তানজিব হাসান সাকিব বাংলাদেশ পেস বোলিং ইউনিটে নতুন এক অস্ত্রের নাম। এশিয়া কাপে ভারতের সাথে শেষ ম্যাচে অভিষেক হয়। প্রথম ম্যাচেই দুর্দান্ত বোলিং করে সবার নজরে আসে এই ছেলে। জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক উইকেট পান রোহিত শর্মার, আকাশে উড়ার মত অবস্থা ছেলের। আরও সুখবর হচ্ছে ম্যাচটা জিতেও বাংলাদেশ। আর বিতর্ক শুরু সেখান থেকেই। যেহেতু নতুন একটা ছেলে তাই সবাই তার সম্পর্কে জানতে চায়। আর জানার সহজ উপায় হচ্ছে এখন ফেসবুক। সবারই ফেসবুক আইডি আছে। সবাই হুমড়ি খেয়ে যখন তার ফেসবুক প্রোফাইল ঘাটাঘাটি শুরু করে তখনই বের হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক গল্পের চিত্র।
তার প্রোফাইল কোন খেলোয়াড়ের মত না। নানা ধর্মীয় বক্তব্য, নানা বক্তার বানী, হাদসি কোরানের নানান কন্টেন্ট। এগুলা কারো প্রোফাইলে থাকা যাবে না এমন না। কিন্তু কেমন যেন বেমানান। আমি কিছুক্ষণ স্ক্রল করে ক্ষেমা দিয়ে নিজের তালে চলে গেছিলাম। কিন্তু আমার মত সবাই না। একটু ঘাটতেই নানা মনি মুক্তা পাওয়া যেতে থাকল। চাকুরীজীবী নারীর প্রতি তীব্র বিদ্বেষমূলক পোস্ট পাওয়া গেল, পাওয়া গেল বিজয় দিবস নিয়ে সন্দেহমূলক পোস্ট, জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে আপত্তিমূলক পোস্ট! খেলা জমে গেল এরপরেই। স্বভাবতই যারা মনে করেছে এইটা চরম অন্যায় একটা কাণ্ড তারা সাথে সাথেই এই সব পোস্টের ব্যাপারে প্রতিবাদ জানায়। আর বিপরীত দিক থেকে আমাদের দেশে তৈরিই হয়ে আছে একটা গোষ্ঠী, যারা ধর্মের প্রলেপ দেওয়া থাকলে যে কোন কিছু গিলে ফেলতে পারে বিনা কোন প্রতিবাদেই। আমরা ধর্ম ঠিকমত পালন করতে পারি না কিন্তু কেউ ধর্ম পালন করতে চাইলে তাকে বাধা দিব? এই লাইন দিয়ে শুরু হচ্ছে তাদের বক্তব্য। এরপরে যথারীতি তার প্রতিটা কথাকে সহি শুদ্ধ বলে বলা শুরু করে দিল।
প্রসঙ্গত বলে রাখি এই ছেলের আগে আরেকজন বোলারের অভিষেক হয়েছিল, নাম মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী, আগে নামের আগে মোহাম্মদ ছিল না, কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় নামটা সম্ভবত ওর কাছে হিন্দুয়ানী লেগেছে বা কেউ কিছু বলেছে তাই এখন নামের আগে মোহাম্মদ লিখে। আগেও থাকতে পারে কিন্তু আমার চোখে পড়েনি। যাই হোক, এই ছেলের বোলিং বেশ চমৎকার ছিল। আমি তখন ওর প্রোফাইল ঘুরতে গিয়ে একই রকম অবাক হয়েছিলাম যেমন অবাক তানজিব হাসানের সময় হয়েছি। এরা দুইজনই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এরা হচ্ছে সেই সোনার টুকরো ছেলে যারা আমাদের জন্য যুব বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিল। ওরা আজ হোক কাল হোক জাতীয় দলে ঢুকবে এইটা জানা ছিল। কারণ ওই দলের প্রায় সবাই অসাধারণ খেলেই বিশ্বকাপ জিতে ছিল। এর মধ্যে শরিফুল নামের বোলারটা এখন জাতীয় দলের নিয়মিত মুখ। ভাল খেলেই এরাও দলে এখন ঢুকছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই দুইজনেরই মনের মধ্যে ভিন্ন ধর্মের প্রতি, নারীর প্রতি যে বিদ্বেষ তা দেখে আর সাহস হয় না যে এরা দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করুক।
