ছিলাম। নাস্তিকতা বলতে আমি বিশ্বাসগত ব্যাপারটাকেই (স্রষ্টায় অবিশ্বাস) বুঝি, আচরণগত ব্যাপারটাকে আমার কাছে গৌণই মনে হয়। একজন ব্যক্তিকে, আমার মতে, আমরা তখনই ‘নাস্তিক’ বলব যখন তার মধ্যে ‘স্রষ্টায় বিশ্বাস’ ব্যাপারটা অনুপস্থিত থাকবে; সে যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে বা দুবেলা পূজা-আহ্নিক করে তারপরও সে বিশ্বাসী হয়ে যাবে না!
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে একজন বিশ্বাসীর সাথে একজন নাস্তিকের পার্থক্য আর থাকল কোথায়? পার্থক্য আছে ঠিকই, তবে এই পার্থক্য তাদের আচরণে নয়, পার্থক্য তাদের আচরণের পেছনের কারণে। একজন বিশ্বাসী নামাজ পড়ে কারণ সে বিশ্বাসকরে নামাজ পড়লে তার জান্নাতপ্রাপ্তির সম্ভাবনা বর্ধিত হবে; অন্যদিকে একজন নাস্তিক কখনোই জান্নাতপ্রাপ্তির সম্ভাবনায় নামাজ পড়বে না, তার কারণটা হবে সামাজিক।
এখন, একজন নাস্তিকের পক্ষে নামাজ পড়া অথবা পূজা দেওয়া কতটুকু যৌক্তিক- এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য আমাদের আলোচনাকে একটু ভিন্নদিকে সরিয়ে নিতে হবে। এখনও পর্যন্ত অন্তত বাঙলাদেশের নাস্তিকরা সমাজের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে আসছে, তাদের বেশির ভাগই নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বে হলেও ধর্মীয় কার্যকলাপে অংশ নিচ্ছে।এটা কিন্তু মোটের উপর নাস্তিকদের অবস্থার উন্নতি করছে না, বরং তাদেরকে আরো দীর্ঘকালের জন্য পর্দার আড়ালে রেখে দিতেই সাহায্য করছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, নাস্তিকদের উচিত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলো পুরোপুরি বর্জন করা, সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে হলেও। যেকোন নতুন ধারণা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে প্রচুর সময় নেয়, কিন্তু সেই নতুন ধারণার ধারকেরাই যদি ‘সামাজিক’ হয়ে ওঠে, তাহলে সেই ধারণা অন্তত নিকট ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠা হওয়ার সম্ভাবনা হারায়। ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো বর্জন করার পাশাপাশি আমাদের উচিত নিজেদের মধ্যে বন্ধন সুদৃঢ় করা, যাতে আমরা পুরোপুরি ‘অসামাজিক’ না হয়ে উঠি!
তাহলে কি আমরা ঈদ বা পূজার মত সার্ব্বজনীন হয়ে ওঠা উৎসবগুলোকেও পুরোপুরি বর্জন করব? এখানে আবার আমি একটু দ্বিমত পোষণ করি। ঈদ-উল-ফিতর কিংবা শারদীয় দুর্গোৎসবকে আমি শুধু ধর্মীয় নয়, বরং সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবেও দেখি। ছোটবেলা থেকেই এই দুটো উৎসবেই আমি ইচ্ছেমত মজা করে এসেছি, আমি চাইনা আমি আমার আদর্শের জন্য এইসব মজা থেকে বঞ্চিত হই!
আমার বক্তব্যগুলোকে পরস্পরবিরোধী বলে মনে হতে পারে। ব্যাপারটা পরিষ্কার করছি।
আমি ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের (rituals) বিরোধিতা করলেও অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ধর্মীয় উৎসবের (festivals) বিপক্ষে নই। পহেলা বৈশাখ একসময় পুরোপুরি ধর্মীয় একটা ব্যাপার ছিল, কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন এর সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ব্যাপারটাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। আমরা দুই দিনে সবাইকে অবিশ্বাসী করে ফেলতে পারব না, কিন্তু চেষ্টা করলে যেকোন মানুষ কিছুদিনের মধ্যেই অসাম্প্রদায়িক হয়ে উঠতে পারে। অসাম্প্রদায়িকতা একসময় মানুষকে অবিশ্বাসের দিকেই নিয়ে যাবে, আর আমি মনে করি ঈদ-উল-ফিতর বা শারদীয় দুর্গোৎসবের মত উৎসবগুলো আমাদেরকে জাতিহিসেবে ক্রমশঃ অসাম্প্রদায়িকতার পথেই নিয়ে যাচ্ছে।
তবে, সব কথার শেষ কথা, নাস্তিকরা স্বাধীন। প্রত্যেক নাস্তিক, আমার বিশ্বাস, স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারে; তাই নাস্তিকদেরকে কোন বাঁধা গন্ডির মধ্যে আটকে ফেলা যাবে না। আমরা বড়জোর বলতে পারি, নাস্তিকদের এটা করা উচিত কিংবা ওটা করা উচিত না; কিন্তু কখনোই ‘তুমি নামাজ পড়, তুমি তো নাস্তিক নও’- এরকম কিছু বলতে পারিনা। নাস্তিক হতে হলে অন্য কোন যোগ্যতাই লাগে না, কেবল ঈশ্বরে অবিশ্বাসী হলেই চলে।তাই যদি কোন আনন্দ অনুষ্টানে কারো ক্ষতি না হয় অথবা সুপারস্টেশনকে ফোর্স করা না হয় তবে সেই আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা বোকামী।
(এই লেখাটার অনুপ্রেরণাটা এসেছে ফেইসবুকে “অ্যাথিয়েস্ট বাংলাদেশ” গ্রুপে অন্যান্য কিছু নাস্তিকদের সাথে আলোচনার ফলস্বরূপ। আজও কিছু মুক্তমনাদের কাজে লাগবে।)
(অক্টোবর ১৬, ২০১০ মুক্তমনা ব্লগে প্রকাশিত)
এখানেই একটা বড় প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় আমাদেরকে, নাস্তিকদের পক্ষে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত? অথবা, যে নাস্তিক ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে অংশ নেয়, তাকে কি আমরা আদৌ নাস্তিক বলতে পারি?
সংকীর্ণভাবে চিন্তা করতে গেলে, যেহেতু নাস্তিকতা মানে ‘স্রষ্টায় অবিশ্বাস’, সেহেতু কোন ব্যক্তি ধর্মীয় কোন অনুষ্ঠানে অংশ নিলে তত্ত্বগতভাবেই তাকে ‘নাস্তিক’ বলা ঠিক হবে না। যে ব্যক্তি ‘স্রষ্টা’য় অবিশ্বাস করছে, সে আবার কিভাবে সেই ‘স্রষ্টা’রই আরাধনা করছে? – এই পরস্পরবিরোধীতার কারণেই আমাদের সমাজের গুটিকয়েক নাস্তিকদের এক বিশাল অংশকেই আর ‘নাস্তিক’ বলা যাবে না। কিন্তু, বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিলে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম হয়ে যায়। আমি একটা ব্যক্তিগত উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা পরিষ্কার করছি।
দুই বছর আগের কথা। তখন আমি পুরোদস্তুর নাস্তিক। আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও ব্যাপারটা জানা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তারপরও তারা (বিশেষ করে আমার মা) ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে অংশ নিতে পীড়াপীড়ি করত। আমি স্বভাবতই রাজি হতাম না, কিন্তু রাজি না হওয়ার মানে হচ্ছে একপ্রকার লঙ্কাকান্ড হয়ে যাওয়া (এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, আমার পরিবার বেশ রক্ষণশীল)! তাই কখনো তাদের রোষানল থেকে বাঁচার জন্য, কখনো বা তাদের মনে কষ্ট না দেওয়ার জন্য, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে প্রায়ই অংশ নিতাম। তত্ত্বগতভাবে, তখন আমি নাস্তিক ছিলাম না!
আমি কিন্তু মনে করি তখনও আমি নাস্তিকই ছিলাম। নাস্তিকতা বলতে আমি বিশ্বাসগত ব্যাপারটাকেই (স্রষ্টায় অবিশ্বাস) বুঝি, আচরণগত ব্যাপারটাকে আমার কাছে গৌণই মনে হয়। একজন ব্যক্তিকে, আমার মতে, আমরা তখনই ‘নাস্তিক’ বলব যখন তার মধ্যে ‘স্রষ্টায় বিশ্বাস’ ব্যাপারটা অনুপস্থিত থাকবে; সে যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে বা দুবেলা পূজা-আহ্নিক করে তারপরও সে বিশ্বাসী হয়ে যাবে না!
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে একজন বিশ্বাসীর সাথে একজন নাস্তিকের পার্থক্য আর থাকল কোথায়? পার্থক্য আছে ঠিকই, তবে এই পার্থক্য তাদের আচরণে নয়, পার্থক্য তাদের আচরণের পেছনের কারণে। একজন বিশ্বাসী নামাজ পড়ে কারণ সে বিশ্বাসকরে নামাজ পড়লে তার জান্নাতপ্রাপ্তির সম্ভাবনা বর্ধিত হবে; অন্যদিকে একজন নাস্তিক কখনোই জান্নাতপ্রাপ্তির সম্ভাবনায় নামাজ পড়বে না, তার কারণটা হবে সামাজিক।
এখন, একজন নাস্তিকের পক্ষে নামাজ পড়া অথবা পূজা দেওয়া কতটুকু যৌক্তিক- এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য আমাদের আলোচনাকে একটু ভিন্নদিকে সরিয়ে নিতে হবে। এখনও পর্যন্ত অন্তত বাঙলাদেশের নাস্তিকরা সমাজের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে আসছে, তাদের বেশির ভাগই নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বে হলেও ধর্মীয় কার্যকলাপে অংশ নিচ্ছে।এটা কিন্তু মোটের উপর নাস্তিকদের অবস্থার উন্নতি করছে না, বরং তাদেরকে আরো দীর্ঘকালের জন্য পর্দার আড়ালে রেখে দিতেই সাহায্য করছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, নাস্তিকদের উচিত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলো পুরোপুরি বর্জন করা, সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে হলেও। যেকোন নতুন ধারণা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে প্রচুর সময় নেয়, কিন্তু সেই নতুন ধারণার ধারকেরাই যদি ‘সামাজিক’ হয়ে ওঠে, তাহলে সেই ধারণা অন্তত নিকট ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠা হওয়ার সম্ভাবনা হারায়। ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো বর্জন করার পাশাপাশি আমাদের উচিত নিজেদের মধ্যে বন্ধন সুদৃঢ় করা, যাতে আমরা পুরোপুরি ‘অসামাজিক’ না হয়ে উঠি!
তাহলে কি আমরা ঈদ বা পূজার মত সার্ব্বজনীন হয়ে ওঠা উৎসবগুলোকেও পুরোপুরি বর্জন করব? এখানে আবার আমি একটু দ্বিমত পোষণ করি। ঈদ-উল-ফিতর কিংবা শারদীয় দুর্গোৎসবকে আমি শুধু ধর্মীয় নয়, বরং সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবেও দেখি। ছোটবেলা থেকেই এই দুটো উৎসবেই আমি ইচ্ছেমত মজা করে এসেছি, আমি চাইনা আমি আমার আদর্শের জন্য এইসব মজা থেকে বঞ্চিত হই!
