Friday, August 16, 2019

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদিবস !!!

হেভেনে দক্ষিণ এশীয় নাগরিকেরা নরক রচনা করায় সিদ্ধান্ত হয় ভারতীয় উপমহাদেশের নেতারা পুরো দক্ষিণ এশিয়া ঘুরে এই জনপদের মানুষের নৈতিক বিচ্যুতির কারণ অনুসন্ধান করবেন। দেবদাসের গান্ধীজীর সঙ্গে ভারতে যাবার কথা থাকলেও তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বাংলাদেশে যাবার আগ্রহ প্রকাশ করেন। গান্ধীজী মুচকি হেসে দেবুদাকে বলেন, মুখ ফুটে বললেই হয় আমার সঙ্গে সময় কাটাতে বোরিং লাগে। শুধু নীতিকথা বলি বলে।
দেবুদা লাজুক হেসে বলেন, কী যে বলেন বাপু! আমি ঢাকাটা ঘুরেই দিল্লীতে আপনার সঙ্গে যোগ দেবো।
বঙ্গবন্ধু দেবুদাকে বলেন, আমরা সৈয়দ আশরাফের বাসায় উঠবো। অন্য কোথাও গেলে আমাদের ভুত ভেবে অজ্ঞান হয়ে যাবে। সৈয়দ আশরাফই আমাদের এই বাংলাদেশ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের ব্যাপারটা বুঝতে পারবে।
--তা ভদ্রলোক কেমন! বঙ্গবন্ধু।
--গেলেই বুঝবেন। নৈর্ব্যক্তিক একটা অভিমত পাওয়া যাবে।
দরজার কাছে বঙ্গবন্ধুকে দেখে সৈয়দ আশরাফ আনন্দে জড়িয়ে ধরেন। চোখের অশ্রু সংবরণ করে বঙ্গবন্ধু দেবুদার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। ধ্রুপদী নায়ক দেবদাসকে পেয়ে খুবই খুশী হন সৈয়দ আশরাফ। ব্যস্ত হয়ে ওঠেন আপ্যায়নের জন্য।
বঙ্গবন্ধু বলেন, আমরা কিন্তু কাজে এসেছি। দাওয়াত খেতে আসিনি। হেভেনে ফিরে গিয়ে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। এর ওপর নির্ভর করছে বাংলাদেশের যারা হেভেনে আছে তাদের ভবিষ্যত। আর অবশ্যই ভবিষ্যতে যারা হেভেনে যেতে ইচ্ছুক তাদের প্রবেশাধিকার পাওয়া-না পাওয়া।
--মানে।
--হেভেনের পরিবেশ বিষাক্ত করে তুলেছে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ। তাই আমরা দেখতে এসেছি এখানকার অবস্থা। কেন এতো এতো বিষাক্ত লোকজন তৈরী হচ্ছে এই জনপদে।
সৈয়দ আশরাফ একটু নার্ভাস বোধ করেন। ভূমিবাস্তবতার যে অবস্থা; তাতো বর্ণনাতীত। জীবনে এতো বড় পরীক্ষার মুখোমুখি হবেন তা কখনো ভাবেন নি।
--আপনি আপনার মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
--দেখো আমি পারসোনাল এবং প্রফেশনাল ব্যাপার আলাদা রাখতে চাই।
দেবুদা হেসে বলেন, বঙ্গবন্ধু তারমানে আমাদের এই সফরে কী কোন আনন্দ থাকবে না। গান্ধীজীর মতো সিরিয়াস থাকবে সবকিছু।
বঙ্গবন্ধু স্বভাবসুলভ হাসিতে ফেটে পড়েন। সৈয়দ আশরাফ একটু নার্ভাসনেস কাটিয়ে ওঠেন।
বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর আমাদের কাছে আছে । আমরা শুধু মিলিয়ে নেবো।
দেবুদা জিজ্ঞেস করেন, আমি কী এখানকার থার্ড ফোর্সের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাবো।
সৈয়দ আশরাফ বলেন, নিশ্চয়ই দেবুদা, আপনাকে সেন্টার ফর পারু ডার্লিং (সিপিডি)-তে আমি নিয়ে যাবো।
বঙ্গবন্ধু হাসেন, সৈয়দ আশরাফ তোমাকে বলতে ভুলে গেছি; দেবুদা হেভেনে থার্ড ফোর্সের আহবায়ক। সাম্যবাদী এবং কাম্যবাদী দলের মনোপলি ভেঙ্গে রাজনীতি ভালোই চালিয়ে যাচ্ছেন।
--তাহলে তো প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারে উনার ইন্টারভিউ দেয়া জরুরী।
দেবুদা বলেন, আহা এটা তো আমাদের সিক্রেট মিশন। ইন্টারভিউ কী করে দিই! তবে বঙ্গবন্ধু যদি অনুমতি করেন, আমার আপত্তি নাই।
বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করেন, মিডিয়ার কী অবস্থা আশরাফ!
