মসজিদ মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষার নিরপেক্ষতা প্রমানে দেশব্যাপী চালু হচ্ছে মন্দিরভিত্তিক শিক্ষা প্রকল্পের ৫ম পর্যায়। কোথায় শিক্ষা কোথায় সাম্প্রদায়িকতার পাঠ দেয়া হয় তা বোধহয় আমাদের শিক্ষা বিশেষজ্ঞেরাই ভালো জানেন। রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকে ধর্ম মন্ত্রনালয়ের অধীনে এসব প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে কোটি টাকা গচ্ছা দিয়ে মসজিদ-মন্দির-মাদ্রাসাভিত্তিক তৃনভোজী শিক্ষা দানে রাষ্ট্রের কি বিধ্বংসী উন্নতি হচ্ছে? উন্নতি হোক না হোক শিক্ষার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে দিয়ে মানুষকে আরো ধর্মপ্রান করে তোলা যাচ্ছে। ধার্মিক বাঙালি হলো জরা গ্রস্থ এইডস রোগীর মত। সামান্য ঠাণ্ডা তেও কাহিল অবস্থা। আর তাতে করে প্রত্যেক রাজনৈতিক দল নিজেদের ইচ্ছেমত রাষ্ট্রক্ষমতায় যাবার পথে ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতাকে কাজে লাগাচ্ছে।
একটি পরিসংখ্যান দেখা যায়,২০০১ সাল পরবর্তী ১৩ বছরে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ২০ হাজারেরও বেশি।২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে এক হাজার ছয়শ নিরানব্বইটি। কেবল গত বছরই সহিংসতা হয়েছে ১৭০০ টি। বিনিময়ে গত ১৩ বছরে বরং যা হয়েছে, তাকে বলা যায় নিরবচ্ছিন্ন ঠোঁটসেবা। আবার অনেকে এই শ্রেষ্ঠতম অনুভূতিটিকে নিজের দলের জন্য কাস্টমাইজ করে নেয়। বাংলাদেশে গত দুই-আড়াই দশকে যেসব নির্বাচন হয়েছে, সেগুলোতে হয় আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপি জিতেছে। একটি দল একবার হারলে আরেকবার জেতার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু প্রতিটি নির্বাচনেই একটি পক্ষ বারে বারে হেরেছে—সেই পক্ষটি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। তাই সাম্প্রদায়িকতার কারণ খুঁজতে পরিশ্রম করতে হয় না—এসব এখন সবার কাছেই স্পষ্ট।
সো লেটস ওয়াক ফর হিস্ট্রি অব দিজ বিগোট্রি পলিটিক্স...। ১৭৫৭ সালে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারতীয় উপমহাদেশ দখলের পর থেকে কিভাবে ঔপনিবেশিক দেশটিতে শাসন ও শোষণে মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে দমিয়ে রাখা যায় এই নিয়ে নানা পরিকল্পনা আটে। এর জন্য যে অস্ত্রটি দিয়ে সফলকাম হয় সেটি হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা। শোষণ, লুন্ঠন ছাড়াও অমানসিক অত্যাচার, নির্যাতনের পরও এর বিপরীতে যাতে করে সকল শ্রেণী পেশার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন গড়ে তোলতে না পারে সেই পরিকল্পনা স্বরুপ এ মহাদেশে হিন্দু, মুসলমান সহ বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর সম্প্রীতির বন্ধনকে উগ্রসাম্প্রদায়িকতাকে কাজে লাগিয়ে বিছিন্ন করে দেয়। ভারতীয় ঔপনিবেশকালে বিভিন্ন সময়ে অঞ্চল ভিত্তিক স্বদেশী আন্দোলন, নীল বিদ্রোহ, হাজং বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন সহ যে ছোট ছোট বিদ্রোহ গড়ে উঠে তা বানচাল করে দেওয়ার জন্য ব্রিটিশরা এই অস্ত্রটিকেই সুপরিকল্পিত ভাবে ব্যবহার করেছে। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার সময়কার বর্বর চিত্রের ইতিহাসও রাজনীতিতে আজও ব্যবহৃত হয়।