আমার বক্তব্যগুলোকে পরস্পরবিরোধী বলে মনে হতে পারে। ব্যাপারটা পরিষ্কার করছি।
আমি ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের (rituals) বিরোধিতা করলেও অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ধর্মীয় উৎসবের (festivals) বিপক্ষে নই। পহেলা বৈশাখ একসময় পুরোপুরি ধর্মীয় একটা ব্যাপার ছিল, কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন এর সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ব্যাপারটাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। আমরা দুই দিনে সবাইকে অবিশ্বাসী করে ফেলতে পারব না, কিন্তু চেষ্টা করলে যেকোন মানুষ কিছুদিনের মধ্যেই অসাম্প্রদায়িক হয়ে উঠতে পারে। অসাম্প্রদায়িকতা একসময় মানুষকে অবিশ্বাসের দিকেই নিয়ে যাবে, আর আমি মনে করি ঈদ-উল-ফিতর বা শারদীয় দুর্গোৎসবের মত উৎসবগুলো আমাদেরকে জাতিহিসেবে ক্রমশঃ অসাম্প্রদায়িকতার পথেই নিয়ে যাচ্ছে।
তবে, সব কথার শেষ কথা, নাস্তিকরা স্বাধীন। প্রত্যেক নাস্তিক, আমার বিশ্বাস, স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারে; তাই নাস্তিকদেরকে কোন বাঁধা গন্ডির মধ্যে আটকে ফেলা যাবে না। আমরা বড়জোর বলতে পারি, নাস্তিকদের এটা করা উচিত কিংবা ওটা করা উচিত না; কিন্তু কখনোই ‘তুমি নামাজ পড়, তুমি তো নাস্তিক নও’- এরকম কিছু বলতে পারিনা। নাস্তিক হতে হলে অন্য কোন যোগ্যতাই লাগে না, কেবল ঈশ্বরে অবিশ্বাসী হলেই চলে।তাই যদি কোন আনন্দ অনুষ্টানে কারো ক্ষতি না হয় অথবা সুপারস্টেশনকে ফোর্স করা না হয় তবে সেই আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা বোকামী।
(এই লেখাটার অনুপ্রেরণাটা এসেছে ফেইসবুকে “অ্যাথিয়েস্ট বাংলাদেশ” গ্রুপে অন্যান্য কিছু নাস্তিকদের সাথে আলোচনার ফলস্বরূপ। আজও কিছু মুক্তমনাদের কাজে লাগবে।)
(অক্টোবর ১৬, ২০১০ মুক্তমনা ব্লগে প্রকাশিত)
Thursday, October 18, 2018
অসুরবন্দনা
দাদু বলতেন, অসুরই মহিষের রূপ ধরেছিল। শাস্ত্রে তাই আছে। .আচ্ছা বেশ, তাহলে অসুর = মহিষ যদি হয়, তবে ওয়াই ইজিকুয়াল টু জিরো'র হিসেবে এক্স ইজিকুয়াল টু জিরো হওয়ার কথা, মানে মহিষ খতম তো অসুরও খতম! একবার মহিষটাকে কাটার পর ফের ঐ মাসলম্যান কালো লোকটা কোত্থেকে এল, তাকে ফের ত্রিশূল খুঁচিয়ে মারার দরকার পড়ল কীজন্যে?
এই বেয়াড়া বীজগাণিতিক জেরায় রেগে যেতেন দাদু। বলতেন, যা যা, ডেঁপোমি করিস নি। ইশকুলের মাস্টারমশাই আবার প্রশ্নের উত্তরে গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন, শোনো। মিথোলজির মধ্যে বাস্তব খুঁজো না। সব রূপক। ঐ যে অসুর, ও হল গিয়ে অশুভের প্রতীক। অন্ধকার, অজ্ঞানতা, পাপ, অন্যায়, অশান্তি ইনকারনেটেড। তাই কালো। আর গৌরাঙ্গী অসুরনাশিনী হলেন আলো। শুভ চেতনা। যা অন্ধকার দূর করে, পাপবুদ্ধির বিনাশ ঘটায়। শোনোনি, বীরেন ভদ্র? বুদ্ধিরূপেণ সংস্থিতা, শান্তিরূপেণ সংস্থিতা?
ওহ্, সবই তবে প্রতীকী? একটু হতাশ হতাম। কেমন জলজ্যান্ত লাগে সব, আকারে-প্রকারে কী অবিকল মানুষ-মানুষ মতো, রাগ-দুঃখ-আঘাত রক্ত-ঘাম-অশ্রু সমেত- সব রূপক?
কিন্তু তারপরেই চোখে পড়ল, বঙ্কিমচন্দ্রের সেই বিখ্যাত উক্তি, "আমি স্বীকার করি, হিন্দুদিগের শাস্ত্রগ্রন্থ সকলে- বেদে, ইতিহাসে, পুরাণে, কাব্যেও রূপকের অতিশয় প্রাবল্য।. কিন্তু তাই বলিয়া এমন স্বীকার করিতে পারি না যে, হিন্দুশাস্ত্রে যাহা কিছু আছে, সবই রূপক- যে রূপক ছাড়া শাস্ত্রগ্রন্থে আর কিছুই নাই।. রামের নামের ভিতর 'রম্' ধাতু পাওয়া, এবং সীতার নামের ভিতর 'সি' ধাতু পাওয়া যায়, এই জন্য রামায়ণ কৃষিকার্যের রূপকে পরিণত হইয়াছে। .চেষ্টা করিলে, বোধ করি, পৃথিবীতে যাহা কিছু আছে, তাহা এইরূপ উড়াইয়া দেওয়া যায়।" তাই, রূপকে তেষ্টা মেটেনি, জিজ্ঞাসাটা জ্বালিয়ে মারত। অতএব গোঁফের রেখা পুরু হওয়ার আগেই জোগাড় করা গেল দেবী ভাগবত, শ্রী শ্রী চন্ডী, কালিকাপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ। কল্প-কল্পান্তরের পরিক্রমা-শেষে জানা গেল পুরো গল্পটা। নানা অলৌকিক অনৈসর্গিক মিথ দিয়ে মোড়া কাহিনী, টেক্সট-কাউন্টারটেক্সটের জাল, বয়ানও সর্বত্র এক নয়। কিন্তু সে-সব ছাড়িয়ে নিলে এ এক করুণ-মনোহর মানবিক গল্প।
#
গল্পের শুরু মহিষাসুরের পিতৃদেব রম্ভাসুরকে দিয়ে। তিনি কঠোর তপস্যা করে শিবকে তুষ্ট করেছিলেন। আদায় করেছিলেন মনোমত এক পুত্রলাভের বর। কেমন পুত্র? ত্রিলোকবিজয়ী, অপরাজেয়, মহাজ্ঞানী, সর্বপূজ্য যেন হয় সে-ছেলে।
মহাজ্ঞানী, সর্বপূজ্য? মানে, ঐ অসুর, যাকে পাপিষ্ঠ দুরাত্মা খলনায়ক বলে জানি, গ্রামাঞ্চলে যাকে 'চোরা' বলে ডাকা হয়- সে-ই? আজ্ঞে। শুধু তাই নয়, তিনি ছিলেন সুশাসক ও সুদর্শন এক দিগ্বিজয়ী রাজা। গ্রন্থ তাই বলছে।
অসুর/দৈত্য মানেই ভাঁটার মতো চোখ কুলোর মতো কান মুলোর মতো দাঁত আর পটাপট মানুষের মুণ্ডু ছিঁড়ে খাচ্ছে, কষ বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে- এই সব খোকা-জুড়নো কনসেপ্ট ঝেড়ে ফেলেই এ গল্পে ঢোকা ভাল। পুরাণেও দৈত্যদের পরিচয় এইই যে, তাঁরা দেবতাদের বৈমাত্রেয় ভাই ; দেব-জননী অদিতি আর দৈত্য-জননী দিতি ছিলেন সপত্নী, দেব-দানবের পিতৃপরিচয় অভিন্ন। একটা সহজ বাস্তব ব্যাখ্যায় বলা যায়, সম্ভবত কোনও আদি আর্য ঋষিপুরুষের আর্য-পত্নীর গর্ভজাত গৌরবর্ণ সন্ততিগণ দেবতা আর অনার্য-পত্নী-সম্ভূত কৃষ্ণাঙ্গ বা ঘোর তাম্রাভ (অস্ট্রিক বৈশিষ্ট্যের ইঙ্গিতও মেলে) সন্তানেরা দৈত্য বলে পরিচয় লাভ করেছিল।
দুই গোষ্ঠী ছিল বিবদমান, তাদের বিচরণক্ষেত্রও ছিল আলাদা। দেবতারা আর্যাবর্তে আর দৈত্যরা দাক্ষিণাত্যে রাজত্ব করতেন, মাঝেমাঝেই এ ওর টেরিটরিতে গিয়ে হামলা করেও আসতেন- দৈত্যরা যেহেতু বেশি বলশালী, এই দুষ্টুমিটা বেশি করতেন তাঁরাই। আবার স্বার্থের টানে দু'দল কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছেন- এও আমরা দেখি সমুদ্রমন্থনের গল্পে।
যাক, সে অন্য কথা। আপাতত, বাপ রম্ভাসুরের কথায় ফেরা যাক। কী মতি হয়েছিল তাঁর, তিনি শিবের বর পেয়ে ডগমগ হয়ে এক স্ত্রী-মহিষকে সঙ্গম করে ফেললেন। সেই 'মহিষী' যথাসময়ে জন্ম দিল এক বলবান রূপবান পুত্রের, নাম হল মহিষাসুর। মহিষ আর অসুরের 'ব্রিড'।
কথা হচ্ছে, এই গাঁজাখুরির কোনও গ্রহণযোগ্য বাস্তব ভার্সন আছে?
আছে বইকি। একদল পুরাণ-গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বলেন, রম্ভাসুর যাকে সঙ্গম করেছিলেন সে বস্তুত এক আরণ্য উপজাতির কন্যা, মহিষ যাদের 'টোটেম'। যেমন রামায়ণে বানর 'টোটেম'-ধারী বন্য জাতি রামের হয়ে লড়েছিল, 'ভল্লুক' জাম্বুবান ছিল তাদের পরামর্শদাতা, যেমন 'নাগ' জাতি মহাভারতে পরীক্ষিতের উপর প্রতিশোধ নিয়েছিল- এ ঠিক তেমনই এক বন্য পশুপূজক সম্প্রদায়কেই ইঙ্গিত করে। মহিষাসুর বড় হয়ে মাতৃকুলের সেই চিহ্ন ধারণ করেন। সম্ভবত মহিষ-শৃঙ্গের শিরস্ত্রাণ বা মহিষ-মুণ্ডের মুখোশ ছিল তাঁর ধর্মাচরণ বা রণসজ্জার অঙ্গ। টোটেম যেমনটি হয়।
এরপর, দুটো বয়ান আছে। একটা হল, মহিষাসুর নিজেই মরণান্তিক তপস্যার পর সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার কাছে বর পান যে, ত্রিভুবনের কোনও পুরুষ তাঁকে পরাস্ত করতে পারবে না। হ্যাঁ, শুধুই 'পুরুষ'। বর-প্রার্থনার সময় মদমত্ত হয়ে নারীর প্রসঙ্গ তিনি বিস্মৃত হয়েছিলেন সম্ভবত, কিংবা বাদ দিয়েছিলেন ইচ্ছে করেই। ঐ রন্ধ্র রয়ে গেল তাঁর অজেয় বর্মে! অন্য বয়ান বলে, দুষ্টুমি করে এক সুন্দরী রমণীর বেশ ধরে ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে ঢুকে, শিষ্যদের ভুলিয়ে যজ্ঞ পণ্ড করে দেন মহিষাসুর। ক্রুদ্ধ কাত্যায়ন শাপ দেন, সুন্দরী রমণীর হাতেই বিনাশ হবে স্পর্ধিত দৈত্যের! আমরা শাপ/বর ইত্যাদি অলৌকিক আপাতত সরিয়ে রাখি বরং। এইটুকু সহজ ইঙ্গিতই আমাদের সামনে ভেসে থাক যে, মহিষাসুর সর্বগুণসম্পন্ন হলেও তাঁর একটি মারাত্মক দুর্বলতা ছিল- নারী! নারী থেকেই হবে তাঁর ধ্বংসের বীজবপন, যেমন বহু বীরপুরুষের নিয়তি লেখা থাকে।
কিন্তু ধ্বংসের তো দেরি আছে! তার আগে রণকুশল ও উচ্চাভিলাষী রাজা মহিষাসুর তার প্রতাপ বিস্তার করতে লাগলেন। অপ্রতিরোধ্য সেনাদল গড়লেন, রাজ্য বেড়ে চলল তাঁর। এমনকী দেবতাদের নিজস্ব রাজ্য স্বর্গটিও নিলেন অধিকার করে। না, এতে যতটা ক্ষুব্ধ হয়ে থাকি আমরা, "অ্যাঁ, ইকী অনাসৃষ্টি, দেবতাদের হঠিয়ে দিয়ে." ইত্যাদি বলে- অতটা আঁতকে ওঠার কিছু নেই। দেব-দৈত্য চিরকালের বৈরী, যে যখন যাকে পায় ঠেসে ধরে, এ চিরকেলে গল্প। দেবতারাও দৈত্য-দানবদের সঙ্গে অন্যায় করেছেন বিস্তর, মেরে ধরে ঠকিয়ে নিয়েছেন ঢের। পালটা সুযোগে দৈত্যরাও মাঝেমধ্যে জ্ঞাতিভ্রাতাদের ভিটেমাটি চাঁটি করবেন, এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই- বিশেষত বলে-বুদ্ধিতে-জ্ঞানে-সাধনায় তাঁরাও যখন কমতি কিছু নন। বহুবার অসুর-পরাক্রমে রাজ্যছাড়া হয়েছেন অমরবৃন্দ। কিন্তু এবার দেবতারা কিছুতেই আর স্ববলে উদ্ধার করতে পাছিলেন না হৃতরাজ্য। তখন তাঁরা অভিযোগ জানাতে ছুটলেন মুশকিল-আসান হরি-হরের কাছে, ব্রহ্মাকে মুখপাত্র করে।
এইবার ঘটল আর-এক অলৌকিক! মহিষসুরের অত্যাচারের সাতকাহন ব্যাখ্যান শুনে বিষ্ণু-মহেশ্বরের ক্রুদ্ধ আনন থেকে তেজ নির্গত হল। ব্রহ্মা ও ইন্দ্রাদি দেবতারাও নির্গত করলেন 'পবিত্র মন্যুজনিত তেজ'- সোজা কথায়, ক্রোধাগ্নি। সেই তেজোসমষ্টি সংহত হয়ে এক অপরূপা গৌরাঙ্গী স্ত্রীমূর্তি সৃষ্টি করল। তাঁর দশ হাতে প্রহরণ ও দেহে অলঙ্কারাদি দিলেন দেবতারাই- শিব দিলেন ত্রিশূল, বিষ্ণু দিলেন চক্র, রুদ্র তাঁর ধনু, যম দণ্ড, কালভৈরব খড়গ, বসুগণ অভেদ বর্ম ইত্যাদি। বাসুকি দিলেন সর্প, ব্রহ্মা দিলেন অক্ষমালা কমন্ডলু, কুবের রত্নহার, বরুণ পদ্ম-মালিকা, সূর্য দিলেন রশ্মিগুচ্ছ, চন্দ্র অর্ধেন্দুশোভা- আর হিমালয় দিলেন বাহন সিংহটিকে। এই দৈব-তেজোসম্ভূতা, দৈব-আয়ুধ-সজ্জিতা, সর্বাভরণভূষিতা বরবর্ণিনী রমণীই দেবী দুর্গা, যিনি অচিরেই হবেন মহিষাসুরমর্দিনী।
সোজা সরল মানেটা কী দাঁড়াল? এক সুন্দরী অথচ তেজীয়ান কাঞ্চণবর্ণা পাহাড়ী মেয়েকে (নগ-দুহিতা, স্মর্তব্য) বেশ করে জাঁদরেল মিলিটারি ট্রেনিং দিলেন সব দেবতা মিলে- অস্ত্রশস্ত্র কলাকৌশল সৈন্যসামন্ত সব দিয়ে রীতিমত 'ফার্নিশ' করে পাঠালেন অসুর নিধনে? নারীই মহিষাসুরের 'আকিলিস হীল', হয়তো ললনা দেখে সে 'আন্ডারএস্টিমেট' করবে কিংবা অতুল সৌন্দর্য দেখে মনঃসংযোগ খুইয়ে বসবে, তেমন গা লাগিয়ে লড়বে না, এই অর্ধমনস্কতার সুযোগে তাকে নিকেশ করা সম্ভব-
এই কি ছিল স্ট্র্যাটেজি?