--পাঠকের চেয়ে সংবাদপত্র বেশী, দর্শকের চেয়ে টিভি বেশী, খবরের চেয়ে টকশো বেশী, কাজের চেয়ে উত্তেজনা বেশী, সাংবাদিকের চেয়ে নেতা বেশী।
--আর সংবাদের মান!
--কেউ সারাক্ষণ তৈলব্রতে তো কেউ সারাক্ষণ এসিড ব্রতে।
--নৈর্ব্যক্তিকতা, নিরপেক্ষতা বলে কী কিছু নেই!
--না নেই; হয় আওয়ামী লীগের নেতা সাংবাদিক; নইলে বিএনপির নেতা সাংবাদিক; নয়তো জামায়াতের হুজুর সাংবাদিক। এদের নীচে পিষ্ট সৎ নৈর্ব্যক্তিক সাংবাদিকেরা।
দেবুদা বলেন, সাংঘাতিক বিষয় মশাই!
--সাংবাদিকদের এদেশে সাংঘাতিকও বলা হয়।
--আর শিক্ষকদের কী অবস্থা!
--একই।
--শিল্প-সাহিত্যের লোকজন!
--সবই টিক চিহ্ন দিয়ে নেবার ব্যাপার।
দেবুদা ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, দেখেছেন বঙ্গবন্ধু আমি হেভেনে ঠিক এই জিনিসটার প্রতিবাদী হয়েছিলাম। মানুষ কেন দলদাস হবে।
বঙ্গবন্ধু বলেন, আর রাজনৈতিক আদর্শ।
সৈয়দ আশরাফ উত্তর দেন,বেশ জগাখিঁচুড়ি অবস্থা। সাম্যবাদ ও কাম্যবাদ মিলে মিশে একাকার।
--অন্যধর্মের মানুষের ওপরে নির্যাতন করছে কারা।
--ব্যাপারটা সর্বদলীয় মস্তিষ্কেই ঢুকে গেছে। গবেষণা-পরিসংখ্যান তাই বলছে।
দেবুদা জিজ্ঞেস করেন, আমার জন্য বাংলাদেশ কী নিরাপদ হবে; নাকী ভারত চলে যাবো। এখানকার লিবেরেল বুদ্ধিজীবীরাও বলেন শুনেছি, হিন্দুদের এক’পা বাংলাদেশে তো আরেক’পা ভারতে।
বঙ্গবন্ধু বলেন, দেবুদা আমরা তো গোপনে চলাফেরা করবো। নইলে শুধু আপনি কেন; আমিও তো নিরাপদ নই।
বঙ্গবন্ধু সৈয়দ আশরাফকে জিজ্ঞেস করেন, আর “সততা” ব্যাপারটা কী আছে সমাজে!
--ওটাতো আপনাদের হত্যাকান্ডের সঙ্গে সঙ্গেই হত্যা হয়ে গেছে।
--তা আমার মৃত্যুদিবসকে ঘিরে চাঁদাবাজি কেমন চলছে!
--চলুন ছাদ থেকে দেখি ব্যাপারটা। বঙ্গবন্ধু আর দেবুদাকে নিয়ে সৈয়দ আশরাফ ছাদে যান। সেখান থেকে দেখা যায় নানা রকম ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার, বিলবোর্ড। বঙ্গবন্ধুর ছবি বাম দিকে কোণায়। সামনে সব বিরাট বিরাট তালেবরের ছবি।
দেবুদা জিজ্ঞেস করেন, আচ্ছা বড় বড় করে লেখা দেখছি “শোক দিবস”; তা মারা গেছে কী সামনের লোকটি!
বঙ্গবন্ধু হো হো করে হেসে ওঠেন। সৈয়দ আশরাফ হাসবেন না কাঁদবেন তা বুঝতে পারেন না। সৈয়দ আশরাফ বলেন, মুজিব কোট অনেক বিক্রি হচ্ছে; আপনার পোস্টারও।
দেবুদা টিপ্পনী কাটে, বঙ্গবন্ধু আপনি দেখছি সেলিব্রেটি হয়ে গেলেন!