ধর্মনিরপেক্ষতাকে মান্যতা দিয়ে বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। ‘সেক্যুলার’ ঘরানার রূপ দিতে তখনকার আইনপ্রণেতারা চেষ্টা করেছিলেন আন্তরিকভাবেই, কিন্তু রাজনীতিতে তার চর্চা শুরু থেকেই অনুপস্থিত। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর পর তথাকথিত ইসলামী ভাবাদর্শ দ্রুত ভিত গড়তে শুরু করে বাংলাদেশে। একাত্তরে পরাজিত পাকিস্তানি ভাবাদর্শ বিতাড়িত করা যায়নি, বরং ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির পালে হাওয়া লাগে সেই সময়ে।
জিয়াউর রহমান ক্ষমতা সংহত করার জন্য আপস করলেন পাকিস্তানি ভাবাদর্শের সঙ্গে। মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী প্রভৃতি দলকে রাজনীতি করার সুযোগ দিলেন। ধর্মভাবাপন্ন পঞ্চম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে সংবিধানে ধর্মীয় ভাব নিয়ে আসা হয়। আর ‘কপট’ ধার্মিক এরশাদ তো সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম সংযোজন করেন।
আগের সংশোধনী বাতিল ও নতুন সংশোধনী ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম’ পরস্পর বিরোধী প্রপঞ্চ পাশাপাশি রেখেছে। আওয়ামী লীগও ধর্মের ‘ব্যাটন’ নিয়ে চলেছে। ধর্মনিরপেক্ষতা কেবল কেতাবি বিষয় হয়েই আছে বাংলাদেশে।
পরে সময়ে সময়ে রাষ্টীয় আইন তৈরি করে সাম্প্রদায়িকতাকে ফোর্স করা হয়েছে। আইনগতভাবে? হ্যাঁ, এটিও একটি বড় প্রশ্ন বটে। আমি বহু পুরনো কিন্তু সদা জীবন্ত একটি আইনের কথা বলি। ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’। আসলে শত্রু সম্পত্তি আইন যা পাকিস্তানের আইয়ুব সরকার ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান ১৭ দিনের যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জারি করে এ দেশে বাংলা পরম্পরায় বসবাসরত কোটি কোটি হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান নাগরিকের বিপুল পরিমাণ আবাদি জমি, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, বসতবাটি প্রভৃতি শত্রু সম্পতি হিসেবে ঘোষণা দিয়ে তা সরকারি নিয়ন্ত্রণে নেয়ার ব্যবস্থা করে তাদের দেশদ্রোহী বলে কার্যত ঘোষণা করে দেশত্যাগী হতে বাধ্য করেছিল তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশকে। আজ তারপর প্রায় অর্ধ শতাব্দী চলে যাচ্ছে। প্রায় ৪৭ বছর আগে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মৌলনীতিতে পরিবর্তন সাধন করে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান নামক ইসলামী রিপাবলিকের স্থানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ বলে ঘোষণা করেন এবং চার মৌলনীতির অন্যতম হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানে লিপিবদ্ধ করেন। সংবিধানে আরো বলা হয় এই রাষ্ট্রে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গগত কারণে কোনো নাগরিক বৈষম্যের শিকার হবেন না রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই। আরো বলা ছিল পাকিস্তান আমলের যে সব আইন বাংলাদেশের মৌলনীতিসমূহের সংঘাতপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে সেগুলোর অস্তিত্ব আপনাআপনি বিলুপ্ত বলে গণ্য হবে। কিন্তু কার্যত কী দেখলাম? সম্ভবত ১৯৭৩ সালে শত্রু সম্পত্তি আইন ১৯৬৫-এর নাম পরিবর্তন করে ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন, ১৯৬৫’ বলে নতুন নামকরণ করে শত্রু সম্পত্তি আইনের সব ধারা উপধারা অব্যাহত রাখা হলো। ফলে ওই সম্পত্তিগুলো সরকারি নিয়ন্ত্রণেই রয়ে গেল। মালিকরা ফেরত পেলেন না এবং বিস্ময়ের ব্যাপার আজো তা ফেরত পাননি। পাবেনও না।
