Sunday, September 30, 2018

মুক্তপ্রাণ আমি

ভেজা আঙ্গুলে টাচস্ক্রিণ মোবাইল কাজ করতে চায় না।বিশ্রী একটা সমস্যা। ৪/৫ বার চেষ্টা করেও ইনকামিং কলটা রিসিভ করা যাচ্ছে না।মোবাইলটা ট্যা ট্যা করে  চিৎকার করে যাচ্ছে। ইচ্ছা হচ্ছে আছাড় মেরে মোবাইল ভেঙ্গে ফেলতে।  চরম বিরক্তি নিয়ে মোবাইলের স্ক্রিণে ভেজা আঙ্গুল বাম থেকে ডানে ঘসে কল রিসিভের ব্যর্থ চেষ্টা করছি, তারপর উপায়ুন্ত না পেয়ে পাওয়ার বাটন চেপে কলটা সাইলেন্ট করে ফেলেছি। দিশেহারা হয়ে ভাবার চেষ্টা করছি, এখন আমার কি করা উচিত। চেপে রাখা বিরক্তিটা আর ভিতরে দমিয়ে রাখতে না পেরে একসময় বলেই বসি - ধুর বাল !!! পাশে থাকা জুনিয়র অবাক হয়ে তাকায় আমার দিকে।
আমার মুখে এমন সাদামাটা গালিটা খুব বেমানান শোনায়। অপ্রত্যাশিতও বটে।  হঠাত বিপদ, মানুষের যত্নে গড়া পার্সোনালিটি ভেঙ্গে দেয়, ব্রেইন যখন বড় রকম অপ্রত্যাশিত ধাক্কা খায় তখন ব্রেইনের কমান্ড ফাংশানে ঝামেলা হয়। ব্রেইন তখন সুশীল অনুশাসনের নিয়ন্ত্রণ হারায় সম্ভবত। আমি এখন আছি তেমন এক বিপদে।

অথচ একসময় শত বিরক্তিতেও  মুক্তপ্রাণ ছিলাম । সব ভাল লাগতো ।
এই শহর,
এর যত যন্ত্রনাদায়ক উপাদান,
এর নোংরা
এর গন্ধ
এর ক্ষত
সব স--ব ।
যা কিছু পার্থিব, তার ক্ষুদ্রতম উপাদানটার জন্যও মায়াটা অনুভব করার নামই মনে হয় জীবন।
এই উপলব্ধি নিয়ে এখনও বেঁচে থাকার প্রতিটা সেকেন্ড উসুল করে নিতে চাই ।

কখনো কোনো কিছু ভাল না লাগলে,চোখ বন্ধ করে বলতাম
see the world from a dying person's perspective, it looks good !!!