এই জায়গায় ফের গোলযোগ। সমস্ত দেবতার 'অবদান' রয়েছে এই স্ত্রীমূর্তির গঠনে, এই বার্তাটিকে বাঁকিয়ে-চুরিয়ে দুর্গাকে বহুদেবভোগ্যা স্বর্বেশ্যা বলে ব্যাখ্যা করে হাল্লা মাচিয়ে দিয়েছেন একদল সমাজতত্ত্ববিদ। যৌনতার মোহিনী-মায়ার ছলে কালো চামড়ার দলিত-নেতা মহিষাসুরকে ফাঁসিয়ে অসতর্ক অবস্থায় হত্যা করেছিল দেবপ্রেরিত অর্থাত্ আর্য-শক্তির বোড়ে হিসেবে ব্যবহৃত সেই স্বৈরিণী, এই হল তাঁদের থিওরি। দুর্গার সৌন্দর্য-বর্ণনার মধ্যে প্রকট সেন্সুয়াস ঝোঁকই সম্ভবত তাঁদের বক্তব্যের সপক্ষে অন্যতম স্তম্ভ। গোটা দেশে সম্প্রতি এ নিয়ে তুমুল কোলাহল, আইনসভায় পর্যন্ত পৌঁছেছে ঢেউ।
পণ্ডিতদের বিচারটি অবশ্য নেহাত মূর্খোচিত মনে হয় একটু তলিয়ে দেখলেই। আর্য-অনার্য বিবাদের একটা লাইন থাকতেই পারে এ-আখ্যানে, কিন্তু 'গণিকা-তত্ত্ব' একেবারেই আবর্জনা। মোহিনী-মায়ায় জব্দ করতে হলে অতশত ঢাল-তলোয়ার নিয়ে দেবীকে অমন যুদ্ধ করতে হল কেন? অমৃত-বিতরণকালে বিষ্ণুর সেই মোহিনী মূর্তিধারণের উপাখ্যান মনে পড়ে যায়, বিনা সংঘর্ষেই কার্যসিদ্ধি ; তার পাশে এ কাহিনী কত আলাদা! সমস্ত প্রামাণ্য গ্রন্থেই বিস্তারিত যুদ্ধবর্ণনা, মহিষাসুরের সেনাপতিদের একে-একে পতন, সেনাদলের বিদ্রাবণ ইত্যাদির পুঙ্খানুপুঙ্খ রেকর্ড রয়েছে। দেবী নিজে একাধিকবার রূপ পরিবর্তন করেছেন, করাল কালীমূর্তিও ধারণ করেছেন প্রয়োজনে, সে রূপ বীভত্স, যৌন-আকর্ষণী নয় মোটেই। রূপে ভোলাতে মোটেই মহিষাসুর-সকাশে যাননি তিনি। তা-ই যদি তাঁর অভিসন্ধি হত- ভুলিয়ে বশ করে বেকায়দায় ফেলে মুণ্ডুটি কেটে নেওয়া- সে-সুযোগ তো তাঁর হাতের মুঠোয় চলে এসেছিল! একেবারে প্রথমবার দূর থেকে তাঁকে দেখেই টলে গিয়েছিলেন অসুররাজ। এমন নারী তো ত্রিভুবনে দেখেননি কখনও! আক্রমণকারিণীকেই দূত মারফত্ প্রণয়-প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। এমনকী, যুদ্ধক্ষেত্রে মুখোমুখি হয়েও, আহ্বান করেছিলেন প্রেমাস্পদ হিসেবে স্বীকার করতে। প্রলুব্ধ করেছিলেন নানাভাবে। দেবী প্রতিবার প্রত্যাখ্যান করেছেন রূঢ় ভঙ্গিমায়, শেষ পর্যন্ত তীব্রতম প্রতিদ্বন্দ্বিতার অন্তে বাহুবলেই পরাস্ত করেছেন দুর্দান্ত প্রতিপক্ষকে। সমাজতত্ত্ব-নৃতত্ত্বের চোখে দুর্গা-বৃত্তান্তের যেমন ব্যাখ্যাই হোক না কেন, তাঁর উত্পত্তি নিয়ে যতই জল ঘোলা হোক, কাহিনিতে তাঁর ভূমিকা যে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যোদ্ধারই, মোহিনীর নয়- এ নিয়ে এতটুকু সন্দেহ নেই।
আমার বরং এই কাহিনির প্রসঙ্গে দুর্গাকে নিয়ে নয়, মহিষাসুরকে নিয়েই একটু বেশি ভাবতে ইচ্ছে করে।নারী ছিল একমাত্র দুর্বলতা- এই অমিত শক্তিধর অনার্য (না কি, অস্ট্রিক?) পুরুষের। কতটা দুর্বল হয়েছিলেন তিনি, অতসীপুষ্প-বর্ণাভা সুপ্রতিষ্ঠা সুলোচনা সুচারুদশনা পীনোন্নতপয়োধরা সেই অলোকসামান্যা যৌবনবতীর প্রতি? কতটা প্রণয়মথিত হলে তবে, সমস্ত সৈন্য-সেনাপতির নির্মম নিধন স্বচক্ষে দেখেও, রক্তাক্ত রণক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে সেই নিহন্ত্রীর কাছেই প্রেম নিবেদন করা যায়?এই প্রেম কি কপট চাতুরী ছিল অসুরের? প্রতিপক্ষকে ঠকানোর ছল? গ্রন্থে তেমন ইঙ্গিত আছে বটে, কিন্তু যুক্তিপরম্পরা বিচারে তা মনে হয় না আদৌ। ছলনার উদ্ভব হতে পারত পরাজয়ের ভয় থেকে। দূর থেকে দুর্গার রণংদেহি মূর্তি দেখে রাজা একবিন্দু ভীত হননি, ভয় বস্তুটি তাঁর রক্তে ছিলই না। বরং, প্রথমে বার্তাবহ অমাত্যকে ও পরবর্তীকালে সৈন্যদলকে বার বার বলে দিয়েছিলেন, যদি প্রেম-প্রস্তাবে রাজি না হন ঐ অপরূপা- তবে তাঁকে যেন 'সযত্নে' বন্দী করা হয়, গায়ে যেন আঁচড় না লাগে!
ছলনার দরকারই বা কী? দেবপ্রেরিতা সুন্দরী যে তাঁর কোনও ক্ষতি করতে পারবেন এমন সম্ভাবনা তো কল্পনাতেও আনেননি আত্মবিশ্বাসী মহাবল পুরুষ। একটিও বাণ বিনিময়ের আগেই তিনি প্রেমে পড়েছিলেন সেই নারীর, প্রথম দর্শনেই। এমনকী, সমস্ত সৈন্যবিনাশের পর সম্মুখসমরে নামতে বাধ্য হলেন যখন, তখনও সেই প্রেমেই তিনি আকণ্ঠ নিমজ্জিত। আসন্ন পতনের সম্ভাবনা কোনও বিপদ-সংকেতই দেয়নি তাঁর অন্তরে, এতই প্রগাঢ় সেই কাঙ্ক্ষা!
এইই হল তাঁর দুর্বলতা, এই রন্ধ্রপথেই তাঁর নিয়তি গ্রাস করেছিল তাঁকে।
মহিষ, হস্তী, সিংহ- পর পর অনেক রূপ ধারণ করে, অর্থাত্ একাধিক পশু-টোটেমের আশ্রয়ে সংগ্রাম করে চলেছিলেন পরাক্রান্ত অসুররাজ। সহজ হয়নি দেবীর পক্ষেও, তাঁকে পরাস্ত করা। গ্রন্থে বলা হয়েছে, অনেকবার বধ করার পরেও ফের বেঁচে উঠে যুদ্ধ করেছে মায়াবী অসুর! অর্থাত্, মৃত্যুর কাছে পৌঁছে গিয়েও, নিপুণ কায়দায় আত্মরক্ষা করেছেন দৈত্যরাজ। টক্কর চলছিল সমানে সমানে। কিন্তু, গ্রন্থ বলছে- এর মধ্যেই একবার এক নয়ন-বিমোহন পুরুষের রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন মহিষাসুর। হ্যাঁ, মহিষ-হস্তী-সিংহ নয়, মানব-রূপ!
আমি অনুমান করি, ঐ সুদর্শন অবয়বটিই তাঁর আসল আকার। ডার্ক অ্যান্ড হ্যান্ডসাম এক রোমান্টিক বীর। টোটেম হিসেবে ব্যবহৃত যাবতীয় পশুমুণ্ড বা পশুচর্ম তিনি হয়তো সাময়িক ভাবে ত্যাগ করে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তখন, নিজমূর্তিতে স্বপ্রকাশ! না, ঐ রূপে তিনি আক্রমণ করতে আসেননি, এনেছিলেন সেই নাছোড় প্রেম-প্রস্তাব, শেষবারের মতো। প্রাণঘাতী যুদ্ধের মধ্যে দাঁড়িয়ে, হয়তো বা রক্তাক্তদেহেই, সম্ভাব্য ঘাতিকাকে তিনি হৃদয় দিতে চেয়েছিলেন। বিনিময়ে পেয়েছিলেন কঠিন প্রত্যাখ্যান। ধারালো শূলে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাওয়ার আগেই হয়তো শতধা বিদীর্ণ হয়েছিল তাঁর হৃদয়- ঐ প্রত্যাখ্যানেই! কে জানে, হয়তো যুদ্ধজয়ের তাগিদই ছিল না আর। ঐ মৃত্যু হয়তো স্বেচ্ছামৃত্যুই একরকম!
