Tuesday, July 26, 2022

সমসাময়িকদের বিচার

সুনীল কোনও একটা লেখায় বলেছিলেন, তিনি তার সমসাময়িকদের বিচার করতে চান না। পূর্বসূরীদের কাজকে মূল্যায়ন করতেই তিনি পছন্দ করেন। সমসাময়িকদের ব্যাপারে চুপ থাকাই ভালো, তাদের বিচার করবে ভবিষ্যত প্রজন্ম। ঠিক কোন লেখায় সুনীল এ কথাগুলো বলেছিলেন তা আপাতত মনে পড়ছে না। তবে কথাগুলোকে ব্যক্তিগত ফিলোসফির অংশ করার চেষ্টা করছি অনেকদিন ধরেই, যদিও পুরোপুরি মেনে চলা সম্ভব হয় না। অনলাইনে এ ওর বিরুদ্ধে বক্তব্য, অমুকের বিরুদ্ধে তমুকের অভিযোগ দেখে দেখে ক্লান্ত। বাংলাদেশে কাউকে অসম্মান করতে প্রমাণ ছাড়াই অভিযোগ করাই যথেষ্ট। বিশ্বাসীরা আছেই তা লুফে নেয়ার জন্য। পুলিশ রেডি হয়ে আছে নির্দোষ-অপরাধী সবাইকেই গ্রেফতার করে মডেলদের মত দুই পাশে দাঁড়িয়ে মিডিয়ার সামনে ফটোসেশন করার জন্য। কে যে ঠিক আর কে যে ভুল তা আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ঢোকে না। এর চেয়ে সুনীলের মত পূর্বসূরীদের নিয়ে ব্যস্ত থাকাটাই মঙ্গলজনক মনে হচ্ছে।

“এখনও বহু বাধা হইতে হবে পার
আত্ম-কলহের বিষম পারাবার…

Tuesday, July 19, 2022

বাঙালী মুসলমান - আবদুল হক

“এক কালে বাঙ্গালী মুসলমানকে এমন কথাও কেউ জিজ্ঞাসা করতে পেরেছিল, ‘আপনি বাঙালী না মুসলমান’?… বাঙালী মুসলমান তার দীর্ঘ দিনের ইতিহাসে নিজেকে প্রবলভাবে এবং অবিচ্ছিন্নভাবে, অকুন্ঠিতভাবে এবং সগৌরবে নিজেকে বাঙালী বলে ঘোষণা করেনি। ঘোষণা করার কথাও তার মনে লক্ষনীয়ভাবে জাগেনি। আর এই কারণে বাঙালী হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তার ইতিহাস ব্যর্থতায় সমাকীর্ণ। এবং এ ব্যর্থতা কোনো এক বিশেষ ক্ষেত্রে নয়, প্রায় সব ক্ষেত্রেই।…

বাঙালী মুসলমান অতীতে সর্বদাই নিজেকে মুসলমান মনে করেছে; কিন্তু সেই সঙ্গে বাঙালীও মনে করেনি এবং এই কারণে তার ইতিহাস পৃথিবীর অন্যান্য ভূভাগ থেকে আগত মুসলমানদের ইতিহাসের অপ্রধান অংশমাত্রে পর্যবসিত হয়েছে। বাঙালী মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় ইতিহাস প্রধানতঃ বাংলায় আগত অবাঙালীদের রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের অঙ্গ মাত্র, এমনকি সে ইতিহাসে লীন। বাংলার ইতিহাস তাই আর যা কিছু হোক, বাঙালী মুসলমানের ইতিহাস নয়।…

এই ইতিহাস নিরীক্ষণ করলে মনে হয়, বাঙালী মুসলমানের ইতিহাস অনেকাংশে পশ্চিমাগত মুসলমানদের কাছে তার আত্মলোপ প্রচেষ্টারই ইতিহাস। বাঙালী মুসলমান যে বাঙালী, পশ্চিমাগত নয়, এই চিন্তার দ্বারা যেন সে পীড়িত হয়েছে; বাঙালী হওয়াটাকে সে যেন একটা অপরাধ বলেই গণ্য করছে; তাই সকল ক্ষেত্রে পশ্চিমাগত মুসলমানদের নেতৃত্বকে-তা ভালোই হোক আর মন্দই হোক-মেনে নেওয়াটাই তার মনে হয়েছে অবশ্যকরণীয়; বাঙালী মুসলমান তার নাম, তার পরিচ্ছদ, তার ধর্মচিন্তা, তার দর্শন-বিজ্ঞান-সংস্কৃতি-চিন্তা পুরোপুরি তাদের কাছ থেকে নেওয়ার চেষ্টা করেছে; সাহিত্যের উপাদান ও উপাখ্যানও প্রধানতঃ নিয়েছে তাদের কাছ থেকে; তার ভাষাকে বদলাবার চেষ্টা করেছে, কখনো কখনো বাংলা বর্ণলিপিও বর্জন করতে চেয়েছে, এমনকি বাঙলা ভাষাকেও অস্বীকার করার প্রয়াস পেয়েছে। সেই সঙ্গে অনেক বাঙালী মুসলমানের প্রবল ঔৎসুক্য দেখা গেছে নিজেকে কোনো আরব অথবা ইরানীর উত্তরপুরুষ বলে প্রমাণ করার জন্য।…