... কোটি লোকের এই শহরটাকে আমার মত করে কেউ দেখে না।

Wednesday, September 5, 2018

ভৃত্য সাহিত্য পাঠক একটা সাংস্কৃতিক দাসত্বের উপজাত

বছর দুয়েক আগে কলকাতার সল্টলেকে  একটি ডিম খেয়ে অন্য ডিম ছোয়ার অপরাধে আমায় পুরো ষোলটি ডিমের দাম দিতে হয়েছিলো। এর পিছনে ঐ রেষ্ট্রুরেন্ট মালিকের যুক্তি ছিলো, এটা নাকি অশুচিতা।  তারা এটাকেই ধর্মীয় বিধান বলে মেনে নিয়েছেন। তিনি ছিলেন গুরুর কাছ থেকে দীক্ষাপ্রাপ্ত এবং তিনি তার গুরুর দ্বারা  ধর্ম সম্পর্কে প্রভাবিত ছিলেন। তাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।  যদি বলেই দেয়া হয় এটাই সত্য , একে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না , তাহলে আর চিন্তার জায়গাটা কোথায় থাকে বলুন ।ধর্মীয় মৌলবাদের সবচেয়ে সুবিধাজনক অস্ত্র হলো, তাদেরকে কোন কিছুর ব্যাখ্যা দিতে হয় না। ‘যেখানে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু’, সেখানে তর্ক কি খাটে?
লোকটির মত কিছু চিন্তাবিদ  বা সোজা বাংলায় বলতে গেলে বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে  প্রভাবিত হবার একটা ব্যাপার অন্য সবার মতো আমার মধ্যেও একসময় ছিল। সেটা দেশে এবং দেশের বাইরেও। মুক্তচিন্তার ক্ষেত্রেও ক্ষেত্রবিশেষ মানসিকভাবে দাসত্বের সৃষ্টি পরিলক্ষীত হয় । পারসুয়েশন ইজ এ ফর্ম অফ ভায়োলেন্স । কাউকে প্ররোচিত করাও ঠিক না। সেটা পরকালের মুলো দিয়েই হউক বা পার্থিব অর্জন দেখিয়েই হউক কারণ সেটা বিশ্লেষনী মন তৈরিতে সাহায্য করে না ।
কয়েকজন ছাড়া বেশিরভাগ বাঙালি সাহিত্যিকদের রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো হয়তো চর্বিতচর্বণ, নয়তো ধর্মীয় পুনর্জাগরণ। এর বাইরে চিন্তা, যুক্তি এবং মনীষার সাহায্যে সামাজিক ডগ্‌মা বা বদ্ধমতসমূহের অসারতা প্রমাণ করেছেন তেমন লেখক-কবি বাঙালি সমাজে খুব কম এসেছেন। বাঙালী  সমাজ স্বাধীন চিন্তাকেই সবচেয়ে ভয় করে।   তার মনের আদিম সংস্কারগুলো কাটেনি। সে কিছুই গ্রহণ করে না মনের গভীরে। ভাসাভাসা ভাবে অনেক কিছুই জানার ভান করে , আসলে তার জানাশোনার পরিধি খুবই সঙ্কুচিত।
আর সে যদি হয় বাঙালি মুসলমান তাহলেতো কথাই নেই। বাঙালী মুসলমানের মন এখনো একেবারে অপরিণত, সবচেয়ে মজার কথা এ-কথাটা ভুলে থাকার জন্যই সে প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে কসুর করে না। যেহেতু আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং প্রসারমান যান্ত্রিক কৃৎকৌশল স্বাভাবিকভাবে বিকাশলাভ করছে এবং তার একাংশ সুফলগুলোও সে ভোগ করছে, ফলে তার অবস্থা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে এঁচড়েপাকা শিশুর মতো। অনেক কিছুরই সে সংবাদ জানে, কিন্তু কোনো কিছুকে চিন্তা দিয়ে, যুক্তি দিয়ে, মনীষা দিয়ে আপন করতে জানে না। যখনই কোনো ব্যবস্থার মধ্যে কোনরকম অসংগতি দেখা দেয়, গোঁজামিল দিয়েই আনন্দ পায় এবং এই গোঁজামিল দিতে পারাটাকে রীতিমত প্রতিভাবানের কর্ম বলে মনে করে। শিশুর মতো যা কিছু হাতের কাছে, চোখের সামনে আসে, তাই নিয়েই সে সন্তুষ্ট। দূরদর্শিতা তার একেবারেই নেই, কেননা একমাত্র চিন্তাশীল মনই আগামীকাল কি ঘটবে সে বিষয়ে চিন্তা করতে জানে। বাঙালী মুসলমান বিমূর্তভাবে চিন্তা করতেই জানে না এবং জানে না এই কথাটি ঢেকে রাখার যাবতীয় প্রয়াসকে তার কৃষ্টি-কালচার বলে পরিচিত করতেও কুণ্ঠিত হয় না।
 একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, বাঙালি মুসলমান তার  চিন্তার  সাবলকত্ত্বে উন্নীত হতে পারেনি । তাই উন্নত স্তরের সাহিত্য ,দর্শন বা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তার স্ফুরণ ঘটেনি।  যারা উন্নত বিজ্ঞান, সাহিত্য বা সংস্কৃতির স্রষ্টা হতে পারে না তাদের দ্বারা উন্নত রাষ্ট্র সৃষ্টিও সম্ভব নয় । আর্যদের দ্বারা, ব্রাম্মনদের দ্বারা নির্যাতিত (দার্শনিক এবং আর্থিক), ইংরেজি শিখবে না বলে মরণপণ এ মুসলমান মোঘলদেরদের স্বজাতি (অন্তত ধর্মে) ভেবে তাদের দ্বারাও প্রত্যাখ্যাত হয়ে দিশেহারা হওয়াই ছিল তার ইতিহাস। তার মধ্যে কোন মুক্ত,স্বাধীন, চিন্তা গড়ে উঠেনি। সে হয়ত কাউকে অনুসরণ করতে যেয়ে এই উনুন থেকে ওই উনুনে নিজেকে নিক্ষিপ্ত করেছে।
 দাস দ্বারা পরিবেষ্টিত স্বাধীনতা মূল্যহীন। তাই আপনি একজন প্রগতিশীল বা অশ্লীল যাই হোন না কেন আপনার মানসিক দাসত্বই    সাংস্কৃতিক  দাসত্বেরই বাই প্রোডাক্ট মাত্র।  মোমবাতি প্রজ্জলনকে  হিন্দুয়ানী  ব্যাপার মনে হতে পারে, কিন্তু এটা যে অন্ধকারের মধ্যে আলো ছড়িয়ে দেবার একটা এলিগরী বা রূপক এটা বোঝার মত  সামান্য মুক্ত চিন্তাও আপনার নাও হতে পারে।একজন ভৃত্য সাহিত্য পাঠক  একটা  সাংস্কৃতিক দাসত্বের  উপজাত ছাড়া আর কিছুই নয়।

এই আবদ্ধ সংস্কৃতির ঘেরাটোপে ধর্ম একটা ব্যবসা সফল জিনিষ, আর এর সাথে যদি যৌনতা যোগ হয়  এবং তাও যদি হয় সুড়সুড়ির আকারে, তাহলে তো কথাই নেই ।