সাম্প্রদায়িক চেতনা মূলত সামন্ততান্ত্রিক সমাজের একটি বৈশিষ্ট্য। এখনো বিশ্ববাস্তবতা হচ্ছে- ধর্মকেন্দ্রিক জাতিসত্তা বা সম্প্রদায়। এবং একটি ধর্মকেন্দ্রিক সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত থেকে অন্যকোনো ধর্মকেন্দ্রিক সম্প্রদায়ের লোকেদের খারাপ/ফালতু ভাবাটা হচ্ছে ট্রেন্ড।
বিষয়টিকে একটু সহজ করে ব্যাখ্যা করা যায়, যেমন আমরা সচারচর বলে থাকি কুমিল্লা-নোয়াখালি-চাঁদপুর-বরিশাল অঞ্চলের লোক খারাপ। অর্থাৎ এরকম বলাটা হচ্ছে একটা ট্রেন্ড। এই অভিধায় বিশ্বাস করে না, এরকম অনেক লোকও কিন্তু ঢালাওভাবে কখনো কখনো মন্তব্য করে ফেলে। অর্থাৎ সমাজের অভ্যাস ব্যক্তির অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায় ব্যক্তির অজান্তে।
শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতার অন্তর্ভূক্তি শিক্ষার্থীর অজান্তেই তাদের মানসিকতাকে প্রতিক্রিয়াশীল করে দেয়। শিশু কি কিছু বোঝে এসব? তারপরেও দেখা যায় একজন শিশু সাম্প্রদায়িক আচরণ করে। এর কারণ হচ্ছে ঐ ট্রেন্ড। সমাজের এই ট্রেন্ড বা ঝোঁক কিন্তু ব্যক্তিমানুষ পরিবর্তন করতে পারেব না। গুটিকতক মানুষও পারবে না, চাইলেও পারবে না। বিভিন্নভাবে পরিকল্পনা করে সমাজের এই বিধ্বংসী ঝোঁক থেকে মানুষকে মুক্ত করতে হয়।এর দায় নিতে হয় রাষ্ট্রের, কারন আইনের অসারতায়-ই জন্ম নিয়েছিল ধর্ম। কিন্তু রাষ্ট্র কি নিবে?
বরং সময়ে সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাবার নেশায় ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে যারা কথা বলেছেন তাদের স্তব্দ করা হয়েছে রাজনৈতিক স্বার্থে। আর তাতে যতটা না লাভ হয়েছে মৌলবাদীদের তার চেয়ে বেশি ব্যবহার হয়েছে রাষ্ট্রক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে। এতে সরকার গাছেরটা খেয়েছে তলেরটাও কুড়িয়েছে। লেখার সঙ্গে ধর্মীয় ভাবাবেগ সম্পৃক্ত থাকে বলে সবসময়ই তা বিতর্কের জন্ম দেয়৷ এ কথা নতুন নয় এবং এমন বিতর্ক আগেও ঘটেছে৷ তবে প্রশ্ন জাগে, অনন্ত অভিজিতরা কি এই অশ্লীল রাজনীতির বলি !!! সবই হয়ত কার্যত নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতায়৷
সব সরকার ও ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান নিজেদের স্বার্থে মিথ্যা বলে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে। সরকারমাত্রই ষড়যন্ত্রপ্রবণ। চিন্তন, মনন ও শিক্ষামূলক চর্চা সর্বদাই বিতর্কিত ৷ সেটা ‘সেন্সারশিপ'-এর হাতকড়া পরিয়ে থামানো যায় না৷ বলা বাহুল্য, এটা সুস্থ সমাজ চেতনার পরিপন্থি৷ একথাও অনস্বীকার্য যে, ধর্ম মানুষের জীবনকে যেভাবে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে তাতে একটা লক্ষণরেখা থাকা উচিত। এই সুন্দর পৃথিবীতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণী পিঁপড়ারও নিজের মত করে বাঁচার অধিকার আছে। আজ যারা ভাবছেন নগর পোড়ুক কিন্তু তাতে কি দেবালয় এড়াবে?