বঙ্গবন্ধু হাসেন, আমার তো ফেসবুকে ফলোয়ারও নেই; ভেরিফায়েড পেজও নেই; আমি সেলিব্রেটি হই কীভাবে!
সৈয়দ আশরাফ বলেন, আপনাকে নিয়ে পেজ-টেজও আছে। রীতিমত পেজ খোলার প্রতিযোগিতাও আছে।
--তা আমাকে নিয়ে লেখা বইপুস্তক কী কেউ পড়ে।
--বই বিক্রিটা কম হয়। বই উপহার দিলে এক দুই লাইন পড়ে ফেসবুকে “রিডিং বঙ্গবন্ধু” লিখে দিয়ে কয়েকদিনের মধ্যে বঙ্গবন্ধু বিদ হয়ে পড়ে কেউ কেউ ।
দেবুদা বিস্মিত হন, এতো দেখছি সব রোদ্দুর রায়ের মতো প্রতিভা মশাই! সে যেমন রবীন্দ্রবিদ হয়ে কবিগুরুর সব্বোনাশ করেছে।
বঙ্গবন্ধু সৈয়দ আশরাফকে জিজ্ঞেস করেন, তা আমার মৃত্যুদিবস পালন করছে কারা কারা!
--এটা নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে। আওয়ামী লীগ এটা পালনের সুযোগই পাছে না। পালন করছে বারো রকম লীগ।
--বারো রকম লীগ মানে। প্রধান দু’তিনটার নাম বলো।
--সাইড কিক লীগ, ছুটা বুয়া লীগ, জন্মদিন লীগ ইত্যাদি।
--সাইড কিক লীগ মানে!
--এরা সজীব ওয়াজেদ জয় লীগ। জয়ের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় যাদের আছে, তারা সুচিন্তিতভাবে গড়ে তুলেছে এই সেলফি ফাউন্ডেশন। জয় থাকে এমেরিকায়; আর এরা ঢাকায় বসে জয়ের নাম বিক্রি করে বা নেম ড্রপিং করে ক্ষমতা দেখায় এবং টাকা-পয়সা চুরির সিন্ডিকেট তৈরী করেছে।
---ঐ সেই চোরের খনির লেটেস্ট সংস্করণ আর কী!
--আর ছুটা বুয়া লীগটা কী!
--এরা ঐ সাইড কিক লীগের পক্ষে ফেসবুকে নৈর্ব্যক্তিক মানুষদের গালাগাল করে বেড়ায়। কাভারে আপনার ছবি থাকে।
দেবুদা আক্ষেপ করেন, বঙ্গবন্ধুর ছবির প্রচ্ছদ লাগিয়ে এমন গালাগাল করে বেড়ালে যে নেতারই অপমান হয়; এটা বোঝে না ছুটা বুয়া লীগ।
সৈয়দ আশরাফ বলেন, ঐ কমনসেন্স সাইড কিক লীগ, ছুটা বুয়া লীগ এদের কারোরই নেই। কমনসেন্স থাকলে তো কিছু করে খেতে পারে মানুষ। নইলে চোরের খনি আর চাটার দলে কী কেউ নাম লেখায়!
বঙ্গবন্ধু হাসেন, সাইড কিক লীগ আর ছুটা বুয়া লীগ তাহলে চোরের খনি আর চাটার দলের সমন্বয়ে একটি “চোরচাট্টা” প্রজাতি।
দেবুদা মন্তব্য করেন, বঙ্গবন্ধু এদের সঙ্গে মুশতাক প্রজাতির মিল পাওয়া যাচ্ছে। এরা মুজিববাদী সেজে থাকলেও আসলে মুশতাকবাদী।
বঙ্গবন্ধু মাথা নাড়েন, এই মুশতাকবাদীরা আমাকে দ্বিতীয়বার হত্যা করতে মরিয়া এতো বোঝাই যাচ্ছে।
তো আশরাফ আরেকটা কী লীগ বললে!
--জন্মদিন লীগ।
দেবুদা খুবই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, পাগল হয়েছেন মশাই! বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু দিনে জন্মদিন লীগের কাজ কী!
--কাজ আছে। ঐদিন এই জন্মদিন লীগ জন্মদিন পালন করে।
--কার জন্মদিন!