Monday, September 3, 2018

ভগবানের উপর খুব বেশি নির্ভর করো না

যুক্তিনির্ভর বিজ্ঞান ছাড়া এই মানব সভ্যতা এগুতে পারে কি? সেটা যদি নাই হয়ে থাকে, তবে ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ দিয়েই রোগ-বালাই দূর করার চেষ্টা চালানো যেতে পারে। নিউটনের আপেল মাথায় না পড়ে উড়ে গেলো না কেন, এমন চিন্তাটাই মুক্তমনা হওয়ার প্রধান লক্ষণ। প্রচলিত ধ্যাণ-ধারণা এবং বদ্ধতার বাইরে ভাবেন বলে, আমরা পদার্থবিদ্যার জগতে আইনস্টাইনকে পাই, আর জীববিদ্যার জগতে ডারউইনকে। বলা হচ্ছে যে, জীববিজ্ঞান ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্বের উপরে ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত – এর স্বপক্ষে রয়েছে হাজারো উদাহরণ। ক্যানাডার টোরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে ২য় বর্ষে পড়ুয়া আমার বোনঝিও যখন বলে, “Life science is based on evolution theory”, বাংলা ব্লগের কোন এক মহারথী বিবর্তনবাদকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে উঠে পড়ে লাগেন, তখন তার জ্ঞানের দৌরাত্ম কতটুকু, তা নিয়ে আর প্রশ্নের অবকাশ থাকে না।
রিচার্ড ডকিন্স মূলতঃ একজন জীববিজ্ঞানী। তিনি তার জ্ঞানের আলোকে ধর্মকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন, এবং সবই দিয়েছেন নিজের পর্যবেক্ষণ এবং বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে। সুতরাং তার রেফারেন্স টেনে কথা বলাটা তাকে নবী-র স্তরে উন্নীত না করে বলা যেতে পারে, বিজ্ঞানসম্মত তার বিশ্লেষণকে উদ্ধৃত করা। মজার ব্যাপার হলো, বিজ্ঞানের যতদূর অগ্রগতি হয়েছে, এখন পর্যন্ত কেউই কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণায় কোন ধর্ম বা ধর্মীয় গ্রন্থের কোন বিষয়-আশয়কে রেফারেন্স হিসেবে উপস্থিত করতে পারেন নি। এইখানে ধর্ম সম্পূর্ণ ব্যর্থ। আর সম্ভবতঃ এই কারণেই এমেরিকার সংবিধানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষা পুরোপরি নিষিদ্ধ। আমরা বিবর্তনবাদ নিয়ে পড়াশুনা করবো (যদিও বাংলাদেশে বিবর্তনবাদ নিয়ে যে পড়াশুনা হয়, তাকে আধা-খ্যাঁচড়া বললে অত্যুক্তি হবে না), আবার বিপরীত দিকে বিবর্তন মনস্ক চিন্তাধারাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবো, তাতো হতে পারে না! তবে কি বিবর্তনবাদ মিথ্যা বা বিবর্তনবাদের মত এমন একটা বিদ্‌ঘুটে তত্ত্ব এই জগতে প্রচলিত আছে, সেটা জানার জন্য আধা-খ্যাঁচড়াভাবে বিবর্তনবাদ পড়ছি? অদ্ভূত তো! পড়ারই বা দরকার কি?
আপনি দেশে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ চাইবেন, আবার বিপরীতে যুক্তিবাদী এবং বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তাধারার বিরুদ্ধে চাপাতিহস্ত হবেন, অথবা চাপাতিহস্তদের ফাঁদে পা দিয়ে তথাকথিত আস্তিক-নাস্তিকের বিভেদের ফর্মূলায় উঠতে-বসতে নাস্তিকদের মুন্ডুপাত করবেন, এ কেমন কথা! নাস্তিক হওয়াটা ইসলাম ধর্মে অন্যায় হতে পারে, ইসলামধর্ম ত্যাগীরাও ধর্মের চোখে অত্যন্ত পাপী হতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্র! সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি কি এমনি এমনি অন্তর্ভূক্ত হয়েছিলো এই কালে? একটা কথা আমি বারে বারে বলি, এখনও বলছি, এই পৃথিবীতে মানুষের স্থায়ীত্ব যত দীর্ঘ হবে, মানুষ যতই সম্মুখ পানে ধাবিত হবে, স্বভাবতঃই মানুষ তার আশ-পাশের সবকিছুকে নিয়ে প্রশ্ন করবে, কষ্টিপাথরে যাচাই করবে এবং চ্যালেজ্ঞ করবে। বিজ্ঞান তাই করছে। এতে নির্দয়-নিষ্ঠুরভাব ধর্মগ্রন্থগুলোও বাছ-বিচারের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। ধর্মগ্রন্থের প্রতিটি বাণী, বাক্য, শব্দ, বর্ণ মানুষের পরীক্ষণ-নিরীক্ষণের কবলে পড়বে। মানুষের সীমা সীমিত, সেই সীমিত সীমায় সে অসীমের শক্তিকে বুঝবে কীভাবে, এধরণের গাল-গল্পে মানুষের মন ভরছে না, ভরেনি কখনো বলেই সবকিছুতেই প্রশ্ন রেখে উত্তর খোঁজা হচ্ছে, সে ধারাবাহিকতায় বিশ্বসভ্যতা এগুচ্ছে। এখানে অন্ধত্বের কানাকড়ি মূল্য নেই।