একটি পরিসংখ্যান দেখা যায়,২০০১ সাল পরবর্তী ১৩ বছরে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ২০ হাজারেরও বেশি।২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে এক হাজার ছয়শ নিরানব্বইটি। কেবল গত বছরই সহিংসতা হয়েছে ১৭০০ টি। বিনিময়ে গত ১৩ বছরে বরং যা হয়েছে, তাকে বলা যায় নিরবচ্ছিন্ন ঠোঁটসেবা। আবার অনেকে এই শ্রেষ্ঠতম অনুভূতিটিকে নিজের দলের জন্য কাস্টমাইজ করে নেয়। বাংলাদেশে গত দুই-আড়াই দশকে যেসব নির্বাচন হয়েছে, সেগুলোতে হয় আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপি জিতেছে। একটি দল একবার হারলে আরেকবার জেতার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু প্রতিটি নির্বাচনেই একটি পক্ষ বারে বারে হেরেছে—সেই পক্ষটি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। তাই সাম্প্রদায়িকতার কারণ খুঁজতে পরিশ্রম করতে হয় না—এসব এখন সবার কাছেই স্পষ্ট।
সো লেটস ওয়াক ফর হিস্ট্রি অব দিজ বিগোট্রি পলিটিক্স...। ১৭৫৭ সালে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারতীয় উপমহাদেশ দখলের পর থেকে কিভাবে ঔপনিবেশিক দেশটিতে শাসন ও শোষণে মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে দমিয়ে রাখা যায় এই নিয়ে নানা পরিকল্পনা আটে। এর জন্য যে অস্ত্রটি দিয়ে সফলকাম হয় সেটি হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা। শোষণ, লুন্ঠন ছাড়াও অমানসিক অত্যাচার, নির্যাতনের পরও এর বিপরীতে যাতে করে সকল শ্রেণী পেশার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন গড়ে তোলতে না পারে সেই পরিকল্পনা স্বরুপ এ মহাদেশে হিন্দু, মুসলমান সহ বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর সম্প্রীতির বন্ধনকে উগ্রসাম্প্রদায়িকতাকে কাজে লাগিয়ে বিছিন্ন করে দেয়। ভারতীয় ঔপনিবেশকালে বিভিন্ন সময়ে অঞ্চল ভিত্তিক স্বদেশী আন্দোলন, নীল বিদ্রোহ, হাজং বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন সহ যে ছোট ছোট বিদ্রোহ গড়ে উঠে তা বানচাল করে দেওয়ার জন্য ব্রিটিশরা এই অস্ত্রটিকেই সুপরিকল্পিত ভাবে ব্যবহার করেছে। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার সময়কার বর্বর চিত্রের ইতিহাসও রাজনীতিতে আজও ব্যবহৃত হয়।
ধর্মনিরপেক্ষতাকে মান্যতা দিয়ে বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। ‘সেক্যুলার’ ঘরানার রূপ দিতে তখনকার আইনপ্রণেতারা চেষ্টা করেছিলেন আন্তরিকভাবেই, কিন্তু রাজনীতিতে তার চর্চা শুরু থেকেই অনুপস্থিত। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর পর তথাকথিত ইসলামী ভাবাদর্শ দ্রুত ভিত গড়তে শুরু করে বাংলাদেশে। একাত্তরে পরাজিত পাকিস্তানি ভাবাদর্শ বিতাড়িত করা যায়নি, বরং ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির পালে হাওয়া লাগে সেই সময়ে।