পুজোমণ্ডপে দাঁড়িয়ে শূলবিদ্ধ অসুরকে দেখি যখন, দীনের মতো দেবীর পদতলে রক্তলিপ্ত, মুমূর্ষু- অথচ অপলক দৃষ্টিখানি অবধারিতভাবে নিবদ্ধ দেবীর মুখের দিকে- মনের মধ্যে কতরকম ভাবনাই যে চলকে ওঠে! ঐ দৃষ্টির কতরকম অর্থই না খুঁজে পাওয়া সম্ভব, যদি নির্জিতের দিক থেকে কাহিনীটার দিকে তাকানো যায়।জয়ী পক্ষের বয়ানে লেখা সব পুরাণ ও ধর্মশাস্ত্র, সেখানে অসুরকে অত্যাচারী পাপাত্মা কামান্ধ হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। তাই আমাদের চোখে সে 'চোরা', সে ভিলেইন, তার বুকে বিঁধে থাকা শূল আমাদের অনুভবে আঘাত দেয় না, আমরা তাকে অন্ধকার-অন্যায়-অজ্ঞানতার রূপকে মুড়ে রেখে তার মৃত্যুর উদযাপন করি । অথবা, উল্টোপথে, তাকে জবরদস্তি হিরো বানাতে যাই- বৈপ্লবিক টেক্সট-সাবটেক্সটের দোহাই দিয়ে দলিত-শোষণের নয়া পোলিটিক্যাল কিস্সা বাজারে ছাড়ি, বাজার খায় ভালো। এসব নিয়ে কথা বলতে না চাওয়া সুশীলগন আবার অনেকটা শবেবরাতের ফকিরের মতো! পাবলিক কী চায় বা খায় বা খাচ্ছে সেদিকে খেয়াল রাখে! সেভাবেই পাল তুলে।
এক ব্যতিক্রমী প্রেমিকের ট্র্যাজিক উপাখ্যান চাপা পড়ে থাকে অন্ধকারে।।
Tuesday, October 16, 2018
ভাষান্তরঃ Hiding Your Assets: The Surprising Origin of the Burka & Niqab
এটা সাধারণভাবে ধারণা করা হয় যে, নারীদের
পোশাক বিশেষ করে বোরকা ও নেকাবের মত পোশাক সম্পর্কে (যথাক্রমে
আফগানিস্তান ও আরব থেকে আগত) ইসলামী বিধান মহিলাদের শালীনতা রক্ষা এবং
পুরুষ দর্শকদের লোলুপ দৃষ্টি এড়ানোর জন্য প্রণীত হয়েছিল।
নিশ্চিতভাবেই এ ধরনের পোশাক পুরুষের আকর্ষণ রোধের একটি অত্যন্ত কার্যকর মাধ্যম। তবে এটা সঠিকভাবে নজরে আনা হয়েছে যে, ইসলামী আইনের কোথাও মুখমণ্ডল ও শরীর পুরোপুরি আবৃত করার কথা বলা হয় নাই। ‘‘শালীনতা’’ সম্পর্কে গুটি কয়েক সতর্ক বাণী ছাড়া কুরআন অথবা অন্য কোন ইসলামী গ্রন্থে কীভাবে নারীরা পোশাক পরবে সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন পরামর্শ দেওয়া হয় নাই বললেই চলে।
এ কারণে সাম্প্রতিক কালে বলা হচ্ছে যে, ইসলামের সঙ্গে বোরকা এবং নেকাবের কোন সম্পর্ক নাই। এগুলো নিছক স্থানীয় প্রথা, পরে এগুলোকে ধর্মীয় অনুশাসনের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। তবে এটা একটা মেকি যুক্তি। এ কথা বিশ্বাস করার কোন কারণ নাই যে, প্রাক-ইসলামী আফগানিস্তানে অথবা ইসলাম-পূর্ব আরবে বোরকা অথবা নেকাব জাতীয় কোন কিছু পরিধান করা হত। এবং তাই এ পোশাকগুলো কেবল ইসলামী প্রেক্ষাপটে এবং ইসলামী সংস্কৃতির আওতায় অনুধাবনযোগ্য।
কিন্তু যদি এ ধরনের পোশাক ইসলামী আইন দ্বারা নির্দেশিত না হয়ে থাকে তবে এগুলো আসলো কোথা থেকে?
ব্যাপারটা বুঝতে হলে আমাদেরকে ইসলাম এবং ইসলাম কর্তৃক বিকশিত সংস্কৃতির উপর ব্যাপক দৃষ্টি দিতে হবে। এটা করলেই বোরকা/নেকাব সংক্রান্ত প্রকৃত সত্য অনাচ্ছাদিত হয়ে বেরিয়ে আসবে। এবং এই সত্য অনেককে ভীষণভাবে বিচলিত করার মত।
গোড়ায় আরব উপদ্বীপ হতে ইসলামের অভুøদয় ঘটেছিল যুদ্ধে বিজয়ী ধর্মীয় মতবাদ রূপে। শুরুর দিকে বিজিত লোকজনের বেশীরভাগ ছিল খ্রীষ্টান। পরাজিতদের মধ্যে অনেক ইহুদীও ছিল। উভয় ধর্মের অনুসারীদের এই শর্তে নিজ নিজ ধর্ম পালনের অনুমতি দেওয়া হয় যে, এর জন্য তাদেরকে মুসলিম বিজেতাদের জিজিয়া নামের বিশেষ কর দিতে হবে।
প্রথম দিকে মধ্যপ্রাচ্যের জনসংখ্যার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ খ্রীষ্টান ও ইহুদী ছিল বিধায় খিলাফত সরকারের আদায়কৃত এই করের পরিমাণ ছিল বিশাল অংকের। এ পরিস্থিতিতে এটা অবধারিত ছিল যে, খ্রীষ্টান ও ইহুদীদের ধর্মান্তরিত না করে প্রজা হিসাবে থাকতে দেওয়াই ছিল আর্থিকভাবে লাভজনক। এ ধরনের কর থেকে মুসলমানদের রেহাই দেওয়া হয়েছিল। জিজিয়া কর এতই আকর্ষণীয় ছিল যে, প্রকৃতপক্ষে মুসলমান শাসকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে খ্রীষ্টানদের ধর্মান্তরিত করতে চান নাই, খ্রীষ্টানদের ধর্মান্তরিত করার অর্থ ছিল রাজস্ব হারানো। বেট ইয়ে’অর মন্তব্য করেছেনঃ
“বালাধুরি লিখেছেন যে, আরব অভিযানকারীদের হাতে ইরাকের পতন ঘটলে সৈন্যরা সাওয়াদ অঞ্চল নিজেদের মধ্যে ‘ভাগ করে নিতে’ চেয়েছিল। খলীফা ওমর বিন আল খাত্তাব তাদের লুণ্ঠিত সামগ্রী ভাগ করে নেওয়ার অনুমতি দিলেও আদেশ জারি করেন যে, জমি এবং উটগুলোকে স্থানীয় কৃষকদের কাছে ছেড়ে আসতে হবে যাতে মুসলমানদের জন্য এগুলো রক্ষিত থাকেঃ “যদি তোমরা এগুলো উপস্থিতদের মধ্যে ভাগ করে দাও তবে যারা পরে আসবে তাদের জন্য কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।” এবং নবীর জামাতা আলী সাওয়াদের অমুসলমান কৃষকদের সম্পর্কে বলেছিলেন, “তাদেরকে রাজস্বের উৎস এবং মুসলমানদের সাহায্যকারী হিসাবে থাকতে দাও।” [ব্যাট ইয়ে’অর’, দি দিম্মি (জিম্মি), ১৯৮৫, পৃ. ৬৮]।
গুণ্ডা, বদমাশ ও ডাকাত জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে মুসলমান সমাজের অদ্ভূত প্রবণতা ব্যাখা করতে গেলে মুসলমানদের এই দৃষ্টিভঙ্গী মাথায় রাখতে হবে যে, মুসলমানরা মনে করে কাফেরদের শ্রম চিরস্থায়ীভাবে ভোগ করে জীবন যাপনের অধিকার তাদের রয়েছে। আমার লেখা ‘‘হোলি ওয়ারিয়রঃ ইসলাম এন্ড্ দি ডিমাইজ অব ক্ল্যাসিক্যাল সিভিলাইজেশন’’ গ্রন্থে আমি সপ্তম শতাব্দীতে গ্রীকো-রোমান সভ্যতার ধ্বংস সাধনে মুসলিম তস্করবৃত্তির ভূমিকা বিশ্লেষণ করেছি। সপ্তম শতাব্দীতে ইসলাম বাকী বিশ্বের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ শুরু করে সেটা ছিল পূর্ণাঙ্গ ও অন্তহীন যুদ্ধ। সকল মানুষ আল্লাহ নামের একমাত্র ঈশ্বরকে মেনে না নেওয়া পর্যন্ত মুসলমানরা অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে বলে মুহাম্মদের এবং কুরআনের (অর্থাৎ কুরআন ৮ঃ৩৯) বক্তব্যের কারণে কাফের শাসিত বিশ্বের সঙ্গে সত্যিকার অথবা স্থায়ী শান্তি অসম্ভব। সকল মুসলমানকে তাই কাফের বিশ্বের বিরুদ্ধে সক্রিয় ‘‘জিহাদে’’ অংশ নিতে অনুমতি এমনকি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোন ব্যক্তি নিজস্ব উদ্যোগে সেনাবাহিনী গড়ে তুলে কাফের পরিচালিত দেশগুলোকে আক্রমণ করতে পারে না; কিন্তু সে ছোট আকারের আক্রমণ এবং গেরিলা অভিযান চালাতে পারে। ইতিহাস ঘাটলে আমরা দেখি, মুসলমানরা যেখানেই অমুসলমানদের সান্নিধ্যে এসেছে সেখানে সব সময় তারা এই কাণ্ড ঘটিয়েছে।
অসংখ্য ডাকাতির ঘটনার মত এই ‘‘ছোট ছোট’’ যুদ্ধ সপ্তম শতাব্দীতে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য কার্যকরভাবে থামিয়ে দিতে এবং ধ্রুপদী সভ্যতার বিনাশ ঘটাতে সক্ষম হয়।
কিন্তু ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে দূরে অবস্থিত লুণ্ঠনোপযোগী অদখলকৃত কাফের সম্প্রদায় অথবা জাতির সংখ্যা হ্রাস পেয়েছিল। অন্যদিকে ইসলামের অধীন বিপুল সংখ্যক ইহুদী ও খ্রীষ্টান জিম্মির সংখ্যা হ্রাস পেতে শুরু করে। জিজিয়া করের ভয়াবহ নিষ্পেষণ ও সেই সঙ্গে মুসলিম প্রভুদের হাতে নিত্য অবমাননা এবং যখন-তখন সহিংসতার কারণে তারা ধর্মান্তরিত হতে থাকায় এমনটি ঘটেছিল।
কর আদায় এবং লুণ্ঠন করার মত খ্রীষ্টান ও ইহুদীদের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসতে থাকায় খলীফা এবং সুলতানগণ তাদের চহিদামত সম্পদ কোথা থেকে অর্জন করবে সেটা একটা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়।
এর উত্তর ছিল পরিষ্কারঃ ইহুদী এবং খ্রীষ্টানরা অতি সামান্য সংখ্যায় অবশিষ্ট থাকলেও মুসলমানদের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছিল। এরা প্রায় সবাই ছিল ইহুদী এবং খ্রীষ্টান থেকে ধর্মান্তরিত। তাদের কাছ থেকে প্রশাসনের রাজস্ব ঘাটতি আদায়ের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী অন্যের শ্রমের বিনিময়ে জীবন ধারণে অভ্যস্ত ছিল বিধায় মুসলমান শাসক শ্রেণী -- খলীফা, আমীর ও তাদের সাঙ্গোপাঙ্গরা গরীব মুসলমানদের নিপীড়ন করতে থাকে। আমরা অবশ্যই ব্যাপকভাবে এটা খঁুজে পাই।
মুসলমানদের ইতিহাসের গোটা সময়কাল জুড়ে খলীফা এবং সুলতানগণ তাদের নাগরিকদের সম্পদ যখন প্রয়োজন হয়েছে নিষ্ঠুরভাবে লুণ্ঠন করেছেন। এতে ধর্মের কোন বাছবিচার ছিল না। এই তথ্যের উল্লেখ করেছেন বার্নার্ড লুইস। ২০০১ সালে প্রকাশিত “হোয়াট ওয়েন্ট রং?’’ গ্রন্থে লুইস প্রশ্ন তুলেছেনঃ যে সভ্যতা তার বিশ্বাস অনুসারে শুরুতে এমন সম্ভবনা জাগিয়ে তুলেছিল তা কেন দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে পরবর্তী সময়ে দারিদ্র্য ও পশ্চাৎপদতায় নিমজ্জিত হয়ে গেল? ভুল ছিল কোথায়?
