বছর দুয়েক আগে কলকাতার সল্টলেকে একটি ডিম খেয়ে অন্য ডিম ছোয়ার অপরাধে আমায় পুরো ষোলটি ডিমের দাম দিতে হয়েছিলো। এর পিছনে ঐ রেষ্ট্রুরেন্ট মালিকের যুক্তি ছিলো, এটা নাকি অশুচিতা। তারা এটাকেই ধর্মীয় বিধান বলে মেনে নিয়েছেন। তিনি ছিলেন গুরুর কাছ থেকে দীক্ষাপ্রাপ্ত এবং তিনি তার গুরুর দ্বারা ধর্ম সম্পর্কে প্রভাবিত ছিলেন। তাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। যদি বলেই দেয়া হয় এটাই সত্য , একে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না , তাহলে আর চিন্তার জায়গাটা কোথায় থাকে বলুন ।ধর্মীয় মৌলবাদের সবচেয়ে সুবিধাজনক অস্ত্র হলো, তাদেরকে কোন কিছুর ব্যাখ্যা দিতে হয় না। ‘যেখানে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু’, সেখানে তর্ক কি খাটে?
লোকটির মত কিছু চিন্তাবিদ বা সোজা বাংলায় বলতে গেলে বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে প্রভাবিত হবার একটা ব্যাপার অন্য সবার মতো আমার মধ্যেও একসময় ছিল। সেটা দেশে এবং দেশের বাইরেও। মুক্তচিন্তার ক্ষেত্রেও ক্ষেত্রবিশেষ মানসিকভাবে দাসত্বের সৃষ্টি পরিলক্ষীত হয় । পারসুয়েশন ইজ এ ফর্ম অফ ভায়োলেন্স । কাউকে প্ররোচিত করাও ঠিক না। সেটা পরকালের মুলো দিয়েই হউক বা পার্থিব অর্জন দেখিয়েই হউক কারণ সেটা বিশ্লেষনী মন তৈরিতে সাহায্য করে না ।
কয়েকজন ছাড়া বেশিরভাগ বাঙালি সাহিত্যিকদের রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো হয়তো চর্বিতচর্বণ, নয়তো ধর্মীয় পুনর্জাগরণ। এর বাইরে চিন্তা, যুক্তি এবং মনীষার সাহায্যে সামাজিক ডগ্মা বা বদ্ধমতসমূহের অসারতা প্রমাণ করেছেন তেমন লেখক-কবি বাঙালি সমাজে খুব কম এসেছেন। বাঙালী সমাজ স্বাধীন চিন্তাকেই সবচেয়ে ভয় করে। তার মনের আদিম সংস্কারগুলো কাটেনি। সে কিছুই গ্রহণ করে না মনের গভীরে। ভাসাভাসা ভাবে অনেক কিছুই জানার ভান করে , আসলে তার জানাশোনার পরিধি খুবই সঙ্কুচিত।
আর সে যদি হয় বাঙালি মুসলমান তাহলেতো কথাই নেই। বাঙালী মুসলমানের মন এখনো একেবারে অপরিণত, সবচেয়ে মজার কথা এ-কথাটা ভুলে থাকার জন্যই সে প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে কসুর করে না। যেহেতু আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং প্রসারমান যান্ত্রিক কৃৎকৌশল স্বাভাবিকভাবে বিকাশলাভ করছে এবং তার একাংশ সুফলগুলোও সে ভোগ করছে, ফলে তার অবস্থা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে এঁচড়েপাকা শিশুর মতো। অনেক কিছুরই সে সংবাদ জানে, কিন্তু কোনো কিছুকে চিন্তা দিয়ে, যুক্তি দিয়ে, মনীষা দিয়ে আপন করতে জানে না। যখনই কোনো ব্যবস্থার মধ্যে কোনরকম অসংগতি দেখা দেয়, গোঁজামিল দিয়েই আনন্দ পায় এবং এই গোঁজামিল দিতে পারাটাকে রীতিমত প্রতিভাবানের কর্ম বলে মনে করে। শিশুর মতো যা কিছু হাতের কাছে, চোখের সামনে আসে, তাই নিয়েই সে সন্তুষ্ট। দূরদর্শিতা তার একেবারেই নেই, কেননা একমাত্র চিন্তাশীল মনই আগামীকাল কি ঘটবে সে বিষয়ে চিন্তা করতে জানে। বাঙালী মুসলমান বিমূর্তভাবে চিন্তা করতেই জানে না এবং জানে না এই কথাটি ঢেকে রাখার যাবতীয় প্রয়াসকে তার কৃষ্টি-কালচার বলে পরিচিত করতেও কুণ্ঠিত হয় না।
একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, বাঙালি মুসলমান তার চিন্তার সাবলকত্ত্বে উন্নীত হতে পারেনি । তাই উন্নত স্তরের সাহিত্য ,দর্শন বা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তার স্ফুরণ ঘটেনি। যারা উন্নত বিজ্ঞান, সাহিত্য বা সংস্কৃতির স্রষ্টা হতে পারে না তাদের দ্বারা উন্নত রাষ্ট্র সৃষ্টিও সম্ভব নয় । আর্যদের দ্বারা, ব্রাম্মনদের দ্বারা নির্যাতিত (দার্শনিক এবং আর্থিক), ইংরেজি শিখবে না বলে মরণপণ এ মুসলমান মোঘলদেরদের স্বজাতি (অন্তত ধর্মে) ভেবে তাদের দ্বারাও প্রত্যাখ্যাত হয়ে দিশেহারা হওয়াই ছিল তার ইতিহাস। তার মধ্যে কোন মুক্ত,স্বাধীন, চিন্তা গড়ে উঠেনি। সে হয়ত কাউকে অনুসরণ করতে যেয়ে এই উনুন থেকে ওই উনুনে নিজেকে নিক্ষিপ্ত করেছে।
দাস দ্বারা পরিবেষ্টিত স্বাধীনতা মূল্যহীন। তাই আপনি একজন প্রগতিশীল বা অশ্লীল যাই হোন না কেন আপনার মানসিক দাসত্বই সাংস্কৃতিক দাসত্বেরই বাই প্রোডাক্ট মাত্র। মোমবাতি প্রজ্জলনকে হিন্দুয়ানী ব্যাপার মনে হতে পারে, কিন্তু এটা যে অন্ধকারের মধ্যে আলো ছড়িয়ে দেবার একটা এলিগরী বা রূপক এটা বোঝার মত সামান্য মুক্ত চিন্তাও আপনার নাও হতে পারে।একজন ভৃত্য সাহিত্য পাঠক একটা সাংস্কৃতিক দাসত্বের উপজাত ছাড়া আর কিছুই নয়।
এই আবদ্ধ সংস্কৃতির ঘেরাটোপে ধর্ম একটা ব্যবসা সফল জিনিষ, আর এর সাথে যদি যৌনতা যোগ হয় এবং তাও যদি হয় সুড়সুড়ির আকারে, তাহলে তো কথাই নেই ।
No comments:
Post a Comment