জিয়াউর রহমান ক্ষমতা সংহত করার জন্য আপস করলেন পাকিস্তানি ভাবাদর্শের সঙ্গে। মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী প্রভৃতি দলকে রাজনীতি করার সুযোগ দিলেন। ধর্মভাবাপন্ন পঞ্চম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে সংবিধানে ধর্মীয় ভাব নিয়ে আসা হয়। আর ‘কপট’ ধার্মিক এরশাদ তো সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম সংযোজন করেন।
আগের সংশোধনী বাতিল ও নতুন সংশোধনী ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম’ পরস্পর বিরোধী প্রপঞ্চ পাশাপাশি রেখেছে। আওয়ামী লীগও ধর্মের ‘ব্যাটন’ নিয়ে চলেছে। ধর্মনিরপেক্ষতা কেবল কেতাবি বিষয় হয়েই আছে বাংলাদেশে।
পরে সময়ে সময়ে রাষ্টীয় আইন তৈরি করে সাম্প্রদায়িকতাকে ফোর্স করা হয়েছে। আইনগতভাবে? হ্যাঁ, এটিও একটি বড় প্রশ্ন বটে। আমি বহু পুরনো কিন্তু সদা জীবন্ত একটি আইনের কথা বলি। ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’। আসলে শত্রু সম্পত্তি আইন যা পাকিস্তানের আইয়ুব সরকার ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান ১৭ দিনের যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জারি করে এ দেশে বাংলা পরম্পরায় বসবাসরত কোটি কোটি হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান নাগরিকের বিপুল পরিমাণ আবাদি জমি, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, বসতবাটি প্রভৃতি শত্রু সম্পতি হিসেবে ঘোষণা দিয়ে তা সরকারি নিয়ন্ত্রণে নেয়ার ব্যবস্থা করে তাদের দেশদ্রোহী বলে কার্যত ঘোষণা করে দেশত্যাগী হতে বাধ্য করেছিল তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশকে। আজ তারপর প্রায় অর্ধ শতাব্দী চলে যাচ্ছে। প্রায় ৪৭ বছর আগে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মৌলনীতিতে পরিবর্তন সাধন করে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান নামক ইসলামী রিপাবলিকের স্থানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ বলে ঘোষণা করেন এবং চার মৌলনীতির অন্যতম হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানে লিপিবদ্ধ করেন। সংবিধানে আরো বলা হয় এই রাষ্ট্রে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গগত কারণে কোনো নাগরিক বৈষম্যের শিকার হবেন না রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই। আরো বলা ছিল পাকিস্তান আমলের যে সব আইন বাংলাদেশের মৌলনীতিসমূহের সংঘাতপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে সেগুলোর অস্তিত্ব আপনাআপনি বিলুপ্ত বলে গণ্য হবে। কিন্তু কার্যত কী দেখলাম? সম্ভবত ১৯৭৩ সালে শত্রু সম্পত্তি আইন ১৯৬৫-এর নাম পরিবর্তন করে ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন, ১৯৬৫’ বলে নতুন নামকরণ করে শত্রু সম্পত্তি আইনের সব ধারা উপধারা অব্যাহত রাখা হলো। ফলে ওই সম্পত্তিগুলো সরকারি নিয়ন্ত্রণেই রয়ে গেল। মালিকরা ফেরত পেলেন না এবং বিস্ময়ের ব্যাপার আজো তা ফেরত পাননি। পাবেনও না।