এই সত্যটা ব্লগার, ব্লগ জগতের একটা অংশ অনুধাবন করতে পারছে বলেই তারা মুক্তবুদ্ধি চর্চার জয়গান করছেন, সাহস দেখাচ্ছেন তাদের মতামত প্রকাশে। কিন্তু আরেকটা অংশ বিবিধ কারণে ধর্মের প্রসংগ এলেই, নিজেদের বাক্‌ স্বাধীনতাকে গুটিয়ে নিচ্ছেন। ধর্ম নিয়ে কোন প্রশ্ন বা চ্যালেজ্ঞ চোখে পড়লে তারা তার থেকে শত হাত দূরত্বে থাকার নীতি অবলম্বন করছেন। পাশাপাশি মুক্তবুদ্ধির চর্চার সেসব ব্লগারকে সন্দেহের চোখে দেখছেন। আর নাস্তিক্যবাদের ছিঁটে-ফোঁটা দেখলে তো কথাই নেই, গালি-গালাজ, নিন্দায় চরমে উঠছেন।
বাংলাদেশের সংবিধানে নাস্তিক্যবাদ অলিখিতভাবে এক অপরাধমূলক আইন বলে সংশোধনী হিসেবে যুক্ত হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। আপনি নাস্তিক হলে বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং বিবিধ নৃ-গোষ্ঠীর চেয়েও নিম্নমানের নাগরিক অধিকারপ্রাপ্ত হিসেবে পরিগণিত হবেন। এ যেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসীদের কাছে ইহুদীরা যেমন। আপনার নাগরিক অধিকার আদৌ আছে কী না সেটাই এখন বিবেচ্য। না, আপনি এখানে অচ্ছুৎ, কোনভাবেই আপনাকে বাংলাদেশের নাগরিক বলা যাবে না। বাংলাদেশে আপনার আদৌ স্থান নেই। এইজন্যই আপনার নিরাপত্তা না দিয়ে, আপনাকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে পুলিশ মহোদয় উপদেশ দিচ্ছেন, সরকার জেনে-শুনেও আপনার নিরাপত্তা দেবেন কোন দুঃখে। তাকে তো অন্ধ ধর্মীয় মৌলবাদকে পাশে নিয়ে চলতে হয়। নতুবা সরকারের পায়ের তলায় মাটি থাকে না। এমনই একটা ধর্মীয় গোঁড়ামীর জালে বাংলাদেশ আবদ্ধ যে, এ থেকে নিস্তার পেতে হলে ‘জীবন হাতে নিয়েই লেখালিখি’ করতে হয় বৈকি!
অচলায়তন ভাঙ্গার সময় হয়েছে বলেই অভিজিৎ, অনন্ত, নিলয়-কে জীবন বিসর্জন দিতে হয়। স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে লেখালেখি করি বলে ব্লগ জগতের মহারথী ’৭১ টিভি মিডিয়ায় নিজের গৌরব প্রকাশের দম্ভ দেখান, অথচ মুক্তিবুদ্ধি প্রচারের স্বাধীনতা রুদ্ধ হওয়াটা তিনি চোখ মেলে দেখেও দেখেন না। ৪৪ বছর আগের বাস্তবতা নিয়ে তিনি তার কলমে ঘাম ঝরান, কিন্তু বর্তমানের সংকটকে দেখেও সযত্নে, স্বার্থবাদিতায় জড়িয়ে যান। হয়ে উঠেন সরকারের বশংবদ।
’৭১-এর ধারবাহিকতায় সমাজ, মানুষ এবং সভ্যতার অগ্রগতির জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই করে এ পর্যন্ত যারা শহীদ হয়েছেন বর্তমান সময়ে অভিজিৎ, অনন্ত, নিলয় অগ্রগণ্য হয়ে থাকবেন। তারা বাংলাদেশের জনগণের দেখায়, শোনায় এবং চিন্তায় নতুন ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করার প্রয়াস পেয়েছেন। জনগণের চোখ-কান এবং মননে যুক্তিবাদ এবং বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরিতে ছিলেন সজাগ সৈনিক। ’৭১-এ স্বাধীনতাই আমরা অর্জন করেছি, কিন্তু আমাদের মুক্তবুদ্ধির বিকাশে যে বন্ধ্যাত্ব চলছিল, তাতে তারা নাড়া দিয়েছেন বলেই হুমায়ুন আজাদ-এর মতই মৌলবাদের ক্রোধান্ধের বলি হলেন।
বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডে সব ধরণের অনুভূতি নিষ্পিষ্ট, জর্জরিত হলেও শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুভূতিটা বড় বেশি অটুট রাখাটা জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। কারণ, বাংলাদেশের ইতিহাসে বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম পূর্বে কখনো এমন ধরণের কোন সংকটে নিপতিত হয় নি। ’৭১-এর আগে ও পরে বাম-রাজনীতির কমিউনিস্টরা ধর্মকে অস্বীকার করলেও ইসলাম বা অন্য কোন ধর্ম তখনও এমন সংকটে পড়েনি। এখন দু’চারজন ব্লগার তাদের লেখনীতে ইসলাম ধর্মের জন্য এমন সংকটের সৃষ্টি করেছে যে, একে ইনকিউবেটর বা ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিট (নিবিড় পর্যবেক্ষণ কক্ষে)-এ রাখা ছাড়া উপায় নেই। বাংলাদেশের মুসলিম জনগণের ধর্মানুভূতি এখন দারুণভাবে বিপর্যস্ত। পাইক-পেয়াদা দিয়ে তাকে সংরক্ষণ করতে হবে। পাইক-পেয়াদা ও তাদের হর্তাকর্তা সরকার বেশ উদাসীন ছিলেন বলে চাপাতি-প্রাণ কিছু মুমিন মুসলিম নাস্তিক-কাফের ব্লগারদের উপর ধর্মীয় আক্রোশে চাপাতিহস্ত হয়েছেন এবং কাপুরুষের মত জান-কবচ করে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। জানি না, আজরাইলের অংশগ্রহণ কতটুকু ছিলো সে জান-কবচে, আমার জানার খুবই ইচ্ছে। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এই ধর্মানুভূতিতে আঘাত নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। কিন্তু কাউকে চিন্তিত হতে আদৌ দেখি না, যখন নাস্তিক্যানুভূতি বা বিবর্তনানুভূতি ভীষণভাবে আঘাত প্রাপ্ত এবং জর্জরিত হয়।
ভঙ্গুর জিনিস অল্প আঘাতেই ভেঙ্গে পড়ে। তবে কি ইসলাম ধর্মটা খুবই ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে যে, নাস্তিকদের ক্যারিকেচার বা চ্যালেজ্ঞের মুখে পড়ে? অথচ এই নাস্তিকদের নরক বা নদর্মার কীট বলেই মনে করা হয়। এই নাস্তিকরা ঢাকা শহরের এডিস মশার মতই ভয়াবহ হয়ে উঠেছে বলেই তাদের চাপাতি দিয়ে বা গলা টিপে যেভাবেই হোক মেরে ফেলতে হবে। নাস্তিক নিধন অভিযান চলছে এখন দেশে। তাই দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে কিছু কিছু ব্লগার।
ডারউইন ধর্ম পালন করতেন কী না জানি না। কিন্তু তার বিবর্তনতত্ত্ব ভীষণভাবে ধর্মানুভূতিতে আঘাত করেছে, ধর্মগুলো সম্পূর্ণভাবে চ্যালেজ্ঞের মুখোমুখি হয়ে পড়েছে। এই ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কোন বক্তব্য আছে কী না, জানা নেই। বিগত ১৫০ বছরে ডারউইনের সেই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে ধর্মের প্রতি সেই চ্যালেজ্ঞ এমন এক পর্যায়ে উন্নীত যে, “১৯৯৫সালে আমেরিকার বিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলীদের মধ্যে চালানো জরীপে (Gallup poll, 1995) দেখা যায় এদের মধ্যে মাত্র ৫% সৃষ্টিবাদী, বাকি সবারই আস্থা আছে বিবর্তন তত্ত্বে। আর যারা জীববিজ্ঞান এবং প্রাণের উৎস নিয়ে গবেষণা করেন তাদের মধ্যে তো ইদানিংকালে সৃষ্টিবাদীদের খুঁজে পাওয়াই ভার। ৪,৮০,০০০ জন জীববিজ্ঞানীদের উপর চালানো জরিপে মাত্র ৭০০ জন সৃষ্টিতাত্ত্বিক পাওয়া গেছে, শতকরা হিসেবে যা ০.১৫ এরও কম। কিন্তু এদের মধ্যে আবার অনেকেই প্রাণের প্রাথমিক সৃষ্টি কোন এক সৃষ্টিকর্তার মাধ্যমে হয়েছে মনে করলেও তারপর যে প্রাণের বিবর্তন ঘটছে প্রাকৃতিক নিয়মেই তা মেনে নেন। এ জরিপের ফল শুধু আমেরিকার ভেতর থেকেই উঠে এসেছে, যে দেশটি আক্ষরিক অর্থেই ‘সৃষ্টিবাদীদের আখড়া’ হিসেবে পরিচিত এবং রাজনৈতিক এবং সামাজিক দিক দিয়ে অনেক বেশী রক্ষণশীল। এদিক দিয়ে অনেক বেশী প্রগতিশীল থাকা ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের মধ্যে কোন সৃষ্টিবাদী বিজ্ঞানী নেই বললেই চলে।
বহু বৈজ্ঞানিক সংগঠন বিবর্তনের স্বপক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণকে এতই জোরালো বলে মনে করেন যে, বিবর্তনের সমর্থনে তারা নিজস্ব statement পর্যন্ত প্রকাশ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, পৃথিবীর বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের নিয়ে গঠিত National Academy of Science এর মত প্রথিতযশাঃ সংগঠন ১৯৯৯ সালে বিবর্তনের স্বপক্ষে লিখিত বক্তব্য দিয়ে একটি ওয়েবসাইট পর্যন্ত প্রকাশ করেছে। ১৯৮৬ সালে লুজিয়ানা ট্রায়ালে বাহাত্তর জন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী সুপ্রিম কোর্টে বিবর্তনের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন প্রদান করেছিলেন।
জীববিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ববিজ্ঞান, জেনেটিক্স, জিনোমিক্স বা আণবিক জীববিদ্যার কোন শাখাই বিবর্তনের কোন সাক্ষ্যের বিরোধিতা করছে না; … ডারউইনের পরে গত দেড়শো বছরে … বিবর্তন তত্ত্ব পরিবর্ধিত এবং পরিমার্জিত হয়েছে। জেনেটিক্সের বিভিন্ন শাখার গবেষণা যে গতিতে এগিয়ে চলেছে তাতে আশা করা যায় আমরা অচিরেই আরও অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর পেতে সক্ষম হব। আর বিজ্ঞানীরা সে লক্ষ্যেই নিরন্তর কাজ করে চলেছেন।” [বিবর্তনের পথ ধরে (পরিশিষ্ট), পৃষ্ঠা ২২-২৩, বন্যা আহমেদ]।