আইসিসির কোড অফ কন্ডাক্টে এই রকম বক্তব্য দেওয়ার কোন সুযোগ নাই। এর চেয়ে কম বৈষম্যমূলক কথা বলে নিষিদ্ধ হয়েছে এমন নজির আমাদের চোখের সামনেই আছে। বিসিবি সেই তুলনায় প্রায় কিছুই করল না ওকে। আজকে যখন ডেকে জিজ্ঞাস করা হয়েছে অফিসিয়ালি তখন সে বলেছে সে কাওকে আঘাত দেওয়ার জন্য এসব বলেনি। তার নিজের মাও একজন নারী, সে কীভাবে নারীকে অপমান করে কিছু লিখতে পারে? হাস্যকর না? মা তো সবারই নারী, এর সাথে নারীকে অপমান করে বক্তব্য দেওয়ার কী সম্পর্ক? বিসিবি অবশ্য এতেই খুশি। তবে এই খুশি কতক্ষণ থাকে সেটাই দেখার বিষয়। কারণ এই ছেলে এখানেই থামবে এমন কোন লক্ষণ আমি দেখি না।
কী লিখছিল পোস্টে? আমি দেখলাম এক জায়গায় লিখেছে নারী চাকরি করলে সমাজ নষ্ট হয়, নারী চাকরি করলে পরিবার নষ্ট হয়, সন্তানের হক আদায় হয় না! আরেকটা দেখলাম লিখেছে ভার্সিটিতে পড়াশোনা মেয়েরা নির্লজ্জ হয়, তাদের বিয়ে করে লজ্জাশীল স্ত্রী পাওয়া যাবে না এমন একটা কথা! কোন জানি বক্তা মূর্তি ভাঙার ব্যাপারে কী লেখছে সে ওইটাই শেয়ার করছে! দারুণ না? এই ছেলের বয়স কত? হয়ত বিশ একুশ, এই বয়সে এর মনের মধ্যে এই যে এই ধরনের কথাবার্তা বাসা বাঁধছে তার প্রতিকার না করলে কোন লাভ হবে না। কোন ওষুধেই কাজ হবে না যদি না এদেরকে এখনই না ফেরানো যায়।
অন্ধ জনগোষ্ঠী যারা অন্ধ ভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে তাদের বক্তব্য হচ্ছে হাসিম আমলা, মইন আলীরা ক্রিকেট খেলছে তাদেরকে তো কেউ বাধা দিচ্ছে না। তাহলে তানজিব হাসনের বেলায় কেন মানুষ এমন করছে! আসলে সমস্যা যে ধর্ম পালনে না তা তারা বুঝতে রাজি না। কেউ সারাদিন ধর্ম পালন করুক না, কে ফেরাচ্ছে? কিন্তু এখানে হচ্ছে ধর্মীয় উগ্রতার প্রকাশ, যার সাথে ধর্ম পালনের কোন সম্পর্ক নাই। হাসিম আমলা নারীর চাকরি নিয়ে চিন্তিত এমন কোন নজির পাওয়া যায় নাই।
ধর্মের নামে যে কোন কিছু খাওয়া যেমন মহা সমস্যা তেমনই আরেক সমস্যা হচ্ছে যারা এগুলা খাওয়ায়। এই ধরণের কোন ইস্যুতে দেখা যায় কিছু তথাকথিত তারকা এদেরকে সমর্থন দেয়। নিজেদের জীবনে ধর্মের কোন লেস মাত্র না থাকলেও কোন সমস্যা নাই, নিজে ভণ্ডামি করে ভণ্ডদের শিরোমণি হয়ে বসে আছে কিন্তু যখনই ধর্মের নামে গুড় খাওয়ার সুযোগ আসে তখনই এরা ঝাঁপিয়ে পরে। আর মানুষ ধর্মের আফিমে মজে সব ভুলে যায়। এই দেশেই এই জন্য এগারশো কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে গিয়ে মানুষ ওমরার ছবি পোস্ট করার সাহস পায়। কারণ তারা জানে ওই একটা পোস্টে দেশের বিপুল মানুষ তাদেরকে পরিস্থিতির শিকার, আসলে ভাল মানুষ বলে মেনে নিবে!