সাম্প্রদায়িক চেতনা মূলত সামন্ততান্ত্রিক সমাজের একটি বৈশিষ্ট্য। এখনো বিশ্ববাস্তবতা হচ্ছে- ধর্মকেন্দ্রিক জাতিসত্তা বা সম্প্রদায়। এবং একটি ধর্মকেন্দ্রিক সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত থেকে অন্যকোনো ধর্মকেন্দ্রিক সম্প্রদায়ের লোকেদের খারাপ/ফালতু ভাবাটা হচ্ছে ট্রেন্ড।
বিষয়টিকে একটু সহজ করে ব্যাখ্যা করা যায়, যেমন আমরা সচারচর বলে থাকি কুমিল্লা-নোয়াখালি-চাঁদপুর-বরিশাল অঞ্চলের লোক খারাপ। অর্থাৎ এরকম বলাটা হচ্ছে একটা ট্রেন্ড। এই অভিধায় বিশ্বাস করে না, এরকম অনেক লোকও কিন্তু ঢালাওভাবে কখনো কখনো মন্তব্য করে ফেলে। অর্থাৎ সমাজের অভ্যাস ব্যক্তির অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায় ব্যক্তির অজান্তে।
শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতার অন্তর্ভূক্তি শিক্ষার্থীর অজান্তেই তাদের মানসিকতাকে প্রতিক্রিয়াশীল করে দেয়। শিশু কি কিছু বোঝে এসব? তারপরেও দেখা যায় একজন শিশু সাম্প্রদায়িক আচরণ করে। এর কারণ হচ্ছে ঐ ট্রেন্ড। সমাজের এই ট্রেন্ড বা ঝোঁক কিন্তু ব্যক্তিমানুষ পরিবর্তন করতে পারেব না। গুটিকতক মানুষও পারবে না, চাইলেও পারবে না। বিভিন্নভাবে পরিকল্পনা করে সমাজের এই বিধ্বংসী ঝোঁক থেকে মানুষকে মুক্ত করতে হয়।এর দায় নিতে হয় রাষ্ট্রের, কারন আইনের অসারতায়-ই জন্ম নিয়েছিল ধর্ম। কিন্তু রাষ্ট্র কি নিবে?
বরং সময়ে সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাবার নেশায় ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে যারা কথা বলেছেন তাদের স্তব্দ করা হয়েছে রাজনৈতিক স্বার্থে। আর তাতে যতটা না লাভ হয়েছে মৌলবাদীদের তার চেয়ে বেশি ব্যবহার হয়েছে রাষ্ট্রক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে। এতে সরকার গাছেরটা খেয়েছে তলেরটাও কুড়িয়েছে। লেখার সঙ্গে ধর্মীয় ভাবাবেগ সম্পৃক্ত থাকে বলে সবসময়ই তা বিতর্কের জন্ম দেয়৷ এ কথা নতুন নয় এবং এমন বিতর্ক আগেও ঘটেছে৷ তবে প্রশ্ন জাগে, অনন্ত অভিজিতরা কি এই অশ্লীল রাজনীতির বলি !!! সবই হয়ত কার্যত নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতায়৷
সব সরকার ও ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান নিজেদের স্বার্থে মিথ্যা বলে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে। সরকারমাত্রই ষড়যন্ত্রপ্রবণ। চিন্তন, মনন ও শিক্ষামূলক চর্চা সর্বদাই বিতর্কিত ৷ সেটা ‘সেন্সারশিপ'-এর হাতকড়া পরিয়ে থামানো যায় না৷ বলা বাহুল্য, এটা সুস্থ সমাজ চেতনার পরিপন্থি৷ একথাও অনস্বীকার্য যে, ধর্ম মানুষের জীবনকে যেভাবে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে তাতে একটা লক্ষণরেখা থাকা উচিত। এই সুন্দর পৃথিবীতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণী পিঁপড়ারও নিজের মত করে বাঁচার অধিকার আছে। আজ যারা ভাবছেন নগর পোড়ুক কিন্তু তাতে কি দেবালয় এড়াবে?
No comments:
Post a Comment