লুইস কোন উত্তর না দিয়ে তার বই শেষ করেছেন। তারপরও এক জায়গায় তিনি এক তীক্ষ্ন পর্যবেক্ষণ রেখেছেন। আধুনিক যুগের আগে পর্যন্ত গোটা মুসলিম জাহানে চাকা যুক্ত গাড়ী কার্যত অজানা ছিল। এটা একেবারে হতবাক করার মত ঘটনা; কারণ চাকা আবিষ্কৃত হয়েছিল মধ্য প্রাচ্যে (ব্যাবিলনিয়ায়) এবং আগেকার যুগে তার ব্যাপক ব্যবহার ছিল। তিনি এর এক চমকপ্রদ উপসংহার টেনেছেনঃ “চাকা যুক্ত গাড়ী আকারে বড় এবং একজন চাষীর জন্য তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল। যেখানে যে সময় কোন আইন অথবা প্রথা এমনকি স্থানীয় কর্তৃপক্ষেরও শক্তির রাশ টেনে ধরার জন্য যথেষ্ট ছিল না সেখানে তখন দৃশ্যমান ও স্থানান্তরযোগ্য সম্পদ ছিল অলাভজনক বিনিয়োগ। লুণ্ঠনজীবী কর্তৃপক্ষ অথবা প্রতিবেশীর ব্যাপারে একই ধরনের ভীতির ছাপ দেখা যায় সে সময়কার সাধারণ বাড়ীঘরের নির্মাণ কাঠামোতেঃ উঁচু, জানালাহীন দেওয়াল, সংকীর্ণ গলিপথে প্রায় লুক্কায়িত প্রবেশ দ্বার; সম্পদের কোন দৃশ্যমান লক্ষণ এড়িয়ে চলার সযত্ন চেষ্টা।” (বার্নার্ড লুইস, হোয়াট ওয়েন্ট রং?, ২০০১, পৃ. ১৫৮)।
খিলাফতের নামে এই চৌর্যোন্মাদনার মধ্যে মনে হয় শুধু ইহুদী আর খ্রীষ্টান কেন, এমনকি মুসলমানরাও অবাধে সমৃদ্ধি লাভে সক্ষম ছিল না।
তবে খলীফা এবং সুলতানগণ তাদের প্রজাদের পাথির্ব সম্পদ লুণ্ঠন বন্ধ করেন নাই। তারা আরো বেশী কেড়ে নিতে সক্ষম ও ইচ্ছুক ছিলেন। একেবারে শুরু থেকেই, প্রথম ‘‘বিশ্বাসীদের কমান্ডার’’ মুহাম্মদ তার বন্ধু ও আত্মীয়দের কাছ থেকে নারী দখল করে নিতে ইতঃস্তত করেন নাই। মুহাম্মদের কমপক্ষে দুইজন স্ত্রী ছিল দখল করা; একজন ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর কাছ থেকে এবং একজন তার পালক পুত্রের কাছ থেকে। খলীফারা অবশ্যই মুহাম্মদের দৃষ্টান্ত অনুসরণে দেরী করেন নাই। মুসলমানদের ইতিহাসের গোটা সময় জুড়ে খলীফা এবং সুলতানরা তাদের প্রজাদের কাছ থেকে নারী কেড়ে নিয়েছেন নিয়মিতভাবে। এমনকি এই নারীরা বিবাহিতা হলেও তাতে ঘটনার কোন হেরফের হত না। বিবাহ বিচ্ছেদের (তালাক) ইসলামী নিয়ম হচ্ছে একজন পুরুষ তার স্ত্রীকে “আমি তোমাকে তালাক দিলাম” এ কথা বললেই সব চুকে গেল। আর কিছুর দরকার হয় না। এর অর্থ হচ্ছে একজন স্বামীকে অতি সহজেই এ বাক্য তিনবার উচ্চারণে বাধ্য করা যেত। অনিচ্ছুক স্ত্রীকে রাজি করানোর জন্য নির্যাতন ও মৃ্ত্যুর হুমকিই যথেষ্ট ছিল।
লুণ্ঠনকারী কর্তৃত্বের এহেন সংস্কৃতিতে অবাক হওয়ার কিছু নাই যে ইসলামী জাহানে পুরুষরা নিজ নিজ স্ত্রীকে বোরকায় আবৃত করে লুকিয়ে রাখতে শুরু করেছিল। এই নূতন স্টাইলকে অবশ্যই শালীনতা অনুশীলনের সৎ প্রচেষ্টা আখ্যা দিয়ে ক্ষমা করা যায় ; কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর প্রকৃত কারণ ছিল মুসলিম বাড়ীঘরের বৈচিত্র্যহীন, জানালাবিহীন বর্হিভাগ নির্মাণের অনুরূপঃ আপনার সম্পদ লুকিয়ে রাখা।
(নিবন্ধটি John J. O’Neill-এর লেখা Hiding Your Assets: The Surprising Origin of the Burka & Niqab-এর বাংলায় ভাষান্তর। মূল ইংরাজী নিবন্ধটি ইসলাম ওয়াচ [Islam-Watch]-এ ২৫ মার্চ ২০১০ তারিখে প্রকাশিত হয়। জন জে, ও’নীল ‘‘হোলি ওয়ারিয়র্সঃ ইসলাম এন্ড দি ডিমাইজ অফ ক্ল্যাসিক্যাল সিভিলাইজেশন” নামক গ্রন্থের প্রণেতা।)
নিশ্চিতভাবেই এ ধরনের পোশাক পুরুষের আকর্ষণ রোধের একটি অত্যন্ত কার্যকর মাধ্যম। তবে এটা সঠিকভাবে নজরে আনা হয়েছে যে, ইসলামী আইনের কোথাও মুখমণ্ডল ও শরীর পুরোপুরি আবৃত করার কথা বলা হয় নাই। ‘‘শালীনতা’’ সম্পর্কে গুটি কয়েক সতর্ক বাণী ছাড়া কুরআন অথবা অন্য কোন ইসলামী গ্রন্থে কীভাবে নারীরা পোশাক পরবে সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন পরামর্শ দেওয়া হয় নাই বললেই চলে।
এ কারণে সাম্প্রতিক কালে বলা হচ্ছে যে, ইসলামের সঙ্গে বোরকা এবং নেকাবের কোন সম্পর্ক নাই। এগুলো নিছক স্থানীয় প্রথা, পরে এগুলোকে ধর্মীয় অনুশাসনের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। তবে এটা একটা মেকি যুক্তি। এ কথা বিশ্বাস করার কোন কারণ নাই যে, প্রাক-ইসলামী আফগানিস্তানে অথবা ইসলাম-পূর্ব আরবে বোরকা অথবা নেকাব জাতীয় কোন কিছু পরিধান করা হত। এবং তাই এ পোশাকগুলো কেবল ইসলামী প্রেক্ষাপটে এবং ইসলামী সংস্কৃতির আওতায় অনুধাবনযোগ্য।
কিন্তু যদি এ ধরনের পোশাক ইসলামী আইন দ্বারা নির্দেশিত না হয়ে থাকে তবে এগুলো আসলো কোথা থেকে?
ব্যাপারটা বুঝতে হলে আমাদেরকে ইসলাম এবং ইসলাম কর্তৃক বিকশিত সংস্কৃতির উপর ব্যাপক দৃষ্টি দিতে হবে। এটা করলেই বোরকা/নেকাব সংক্রান্ত প্রকৃত সত্য অনাচ্ছাদিত হয়ে বেরিয়ে আসবে। এবং এই সত্য অনেককে ভীষণভাবে বিচলিত করার মত।
গোড়ায় আরব উপদ্বীপ হতে ইসলামের অভুøদয় ঘটেছিল যুদ্ধে বিজয়ী ধর্মীয় মতবাদ রূপে। শুরুর দিকে বিজিত লোকজনের বেশীরভাগ ছিল খ্রীষ্টান। পরাজিতদের মধ্যে অনেক ইহুদীও ছিল। উভয় ধর্মের অনুসারীদের এই শর্তে নিজ নিজ ধর্ম পালনের অনুমতি দেওয়া হয় যে, এর জন্য তাদেরকে মুসলিম বিজেতাদের জিজিয়া নামের বিশেষ কর দিতে হবে।
প্রথম দিকে মধ্যপ্রাচ্যের জনসংখ্যার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ খ্রীষ্টান ও ইহুদী ছিল বিধায় খিলাফত সরকারের আদায়কৃত এই করের পরিমাণ ছিল বিশাল অংকের। এ পরিস্থিতিতে এটা অবধারিত ছিল যে, খ্রীষ্টান ও ইহুদীদের ধর্মান্তরিত না করে প্রজা হিসাবে থাকতে দেওয়াই ছিল আর্থিকভাবে লাভজনক। এ ধরনের কর থেকে মুসলমানদের রেহাই দেওয়া হয়েছিল। জিজিয়া কর এতই আকর্ষণীয় ছিল যে, প্রকৃতপক্ষে মুসলমান শাসকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে খ্রীষ্টানদের ধর্মান্তরিত করতে চান নাই, খ্রীষ্টানদের ধর্মান্তরিত করার অর্থ ছিল রাজস্ব হারানো। বেট ইয়ে’অর মন্তব্য করেছেনঃ
“বালাধুরি লিখেছেন যে, আরব অভিযানকারীদের হাতে ইরাকের পতন ঘটলে সৈন্যরা সাওয়াদ অঞ্চল নিজেদের মধ্যে ‘ভাগ করে নিতে’ চেয়েছিল। খলীফা ওমর বিন আল খাত্তাব তাদের লুণ্ঠিত সামগ্রী ভাগ করে নেওয়ার অনুমতি দিলেও আদেশ জারি করেন যে, জমি এবং উটগুলোকে স্থানীয় কৃষকদের কাছে ছেড়ে আসতে হবে যাতে মুসলমানদের জন্য এগুলো রক্ষিত থাকেঃ “যদি তোমরা এগুলো উপস্থিতদের মধ্যে ভাগ করে দাও তবে যারা পরে আসবে তাদের জন্য কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।” এবং নবীর জামাতা আলী সাওয়াদের অমুসলমান কৃষকদের সম্পর্কে বলেছিলেন, “তাদেরকে রাজস্বের উৎস এবং মুসলমানদের সাহায্যকারী হিসাবে থাকতে দাও।” [ব্যাট ইয়ে’অর’, দি দিম্মি (জিম্মি), ১৯৮৫, পৃ. ৬৮]।
গুণ্ডা, বদমাশ ও ডাকাত জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে মুসলমান সমাজের অদ্ভূত প্রবণতা ব্যাখা করতে গেলে মুসলমানদের এই দৃষ্টিভঙ্গী মাথায় রাখতে হবে যে, মুসলমানরা মনে করে কাফেরদের শ্রম চিরস্থায়ীভাবে ভোগ করে জীবন যাপনের অধিকার তাদের রয়েছে। আমার লেখা ‘‘হোলি ওয়ারিয়রঃ ইসলাম এন্ড্ দি ডিমাইজ অব ক্ল্যাসিক্যাল সিভিলাইজেশন’’ গ্রন্থে আমি সপ্তম শতাব্দীতে গ্রীকো-রোমান সভ্যতার ধ্বংস সাধনে মুসলিম তস্করবৃত্তির ভূমিকা বিশ্লেষণ করেছি। সপ্তম শতাব্দীতে ইসলাম বাকী বিশ্বের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ শুরু করে সেটা ছিল পূর্ণাঙ্গ ও অন্তহীন যুদ্ধ। সকল মানুষ আল্লাহ নামের একমাত্র ঈশ্বরকে মেনে না নেওয়া পর্যন্ত মুসলমানরা অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে বলে মুহাম্মদের এবং কুরআনের (অর্থাৎ কুরআন ৮ঃ৩৯) বক্তব্যের কারণে কাফের শাসিত বিশ্বের সঙ্গে সত্যিকার অথবা স্থায়ী শান্তি অসম্ভব। সকল মুসলমানকে তাই কাফের বিশ্বের বিরুদ্ধে সক্রিয় ‘‘জিহাদে’’ অংশ নিতে অনুমতি এমনকি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোন ব্যক্তি নিজস্ব উদ্যোগে সেনাবাহিনী গড়ে তুলে কাফের পরিচালিত দেশগুলোকে আক্রমণ করতে পারে না; কিন্তু সে ছোট আকারের আক্রমণ এবং গেরিলা অভিযান চালাতে পারে। ইতিহাস ঘাটলে আমরা দেখি, মুসলমানরা যেখানেই অমুসলমানদের সান্নিধ্যে এসেছে সেখানে সব সময় তারা এই কাণ্ড ঘটিয়েছে।
অসংখ্য ডাকাতির ঘটনার মত এই ‘‘ছোট ছোট’’ যুদ্ধ সপ্তম শতাব্দীতে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য কার্যকরভাবে থামিয়ে দিতে এবং ধ্রুপদী সভ্যতার বিনাশ ঘটাতে সক্ষম হয়।
কিন্তু ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে দূরে অবস্থিত লুণ্ঠনোপযোগী অদখলকৃত কাফের সম্প্রদায় অথবা জাতির সংখ্যা হ্রাস পেয়েছিল। অন্যদিকে ইসলামের অধীন বিপুল সংখ্যক ইহুদী ও খ্রীষ্টান জিম্মির সংখ্যা হ্রাস পেতে শুরু করে। জিজিয়া করের ভয়াবহ নিষ্পেষণ ও সেই সঙ্গে মুসলিম প্রভুদের হাতে নিত্য অবমাননা এবং যখন-তখন সহিংসতার কারণে তারা ধর্মান্তরিত হতে থাকায় এমনটি ঘটেছিল।
কর আদায় এবং লুণ্ঠন করার মত খ্রীষ্টান ও ইহুদীদের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসতে থাকায় খলীফা এবং সুলতানগণ তাদের চহিদামত সম্পদ কোথা থেকে অর্জন করবে সেটা একটা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়।
এর উত্তর ছিল পরিষ্কারঃ ইহুদী এবং খ্রীষ্টানরা অতি সামান্য সংখ্যায় অবশিষ্ট থাকলেও মুসলমানদের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছিল। এরা প্রায় সবাই ছিল ইহুদী এবং খ্রীষ্টান থেকে ধর্মান্তরিত। তাদের কাছ থেকে প্রশাসনের রাজস্ব ঘাটতি আদায়ের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী অন্যের শ্রমের বিনিময়ে জীবন ধারণে অভ্যস্ত ছিল বিধায় মুসলমান শাসক শ্রেণী -- খলীফা, আমীর ও তাদের সাঙ্গোপাঙ্গরা গরীব মুসলমানদের নিপীড়ন করতে থাকে। আমরা অবশ্যই ব্যাপকভাবে এটা খঁুজে পাই।
মুসলমানদের ইতিহাসের গোটা সময়কাল জুড়ে খলীফা এবং সুলতানগণ তাদের নাগরিকদের সম্পদ যখন প্রয়োজন হয়েছে নিষ্ঠুরভাবে লুণ্ঠন করেছেন। এতে ধর্মের কোন বাছবিচার ছিল না। এই তথ্যের উল্লেখ করেছেন বার্নার্ড লুইস। ২০০১ সালে প্রকাশিত “হোয়াট ওয়েন্ট রং?’’ গ্রন্থে লুইস প্রশ্ন তুলেছেনঃ যে সভ্যতা তার বিশ্বাস অনুসারে শুরুতে এমন সম্ভবনা জাগিয়ে তুলেছিল তা কেন দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে পরবর্তী সময়ে দারিদ্র্য ও পশ্চাৎপদতায় নিমজ্জিত হয়ে গেল? ভুল ছিল কোথায়?
