পরবাসের প্রথম দিনগুলো ভালোই কাটে। নতুন দেশ, নতুন মাটি, নতুন মুখ, রঙিন দুনিয়া। বেড়াতে আসার মতো। এই সময়টাতে দেশের জন্য কষ্ট হয়না। নতুন পরিবেশের শতেক সংকেতের পাঠোদ্ধার করতে করতে মস্তিস্ক এই সময়টাতে দুঃখী হওয়ার সময় পায়না বোধহয়।
দুঃখ শুরু হয় বেড়াতে আসার অনুভূতিটুকু শেষ হয়ে গেলে। বিষন্নতা সেই সময়ে দূর্ভেদ্য অন্ধকারের মতো চারদিক থেকে ঘিরে আসে। এই মাটি চেনা নয়, এইসব মানুষ, এইসব দিনযাপন অচেনা। তখন শুধু মনে হতে থাকে আমার কিছু নেই, কিচ্ছু নেই। নেই নেই। চারিদিকে কী বিশাল সেই শূন্যতা। ওই সময়টাতে শুরু হয় স্মৃতিচারণের মহড়া।
সকাল হলে হয়তো মনে পড়তে থাকে ফেলে আসা গ্রামের সকালের কথা। কয়েক বছর আগের যে সকালের সব স্মৃতিচিহ্ন নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলো, সেসব পুণর্জন্ম নেয়। যে চেনা জগত ফেলে এসেছি তার সকাল, দুপুর, রাত্রি সবকিছু মুহূর্মুহূ মস্তিস্কে ঘোর লাগাতে থাকে। ঠিক ঠিক জেগে আছি নাকি ঘুম জাগরণের মাঝে অধোচেতন হয়ে আছি সে বুঝে উঠতে পারিনা। এইসব নানান স্মৃতিচারণ আর দুঃখবিলাসে মস্তিস্ক যখন হাঁপিয়ে ওঠে, যখন আর স্মৃতিতে কুলোয় না, দুঃখে করে করে মগজ ক্লান্ত হয়ে যায়, তখন শুরু হয় স্বপ্ন দেখা। ফিরে যাবার স্বপ্ন। সব ফিরে পাওয়ার আয়োজন। সব উদ্ধারের পরিকল্পনা।
সেইসব পরিকল্পনায় যে কী ভয়াবহ ‘ডিটেইলস’ থাকে, তা ভেবে হেসে ফেলা উচিত, নাকি ‘আহা বেচারা’ বলে করুণা করা উচিত তা বুঝে উঠতে পারিনা।
এইতো কদিন পরেই দেশে ফিরে মুন্নার দোকানে ঠিক কোনখানে কীভাবে দাঁড়িয়ে কীভাবে এককাপ চা চাইব তার তিলতিল মাপজোখের হিসেব করতে থাকি। পুতুল তুতুলের সঙ্গে ঠিক কী কী খেলব, কীভাবে কোন কথাটা বলব আর তারা ঠিক কীভাবে জবাব দেবে সেসবও আয়োজন করে রাখি মনে মনে। এবার বাড়ি গিয়ে দুম করে রাহুলের সামনে হাজির হলে সে কীভাবে আমাকে চিনে ফেলবে সেই হিসেব করি মনে মনে।
কীভাবে মায়ের পাশে খানিক্ষণ বসে থাকবো কোনো কারণ ছাড়াই। বলার কিছু থাকবেনা বলে কীভাবে ফোনে এটাসেটা খুঁচিয়ে দেখবো। কীভাবে মা তার স্বভাব বশত, পিঠে হাত রাখবেন। আমায় দেখতে আসা বোনটার সঙ্গে কী কী নিয়ে কথা হবে। কীভাবে ওর ঘরের সোফায় বসে তাকিয়ে দেখব। কী অদ্ভুত শান্তিতে তখন বুঝবো, এই শীতল শান্তির মায়াবী মানবী আমার বোন। সে কতো ভালো আছে সে দেখব চেয়ে চেয়ে। কীভাবে খুব সামান্য কিছুতে বিরক্ত হচ্ছে সে, কীভাবে গুছিয়ে নিচ্ছে সব। কীভাবে জিজ্ঞেস করছে, খাবি কিছু? ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত স্বর্গটাকে তখন কী তুচ্ছ লাগবে, কতো খেলো লাগবে, সেসব ভেবে রাখি আগে থেকে।