--খালেদা জিয়ার।
--এও কী সম্ভব! বঙ্গবন্ধুর হত্যা দিবসে জন্মদিন পালন।
--কয়েকটা দিন ঢাকায় থাকলেই বুঝবেন দেবুদা এখানে আর কী কী সম্ভব!

Sunday, August 4, 2019

আয়োজনের খাতা

পরবাসের প্রথম দিনগুলো ভালোই কাটে। নতুন দেশ, নতুন মাটি, নতুন মুখ, রঙিন দুনিয়া। বেড়াতে আসার মতো। এই সময়টাতে দেশের জন্য কষ্ট হয়না। নতুন পরিবেশের শতেক সংকেতের পাঠোদ্ধার করতে করতে মস্তিস্ক এই সময়টাতে দুঃখী হওয়ার সময় পায়না বোধহয়।
দুঃখ শুরু হয় বেড়াতে আসার অনুভূতিটুকু শেষ হয়ে গেলে। বিষন্নতা সেই সময়ে দূর্ভেদ্য অন্ধকারের মতো চারদিক থেকে ঘিরে আসে। এই মাটি চেনা নয়, এইসব মানুষ, এইসব দিনযাপন অচেনা। তখন শুধু মনে হতে থাকে আমার কিছু নেই, কিচ্ছু নেই। নেই নেই। চারিদিকে কী বিশাল সেই শূন্যতা। ওই সময়টাতে শুরু হয় স্মৃতিচারণের মহড়া।
সকাল হলে হয়তো মনে পড়তে থাকে ফেলে আসা গ্রামের সকালের কথা। কয়েক বছর আগের যে সকালের সব স্মৃতিচিহ্ন নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলো, সেসব পুণর্জন্ম নেয়। যে চেনা জগত ফেলে এসেছি তার সকাল, দুপুর, রাত্রি সবকিছু মুহূর্মুহূ মস্তিস্কে ঘোর লাগাতে থাকে। ঠিক ঠিক জেগে আছি নাকি ঘুম জাগরণের মাঝে অধোচেতন হয়ে আছি সে বুঝে উঠতে পারিনা। এইসব নানান স্মৃতিচারণ আর দুঃখবিলাসে মস্তিস্ক যখন হাঁপিয়ে ওঠে, যখন আর স্মৃতিতে কুলোয় না, দুঃখে করে করে মগজ ক্লান্ত হয়ে যায়, তখন শুরু হয় স্বপ্ন দেখা। ফিরে যাবার স্বপ্ন। সব ফিরে পাওয়ার আয়োজন। সব উদ্ধারের পরিকল্পনা।
সেইসব পরিকল্পনায় যে কী ভয়াবহ ‘ডিটেইলস’ থাকে, তা ভেবে হেসে ফেলা উচিত, নাকি ‘আহা বেচারা’ বলে করুণা করা উচিত তা বুঝে উঠতে পারিনা।
এইতো কদিন পরেই দেশে ফিরে মুন্নার দোকানে ঠিক কোনখানে কীভাবে দাঁড়িয়ে কীভাবে এককাপ চা চাইব তার তিলতিল মাপজোখের হিসেব করতে থাকি। পুতুল তুতুলের সঙ্গে ঠিক কী কী খেলব, কীভাবে কোন কথাটা বলব আর তারা ঠিক কীভাবে জবাব দেবে সেসবও আয়োজন করে রাখি মনে মনে। এবার বাড়ি গিয়ে দুম করে রাহুলের সামনে হাজির হলে সে কীভাবে আমাকে চিনে ফেলবে সেই হিসেব করি মনে মনে।
কীভাবে মায়ের পাশে খানিক্ষণ বসে থাকবো কোনো কারণ ছাড়াই। বলার কিছু থাকবেনা বলে কীভাবে ফোনে এটাসেটা খুঁচিয়ে দেখবো। কীভাবে মা তার স্বভাব বশত, পিঠে হাত রাখবেন। আমায় দেখতে আসা বোনটার সঙ্গে কী কী নিয়ে কথা হবে। কীভাবে ওর ঘরের সোফায় বসে তাকিয়ে দেখব। কী অদ্ভুত শান্তিতে তখন বুঝবো, এই শীতল শান্তির মায়াবী মানবী আমার বোন। সে কতো ভালো আছে সে দেখব চেয়ে চেয়ে। কীভাবে খুব সামান্য কিছুতে বিরক্ত হচ্ছে সে, কীভাবে গুছিয়ে নিচ্ছে সব। কীভাবে জিজ্ঞেস করছে, খাবি কিছু? ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত স্বর্গটাকে তখন কী তুচ্ছ লাগবে, কতো খেলো লাগবে, সেসব ভেবে রাখি আগে থেকে।