বাঙালী মুসলমান স্বদেশের ইতিহাস থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে অন্য মুসলিম দেশের ইতিহাসের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করতে চেয়েছে; অন্যভাবে বলতে গেলে, বাঙালী মুসলমান অন্যদেশের মুসলমানের ইতিহাসকেই নিজের ইতিহাস মনে করেছে, নিজস্ব ইতিহাস সৃষ্টির চেষ্টা করেনি; অন্য দেশের মুসলমানের জয়ে আনন্দ বোধ করেছে এবং পরাজয়ে বিমর্ষ হয়েছে, নিজে বিজয়ী হতে চায়নি।…

বাঙালী মুসলমান যদি নিজেকে বাঙালী মনে করতো, সগৌরবে এবং সবলে নিজেকে বাঙালী বলে ঘোষণা করতো এবং নিজের সত্তা ও ব্যক্তিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইতো তবে তার গোষ্ঠীচেতনা প্রবল হতে পারতো, তার চিন্তা সংহত হতে পারতো এবং অনুকরণবৃত্তি এত প্রবল হতে পারতো না। কিন্তু ঠিক এই বাঙালী হওয়াটাকেই সে একটা অনুচিত কাজ মনে করে এসেছে।…
স্বাধীনতার যুগে এ অবস্থার কিছু পরিবর্তন হয়েছে। এ যুগে অবাঙালী-অধ্যুষিত পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সহ-অবস্থান করতে গিয়ে বাঙালী মুসলমানকে ভাবতে হচ্ছে যে, সে বাঙালী। স্বাধীনতা-পূর্ব কালের তুলনায় এ চেতনার প্রকৃতি পৃথকঃ তখন হিন্দুর সঙ্গে সহ-অবস্থান করতে গিয়ে তাকে ভাবতে হতো সে মুসলমান; স্বাধীনতার যুগে অবাঙালী পাকিস্তানীদের সঙ্গে সহ-অবস্থান করতে গিয়ে স্বার্থ-সংঘাতের তাড়ণায় তাকে ভাবতে হচ্ছে সে বাঙালী। এ ভাবনার একটা প্রবল উজ্জ্বল ঐতিহাসিক উদাহরণ ভাষা আন্দোলন।…

কার ঐতিহ্য কতখানি সমৃদ্ধ এবং গৌরবময় সেটা একটা আপেক্ষিক ব্যাপার-আসল কথা হচ্ছে চেতনা ও গৌরববোধ। অন্যান্য দেশের কথা বাদ দিলেও পাকিস্তানে পাঠান, পাঞ্জাবী এবং সিন্ধীরাও সে-চেতনার অধিকারী, সে-চেতনায় সমৃদ্ধ ও বলবান। বাঙালী মুসলমান কখনই এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন হতে পারেনি। সে সচেতন হতে পারেনি যে তার গৌরববোধ, তার ঐতিহ্যবোধ কখনো অন্য ভূখণ্ডের মতো হতে পারে না। এমনকি অন্য কোনো মুসলিম মানব-গোষ্ঠীরও মতো নয়। সে সচেতন হতে পারেনি যে সে আরব নয়, ইরানী নয়, পাঠান-পাঞ্জাবী-সিন্ধী নয়-বাঙালী। তার প্রাকৃতিক পরিবেশ, তার ভাষা, এবং তার আরও অনেক নিজস্ব সম্পদ তাকে অলঙ্ঘনীয়ভাবে পৃথিবীর আর সব মানব-গোষ্ঠী থেকে স্বতন্ত্র করে দিয়েছে।… শুধু ধর্মের ঐক্য দিয়ে এই স্বাতন্ত্র্যকে মুছে ফেলা সম্ভব না, সম্ভব হয়নি কখনো। কিন্তু বাঙালী মুসলমান ঠিক এই ব্যাপারেই সচেতন থাকতে পারেনিঃ বহুকাল যাবৎ এই একটি কথা মন্ত্রের মতো তার কানের কাছে আওড়ানো হয়েছে যে ধর্ম ছাড়া বিবেচনা করার আর কিছু নেই, গর্ব করার আর কিছু নেই, এবং ধর্মপ্রাণতার বড়ো প্রমাণই হচ্ছে নিজের বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তিত্ব ভুলে আরব-ইরানিয়ার চর্চা করা। নানাভাবে তাকে বোঝানো হয়েছে যে সে যে বাঙালী, একথা ভুলে যাওয়াই মুসলমানত্বের পরম পরিচয়। পুঁথি-সাহিত্য সহ সমগ্র মুসলিম বাংলা সাহিত্যকে পরিমাণগতভাবে দেখলে দেখা যাবে, এই সাহিত্যে বাঙালী মুসলমানের কথা আজ পর্যন্ত যত লেখা হয়েছে, অবাঙালী মুসলমান, অবাঙালী অমুসলমান, এবং আরব-ইরানী সংস্কৃতির কথা লেখা হয়েছে ঢের বেশী”।…