সৃষ্টিবাদী তাদেরই বলে, যারা মনে করে, বিশ্বের এই তাবৎ প্রাণীকূল কোন এক সৃষ্টিকর্তার দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে। উপরের উদ্ধৃতি থেকে ভালভাবেই প্রতীয়মান যে, বাংলাদেশ এবং তার জনগণ বৈজ্ঞানিক চিন্তাকে এখনো যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে গ্রহণ করার মত মানসিকতায় উপনীত হয়নি। আর এ কারণেই ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের নগ্ন ফ্যাসিবাদী আচরণ এই ভূ-খন্ডে নির্মম হয়ে উঠেছে। দু’টি বিরুদ্ধ মত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থাকার যে দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হবার প্রয়োজন, সেই সংস্কৃতি থেকে আমরা অনেক দূরবর্তী। আমাদের ইসলাম ধর্মই সর্বশ্রেষ্ঠ, এই উদ্যত-উগ্র মনোভাব ভিন্নমতের বিকাশের পেছনে বড় অন্তরায়।
সে সাথে যারা প্রতিনিয়ত নতুন জ্ঞান এবং দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সভ্যতাকে হৃদ্য করছে, তাদের বেড়ে ওঠার, বেঁচে থাকার পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে এই উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদ। রাষ্ট্র নিজেকে এতই দুর্বল করে তুলেছে যে, সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি থেকে বেরিয়ে এসে এই নষ্ট ধর্মীয় মৌলবাদীতার সাথে আপোষকামী হয়ে উঠেছে। অথচ আমাদের ‘৭১-এর স্বাধীনতার মূলনীতি থেকে সেটা অনেক দূরে সরে আসা। এর জন্য দায়ী কে? সেটা হবে ভিন্ন এক আলোচনা। রাষ্ট্রকে এতটুকু সতর্ক থাকা উচিত যে, হিটলারেরও জার্মানীতে বিপুল জনসমর্থন ছিল। তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও সে সময় সেভাবে দানা বাঁধতে পারেনি। বর্তমান সরকার যদি এই অন্ধ মৌলবাদী জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার ছক আঁকে, তবে তা সেরকম রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় পরিবেশের দিকে আমাদের ঠেলে দেবে, যার ফলাফল হিটলারের জার্মানীর মত ভয়াবহ না হলেও তালেবানী আফগানিস্থানের মতই হবে ভয়াবহ। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে ধর্মবাদী ধার্মিক এবং যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক মুক্তমনারা সহ-অবস্থানের নীতিতেই চলছে সব ধরণের সংঘাত এড়িয়ে। বাংলাদেশে তা সম্ভব না হওয়ার জন্য দায়ী অন্ধ মৌলবাদী জনগণ এবং তাদের সরকার। আর তাই এই জনগণের সেন্টিমেন্ট বুঝে চলার নীতিতে বিশ্বাসী বাংলাদেশের সরকার, মিডিয়ায় মন্ত্রী এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী ব্যক্তিদের প্রকাশ্য বক্তব্য তারই প্রমাণ দিচ্ছে অনায়াসে।
বিজ্ঞান যুক্তি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণের উপর প্রতিষ্ঠিত। আর এসব কিছুই মুক্তমন এবং মুক্তবুদ্ধিতেই করতে হয়। যে কোন পূর্বতর সংস্কার এবং আবদ্ধ বিশ্বাস আমাদের অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গির লাগাম টেনে ধরাটাই খুব স্বাভাবিক। সৃষ্টিশীল এবং সৃজনশীলতার বিকাশে পরিপূর্ণ স্বাধীন চিন্তা ভীষণ অপরিহার্য। সুতরাং নবীন দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভাবনায়, পুরাতন সব কিছুই চ্যালেজ্ঞের মুখোমুখি হবেই। এতে আপনার জন্ম থেকে প্রাপ্য লালিত বিশ্বাসীয় অনুভূতি আঘাত প্রাপ্ত হয়, দায় আপনারাই। এ নতুন কালের বাস্তবতায় আপনাকেই আপনার অনুভূতি্র রাশ টেনে ধরতে হবে। আপনার প্রাচীন এই অনুভূতিকেই যুগের বাস্তবতায় তাবৎ প্রশ্ন এবং চ্যালেজ্ঞের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। অন্যের চিন্তার রাশ টানার অধিকার আপনাকে সংবিধানে দেয়া হয় নি। জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত বিশ্বে, স্বাধীন মত প্রকাশকে অনেক আগেই যায়েজ করা হয়েছে।