কীভাবে কোন সন্ধ্যায় আড্ডা দেবো, কীভাবে কোন কথাটা বলে হো হো করে হাসবো। কীভাবে কার সঙ্গে রাস্তায় দেখা হয়ে যাবে অনেকদিন পর। কীভাবে খুব গরম পড়বেনা, খুব ধুলো হবেনা, শরীর খারাপ করবেনা, কীভাবে সব খুব আচমকা স্বর্গের মতো হয়ে যাবে এবার দেশে ফিরলে তার হিসেব করি। সেই হিসেব অঙ্কের মতো পাকা। তাতে কোনো নড়চড় হবার সুযোগ নেই। যেনো আমি সর্বময় ঈশ্বর। নিজের ভবিষ্যৎ লিখছি আমার ইচ্ছেমতো। লিখছি ঠিক যেভাবে আমার রুচি।
পরিকল্পনাগুলো সব যে অযথা করা হয়, তা নয়। দেশে ফেরার দিন আসেই। তবে সেইসঙ্গে পরবাসে বসে নিয়তি লেখা ঈশ্বরের মাটিতে নেমে আসার সময় শুরু হয়। পরবাসী মানুষের দেশে ফেরা ছুটি হচ্ছে বাঙালি নিন্মবিত্তের মাসের বেতনের মতো। বেতনের দিনটায় লটারি পাওয়ার মতো আনন্দ থাকে বটে, কিন্তু বাস্তবতায় কিছু থাকে না। হাত টিপে টিপে খরচ করে জীবন বাঁচাতে হয় কেবল। মাসটা কোনোমতে পার করতে করতে পরের মাসের বেতনের স্বপ্ন দেখা হয় শুধু।
দেশে ফিরে মুন্নারর দোকান খুঁজে পাওয়া যায় না। রাস্তায় কারো সঙ্গে দেখা হয়ে যায় না। একসপ্তাহ পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার যে শক্ত আয়োজন, সে হয়ে ওঠে না। সব চেনা মুখের সঙ্গে আড্ডা দেয়ার যে বিশাল পরিকল্পনা, তার সময় মেলে না। সঙ্গী মেলে না। বন্ধু মহলে ভাঙন, নানা সংযোজন-বিয়োজন। সব অপরিচিত লাগে। ধুলো ধোঁয়ায় জীবন অস্থির হয়ে ওঠে। দিনগুলো পার হতে থাকে পলকে পলকে। মনে হতে থাকে দীর্ঘ আয়োজন করে বেড়াতে বেরিয়ে ট্রাফিক জ্যামের ধুলো-ধোঁয়ায় অনন্তকাল ধরে আটকে বসে আছি।
একেবারে যে কিছু হয়না তা-ও নয়। মার পাশে একটু হলেও বসে থাকা হয়। আপুর দিকে তাকিয়ে দেখা হয়। পুতুল-তুতুল মামা বলে ডাকতে শিখেছে। সেই ডাক শুনে চমকে ওঠা হয়। মনে হয়, আহা, কতোকালের তৃষ্ণা জুড়িয়ে দেয়া এই শব্দগুলো আমার! মস্তিস্ক সেই শব্দের পাঠোদ্ধার করতে সময় নিয়ে ফেলে। মনে হয় সত্যি সত্যি একটা লটারি বোধহয় জিতলাম।
কারো কারো সঙ্গে দেখা হয়, আড্ডা হয়। খানিকটা হেসে ওঠা হয়। মুন্না না হোক, অন্য কারো টং দোকানে চা খাওয়া হয়। যেভাবে হিসেব করা ছিলো ঠিক সেরকম না হলেও সেই চা একেবারে খারাপও হয়না। এর মাঝেই দিন শেষ হতে থাকে। কতো মানুষের সঙ্গে কথা হয়ে ওঠেনা, দেখা হয়ে ওঠে না। ছুটি শেষের সপ্তাহখানেক আগে থেকেই সেই পুরোনো ঈশ্বর উঁকি দিতে থাকে মস্তিকে। সে তার আয়োজনের খাতায় লিখতে থাকে, "পরেরবার এসে হবে সব। পরেরবার সব পুষিয়ে নেবো"!
No comments:
Post a Comment