লুইস কোন উত্তর না দিয়ে তার বই শেষ করেছেন। তারপরও এক জায়গায় তিনি এক তীক্ষ্ন পর্যবেক্ষণ রেখেছেন। আধুনিক যুগের আগে পর্যন্ত গোটা মুসলিম জাহানে চাকা যুক্ত গাড়ী কার্যত অজানা ছিল। এটা একেবারে হতবাক করার মত ঘটনা; কারণ চাকা আবিষ্কৃত হয়েছিল মধ্য প্রাচ্যে (ব্যাবিলনিয়ায়) এবং আগেকার যুগে তার ব্যাপক ব্যবহার ছিল। তিনি এর এক চমকপ্রদ উপসংহার টেনেছেনঃ “চাকা যুক্ত গাড়ী আকারে বড় এবং একজন চাষীর জন্য তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল। যেখানে যে সময় কোন আইন অথবা প্রথা এমনকি স্থানীয় কর্তৃপক্ষেরও শক্তির রাশ টেনে ধরার জন্য যথেষ্ট ছিল না সেখানে তখন দৃশ্যমান ও স্থানান্তরযোগ্য সম্পদ ছিল অলাভজনক বিনিয়োগ। লুণ্ঠনজীবী কর্তৃপক্ষ অথবা প্রতিবেশীর ব্যাপারে একই ধরনের ভীতির ছাপ দেখা যায় সে সময়কার সাধারণ বাড়ীঘরের নির্মাণ কাঠামোতেঃ উঁচু, জানালাহীন দেওয়াল, সংকীর্ণ গলিপথে প্রায় লুক্কায়িত প্রবেশ দ্বার; সম্পদের কোন দৃশ্যমান লক্ষণ এড়িয়ে চলার সযত্ন চেষ্টা।” (বার্নার্ড লুইস, হোয়াট ওয়েন্ট রং?, ২০০১, পৃ. ১৫৮)।
খিলাফতের নামে এই চৌর্যোন্মাদনার মধ্যে মনে হয় শুধু ইহুদী আর খ্রীষ্টান কেন, এমনকি মুসলমানরাও অবাধে সমৃদ্ধি লাভে সক্ষম ছিল না।
তবে খলীফা এবং সুলতানগণ তাদের প্রজাদের পাথির্ব সম্পদ লুণ্ঠন বন্ধ করেন নাই। তারা আরো বেশী কেড়ে নিতে সক্ষম ও ইচ্ছুক ছিলেন। একেবারে শুরু থেকেই, প্রথম ‘‘বিশ্বাসীদের কমান্ডার’’ মুহাম্মদ তার বন্ধু ও আত্মীয়দের কাছ থেকে নারী দখল করে নিতে ইতঃস্তত করেন নাই। মুহাম্মদের কমপক্ষে দুইজন স্ত্রী ছিল দখল করা; একজন ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর কাছ থেকে এবং একজন তার পালক পুত্রের কাছ থেকে। খলীফারা অবশ্যই মুহাম্মদের দৃষ্টান্ত অনুসরণে দেরী করেন নাই। মুসলমানদের ইতিহাসের গোটা সময় জুড়ে খলীফা এবং সুলতানরা তাদের প্রজাদের কাছ থেকে নারী কেড়ে নিয়েছেন নিয়মিতভাবে। এমনকি এই নারীরা বিবাহিতা হলেও তাতে ঘটনার কোন হেরফের হত না। বিবাহ বিচ্ছেদের (তালাক) ইসলামী নিয়ম হচ্ছে একজন পুরুষ তার স্ত্রীকে “আমি তোমাকে তালাক দিলাম” এ কথা বললেই সব চুকে গেল। আর কিছুর দরকার হয় না। এর অর্থ হচ্ছে একজন স্বামীকে অতি সহজেই এ বাক্য তিনবার উচ্চারণে বাধ্য করা যেত। অনিচ্ছুক স্ত্রীকে রাজি করানোর জন্য নির্যাতন ও মৃ্ত্যুর হুমকিই যথেষ্ট ছিল।
লুণ্ঠনকারী কর্তৃত্বের এহেন সংস্কৃতিতে অবাক হওয়ার কিছু নাই যে ইসলামী জাহানে পুরুষরা নিজ নিজ স্ত্রীকে বোরকায় আবৃত করে লুকিয়ে রাখতে শুরু করেছিল। এই নূতন স্টাইলকে অবশ্যই শালীনতা অনুশীলনের সৎ প্রচেষ্টা আখ্যা দিয়ে ক্ষমা করা যায় ; কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর প্রকৃত কারণ ছিল মুসলিম বাড়ীঘরের বৈচিত্র্যহীন, জানালাবিহীন বর্হিভাগ নির্মাণের অনুরূপঃ আপনার সম্পদ লুকিয়ে রাখা।
(নিবন্ধটি John J. O’Neill-এর লেখা Hiding Your Assets: The Surprising Origin of the Burka & Niqab-এর বাংলায় ভাষান্তর। মূল ইংরাজী নিবন্ধটি ইসলাম ওয়াচ [Islam-Watch]-এ ২৫ মার্চ ২০১০ তারিখে প্রকাশিত হয়। জন জে, ও’নীল ‘‘হোলি ওয়ারিয়র্সঃ ইসলাম এন্ড দি ডিমাইজ অফ ক্ল্যাসিক্যাল সিভিলাইজেশন” নামক গ্রন্থের প্রণেতা।)
Thursday, October 11, 2018
মনোবিজ্ঞানের কোথাও তরুণ- তরুণীদের পারস্পারিক ভালবাসার কোন স্থান নেই
আমাদের সমাজের তরুণ-তরুণীদের মাঝে বর্তমানে যে সমস্যা বা বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গভীরে থেকে প্রবেশ করছে তা হল প্রেম।বেশিরভাগ তরুণ-তরুণীই মনে করে টিনেজ থেকে প্রেম শুরু করলে ভবিষ্যতে এই ব্যাপারটিকে খুব ভালভাবে বোঝা যাবে।তাই কোন মতে স্কুলের গণ্ডী পেরিয়েই তরুণ- তরুণীরা রিলেশনে জড়িয়ে পরে। অনেকে আবার স্কুল জীবনেই বান্ধবী প্রাপ্তির অপার আনন্দে জীবনকে ধন্য করে।এসকল বিষয়ে কোন অভিযোগ নেই তবে যোগাযোগ আছে বলে মাঝে মাঝে লিখি।
পৃথিবীর সকল জটিল সমস্যা মূলত বিজ্ঞানের মাধ্যমে সমাধান করা যায়।এমনকি মানুষের আবেগ- অনুভূতি এবং অপ্রকাশমান সকল বিষয়কেও বিজ্ঞানের আলোকে বিশ্লেষণ করা যায়। বিজ্ঞানের এই জনপ্রিয় শাখার নাম হল মনোবিজ্ঞান।এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার সাইকোলজি অনুচ্ছেদে মনোবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দেওয়া আছে এভাবে- “psychology is the science of individual or group behavior.The word ‘psychology’ literally means “study of the mind”;the issue of the relationship of mindand body is pervasive in psychology.” তরুণ-তরুণীদের যে পারস্পারিক অন্তরঙ্গতাকে আমাদের সমাজ স্বাদরে গ্রহণ করছে পবিত্রতার মাপকাঠি দিয়ে যাচাই করে,চলুন মনোবিজ্ঞানের আলোকেই বিশ্লেষণ করি সেই পবিত্র অনুভুতির প্রকৃত অবস্থান কোথায়।
‘ইমোশন’ কথাটির বাংলা অর্থ আবেগ।আক্ষরিক অর্থে আবেগ হল মানুষের আলোড়িত অবস্থা।মা-বাবা,ভাই-বোন,বন্ধু-বন্ধু বা প্রেমিক-প্রেমিকা যে ধরনের ভালবাসার কথাই আমরা বলি না কেন সব কিছু একই ডোমেইন এর মধ্যে অবস্থান করে,আর তা হল ইমোশন+মোটিভেশন। বি-লাভ এবং ডি-লাভঃ মনোগবেষক আব্রাহাম মেসলো নিজস্ব গবেষণার মাধ্যমে ভালোবাসার অভিধানে দুইটি সম্পূর্ণ নতুন পরিভাষা যোগ করেন;বি-লাভ এবং ডি-লাভ। তার মতে বি-টাইপের ভালবাসা হচ্ছে নিখুঁত ভালবাসা,এটি পরিণত ভালবাসা।উভয় নারী-পুরুষ যদি চারিদিক থেকে সমৃদ্ধ মনমানসিকতা নিয়ে পরিণত হতে পারে,উভয়ের ভুল- ত্রুটিকে মেনে নিতে পারে তাহলেই বিচ্ছুরিত হয় বি-টাইপের ভালবাসা, যা বেশমাত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ নারীপুরুষের মধ্যেই সম্ভব। অপরদিকে ডি টাইপের ভালবাসা অর্থ ডেফিসিয়েন্সি ভালবাসা।দুইজনের ভালবাসায় থাকে ঘাটতি।স্বার্থ নির্ভর এই ভালবাসায় নানা টানাপোড়ার সংঘাত তৈরি হতে থাকে।দুই জনের মনের মনস্তাত্ত্বিক মিলের ঘাটতি এক্ষেত্রে বেশীমাত্রায় লক্ষণীয়। এখানে থাকে খুঁত,কৃত্রিমতা।এই ধরনের ভালবাসার সাথে তরুণ- তরুণীদের পারস্পারিক অপূর্ণ ভালবাসার গভীর মিল পাওয়া যায়। মূলত মানুষের শরীরের বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানই তার আবেগীয়অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে।এমনই কিছু উপাদান হলঃএমফিটামিন,ফিনাইল- ইথাইলামিন বা পী পদার্থ,নরইপিনেপ্রিন,এন্ডরফিন্স ইত্যাদি। তরুণ-তরুণীদের মধ্যেকার ভালবাসা টিকে থাকার নজির খুবই বিরল।এসব রাসায়নিক পদার্থের আনুপাতিক পরিবর্তনের আলোকে একে সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়।প্রথম প্রথম যখন তরুণ-তরুণীরা রিলেশনে লিপ্ত হয় তখন তাদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি থাকে তীব্র আকুলতা।‘পী পদার্থ’ মূলত এই আকুলতাকে নিয়ন্ত্রণ করে।কিন্তু একই মুখ,একই চোখ এবং একই স্পর্শে পী পদার্থের নিঃসরণ মাত্রা দীর্ঘদিন একই রকম থাকে না।সময়ের পরিক্রমায় এটির নিঃসরণ মাত্রা এবং প্রতিক্রিয়ার তীব্রতা হ্রাস পায়।ভালবাসার উত্তাল জোয়ারে তখন নেমে আসে ভাঁটির টান।এই পুলকের নিম্নগতি শুরু হলেই বিচ্ছেদের অশনিসঙ্কেত বেজে ওঠে।তাই তরুণ- তরুণীদের মন প্রতিনিয়তই নতুন কিছু খুঁজতে থাকে। কিন্তু বিবাহিত নারী-পুরুষদের মধ্যে ভিন্ন ঘটনা ঘটে।মূলত এক্ষেত্রে দুজন মানব মানবী দীর্ঘদিন একসাথে থাকার কারণে একটি অদৃশ্য মায়ার বাঁধনে আটকে পড়ে।এই বাঁধনে শক্ত গিঁট এঁটে দেয় এন্ডরফিন্স নামক রাসায়নিক উপাদান এবং অক্সিটসিন নামক হরমন।‘এন্ডরফিন্স’ দু’জনের মাঝে শান্তি,সৌম্য আর নিরাপত্তার অনুভূতি জাগ্রত করে। উম্মত্ততার ঢেউ জাগায় না। সাধারনত উত্তাল অনুভূতি তৈরি হয় কম বয়সী প্রেমিক-প্রেমিকার মাঝে। কম বয়সের প্রেম দ্রুত মিলিয়ে গেলেও নিঃশেষ হয়ে যায় না। এদের প্রেম পাত্র থেকে পাত্রে সঞ্চালিত হয়।নতুন মুখ,নতুন চোখ,নতুন হাঁসি তুমুল উদ্দীপনায় ব্রেনকে উদ্দীপ্ত করে।তখন নতুন করেই সমান মাত্রায় পী পদার্থের নিঃসরণ বেড়ে যেতে পারে।নতুন প্রেমের জোয়ার পুনরুদ্দমে এভাবেই চলে আসতে পারে। পক্ষান্তরে এন্ডরফিন্স এর কারণে ভালবাসায় স্থিতি আসে বিধায় স্বামী- স্ত্রী নিজেদের অনেক ভুলত্রুটি সয়ে নিতে পারে।হুট করে এদের ভালবাসা চলে যায় না,রঙও বদলায় না।ভালোবাসাকে পবিত্র বলে চিহ্নিত করে অনেকে তরুণ-তরুণীদের মধ্যেকার ভালোবাসাকে প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন। অথচ মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ আলাদা। মনোবিজ্ঞান বলে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রেম-রোমান্স এর সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকে কামের নেশা।এই নেশা প্রথমে থাকে লুকনো।সুযোগ ও সময় পেলেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