একজন বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, স্বনামধন্য জহির রায়হানও এই ইসলামী মৌলবাদীদের চরিত্র নিরূপণ করেছিলেন, তার ছাত্রাবস্থায়, “ … আজকের যুগে জন্মগ্রহণ করেও এ যুগের সাথে তারা নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না। বিজ্ঞানকে তারা অবজ্ঞা করছে। দর্শনকে করছে অস্বীকার। যুক্তিতর্ক মানতে তারা কোন সময়েই প্রস্তুত নয়। অন্ধ ভক্তির দর্শনে সকল যুক্তিকে নস্যাৎ করার জন্যে এরা সব সময় খড়গ হস্ত। বৈজ্ঞানিক ও সুচিন্তিত যুক্তিতর্ক নিয়ে যদি কেউ এদের সম্মুখীন হয় – তাহলে ভয়ে এদের বাকরুদ্ধ হয়, বুক দুরু দুরু করে, নাভিশ্বাস উঠে। তখন দিক বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে এরা চিৎকার করে বলে উঠে, ‘আমরা যা বলছি তা বিনা যুক্তিতেই বিশ্বাস করো। কেননা বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।” এরপরেও যদি কেউ যুক্তি যুদ্ধ চালাতে তৎপর হন, তাহলে আঃর রক্ষে নেই। এরা এদের অন্ধভক্তদের আপনার পিছনে লেলিয়ে দেবে। আঃর তারা আপনাকে শুধুমাত্র জাহান্নামে যাও বলে ক্ষ্যান্ত থাকবে না। আপনার ধড় থেকে প্রাণটাকে বিচ্ছিন্ন করে তবে তৃপ্ত হবে।” [জহির রায়হানের ১৯৫৬ সালের ডায়েরী থেকে যখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন।]
সুতরাং দ্বন্দ্বটা হচ্ছে, নতুন জ্ঞান আহরণের দিকে ধাবিত হওয়ার সাথে প্রাচীন বিশ্বাস এবং মূল্যবোধে আজীবন আকঁড়ে থাকার।
সম্প্রতি ভারতে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র মাঝি (MANJHI)-র কেন্দ্রীয় চরিত্র দশরথ মাঝিকে চলচ্চিত্রের শেষের দিকে জিজ্ঞেস করা হয় এক সাংবাদিকের ভাষ্যে, আপনি তো একজন সুপারম্যান, অসম্ভবকে সম্ভব করার পর আপনি কিছু একটা বলুন! তখন মাঝি উত্তর দিয়েছিলেন, ভগবানের উপর খুব বেশি নির্ভর করো না। সম্ভবতঃ ভগবানই আমাদের উপর নির্ভর করে আছে। তারপর তিনি হে হে করে যেভাবে হাসতে থাকেন, মনে হলো, আমাদের পুরো সমাজ বাস্তবতার মধ্যে লুকিয়ে থাকা অগাধ সত্যই যেন উচ্চারিত হলো, এক উপভোগ্য পরিহাসে। কবি নজরুলের কথার (মানুষ এনেছে ধর্ম, ধর্ম আনেনি মানুষ কোন) অন্য এক অনুরণন খুঁজে পাই মাঝির বক্তব্যে। বাংলা সাহিত্য দেব-নির্ভরতা বা দেব-বন্দনা থেকে বেরিয়ে এসেছে সেই মধুসূদনের আধুনিক কালের সূচনার ঠিক আগে আগেই, গেয়ে গেছে মানুষের অবারিত উন্মোচনের গান, তার অজেয় শক্তি ও অনুভূতির সুনিপুণ চিত্রাঙ্কন।
কিন্তু এখন আমাদের ভেতরের আদিম-প্রাচীন গুহায় নিত্য নতুন আলোর ঝলকানি আঁধারের মানুষদের ভীত করে তুলেছে। তারা ‘৭১-এ যেমন ইসলাম ধর্মের নামে মানবতার বিরুদ্ধে গণ-ঘাতক হয়ে উঠেছিলো, মানুষ হত্যা, লুটতরাজ, মা-বোন-কন্যাদের ধর্ষণের বস্তু বানিয়েছিলো, হিন্দু-মুসলিম অমানবিক এক ভেদাভেদ টেনে জাতিসত্ত্বাকে বিধ্বস্ত করেছিলো, এখনও সে ধারাবাহিকতায় আস্তিক-নাস্তিক ইস্যু তুলে দেশ ও জাতিকে ধ্বংসের প্রান্তে তুলে দিতে অতি তৎপর। আর মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারীরাই তাই তাদের গোঁদের উপর বিষফোঁড়া বলে তাদেরকে নিধন করাটা অতীব জরুরী হয়ে উঠেছে।
রাজনীতির সংস্পর্শে কোন কিছুকেই শুদ্ধ রাখা সহজ নয় বলে রাজনৈতিক ইসলামের এক ভয়াবহতা (যা থেকে রাষ্ট্র ‘৭১-এ বেরিয়ে আসতে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করেছিলো) রাষ্ট্রের উপর চাপিয়ে দিয়ে ধর্মান্ধ ইসলামী মৌলবাদ তাদের দায়িত্বের শেষ এবং শুরুকে এক বিন্দুতে নিয়ে এসেছে। এই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে উত্তরণে ব্লগারদের যথাযথ ভূমিকাই পালন অত্যাবশ্যক। প্রচলিত সরকার বা রাজনীতির তল্পি বহনকারী হিসেবে ব্লগারদের নিজেদের পরিচয় উন্মোচন করলে ইতিহাস ক্ষমা করবে না। সেই গুরু দায়িত্ব থেকেই ব্লগারদের সত্য উচ্চারণের কন্ঠকে আরো উচ্চকিত করতে হবে। এই অনলাইনের যুগে মুক্তমত প্রকাশে সরকার এবং মৌলবাদের স্বার্থে, কোন রকমের মুখা (MUZZLE ME NOT) পরিয়ে দেবার মত ছলচাতুরীকে দারুণভাবে উপেক্ষা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, জাতির বিবেককে এ সময়ে ধারণ করতে পারে, একমাত্র ব্লগাররাই, তাদের চিন্তাশীল এবং মেধাবী লেখনীতে।