কীভাবে কোন সন্ধ্যায় আড্ডা দেবো, কীভাবে কোন কথাটা বলে হো হো করে হাসবো। কীভাবে কার সঙ্গে রাস্তায় দেখা হয়ে যাবে অনেকদিন পর। কীভাবে খুব গরম পড়বেনা, খুব ধুলো হবেনা, শরীর খারাপ করবেনা, কীভাবে সব খুব আচমকা স্বর্গের মতো হয়ে যাবে এবার দেশে ফিরলে তার হিসেব করি। সেই হিসেব অঙ্কের মতো পাকা। তাতে কোনো নড়চড় হবার সুযোগ নেই। যেনো আমি সর্বময় ঈশ্বর। নিজের ভবিষ্যৎ লিখছি আমার ইচ্ছেমতো। লিখছি ঠিক যেভাবে আমার রুচি।
পরিকল্পনাগুলো সব যে অযথা করা হয়, তা নয়। দেশে ফেরার দিন আসেই। তবে সেইসঙ্গে পরবাসে বসে নিয়তি লেখা ঈশ্বরের মাটিতে নেমে আসার সময় শুরু হয়। পরবাসী মানুষের দেশে ফেরা ছুটি হচ্ছে বাঙালি নিন্মবিত্তের মাসের বেতনের মতো। বেতনের দিনটায় লটারি পাওয়ার মতো আনন্দ থাকে বটে, কিন্তু বাস্তবতায় কিছু থাকে না। হাত টিপে টিপে খরচ করে জীবন বাঁচাতে হয় কেবল। মাসটা কোনোমতে পার করতে করতে পরের মাসের বেতনের স্বপ্ন দেখা হয় শুধু।
দেশে ফিরে মুন্নারর দোকান খুঁজে পাওয়া যায় না। রাস্তায় কারো সঙ্গে দেখা হয়ে যায় না। একসপ্তাহ পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার যে শক্ত আয়োজন, সে হয়ে ওঠে না। সব চেনা মুখের সঙ্গে আড্ডা দেয়ার যে বিশাল পরিকল্পনা, তার সময় মেলে না। সঙ্গী মেলে না। বন্ধু মহলে ভাঙন, নানা সংযোজন-বিয়োজন। সব অপরিচিত লাগে। ধুলো ধোঁয়ায় জীবন অস্থির হয়ে ওঠে। দিনগুলো পার হতে থাকে পলকে পলকে। মনে হতে থাকে দীর্ঘ আয়োজন করে বেড়াতে বেরিয়ে ট্রাফিক জ্যামের ধুলো-ধোঁয়ায় অনন্তকাল ধরে আটকে বসে আছি।
একেবারে যে কিছু হয়না তা-ও নয়। মার পাশে একটু হলেও বসে থাকা হয়। আপুর দিকে তাকিয়ে দেখা হয়। পুতুল-তুতুল মামা বলে ডাকতে শিখেছে। সেই ডাক শুনে চমকে ওঠা হয়। মনে হয়, আহা, কতোকালের তৃষ্ণা জুড়িয়ে দেয়া এই শব্দগুলো আমার! মস্তিস্ক সেই শব্দের পাঠোদ্ধার করতে সময় নিয়ে ফেলে। মনে হয় সত্যি সত্যি একটা লটারি বোধহয় জিতলাম।
কারো কারো সঙ্গে দেখা হয়, আড্ডা হয়। খানিকটা হেসে ওঠা হয়। মুন্না না হোক, অন্য কারো টং দোকানে চা খাওয়া হয়। যেভাবে হিসেব করা ছিলো ঠিক সেরকম না হলেও সেই চা একেবারে খারাপও হয়না। এর মাঝেই দিন শেষ হতে থাকে। কতো মানুষের সঙ্গে কথা হয়ে ওঠেনা, দেখা হয়ে ওঠে না। ছুটি শেষের সপ্তাহখানেক আগে থেকেই সেই পুরোনো ঈশ্বর উঁকি দিতে থাকে মস্তিকে। সে তার আয়োজনের খাতায় লিখতে থাকে, "পরেরবার এসে হবে সব। পরেরবার সব পুষিয়ে নেবো"!