ধর্মের নাম নিয়ে যা ইচ্ছা, যা ইচ্ছা করে দেখুন, কিছু হবে না এখানে। তানজিব হাসানের দোষ খুব অল্পই এখানে। ওর মূল দোষ হচ্ছে এগুলা প্রকাশ্যে ফেসবুকে লিখে রাখছিল। কিন্তু ওর মত এমন চিন্তা ধারা নিয়ে দেশের লাখ লাখ মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে! এর আগে মুশফিক বিসিবির লোগোতে বাঘের ছবিতে টেপ লাগিয়ে ঘুরছে এমন ছবি পাওয়া গেছে। এমন আরও অনেকেই আছে। আমি নিজে ফেসবুকে খুব অল্প কিছু বন্ধু নিয়ে সুখে শান্তিতে ঘর করছি বলে মনে করতাম সব সময়। এবার এই বিষয়ে লেখার পরে তীব্র ভাবে প্রতিরোধের সম্মুখীন হলাম। আমি ভাবতাম আমার এই অল্প সংখ্যক বন্ধুর ভিতরে এমন কেউ নাই যে আমাকে অন্তত এই বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করবে। কিন্তু দেখলাম সে খুব যত্ন করে আমাকে বুঝায় দিল যে আমি আসলে ইসলামের সাথে নাই, আমি অন্য কোন ধর্ম পালন করছি! মানে আমি বিধর্মী বা নাস্তিক! এইটা আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা।
গেম অফ থ্রোন্স একটা ফ্যান্টাসি সিরিজ। ফ্যান্টাসি সিরিজ হলেও কিছু বিষয় দুর্দান্ত ভাবে তুলে এনেছে এখানে। চার নাম্বার সিজনে সম্ভবত দেখায় এক কট্টর ধর্মীয় গ্রুপ, যারা আগের রাজার আমলে ধারে কাছে আসতে না পারলেও রাজা মরার পরে আস্তে আস্তে করে রাজধানীতে আসার চেষ্টা করছে। রানী নিজের স্বার্থে তাদেরকে ব্যবহার করে। তারা ধীরে ধীরে শক্ত আসন গেড়ে বসে রাজধানীতে। ওই ধর্মীয় শক্তি এমনই শক্তিশালী হয়ে উঠে যে যে রানী তাদেরকে নিজের স্বার্থে প্রশ্রয় দিয়েছিল তারা তাকেই বন্দী করে, উলঙ্গ করে রাজপথে হাঁটায়!
ধর্মীয় গোষ্ঠীকে প্রশ্রয় দিলে এমন কাণ্ড যে বাস্তবেও সম্ভব তা আমরা জানি না। সরকারের প্রশ্রয়েই মতিঝিল দখল করে বসে পড়েছিল এরা। গেম অফ থ্রোন্সের মতোই এখানেও ধামাকা দিয়েও থামানো হয় এদেরকে। মুশকিল হচ্ছে আমরা অতীত থেকে শিক্ষা নেই না। তাই দিনের পর দিন ধর্মের নামে ব্যবসা চলছে এই দেশে, এদের শক্তি দিন দিনই ধরা ছোঁয়ার বাহিরে চলে যাচ্ছে। আমাদের দশা কী হবে কে জানে! তবে তানজিন হাসান সাকিবদের সংখ্যা যে ধীরে ধীরে উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা তো চোখের সমানেই দেখতে পারছি! এরা আমাদের কোন বাংলাদেশ উপহার দেবে?
তানজিব অল্প বয়সের ভুল থেকে যদি ফিরে আসতে পারে তাহলে আমাদের থেকে খুশি আর কে বেশি হবে? সে প্রথম ম্যাচেই নিজের জাত চিনিয়েছে। তাকে বাংলাদেশ দলে দরকার। কিন্তু আমরা খেলার মত বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য দেশের ভাবমূর্তিকে নিশ্চয়ই প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইব না? দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব নিয়ে কেউ ফাইজলামি করবে এইটা নিশ্চয়ই আমাদের চাওয়া হবে না? অলিভার রবিনসনের অভিষেক টেস্টের সময় ভাইরাল হয়ে যায় তার বেশ আগের কিছু বর্ণবাদী টুইট। এরপরে তিনি প্রকাশ্যে ক্ষমা চান, বলেন বয়স অনেক কম ছিল, বুঝতে পারিনি। কিন্তু অভিষেক টেস্টে ৭ উইকেট নেওয়ার পরও তাকে নিষিদ্ধ করে ইংলিশ বোর্ড। কেউই নিজের দেশের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইবে না এমন পোস্টকে সমর্থন করে। বাংলাদেশ কমে ছেড়ে দিয়ে ভাল করল না খারাপ করল সময়েই বলে দিবে, আপাতত ভাল কিছুর আশা করা ছাড়া আর কিবা করার আছে?
শুভ বুদ্ধির উদায় হোক সকলের।