Saturday, September 1, 2018

একটি বিস্মৃত মানব দেহ, যার আত্মার মৃত্যু হয়নি , কিন্তু পরিচিতির মৃত্যু ঘটেছে।

তবারক নাই হইয়া যাইতে পারে।
নাই হইয়া যাওয়া মানে মুখের কথা না। আবার নাই হইয়া যাওয়া মানে মইরা যাওয়া ও না। মানুষ কিভাবে নাই হয় ? মানে নাই হইয়া যাওয়া বলতে কি বুঝায় ? কোনো জিনিস শেষ হইয়া গেলে আমরা বলি নাই। কিন্তু মানুষ তো ডিব্বায় রাখা মুড়ি বা অর্ধেক খাইয়া পলিথিনের প্যাকেটের মুখ মোড়াইয়া রাখা বিস্কিট না যে নাই বলা যায়।তবারকের মৃত্যু হইসে এমন কথাও কেউ শুনে নাই। কিন্তু  বাঁইচা থাইকাও তবারক নাই হইয়া যাইতে পারে এটাও বা কেমন ব্যাপার ?

তবারক নাই হয়া যাইব !! করসে কি  ? মিনুরে এসিড মারসে? কারো মাথায় বারি মারসে?  কাউরে বলতকার করসে?। যদি এসব কিসু না করে  তাইলে তবারক নাই হইয়া যাইতে পারে  কেন? আসলে তবারক করসেটা কি ? তবারক দরমো লইয়া বিটলামী করসে। কি বিটলামী করসে?
  সে কইসে "ধৃ + মন প্রত্যয় থেকে ধর্মের উৎপত্তি হইসে। ধৃ অর্থ ধারণ করা আর মন অর্থ হৃদয়। পরশ্ন হইলো হৃদয়ে কি ধারন করবো মানুষ ? যা ধারন করলে মানব তথা জগতের কল্যাণ হয় তা ধারন করতে বলসে। আর তাই অইলো ধর্ম। আরো বলসে সকাল সইন্ধ্যা পূজা আর পাঁস ওয়াক্ত নামাজ নামাজ পড়িয়া দোয়া দূরুত মুখস্থ করলে মানবসভ্যতার কি উন্নতি হইবো?
এই ভাবনাটা আসলে তবারকের নিজস্ব। এই কথাগুলা বলার পর তার সাথে কাছের মানুষগুলা দূরত্ব  বজায় রাইখা চলে। নিজেদের  ম্যাস মেন্টালিটিই সীমানা টেনে বেঁধে দিয়েসে এসব কাছের মানুষদের। নিজের অস্তিত্বের প্রমাণ,  দিন দিন কইমা ঝাপসা হইয়া যাইতেসে বইলা তবারকের এমন মনে হয়। মাঝে মাঝে তবারকের মনে হয় সে কি আসলেই আছে ? তাহলে তারে কেউ দেখে না কেন?
এই পৃথিবীতে এখন তবারকের অস্তিত্বের প্রমাণ শুধুমাত্র ঋণে। চাকুরীর অন্নে যদি সে নির্ভরশীল না থাকতো, অফিসও হয়ত তবারকের থাকা, না থাকা নিয়া মাথা ঘামাইতো না। যদি তার কিছু ঋন না থাকতো তাহলে  তারাও খেয়াল করতো না তবারক আছে নাকি নাই। কয়েকবছর যে কয়টা জায়গায় তবারক চাকরীর ইন্টারভিউ দিসিলো, যেখানে তার চাকরী হয় নাই, অনেক গুলায় তো ইন্টার্ভিউও হয় নাই, সেই সব জায়গায় কেউ জানেনা তবারক আছে নাকি নাই। সামনের দিনগুলায় ও তবারক যেসব জায়গায় চাকরীর জন্য ইন্টার্ভিউ দিবে তারাও জানেনা তবারক নামের কেউ আছে নাকি নাই। যাদের সাথে তবারক স্কুলে, কলেজে পড়সিলো, তারা কোথায় আছে তবারক যেমন বলতে পারে না। তারাও জানেনা তবারক কোথায় আছে। এমনকি যারা তবারকের ঘাড়ে পা মাড়াইয়া নিজেদের নাম ফলাইসে তাদের কারো মনে পড়ে না তবারক বইলা কেউ ছিল। একই কথা তবারকের যে গুটিকয় আত্মীয় আছে, তাদের বেলায়ও খাটে।  মাঝে মাঝে তারা নিজেরা ফেসবুকে নিজেদের ছবি দেয়। নিজেদের যাপিত জীবনের নানা উপলক্ষ বা বিনা উপলক্ষে ছবি আপ করে, তাদের পরিচিত কেউ সেসবে লাইক দেয়। তারা টের পায় তারা আছে, তাদের পরিচিত কেউ আছে, অন্তত তাতেই তো তাদের ছবিতে লাইক পড়ে। তারা কেউ খেয়াল করে না ফেসবুকে তবারক বলে তাদের এক সহপাঠি বা আত্মীয় কোনো ছবি দেয় নাই, কারো ছবিতে লাইক দেয় নাই, কারো কোনো ফেসবুক পোস্টে কমেন্ট করে নাই। এই যে অন্য সবার মত ফেসবুকে নাই বইলা তবারকের জীবন নিয়া তাদের কোন উতসুক হবার ও চেতনা নাই।
তবারকের জীবন আছে, কিন্তু উপলক্ষ বা বিনা উপলক্ষে ছবি বা ফেসবুক পোষ্ট নাই বইলা, কারো বার্থডে, ডেথডে, তেলডে উইশ করেনা বইলা তবারক সামাজিক জীবনের স্বাদ গন্ধ ও ভুইলা যাইতেসে। তবারক নিমন্ত্রিত হয় না, তবারকের প্রশংসা বা নিন্দা হয় না, কেউ তবারককে মিস করে না। তবারক যে প্রতিদিন খাবার খায়, আদৌ কি খায় কিনা, এইটা কেউ জানেনা। কারন ফেসবুকে সেটার কোনো প্রমাণ নাই। তবারক কোথাও যায় কিনা, কিছু কিনে কিনা, কারো সাথে দেখা হয় কিনা, কেউ জানেনা। তবারকের পরিচিত কারো বিয়ে, জন্মদিন, পার্টি, মৃত্যু,  দাফন , জানাজা, কুলখানী কিছু হয় কিনা তাও কেউ জানেনা। এই পৃথিবীটা তবারকের সুন্দর লাগে কিনা, কোনো ঘটনায় তার খুশি, বিরক্ত, রাগ বা হতাশা হয় কিনা কেউ জানেনা। তবারক কখনো একটা সুন্দর ভোর বা সূর্যাস্ত দেখসে কিনা তাও কারো জানা নাই। তবারকের কোনো মেয়েরে ভাল লাগে কিনা, কারো জন্য তার বুকে হু হু করে কিনা বা কারো বাহুতে তবারকের আবেগ মিশ্রিত আশ্রয় হয় কিনা তাও কেউ জানে না। সবচেয়ে বড় কথা তবারকের চেহারা কেমন হইসে এখন, দুই মাস আগে চুল কাটার পর, তাও কেউ জানেনা। তবারক শেষ কবে সিনেমা দেখসে বা একটা গল্পের বই পড়সে তা কারো জানা নাই। মোদ্দা কথা এই পৃথিবী, এই দেশ, শহর বা সমাজ যাই বলি না কেন, কেউই জানেনা তবারক আছে নাকি নাই। আর কে কে জানে তবারক আছে, এটা অনেকে যেমন জানে না, তবারক ও জানেনা।

কেউ যখন খোজ করে না, মনে করে না এমন একটা মানুষ মৃত হইলে ঠিক আছে, কিন্তু জীবিত হইলে, এই অনুভুতিটা ভুতের মতন তারে অনুসরণ করে। ভর দুপুরেও, অন্ধকার অমাবস্যার রাতে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেতের মাঝখানে পথহারা মানুষের মতন আতংকগ্রস্থ কইরা তোলে। মাঝে মাঝে তবারকের ইচ্ছা করে চৌরাস্তার মাঝখানে দাঁড়াইয়া জোরে চিতকার দিতে। তাও যদি কয়েকটা মানুষ ঘুইরা তার দিকে তাকায়। আশে পাশের এত এত মানুষ তাও তবারকের সাথে যোগাযোগ হইয়া উঠার মত মানুষ নাই, এটা দিন দিন তারে নাই কইরা দিতেসে।


তবারক একটা বিস্মৃত মানব দেহ, যার আত্মার মৃত্যু হয় নাই, কিন্তু পরিচিতির মৃত্যু ঘটসে।