বাঙালী মুসলমানঃ ভূমিকা ও নিয়তি
-আবদুল হক।

>>১৯৭১ সালের আশেপাশের সময়কালে বাঙালী মুসলমান অনেকটাই বাঙালী হয়ে উঠেছিল, ফলস্বরূপ সফলতাও পেয়েছিল হাতেনাতে। আজ তারা আবার বাঙালীয়ানা বাদ দিয়ে মুসলমান হতে ব্যস্ত। অর্থাৎ হাজার বছরের পুরনো রাত আবার বাড়ছে। সিকানদার আবু জাফর সম্পাদিত প্রগতিশীল পত্রিকা ‘সমকাল’-এ ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত এই প্রবন্ধটি তাই এখনও প্রাসঙ্গিক। এই প্রবন্ধটি আবদুল হকের ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ ও অন্যান্য প্রবন্ধ বইতে আছে।

অং-বং ধর্মের সংস্কৃতি ও আদি ঐতিহ্য

আপনি কি জানেন মূর্তি ভাংগা, বাড়িঘর লুটপাট অং-বং ধর্মের সংস্কৃতি ও আদি ঐতিহ্যেরই অংশ। অং-বং ধর্মের অবতার নিজে ভেঙেছিলেন। সুতরাং অং-বং ধর্মের অনুসারীরা প্রতিবার ভুং-চুং ধর্মের উৎসবের সময় মূর্তি ভাংগে,ভাংবে। আবার অং-বংদের অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হলেও এমন হয়। এই নিয়ে অবাক হবার কিছু নেই, প্রতিবাদ করেও লাভ নেই, কারণ অং-বং ধর্মের লোকেরাই হীরক রাজার দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাছাড়া হীরক রাজা নিজেই একজন নিষ্ঠাবান অং-বং। তিনি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে অং-বং ধর্মের মহাপবিত্র গ্রন্থাবলী পাঠ করেন, প্রতি পাঁচ বছর অন্তর-অন্তর তীর্থস্থানেও যান এবং অং-বং সনদের মাধ্যমেই তিনি দেশ পরিচালনা করেন। শুধু তাই না, রাজার প্রতিদ্বন্দ্বীরাও একেকজন আরও সাচ্চা অং-বং।


আমরা সবাই জানি, অং-বং রাই সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় ধর্মগোষ্ঠী এবং আধুনিক বিজ্ঞানের সবকিছুই অং-বং ধর্মগ্রন্থ থেকে আবিষ্কার হয়েছে। এই যে কয়েকদিন আগে জেমস ওয়েবের টেলিস্কোপ ছবি ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগের মহাবিশ্বের গভীরতম এবং পরিষ্কার ইনফ্রারেড ছবি তুলেছে তার কথাও অং-বং মহাধর্মগ্রন্থে আছে। দুর্মুখ নিধর্মী বিদ্বেষীরা ভুং-চুংদের সাথে হাত মিলিয়ে মহাসম্মানিত অং-বংদের নামে উল্টা-পাল্টা মিথ্যা ছড়ালে কিন্তু হীরক রাজার দরবারে অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ দায়ের করা হবে। হীরক রাজার এক সভাসদ যিনি কিনা আবার প্রাক্তন বীরযোদ্ধা তিনিও অনুভূতিতে আঘাতের মত ন্যাক্কারজনক অপরাধ করে বাঁচতে পারেননি। সুতরাং, সাধু সাবধান। মনে রাখবেন, অং-বংদের মন ভাংগা ভুং-চুংদের বাড়িঘর লুটপাট, মূর্তি ভাংগার চাইতেও বড় অপরাধ।

[একটি কাল্পনিক ছোট গল্প, বাস্তবের সাথে কেউ মিল খুঁজে পেলে আমি দায়ী নই।]