প্রেম ও কাম তাই বিলীন হয়ে থাকে একই মুদ্রার দু’পিঠে। তখন সবকিছু আর আবেগের গণ্ডির মধ্যে থাকে না। মনোবিজ্ঞানের এই ধারণা যে আমাদের আধুনিক সমাজের সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ক্লার্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো স্যানফর্ড বেল তার ‘ A preliminary study of the emotion of love between sexes’ বইয়ের ৩৩০ পৃষ্ঠায় বলেছেন মানুষের সমগ্র জীবনকে সেক্সুয়াল অনুভুতির আদলে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়।প্রথম স্তর ৩-৮ বছর, দ্বিতীয় স্তর ৯-১৪ বছর, তৃতীয় স্তর ১৫ থেকে মেয়েদের জন্য ২২ এবং ছেলেদের জন্য ২৬ বছর।বাকি দুটো স্তর মানুষের মনমানসিকতার উপর নির্ভরশীল। প্রথম দুই স্তরের তুলনায় তৃতীয় স্তরকে তিনি বেশি ক্রিটিক্যাল বলেছেন।এই স্তরের নারী-পুরুষের মাঝেই মূলত রিলেশন ভাঙা গড়ার একটা প্রবণতা দেখা যায়।
দেহ ও মনের রসায়ন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কয়েকজন বিজ্ঞানী সাম্প্রতিক সময়ে প্রেমকে এক ধরনের উম্মাদনা বলে আখ্যায়িত করেছেন। প্রেমে আক্রান্ত নরনারী চিন্তা ও আচরণে যেন স্বপ্ন রাজ্যে ভেসে বেড়ায়।একটা ঘোড়ের মাঝে ডুবে থাকে সর্বদা। আচ্ছন্নতা গ্রাস করে তাদের সকল চাওয়া পাওয়া,গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড গুঁটিয়ে এসে যেন প্রেমিকার শরীরী অবয়ব ধারন করে।প্রেমের এই বিশিষ্টের সাথে মনোবিজ্ঞানীরা ‘ Obsessive Compulsive Disorder(OCD)’ এর মিল দেখতে পেয়েছেন। এটি একটি মানসিক রোগ।OCD আক্রান্তদের মনে একই চিন্তা বার বার মনের মাঝে জেগে ওঠে।একই কাজ বার বার করতে বাধ্য হয়। যারা প্রেমে পড়ে তাদের ভেতরও একই চিন্তা,একই মুখ বার বার মনের পর্দায় ভেসে ওঠে।একই উদ্বেগ অনুভূতি আশংকা মনের ভেতর ক্রমাগত ঘুরপাক খেতে থাকে। উভয়ক্ষেত্রে কেবল বাইরের আচরণের মধ্যেই নয়,ব্রেন এর ভেতরগত রাসায়নিক উপাদানের মাঝেও একই ধরনের মিল লক্ষণীয়। ইতালির পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডেনোটেলা মারটিজি এবং যুক্তরাষ্ট্রের মলিকুলার বায়োলজিস্ট ডিন হ্যামারের গবেষণার ফলাফল থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়েছে যে , OCD আক্রান্তদের নিউরোট্রান্সমিটারে সেরোটোনিন এর মাত্রা কমে যায়,তেমনি প্রেমে আক্রান্ত নারী-পুরুষের ও সেরোটোনিন কম থাকে।আবার অধ্যাপক হ্যামারের গবেষণায় দেখা গেছে,যাদের ব্রেনে দীর্ঘদিন ধরে সেরোটোনিন কম থাকে তারা অস্বাভাবিকভাবে যৌনকাতর হয়ে থাকে।এদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বেশি,যৌনক্ষমতাও বেশি।একিস্কাল আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন।তার মতে রোমান্টিক মনের মানুষ আসলে সাইক্লোথাইমিক রোগী। তারা যখন উৎফুল্ল থাকেন,ব্রেনে সেরোটোনিন এর মাত্রা বেড়ে যায়,তখন দ্রুতই তারা প্রেমে পড়েন।যখন বিষণ্ণ থাকেন,সেরোটোনিন এর মাত্রা কমে যায়,তখন আত্মঘাতী মনোভাবও আসতে পারে তাদের মাঝে।
আমার একটা ফ্রেন্ড এর কাহিনী বলি ।সে তার এক খালাতো বোন এর প্রেমে পড়ে।কিন্তু কখনও বলতে পারত না মেয়েটাকে।আবার তার প্রতি মেয়েটার ভক্তি দেখে সে ভাবতো মেয়েটাও হয়ত তার দিক থেকে পজিটিভ। মেয়েটা খুবই মিশুক টাইপের।তাই সবার সাথে মিশত,এমনকি তার ক্লাস এর ছেলেদের সাথেও।এসব দেখে আমার ফ্রেন্ডটা মোটেই সহ্য করতে পারত না।আবার এই ব্যাপারে মেয়েটাকে কিছু বলতেও পারতনা,যেহেতু মেয়েটাকে সে এখনও তার দুর্বলতার কথা বলেই নি।কিন্তু সব সময় মেয়েটার এই ব্যাপারগুলো তাকে খুব কষ্ট দিত।কিন্তু আমার বন্ধুটি যখন অন্যান্য মেয়েদের সাথে কথা বলত তখন তার খালাতো বোন কোন মাইন্ড করত না। আমার বন্ধুটা চাইত সে যেভাবে কষ্ট পেয়েছে ঠিক একই ভাবে মেয়েটিকে কষ্ট দিতে,কিন্তু কোন লাভ হতো না।এভাবে আমার বন্ধুটি মেয়েটার চিন্তায় তার পড়াশুনার জীবন পুরো নষ্ট করে ফেলে।কিন্তু ওইদিকে মেয়েটার কোন খবর নাই।
আমার বন্ধুটি আসলে প্যাথলজিক্যাল জেলাসিতে আক্রান্ত।এর আর এক নাম হল ওথেলো সিনড্রোম। এটি একধরণের ডিল্যুশনাল ডিসওর্ডার।মেয়েদের তুলনায় পুরুষেরা এই বিষয়টিতে বেশি ভুগে। মহিলা ও পুরুষের এতে আক্রান্ত হওয়ার আনুপাতিক হার ১:৩.৭৬। গবেষণায় দেখা গেছে,প্যাথলজিকাল জেলাসি কয়েকটি প্রাথমিক রোগের সাথেও সংযুক্ত থাকতে পারে।এ ধরনের রোগীদের ১৭-৪৪% এর সঙ্গে প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়া,৩-১৬% এর সঙ্গে ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার,৩৮-৫৭% এর সঙ্গে নিউরোসিস এবং পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার,৫-৭% এর সঙ্গে এলকোহলিজম এবং ৬-২০% ক্ষেত্রে অরগানিক ডিসঅর্ডার জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্যাথলজিকাল জেলাসির ফলে ভয়াবহ সহিংসতা ঘটে যেতে পারে। ব্রিটেনে ব্রডমুর হাঁসপাতালে ভর্তিরত ঘাতক রোগীদের(homicidal patients) ওপর পরিচালিত এক গবেষণা রিপোর্টে ডঃ মোয়াট দেখিয়েছেন,এদের মাঝে ১২% মহিলা এবং ১৫% পুরুষ প্যাথলজিকাল জেলাসিতে আক্রান্ত ছিল।এমনও দেখা গেছে ক্রমাগত তীব্র সন্দেহের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে অনেকে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছে। উপরের কেসস্ট্যাডি এবং তার পর্যালোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট যে অনেক মানসিক ভয়াবহ রোগের সাথে প্রেমের যোগাযোগ রয়েছে। ভালবাসা এক ধরনের পজিটিভ ইমোশন এই ব্যাপারে কেও আপত্তি করবে না।মূলত মানুষে মানুষে পারস্পারিক ভালবাসার ফলেই পৃথিবী টিকে আছে।কিন্তু মনোবিজ্ঞানের কোথাও তরুণ- তরুণীদের পারস্পারিক ভালবাসার কোন স্থান নেই এবং মনোবিজ্ঞান মনে করে এই ভালবাসার ফলাফল সমাজ এবং ব্যাক্তি জীবনের জন্য অসহনীয়।এতে ভালবাসায় লিপ্ত প্রেমিক-প্রেমিকারা যতই আপত্তি করুক আর প্রতিবাদ জানাক তাতে কোন কিছুই তাদের অনুকূলে যাবে না।
পৃথিবীর সকল জটিল সমস্যা মূলত বিজ্ঞানের মাধ্যমে সমাধান করা যায়।এমনকি মানুষের আবেগ- অনুভূতি এবং অপ্রকাশমান সকল বিষয়কেও বিজ্ঞানের আলোকে বিশ্লেষণ করা যায়। বিজ্ঞানের এই জনপ্রিয় শাখার নাম হল মনোবিজ্ঞান।এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার সাইকোলজি অনুচ্ছেদে মনোবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দেওয়া আছে এভাবে- “psychology is the science of individual or group behavior.The word ‘psychology’ literally means “study of the mind”;the issue of the relationship of mindand body is pervasive in psychology.” তরুণ-তরুণীদের যে পারস্পারিক অন্তরঙ্গতাকে আমাদের সমাজ স্বাদরে গ্রহণ করছে পবিত্রতার মাপকাঠি দিয়ে যাচাই করে,চলুন মনোবিজ্ঞানের আলোকেই বিশ্লেষণ করি সেই পবিত্র অনুভুতির প্রকৃত অবস্থান কোথায়।
‘ইমোশন’ কথাটির বাংলা অর্থ আবেগ।আক্ষরিক অর্থে আবেগ হল মানুষের আলোড়িত অবস্থা।মা-বাবা,ভাই-বোন,বন্ধু-বন্ধু বা প্রেমিক-প্রেমিকা যে ধরনের ভালবাসার কথাই আমরা বলি না কেন সব কিছু একই ডোমেইন এর মধ্যে অবস্থান করে,আর তা হল ইমোশন+মোটিভেশন। বি-লাভ এবং ডি-লাভঃ মনোগবেষক আব্রাহাম মেসলো নিজস্ব গবেষণার মাধ্যমে ভালোবাসার অভিধানে দুইটি সম্পূর্ণ নতুন পরিভাষা যোগ করেন;বি-লাভ এবং ডি-লাভ। তার মতে বি-টাইপের ভালবাসা হচ্ছে নিখুঁত ভালবাসা,এটি পরিণত ভালবাসা।উভয় নারী-পুরুষ যদি চারিদিক থেকে সমৃদ্ধ মনমানসিকতা নিয়ে পরিণত হতে পারে,উভয়ের ভুল- ত্রুটিকে মেনে নিতে পারে তাহলেই বিচ্ছুরিত হয় বি-টাইপের ভালবাসা, যা বেশমাত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ নারীপুরুষের মধ্যেই সম্ভব। অপরদিকে ডি টাইপের ভালবাসা অর্থ ডেফিসিয়েন্সি ভালবাসা।দুইজনের ভালবাসায় থাকে ঘাটতি।স্বার্থ নির্ভর এই ভালবাসায় নানা টানাপোড়ার সংঘাত তৈরি হতে থাকে।দুই জনের মনের মনস্তাত্ত্বিক মিলের ঘাটতি এক্ষেত্রে বেশীমাত্রায় লক্ষণীয়। এখানে থাকে খুঁত,কৃত্রিমতা।এই ধরনের ভালবাসার সাথে তরুণ- তরুণীদের পারস্পারিক অপূর্ণ ভালবাসার গভীর মিল পাওয়া যায়। মূলত মানুষের শরীরের বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানই তার আবেগীয়অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে।এমনই কিছু উপাদান হলঃএমফিটামিন,ফিনাইল- ইথাইলামিন বা পী পদার্থ,নরইপিনেপ্রিন,এন্ডরফিন্স ইত্যাদি। তরুণ-তরুণীদের মধ্যেকার ভালবাসা টিকে থাকার নজির খুবই বিরল।এসব রাসায়নিক পদার্থের আনুপাতিক পরিবর্তনের আলোকে একে সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়।প্রথম প্রথম যখন তরুণ-তরুণীরা রিলেশনে লিপ্ত হয় তখন তাদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি থাকে তীব্র আকুলতা।‘পী পদার্থ’ মূলত এই আকুলতাকে নিয়ন্ত্রণ করে।কিন্তু একই মুখ,একই চোখ এবং একই স্পর্শে পী পদার্থের নিঃসরণ মাত্রা দীর্ঘদিন একই রকম থাকে না।সময়ের পরিক্রমায় এটির নিঃসরণ মাত্রা এবং প্রতিক্রিয়ার তীব্রতা হ্রাস পায়।ভালবাসার উত্তাল জোয়ারে তখন নেমে আসে ভাঁটির টান।এই পুলকের নিম্নগতি শুরু হলেই বিচ্ছেদের অশনিসঙ্কেত বেজে ওঠে।তাই তরুণ- তরুণীদের মন প্রতিনিয়তই নতুন কিছু খুঁজতে থাকে। কিন্তু বিবাহিত নারী-পুরুষদের মধ্যে ভিন্ন ঘটনা ঘটে।মূলত এক্ষেত্রে দুজন মানব মানবী দীর্ঘদিন একসাথে থাকার কারণে একটি অদৃশ্য মায়ার বাঁধনে আটকে পড়ে।এই বাঁধনে শক্ত গিঁট এঁটে দেয় এন্ডরফিন্স নামক রাসায়নিক উপাদান এবং অক্সিটসিন নামক হরমন।‘এন্ডরফিন্স’ দু’জনের মাঝে শান্তি,সৌম্য আর নিরাপত্তার অনুভূতি জাগ্রত করে। উম্মত্ততার ঢেউ জাগায় না। সাধারনত উত্তাল অনুভূতি তৈরি হয় কম বয়সী প্রেমিক-প্রেমিকার মাঝে। কম বয়সের প্রেম দ্রুত মিলিয়ে গেলেও নিঃশেষ হয়ে যায় না। এদের প্রেম পাত্র থেকে পাত্রে সঞ্চালিত হয়।নতুন মুখ,নতুন চোখ,নতুন হাঁসি তুমুল উদ্দীপনায় ব্রেনকে উদ্দীপ্ত করে।তখন নতুন করেই সমান মাত্রায় পী পদার্থের নিঃসরণ বেড়ে যেতে পারে।নতুন প্রেমের জোয়ার পুনরুদ্দমে এভাবেই চলে আসতে পারে। পক্ষান্তরে এন্ডরফিন্স এর কারণে ভালবাসায় স্থিতি আসে বিধায় স্বামী- স্ত্রী নিজেদের অনেক ভুলত্রুটি সয়ে নিতে পারে।হুট করে এদের ভালবাসা চলে যায় না,রঙও বদলায় না।ভালোবাসাকে পবিত্র বলে চিহ্নিত করে অনেকে তরুণ-তরুণীদের মধ্যেকার ভালোবাসাকে প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন। অথচ মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ আলাদা। মনোবিজ্ঞান বলে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রেম-রোমান্স এর সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকে কামের নেশা।এই নেশা প্রথমে থাকে লুকনো।সুযোগ ও সময় পেলেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
প্রেম ও কাম তাই বিলীন হয়ে থাকে একই মুদ্রার দু’পিঠে। তখন সবকিছু আর আবেগের গণ্ডির মধ্যে থাকে না। মনোবিজ্ঞানের এই ধারণা যে আমাদের আধুনিক সমাজের সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ক্লার্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো স্যানফর্ড বেল তার ‘ A preliminary study of the emotion of love between sexes’ বইয়ের ৩৩০ পৃষ্ঠায় বলেছেন মানুষের সমগ্র জীবনকে সেক্সুয়াল অনুভুতির আদলে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়।প্রথম স্তর ৩-৮ বছর, দ্বিতীয় স্তর ৯-১৪ বছর, তৃতীয় স্তর ১৫ থেকে মেয়েদের জন্য ২২ এবং ছেলেদের জন্য ২৬ বছর।বাকি দুটো স্তর মানুষের মনমানসিকতার উপর নির্ভরশীল। প্রথম দুই স্তরের তুলনায় তৃতীয় স্তরকে তিনি বেশি ক্রিটিক্যাল বলেছেন।এই স্তরের নারী-পুরুষের মাঝেই মূলত রিলেশন ভাঙা গড়ার একটা প্রবণতা দেখা যায়।
দেহ ও মনের রসায়ন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কয়েকজন বিজ্ঞানী সাম্প্রতিক সময়ে প্রেমকে এক ধরনের উম্মাদনা বলে আখ্যায়িত করেছেন। প্রেমে আক্রান্ত নরনারী চিন্তা ও আচরণে যেন স্বপ্ন রাজ্যে ভেসে বেড়ায়।একটা ঘোড়ের মাঝে ডুবে থাকে সর্বদা। আচ্ছন্নতা গ্রাস করে তাদের সকল চাওয়া পাওয়া,গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড গুঁটিয়ে এসে যেন প্রেমিকার শরীরী অবয়ব ধারন করে।প্রেমের এই বিশিষ্টের সাথে মনোবিজ্ঞানীরা ‘ Obsessive Compulsive Disorder(OCD)’ এর মিল দেখতে পেয়েছেন। এটি একটি মানসিক রোগ।OCD আক্রান্তদের মনে একই চিন্তা বার বার মনের মাঝে জেগে ওঠে।একই কাজ বার বার করতে বাধ্য হয়। যারা প্রেমে পড়ে তাদের ভেতরও একই চিন্তা,একই মুখ বার বার মনের পর্দায় ভেসে ওঠে।একই উদ্বেগ অনুভূতি আশংকা মনের ভেতর ক্রমাগত ঘুরপাক খেতে থাকে। উভয়ক্ষেত্রে কেবল বাইরের আচরণের মধ্যেই নয়,ব্রেন এর ভেতরগত রাসায়নিক উপাদানের মাঝেও একই ধরনের মিল লক্ষণীয়। ইতালির পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডেনোটেলা মারটিজি এবং যুক্তরাষ্ট্রের মলিকুলার বায়োলজিস্ট ডিন হ্যামারের গবেষণার ফলাফল থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়েছে যে , OCD আক্রান্তদের নিউরোট্রান্সমিটারে সেরোটোনিন এর মাত্রা কমে যায়,তেমনি প্রেমে আক্রান্ত নারী-পুরুষের ও সেরোটোনিন কম থাকে।আবার অধ্যাপক হ্যামারের গবেষণায় দেখা গেছে,যাদের ব্রেনে দীর্ঘদিন ধরে সেরোটোনিন কম থাকে তারা অস্বাভাবিকভাবে যৌনকাতর হয়ে থাকে।এদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বেশি,যৌনক্ষমতাও বেশি।একিস্কাল আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন।তার মতে রোমান্টিক মনের মানুষ আসলে সাইক্লোথাইমিক রোগী। তারা যখন উৎফুল্ল থাকেন,ব্রেনে সেরোটোনিন এর মাত্রা বেড়ে যায়,তখন দ্রুতই তারা প্রেমে পড়েন।যখন বিষণ্ণ থাকেন,সেরোটোনিন এর মাত্রা কমে যায়,তখন আত্মঘাতী মনোভাবও আসতে পারে তাদের মাঝে।
আমার একটা ফ্রেন্ড এর কাহিনী বলি ।সে তার এক খালাতো বোন এর প্রেমে পড়ে।কিন্তু কখনও বলতে পারত না মেয়েটাকে।আবার তার প্রতি মেয়েটার ভক্তি দেখে সে ভাবতো মেয়েটাও হয়ত তার দিক থেকে পজিটিভ। মেয়েটা খুবই মিশুক টাইপের।তাই সবার সাথে মিশত,এমনকি তার ক্লাস এর ছেলেদের সাথেও।এসব দেখে আমার ফ্রেন্ডটা মোটেই সহ্য করতে পারত না।আবার এই ব্যাপারে মেয়েটাকে কিছু বলতেও পারতনা,যেহেতু মেয়েটাকে সে এখনও তার দুর্বলতার কথা বলেই নি।কিন্তু সব সময় মেয়েটার এই ব্যাপারগুলো তাকে খুব কষ্ট দিত।কিন্তু আমার বন্ধুটি যখন অন্যান্য মেয়েদের সাথে কথা বলত তখন তার খালাতো বোন কোন মাইন্ড করত না। আমার বন্ধুটা চাইত সে যেভাবে কষ্ট পেয়েছে ঠিক একই ভাবে মেয়েটিকে কষ্ট দিতে,কিন্তু কোন লাভ হতো না।এভাবে আমার বন্ধুটি মেয়েটার চিন্তায় তার পড়াশুনার জীবন পুরো নষ্ট করে ফেলে।কিন্তু ওইদিকে মেয়েটার কোন খবর নাই।
আমার বন্ধুটি আসলে প্যাথলজিক্যাল জেলাসিতে আক্রান্ত।এর আর এক নাম হল ওথেলো সিনড্রোম। এটি একধরণের ডিল্যুশনাল ডিসওর্ডার।মেয়েদের তুলনায় পুরুষেরা এই বিষয়টিতে বেশি ভুগে। মহিলা ও পুরুষের এতে আক্রান্ত হওয়ার আনুপাতিক হার ১:৩.৭৬। গবেষণায় দেখা গেছে,প্যাথলজিকাল জেলাসি কয়েকটি প্রাথমিক রোগের সাথেও সংযুক্ত থাকতে পারে।এ ধরনের রোগীদের ১৭-৪৪% এর সঙ্গে প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়া,৩-১৬% এর সঙ্গে ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার,৩৮-৫৭% এর সঙ্গে নিউরোসিস এবং পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার,৫-৭% এর সঙ্গে এলকোহলিজম এবং ৬-২০% ক্ষেত্রে অরগানিক ডিসঅর্ডার জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্যাথলজিকাল জেলাসির ফলে ভয়াবহ সহিংসতা ঘটে যেতে পারে। ব্রিটেনে ব্রডমুর হাঁসপাতালে ভর্তিরত ঘাতক রোগীদের(homicidal patients) ওপর পরিচালিত এক গবেষণা রিপোর্টে ডঃ মোয়াট দেখিয়েছেন,এদের মাঝে ১২% মহিলা এবং ১৫% পুরুষ প্যাথলজিকাল জেলাসিতে আক্রান্ত ছিল।এমনও দেখা গেছে ক্রমাগত তীব্র সন্দেহের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে অনেকে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছে। উপরের কেসস্ট্যাডি এবং তার পর্যালোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট যে অনেক মানসিক ভয়াবহ রোগের সাথে প্রেমের যোগাযোগ রয়েছে। ভালবাসা এক ধরনের পজিটিভ ইমোশন এই ব্যাপারে কেও আপত্তি করবে না।মূলত মানুষে মানুষে পারস্পারিক ভালবাসার ফলেই পৃথিবী টিকে আছে।কিন্তু মনোবিজ্ঞানের কোথাও তরুণ- তরুণীদের পারস্পারিক ভালবাসার কোন স্থান নেই এবং মনোবিজ্ঞান মনে করে এই ভালবাসার ফলাফল সমাজ এবং ব্যাক্তি জীবনের জন্য অসহনীয়।এতে ভালবাসায় লিপ্ত প্রেমিক-প্রেমিকারা যতই আপত্তি করুক আর প্রতিবাদ জানাক তাতে কোন কিছুই তাদের অনুকূলে যাবে না।
Subscribe to:
Posts (Atom)